ভবঘুরেকথা
কোরান শরীফ কিতাব শাস্ত্র

ধর্মের ব্যাখ্যা

-লুৎফর রহমান

বাংলা ১৩৮৪ সালে বৈশাখ সংখ্যায় মাসিক সাহিত্যিক’ পত্রিকায় গোলাম মকসুদ এম, এ, ‘মানব ধর্ম’ শীর্ষক প্রবন্ধে হযরত মহম্মদ-এর দুইটি বাক্য উদ্ধৃত করেছিলেন;

“ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত হও।”

“সমস্ত জগৎ আল্লাহতায়ালার নিকট পরিবার। যিনি তাঁহার পরিবারের যত অধিক উপকার করেন, তিনি তাঁহার নিকট তত অধিক প্রিয়।”

মৌলানা রুমীর কবিতায় দুই ছত্রের অনুবাদ লিখেছেন- তোমার মধ্যে দেবত্ব ও পশুত্ব দুই-ই আছে, যদি পশুত্বটুকু দূর করতে পার, তুমি দেবতাদেরকে (ফেরেস্তা অর্থাৎ আল্লাহর অর্চনারত ফেরেস্তা) অতিক্রম করে যেতে পার।

ধর্ম সম্বন্ধে নিজের মতামত লিখেছেন শয়তানের উপর জয়যুক্ত হওয়াই মনুষ্যত্বের সার ধর্ম। এই-ই বিশ্ব মানব ধর্মের মূলমন্ত্র। …কেবল আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা ও উপবাসই ধর্ম নহে।

সৈয়দ আবদুর রব ‘মাসিক মোয়াজ্জিন’ পত্রিকায় ৭ম বর্ষ ১৩৪১, বৈশাখ সংখ্যায় ৮ম পৃষ্ঠায় লিখেছেন; “আত্মায় সত্যের আসন প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম। সত্যের যে প্রাণবন্ত ঝঙ্কার সজ্ঞান মানুষ আপন আত্মায় অনুভব করিবে তাহাই তাহার ধর্ম।”

এই দুটি বস্তু এবং যারা ধর্মের প্রকৃত পরিচয় আত্মীয় অনুভব করতে পেরেছেন, তাদের কালবিলম্ব না করে একসঙ্গে মিলিত হওয়া উচিত। বিদ্রোহ ব্যতীত কোনো সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যে সত্যের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে, মিথ্যাকে দলিত করে।

ইসলামের পরম দান ঈশ্বরের একত্ব। পূর্বে মনুষ্য সমাজে ঈশ্বরকে বহু ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ঈশ্বরের শক্তি ও ভাব যার মাঝে বহুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে, মনুষ্য ভক্তি আপুত প্রাণে তাকে ঈশ্বরের আসন দিয়ে এসেছে। এই মনুষ্য-ঈশ্বরের ভক্ত যারা, আত্মার যাঁরা, তাঁরাও ক্রমে ঈশ্বর হয়েছেন।

যিশু খৃষ্টের মাতাকে মনুষ্য জ্ঞানে তার ভক্তগণ বর্জন করতে পারেন নি। ঈশ্বরের মাতা যিনি, তাকে কীভাবে বাদ দেওয়া যায়?” খৃষ্ট বলেন; আমাকে পরিধান কর। যারা তাকে পরিধান করলেন তারাও খৃষ্ট অর্থাৎ ঈশ্বর হলেন। ধার্মিক রাম, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, ঈশ্বরের বিরাট শক্তির প্রতিচ্ছবি।

– সমুদ্র, বিশাল বৃক্ষ, হিমালয়, পর্বত, বিষধর সর্প ভক্তের শ্রদ্ধা হতে বঞ্চিত হলেন না। এরা হলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। আর্য সমাজীরা বললেন Let us try to make every man a god। এসব ফকিরি কথার মূল্য ফকিরদের কাছে আছে- সাধারণ মানুষের কাছে এইসব কথার গুরুতর অপব্যবহার হয়।

