ভবঘুরেকথা
সূফীবাদের গোড়ার কথা সুফি সাধক রুমি

দেহতত্ত্বে লতিফা ও চক্র ভেদ

-আবুতালেব পলাশ আল্লী

সকল ধর্মেই দেহতত্ত্ব আছে। দেহতত্ত্ব হচ্ছে মূলত একটা নকশা। যার সাহায্যে ব্রহ্মাণ্ড ও স্রষ্টাকে চেনা বা জানার পথ পাওয়া যায়। বলা হয়, ব্রহ্মাণ্ড স্রষ্টা ও সৃষ্টি এই দুই ভাগে বিভক্ত। স্রষ্টা হচ্ছেন ‘একক অজুদ’ আর সৃষ্টি ‘বহু অজুদ’।

স্রষ্টা সূক্ষ্ম(লাতিফা) অজুদ, অপরদিকে সৃষ্টি অজুদে স্থূল(কাশিফ) দেহ ও সূক্ষ্ম(লাতিফা) দেহ উভয়ই বিদ্যমান। বলা হয়, এই ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সকল কিছুরই নকশা এই দেহে আছে। তাই এই দেহকে স্রষ্টা কর্তৃক নির্মিত ব্রহ্মাণ্ডের একটা ছোট্ট সংস্কার বা নকশা বলা হয়।

সেকারণে অনেক তরিকতে লতিফার জিকিরকে শাস্ত্রবিরোধী বলা হয়। কারণ সূক্ষ্মদেহের বা লতিফার কোন মুকাম হয় না তাই এর জিকিরও হয় না। অর্থাৎ অজুদের জিকির হয়, তনের জিকির হয় না। যেমন আল্লাহ একক সত্ত্বা বা অজুদ, আল্লাহর জিকির হয়। আবার মানুষও একটা অজুদ, তারও জিকির হয়। যেমন মানুষ ভাল কাজ করলে তাকে স্মরণ বা জিকির করা হয়।

কাশিফ দেহ ও লাতিফা দেহের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তরিকতে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কোনো তরিকতে ১৮টা তনকেই লতিফা বলেছে। যেমন-

১. কাল্ব।
২. রূহ।
৩. সির।
৪. খফি।
৫. আখফা।
৬. নফস।
৭. আব।
৮. আতস।
৯. খাক।
১০. বাদ।
১১. সিদ্দাত।
১২. হুরুদাত।
১৩. বুরুদাত।
১৪. নাফিয়াত।
১৫. ফিসকাত।
১৬. আব্বাদ।
১৭. রূহিয়াত।
১৮. কাল্বিয়াত।

কোনো তরিকতে এর ১ থেকে ৬ পর্যন্ত তনকে লাতিফা। আর ৭ থেকে ১০ পর্যন্ত তনকে স্থূল দেহ বা কেবল দেহ বলা হয়েছে। ভিন্নতা থাকতেই পারে, মূল ব্যাপারটা জানতে পারলেই হল।

অনেক তরিকতেই উচ্চস্বরে জিকির করা হয় লতিফার মুকাম ও রঙকে ধ্যানের মাধ্যমে। যদিও স্থূলদেহের মুকাম থাকতে পারে কিন্তু লাতিফা বা সূক্ষ্মদেহের কোন সুনির্ধারিত স্থায়ী মুকাম হয় না।

যেমন স্রষ্টা সূক্ষ্ম, তিনি সকল স্থানে বিরাজিত। সকল জায়গায় মহিত প্রথিস্থিত। তার কোন নির্দিষ্ট মুকাম নাই। যেমন রুহের কোনো সুনির্ধারিত স্থায়ী মুকাম নাই। যেমন সুনির্ধারিত স্থায়ী মুকাম নেই আল্লাহর নুর, নুরে মুহাম্মাদির। তারা সকল স্থানে বিদ্যমান।কাজেই লাতিফার সংখ্যা যাই হোক না কেনো এর কোনো স্থায়ী মুকাম বা আবাস নাই।

সেকারণে অনেক তরিকতে লতিফার জিকিরকে শাস্ত্রবিরোধী বলা হয়। কারণ সূক্ষ্মদেহের বা লতিফার কোন মুকাম হয় না তাই এর জিকিরও হয় না। অর্থাৎ অজুদের জিকির হয়, তনের জিকির হয় না। যেমন আল্লাহ একক সত্ত্বা বা অজুদ, আল্লাহর জিকির হয়। আবার মানুষও একটা অজুদ, তারও জিকির হয়। যেমন মানুষ ভাল কাজ করলে তাকে স্মরণ বা জিকির করা হয়।