কোথায় ঈশ্বর রইলেন পড়ে- বুদ্ধের পাষাণ মূর্তি ঈশ্বর হয়ে হাট, ঘাট, পর্বত, মন্দির ছেয়ে ফেলো। মানবচিত্তের চরম অধঃপতন হল।

ইসলাম বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ভ্রান্ত কাফেরগণ! ক্ষান্ত হও- ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যাপী, তিনি জন্মগ্রহণ করেন না, তাকেও কেউ জন্ম দেন না। ইসলাম সত্যই বলেছেন। জগতকে বিশাল পতন হতে রক্ষা করেছেন। ইসলামের আজান এবং রোজা-নামাজ পৃথিবীতে ঈশ্বরের নাম অতি সুন্দরভাবে বজায় রেখেছে।

সর্ব পাপমুক্ত হওয়াই ইসলাম ধর্ম। মুসলমানের ধর্ম জীবনের একমাত্র সাধনা পাপকে জয় করা। হে আল্লাহ, আমি শয়তানের হাত হতে তোমার আশ্রয় চাই- এই হচ্ছে তার বড় প্রার্থনা। তার জীবনে পাপ-পুণ্যের কাটা-কাটি, জমা-খরচ হবে না।

ইসলামের আবির্ভাব না হলে জগতের মানুষ ঈশ্বরের নাম একেবারেই ভুলে যেতো। ইসলামের কল্যাণে চরম পৌত্তলিকও বলে-ঈশ্বর এক, যদিও সে ব্যবহার জগতে আদি শক্তি দুর্গারূপিনী মূর্তিতে জগতে ঈশ্বরের জননী ভাবের ছবি জগধাত্রীরূপে পূজা করে।

এই প্রকাশ্য রোজা নামাজ ও আজান জগতে ধর্মের বাহ্যিক চর্চা রেখে- পৃথিবীর মহাকল্যাণ করেছে। রাজা থেকে পথের বেশ্যা মুসলিমের আজান ও শরিয়তের কল্যাণে আল্লাহর সত্তা নিত্য অনুভব করেছে। রোজা নামাজ মানব সমাজের ধর্মের ধ্বজা জীবিত রাখার জন্যে একটি সামাজিক জীবিত অনুষ্ঠান মাত্র। এই-ই সব নয়।

এই-ই ইসলাম ধর্মের সব নয়- প্রাণের সঙ্গে যোগহীন আবৃত্তি অর্থাৎ মুখস্থ পাঠ ইসলাম ধর্ম নহে। জগতে ধর্মের ভাব জীবিত ও সবল রাখবার জন্যে তার নিজের আধ্যাত্মিক জীবন একেবারে মরে গেছে। তার প্রার্থনা একটা অভিনয়ে পরিণত হয়েছে।

প্রকৃত প্রার্থনাশীল জীবন তার নাই, আপন আত্মায় সে ঈশ্বরের সজাগ বাণী শোনে না। সে নামাজে বুঝে নামাজই পড়ে, দিকে দিকে আজানের দ্বারা প্রভুর বাণী প্রচার করে- যে নিজে এক বর্ণ বোঝে না। পাপের প্রতি তার ঘৃণা নাই। সত্যের বাক্য তার আত্মায় নাই। ঈশ্বরের সত্তা তার আত্মায় অনুভব করে না।

মুসলিম জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ইসলামকে সত্যরূপে আবার তার সামনে ধরতে হবে। তার ধর্ম শুধু মুখস্থ আর গুনাহ মাফ চাওয়া ধর্ম নয়। তার কাজ আছে- তার জীবনে সংগ্রাম আছে। ধর্মযুদ্ধ ও তার ধর্ম- মুমীনের হৃদয় ঈশ্বরের আসন; রুহে কুদুসের বিশ্বাসী- তাকে হতে হবে।

মুহূর্তে মুহূর্তে তার আত্মায় সত্যের যে বাণী ধ্বনিত হয়- তাই মানা তার ধর্ম। যে মুসলমানের বুকে বিবেক, প্রজ্ঞা বা সত্যের বাণী জাগে না সে মৃত। মুসলমান জাতি আজ মৃত। ত্বকচ্ছেদই তার ধর্ম হয়েছে। কোরবানী করে ষাড়ের পিঠে চড়ে সে দৌড়ে স্বর্গে যাবে- এই অন্ধ বিশ্বাস সে পোষণ করে।

পাপের সঙ্গে, মিথ্যার সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে, শয়তানের সঙ্গে, তার জীবনের সংগ্রাম নেই। মাথার উপর টিকির মতো এক টুপি রেখে সে মহাধার্মিক হয়েছে এই ভাব দেখায়। সে জ্ঞান বর্জিত, বিবেক বর্জিত, আত্মজিজ্ঞাসা বর্জিত চিন্তাশূন্য পশু।- মন্দতায় আকণ্ঠ সে ডুবে আছে।

মুসলমানের ধর্ম জীবন-কী? তার কাছে প্রার্থনাশীল জীবনের স্বরূপ কী? তার পরিষ্কার উত্তর এখানে দেওয়া হচ্ছে।

সর্ব পাপমুক্ত হওয়াই ইসলাম ধর্ম। মুসলমানের ধর্ম জীবনের একমাত্র সাধনা পাপকে জয় করা। হে আল্লাহ, আমি শয়তানের হাত হতে তোমার আশ্রয় চাই- এই হচ্ছে তার বড় প্রার্থনা। তার জীবনে পাপ-পুণ্যের কাটা-কাটি, জমা-খরচ হবে না।

অথচ প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ম মন্দিরে তাড়াতাড়ি প্রার্থনাটি সেরে দেবার জন্য অনেকে মোল্লা-মৌলভীকে অনুরোধ করেন। যে জিনিসের সঙ্গে প্রাণের যোগ নেই তাতে তো কষ্ট হবেই। না বুঝে দীর্ঘ সময় প্রার্থনার নামে ব্যায়াম করতে, উপস্থিত উপাসক জনমণ্ডলীর যে কি কষ্ট হয়, তার তাদের প্রাণ তাড়াতাড়ি ছুটি পাবার জন্য কীভাবে কাতর হয়ে উঠে, তা ভুক্তভোগীরা মাত্রই জানেন।

নামাজের পুণ্য আলাদা, পাপের শাস্তি আলাদা- তা হবে না! তা হবে না! নামাজ পড়লে পাপের ক্ষমা হবে না। না বুঝে নামাজ পড়া এও ইসলাম ধর্ম নয়, কোন ধর্ম নয়। প্রার্থনা তা আন্তরিক এবং আত্মার সত্য বেদনা নিবেদন হওয়া চাই। মানুষকে কোনো রকম দুঃখ দেওয়া পাপ। জগতে দুঃখ সৃষ্টি করা পাপ।

তোমার জীবনের দ্বারা, কথা ও ব্যবহারে যদি পৃথিবীতে দুঃখ ও জ্বালা উপস্থিত হয়, তুমি পাপী। নামাজ দুই-একবার ত্যাগ করলে তত পাপ হয় না, যত হয় মিথ্যা, অন্যায়, প্রবঞ্চনা ব্যভিচার, লোভ, চুরি এবং মানুষকে দুঃখ দেওয়াতে।

অথচ ঠিক এর উল্টা সমাজে চলছে। নামাজ ঠিক আছে- পাপ ও শঠতার অন্ত নেই। ত্বকচ্ছেদ,. আরবিতে নাম রাখা, মৃত্যুর পর ফাতেহা পাঠ করা, মসজিদ ঘর তোলা, মৃত্যুর পর খতম। পড়ান, লক্ষ কলেমা পাঠ, শুশ্রু রাখা এবং ইসলাম ধর্মের গর্ব করাই যেন এদের ধর্ম। আত্মার দিকে এরা তাকায় না।