মূলাধারচক্রে ক্ষিতি(পৃথিবী) বা গন্ধতত্ত্বের অবস্থান। স্বাধীষ্ঠানচক্রে অপ(জল) বা রসতত্ত্বের অবস্থান। মনিপুরচক্রে তেজ(অগ্নি) রূপতত্ত্বে অবস্থান। অনাহত চক্রে মরূৎ(বায়ু) বা স্পর্শ তত্ত্বের অবস্থান।বিশুদ্ধ চক্রে আকাশ বা শব্দ তত্ত্বের অবস্থান নিরূপিত হয়।

অনেকে প্রশ্ন তোলেন, তাহলে স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে এই লতিফার জিকির করা হয় কেন? উত্তরে বলা হয়, প্রথমে কলব জারি করার জন্য, তারপর ধীরে ধীরে অন্যন্য লতিফাকে জারি করার জন্য। তবে লতিফা জারি করার কোন নির্দেশনা কোরানে নাই।

কলবের ব্যাপারে কোরানে বলা হয়েছে, মমিনের কলবই আল্লাহর আরশ। কাজেই মুমিন হলেই তাঁর কলবে আল্লাহর স্থান হয়ে যাবে। তাই মুমিন কিভাবে হওয়া যায়, মুত্তাকি কিভাবে হওয়া যায় এবং মহসেন কিভাবে হওয়া যায়, তা কোরানে বলা হয়েছে। সে কারণে ৬ লতিফার জিকির ও কলব জারি করতে কোরানে কিছু বলা নাই।

অনেকে মনে করে, এই ৬ লতিফা সম্ভবত আদি ধর্মের দেহতত্ত্ব অর্থাৎ ৬ চক্র মতবাদ থেকে ইসলামে প্রবেশ করেছে। এর মূল্যায়ন করতে গেলে আদি ধর্মের দেহতত্ত্ব আ ৬ চক্র মতবাদটা একটু ধারণা নেয়া যাক-

আদি ধর্মের দেহাভ্যন্তরে ৬ চক্র-

১. গুহ্যমূলে মূলাধারচক্র।
২. লিঙ্গমূলে স্বাধীষ্ঠানচক্র।
৩. নাভিমূলে মনিপুরচক্র।
৪. হৃদয়ে অনাহতচক্র।
৫. কণ্ঠে বিশুদ্ধচক্র এবং
৬. ভ্রূ-যুগলের মধ্যে স্থিত আজ্ঞাচক্র।

ছয়টি চক্রের মধ্যে মনিপুর চক্রে রূদ্রগ্রন্থি, অনাহত চক্রে বিষ্ণুগ্রন্থি এবং আজ্ঞা চক্রে ব্রহ্মগ্রন্থি।

মূলাধারচক্রে ক্ষিতি(পৃথিবী) বা গন্ধতত্ত্বের অবস্থান। স্বাধীষ্ঠানচক্রে অপ(জল) বা রসতত্ত্বের অবস্থান। মনিপুরচক্রে তেজ(অগ্নি) রূপতত্ত্বে অবস্থান। অনাহত চক্রে মরূৎ(বায়ু) বা স্পর্শ তত্ত্বের অবস্থান।বিশুদ্ধ চক্রে আকাশ বা শব্দ তত্ত্বের অবস্থান নিরূপিত হয়।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করাই হচ্ছে সাধকের মূল সাধনা। এই কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করা ভিন্ন কোন সাধনায়ই সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। এই কুলকুণ্ডলিনী শক্তির সহায়তায় সাধক ঊর্দ্ধরেতা শক্তি সম্পন্ন হয়।

ঊর্দ্ধরেতা শক্তি অর্জিত হলে সাধকের দেহের আত্মজ্যোতি বা দিব্যজ্যোতি প্রথমে অভ্যন্তরে, পরে বাহিরে প্রকাশিত হয়। এই দিব্যজ্যোতি প্রকাশিত হলে সাধকের মনের সমস্ত কপাট খুলে যায়। সাধক দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হয়।

সাধনার ধারা>>

……………………………
পুনপ্রচারে বিনীত: আবুতালেব পলাশ আল্লী
মা শাহে সেতারার রওজা বা দরবার শরিফ
খুলনা, বাংলাদেশ।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………
আরও পড়ুন-
দোজখ
নফসের সংযম
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব
মোরাকাবা-মোশাহেদা
নফসের পঞ্চস্তর
তরিকায় নামাজ রোজা
তরিকায় জাকাত
দেহতত্ত্বে লতিফা ও চক্র ভেদ
সাধনার ধারা

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • রাজু , সোমবার ১১ এপ্রিল ২০২২ @ ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

    অসাধারণ উপস্থপনা দরদী জয় হোক

    • ভবঘুরে , মঙ্গলবার ১২ এপ্রিল ২০২২ @ ১১:২৪ অপরাহ্ণ

      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!