তওবা (অনুতাপ) ব্যাপারটিও এরা মোল্লার পাগড়ী ধরে এক টাকা নজর দিয়ে শেষ করে। কী বিড়ম্বনা! আত্মার লজ্জা প্রকাশ ও অনুতাপ তাও এরা না বুঝে করে।

হযরত মুহম্মদ (স) মুসলমানকে ত্রাণ করেন, এই একটি অন্ধবিশ্বাস কিছুদিন থেকে ইসলাম ধর্মে চলেছে। অথচ মানুষ মানুষকে ত্রাণ করবে না- এই কথা প্রচার করাই তার খ্রিষ্টানধর্ম হতে পৃথক হবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবি। হযরতের নামে দরূদ পড়ার তার অন্ত নেই অথচ হযরতের বাণী একজনও জীবনে অনুসরণ করে না।

মুসলিম জীবনে কাজ নেই, মোটেই কাজ নেই। শুধু আছে মুখস্থ পাঠ এবং আল্লাহ দয়ালু এই কথা বলে মাফ চাওয়া। তাকে পথ দেখাইবার জন্যে কোরান- অথচ চোখ বেঁধে সে কোরান পড়ে। চোখ বুজে কে কার গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারে। আল্লাহ্, তাকে কি বলেছেন, জীবন ভরেও সে তা শুনতে ও জানতে চায় না।

তার আত্মার জন্য যা চরম কল্যাণের মন্ত্র, তা সে বুঝতে চায় না। যদিও সে জীবনে কত কঠিন পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করে ফেলে। প্রার্থনাশীল জীবনের কোনো ভাব মুসলমান সমাজে নাই। আত্মার নিবেদনের নাম প্রার্থনা। অপ্রাসঙ্গিক ঈশ্বর বাক্য পড়লে কি প্রাণ ঘামে?

দুই হাজার বার কুলহু’ পড়লে, দুই হাজার বার সূরা এখলাস পড়লে মহাপুণ্য হয় এইরূপ কথা আধ্যাত্মিকেরা অনেক সময় শিষ্যদিগকে বলে থাকেন। যে প্রার্থনা পাষাণ ভার হয়ে মনুষ্য চিত্তকে কষ্ট দেয়, তা প্রার্থনা নয়। প্রার্থনায় কখনও ক্লান্তি হবার কথা নাই।

অথচ প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ম মন্দিরে তাড়াতাড়ি প্রার্থনাটি সেরে দেবার জন্য অনেকে মোল্লা-মৌলভীকে অনুরোধ করেন। যে জিনিসের সঙ্গে প্রাণের যোগ নেই তাতে তো কষ্ট হবেই। না বুঝে দীর্ঘ সময় প্রার্থনার নামে ব্যায়াম করতে, উপস্থিত উপাসক জনমণ্ডলীর যে কি কষ্ট হয়, তার তাদের প্রাণ তাড়াতাড়ি ছুটি পাবার জন্য কীভাবে কাতর হয়ে উঠে, তা ভুক্তভোগীরা মাত্রই জানেন।

সামাজিক লোক-দেখান নামাজে কখনও প্রার্থনা হয় না। পৃথিবীতে মানব-সমাজে আল্লাহর সত্তা জীবন্ত করে রাখবার জন্যেই এই প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। প্রার্থনা যা, তা একান্ত আন্তরিক হবে তা হবে আত্মার স্বতঃউৎসারিত ভাব।

জাগতিক সম্মান ও প্রতাপই যার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, সে জীবন নিশ্চয়ই অপবিত্র, তার স্পর্শিত খাদ্য খাওয়া মুসলমানদের উচিত নয়। জীবনই তার বৃথা- যে ঈশ্বরের বশ্যতা স্বীকার করে না- জীবনে নিত্য ঈশ্বরের অর্থহীন আশীর্বাদ লাভ করে একবারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।

দীর্ঘ পঞ্চাশ, ত্রিশ, বিশ, ও চৌদ্দবার উঠা-বসা না করে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু ফরয নামাজটুকু (ঈশ্বর নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় সংক্ষিপ্ত উপাসনা) পালন করে সামাজিক প্রার্থনায় মর্যাদা রাখলেই যথেষ্ট হয়। উঠা-বসা করলে কখনও আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ যোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

সামাজিক নামাজ শেষ করে- আপন মাতৃভাষায়- সকলে মিলে বা একাকী নীরবে আত্মার ও সত্যের প্রার্থনা করাই যুক্তিযুক্ত। প্রার্থনায় কখনও বল-বাধ্যতা ভালো নয়। যখন ইচ্ছা নাই তখন প্রার্থনা করা উচিত নয়। পৃথিবীতে এখন কর্মের যুগ এসেছে। এখন বাইরে কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আল্লাহর এবাদত করতে হবে।

ঘরের মধ্যে বহুক্ষণ বসে সময় নষ্ট করবার সময় নেই। যখনই ইচ্ছা তখনই মানুষ প্রার্থনা করতে পারে। এখন নতুন কালের নতুন নিয়মে চলতে হবে। তাতে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হবে না।

আল্লাহ্ নিরাকার, এক তিনি কারো জনক নন, তারও কেউ জনক নাই- তিনি। আকবর- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ- ইহাই ইসলামের প্রাণবাণী-এ কথার তো পরিবর্তন হচ্ছে না। কাল ও অবস্থাভেদে অন্যান্য বিষয়ের পরিবর্তন আবশ্যক। প্রার্থনায় কখনও সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া ঠিক নয়।

নামাজে দাঁড়িয়ে কী সুন্দর সুরকে উপেক্ষা করা হয়! কণ্ঠে লালিত্য সকল দেশে সকল মানুষকে ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমরা যদি সঙ্গীতকে অসিদ্ধ ও অবৈধ বলে বর্জন করি, তা হলে আমাদেরই আধ্যাত্মিক জীবন পঙ্গু হয়ে উঠবে। সামাজিক প্রার্থনায় কোরানের বাক্য ব্যবহার করা যায়।

কারণ, সমস্ত মুসলমান জগতের মিলনক্ষেত্র। হচ্ছে এই সামাজিক প্রার্থনা অর্থাৎ নামাজ। সামাজিক প্রার্থনাকে কখনও প্রকৃত প্রার্থনা বলা চলে না। ও যেন একটা কর্মশালার ভঙ্গি বজায় রাখা। অপ্রাসঙ্গিক কথায় কখনও প্রাণ ধর্মরসে বিগলিত হয় না।

প্রার্থনা জিনিসটা কখনও সকলের এক প্রকার হতে পারে না। কখনো কখনো সমবেতভাবে এবং কখনো কখনো স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের স্বতন্ত্র ভাবে প্রার্থনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

প্রার্থনায় সঙ্গীত ও সুরযন্ত্র ব্যবহারের অর্থ অশ্লীলতা ও উচ্ছলতা নয় বা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নয়। নামাজিরা বলে- বেনামাজির হাতে খেতে নাই। এ কথাটি খুব সত্য। বাস্তবিক যার জীবন প্রার্থনাশীল নয়, যার কর্মবহুল জীবনে আল্লাহর প্রতি প্রেমের অভিব্যক্তি নাই,- যে জীবনে, কাজে-অন্তরে আল্লাহকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করে না,

জাগতিক সম্মান ও প্রতাপই যার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, সে জীবন নিশ্চয়ই অপবিত্র, তার স্পর্শিত খাদ্য খাওয়া মুসলমানদের উচিত নয়। জীবনই তার বৃথা- যে ঈশ্বরের বশ্যতা স্বীকার করে না- জীবনে নিত্য ঈশ্বরের অর্থহীন আশীর্বাদ লাভ করে একবারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।

প্রার্থনাশীল জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাব- ঈশ্বরে পূর্ণ আত্মসমর্পণ, বিনয় এবং সকলের উপর দরদবোধ।

দরদ চিরসহিষ্ণু, ক্ষমাশীল, ক্রোধবর্জিত। অভিশাপ করে না, গর্ব জানে না, বড়াই করে না, মিথ্যা কহে না, নিন্দা করে না, বঞ্চিত করে না, প্রতারণা করে না, দুঃখ দেয় না।

আজগুবী গল্প

মুসলমান সমাজে আজগুবী গল্পের প্রভাব অতিরিক্ত বেশি। বুজরুকী, মিথ্যা কেরামতিতে বিশ্বাস- মূর্খ মুসলমান সমাজকে পতনের গভীর গুহায় নিয়েছে। আত্মা দলের পর দল মেলে স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরের পরিচয়ে সুরভিত, বিকশিত হয়ে উঠবে- এইটিই হচ্ছে।

স্বাভাবিক ও নিয়মসঙ্গত। তা তো নয়- হঠাৎ একটা কেরামতি দেখে ইসলাম ধর্মে আসক্ত হবার অর্থ ভয় পেয়ে মুসলমান হওয়া- গুণমুগ্ধ হয়ে নয়।

আজগুবী গল্প রচনা করার ঝোঁক মুসলমান লোকদের মাঝে কেন বেড়েছিল তা বুঝা যায় না। খ্রিষ্টান সমাজে পাদ্রীরা কোনো কোনো সাধুর জীবন সম্বন্ধে সাধারণে ভক্তি বাড়াবার জন্য মিথ্যা গল্প যোজনা করতে উৎসাহ দিতেন- এমন শোনা যায়। মুসলমান।

সমাজে লেখকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল বলে মনে হয় না, অথচ তারা অসম্ভব মিথ্যা কথা মুসলমান সাধুর জীবনে যোজনা করে ইসলাম ধর্মের গৌরব খর্ব করেছেন। হযরতের জন্মবৃত্তান্ত যে-সব পুস্তকে লেখা হয়েছে তাতে মুসলিম তাপসদের জীরনী পুস্তকে এই শ্রেণীর মিথ্যা অলীক গল্পে অবতারণা দেখা যায়।

হযরত মরা মানুষকে জীবন দিয়েছেন, ইতিহাসে তার কোনো প্রমাণ নেই- আমরা এরূপ কথা বিশ্বাস করি না। তার শিষ্যেরা। মৃতকে জীবিত করেছেন, লোহাকে সোনা করেছেন, তাল গাছে কাঁঠাল তৈরি করেছেন- পাথরে চড়ে নদী পার হয়েছেন, স্রোতের উপর বসে নামাজ পড়েছেন,- এরূপ অসংখ্য মিথ্যা গল্প দেখতে পাওয়া যায়।

পরবর্তী মুসলমান সাধুদের জীবনের সঙ্গে অল্প শিক্ষিত মিথ্যাবাদী ভক্তদের দ্বারা এমন সমস্ত অসম্ভব গল্প রচিত হয়েছে, যে সব গল্পে ঘটনা হযরত রসুলের করিমের জীবনে সম্ভব হয় নাই। কেরামতিতে গুরুর চাইতে শিষ্যরা দুই-চার সিঁড়ি উপরে উঠেছেন। গল্প। রচয়িতাদের এমনই কলমে জোর আর ছাপাখানার প্রাদুর্ভাব ফল!

মাটি, বৃক্ষ, শুকনা গাছের ডাল প্রথম কলেমা (বিশ্বাস মন্ত্র) পাঠ করে ইসলাম ধর্মের সত্যতার প্রমাণ দিয়েছে- এমন গল্প শোনা যায়। এই সমস্ত মূর্খ। মোল্লা-মৌলবী টিকিমার্কা টুপি নেড়ে ভক্তির ভান করে, মিথ্যা কাঁদার ভান করে সভার মাঝে বলে থাকেন।

প্রবীণ ব্যক্তিরা এই সমস্ত কথা বলে নিরক্ষর মুসলমানদের ভক্তি ও বিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেন। বস্তুত এইসব গল্প শুনে বিশ্বাসের ভান করতে বাধ্য হয় মাত্র। বিশ্বাস ও ভক্তি এ দুটি স্বর্গীয় জিনিস- মানবাত্মার স্বাভাবিক ঘটনা। বল প্রয়োগে, ভয় দেখিয়ে হঠাৎ এ জিনিস তৈরি হয় না।

আত্মা ক্রমানুগতিতে বিশ্বাসী হয় এবং ভক্তিরসে আপুত হয়। এ কি চপেটাঘাত করে মুহূর্তের মাঝে সৃষ্টি করা যায়? একটা আজগুবী কাণ্ড করা আর আত্মাকে চপেটাঘাত করা এক কথা।

কখনো কখনো আশ্চর্য, অস্বাভাবিক ঘটনা বিশ্বাস করবে না। ধর্ম জীবনের সঙ্গে এ সকলের কোনো সম্বন্ধ নেই। ঈশ্বরের কোনো কাজ অস্বাভাবিক এবং অকস্মাৎ হয় না। সৃষ্টির বহু পূর্বে তার প্রকাশের আয়োজন চলতে থাকে। কখনো আম গাছে কাঁঠাল হয় না- এ মিথ্যা কথা।

এমন কাজ কোনো সাধুর দ্বারা হয়েছে, এ কথা বললেও পাপ হয়। মেসমরিজম বলে এক রকম বিদ্যা আছে, তাতে মানুষ অন্যের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে অনেক ভুল জিনিস দেখে, কিন্তু এর সঙ্গে তো মানুষের ধর্ম জীবনের কোনো সম্বন্ধ নাই।

এমন একটা সময় এসেছে যে পুরাতন শ্রেণীর ভ্রান্ত মোল্লা-মৌলবীকে ধর্মমন্দিরে আর প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। নব-আলোকপ্রাপ্ত, সংস্কৃতিতে অভ্রান্ত বিশ্বাস যারা পোষণ করেন, তাদের প্রার্থনায় অগ্রগামী করা উচিত।

তারা বাড়িতে বাড়িতে হযরতের জীবনী পাঠের উৎসব- ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা পাঠ করে হযরতের বাণীর ব্যাখ্যার বর্ণনা দিয়ে। জনসাধারণকে ধর্ম জীবনে অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করবেন।

মুসলিম জগতে হযরতের জীবনী পাঠ মুসলিম গার্হস্থ্য জীবনের একটা মস্ত বড় উৎসব। মোল্লাদের দৌরাত্মে একেবারে মাটি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠজ্ঞানী মহৎ ব্যক্তিদের অগ্রণী হওয়া উচিত। বাংলাদেশে কিন্তু যারা অশিক্ষিত, অপদার্থ ভিক্ষুক তারাই মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে কর্মকর্তা হয়ে ওঠে।

পরবর্তী মুসলমান সাধুদের জীবনের সঙ্গে অল্প শিক্ষিত মিথ্যাবাদী ভক্তদের দ্বারা এমন সমস্ত অসম্ভব গল্প রচিত হয়েছে, যে সব গল্পে ঘটনা হযরত রসুলের করিমের জীবনে সম্ভব হয় নাই। কেরামতিতে গুরুর চাইতে শিষ্যরা দুই-চার সিঁড়ি উপরে উঠেছেন। গল্প। রচয়িতাদের এমনই কলমে জোর আর ছাপাখানার প্রাদুর্ভাব ফল!

ধর্মের জীবিত উৎস>>

…………………….
ধর্ম জীবন – লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

.……………………
আরও পড়ুন-
ঈমান ধর্ম-বিশ্বাস
ধর্মের ব্যাখ্যা
ধর্মের জীবিত উৎস
ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার
অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!