ভবঘুরেকথা
ধর মানুষ রূপ নেহারে লালন

ধর মানুষ রূপ নেহারে

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল

যে সভ্যতা লালনকে বুঝবার চেষ্টা করে না, জীবনানন্দ দাশকে চেনেই না। যে সমাজব্যবস্থা লালনকে শুধুই একজন গীতিকার, রুমিকে স্রেফ একজন কবি কিংবা সুলতানকে পাড়াগায়ের শিল্পী মনে করে। যে জীবনব্যবস্থা মীর্জা গালিব-ওমর খৈয়ামকে ধর্মীয় বেড়া জ্বালে আটকে রাখতে চায়।

সে সভ্যতা-সে সমাজ-সে জীবন আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো- যে সভ্যতা-সমাজ-জীবনকে আমি ঠিকঠাক মতো বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি। সেসবের মাঝেই আমাকে বাস করতে হয়।

যে সভ্যসমাজের সাথে আমার সেভাবে আজ আর কোন সম্পর্কই নেই। পরিতাপের বিষয় হলো তাদের পাশাপাশিই আমাকে স্থূলদেহে বসবাস করতে হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাকে, আমার ভাবনাকে অবজ্ঞা করলেও এই সভ্যতা আমাকে বা আমার মতো জীবকেও এখনো পোষে। আর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় ‘অর্থ’ই সকল কিছু মূল্যায়নের একমাত্র একক। তোমার পকেটে পয়সা নেই তাই তুমি বাতিল মাল।

এই সব চাপিয়ে দেয়া যন্ত্রণা আমাকে প্রতিনিয়ত বিজয় প্রতীক দেখিয়ে দেখিয়ে কামারের হাতুড়ির মতো পেটায়। আমাকে এক পলকের জন্য স্থির হতে দেয় না। আমি বা আমরা অস্থির হলে সে ভূঁড়ি নাচিয়ে হাসে। বিদ্রূপ করার বিন্দু মাত্র ছাড় দেয় না।

আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় সুতা যতই দীর্ঘ হোক নাটাইটা কিন্তু তারই হাতে।

এটাই সেই সভ্যতা যার ইতিহাসের পাতায় কেবলই রক্তপাতের কাহিনী লিপিবদ্ধ। এটাই সেই সভ্যতা যেখানে এখনো গায়ের রং কালো বলে, প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে মানুষ মারাকে অধিকার মনে করে।

এটাই সেই সভ্যতা যেখানে কেবল জয়ী মানুষকে বীর ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তার পেছনের রক্তের ইতিহাসটা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে। এখানে আলেকজান্ডার হয় ‘আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’।

মার্কোস, মুসলিনি, হিটলার, অগাস্টাস, চেঙ্গিস খান প্রমুখের পাশাপাশি কলাম্বাস, ভাস্কো দা গামাকে দেয়া হয় বিশেষ মর্যাদা।

রীতি মতো ঘটা করে এদের জীবনী পড়িয়ে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টাও করা হয়। আর মার্কিন আগ্রাসন নীতি, বিশ্বঅর্থনীতি, বিশ্বায়ন নিয়ে কথা না হয় নাই বা বল্লাম।

এই তথাকথিত সভ্যতার এই যে একটা ক্রমাগত অস্থির করে তোলার প্রচেষ্টা। সেই হাতুড়ির ক্রমাগত আঘাতের ভেতর লালনকে লালন করা, মাঝে মধ্যেই বেশ জটিল হয়ে উঠে।

প্রতিমুহূর্তে এই সভ্যতার বাস্তবাতায় বাস করতে করতে, সেই সভ্যসমাজের মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে হতে ভাবি। কি করে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন শাহ্ আব্দুল করিম সাহস করে বলেছিলেন, ‘একদিন পৃথিবীটা বাউলদের হয়ে যাবে’?

অবাক হয়ে ভাবি- কি করে অন্ধ নিঃস্ব-রিক্ত ভিখিরিটা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে শেষ পর্যন্ত স্রষ্টার নামের গুণগানই গেয়ে যায়??

এতো কিছুর পড়েও আমাকে এ কথা স্বীকার করে নিতেই হয়। আমি ধারণ করি বা করতে পারি কিংবা না পারি, আমিও এই সভ্যতারই একটা প্রোডাক্ট মাত্র। এর বেশি কিচ্ছু না। এখান থেকে এটা প্রশ্ন জাগে- নিজেকে প্রোডাক্ট ভাবতে পেরে। নিজেকে পণ্য মেনে নিয়েও যারা জয়ধ্বনি দিতে পারে- তাদের দেখে কি তবে আমার হিংসে হয়?

নাকি আমি তা পারি না বলে হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে এ সব কথা ভাবছি বা বলছি? হয়তো আমার বাজার দর নেই বলেই বিক্রির তালিকায় আমার নাম উঠেনি। তাই হয়তো আমি প্রতিনিয়ত তাদের সকল প্রাপ্তিতে নিজেকে ব্রাত্য ভাবছি।

অবাক হচ্ছি! তাদের বেঁচে থাকবার অভিনয় দেখে দেখে!!

যারা প্রতিনিয়ত মাথা বিক্রি করেও হাসতে পারে! যারা প্রতিনিয়ত অন্যের পা চাটতে চাটতেও দামী দামী খাবার খেয়ে চলে!!

আমি অবাক হয়ে দেখি যারা নিজের সত্তাকে বিক্রি করে দিয়েও জীবন নিয়ে উচ্ছ্বাস করতে পারে।

তারপর থমকে দাঁড়াই। ভাবি, আমার ভাবনাটা তবে কি প্রথাগত হচ্ছে না? আমার ভাবনাটা হেরে যাওয়া মানুষের পক্ষে হয়ে যাচ্ছে? বড্ড একপেশে?? আমি হেরে যাওয়াদের দলে বলেই কি জয়ীদের উচ্ছ্বাস আমার কাছে খেলো মনে হয়?

আবার প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি তাই? আমি কি আসলেই তাদের মতো একটা জীবনের প্রত্যাশা করি? যেখানে লালন নেই! যেখানে জীবনানন্দ নেই!! যেখানে বাউল গান নেই!!! যেখানে সাধুসঙ্গ নেই!

আবার যেখানে এই সকল কিছু আছে কিন্তু তা কেবল শুধুই বিনোদনের জন্য। বোধের জন্য নয়!!! আমি কি আদৌ এমন কোনো জীবন কামনা করি??

যে সভ্যসমাজ একজন সাধকের চুল-দাঁড়ি কেটে নিলে, বাদ্যযন্ত্র-ঘর-আখড়াবাড়ি পুুড়িয়ে দিলেও রা করে না। কিঞ্চিৎ বিচলিতও হয় না। একটা ব্যর্থ মানববন্ধনকেই সর্বোচ্চ কর্মসূচি মনে করে।

সেই সমাজের অমৃতের সন্তানেরা একজন নারীকে সিগারেট ফুকতে দেখলে কিংবা মোটরবাইক চালাতে দেখলে সভ্যতার প্রদীপ নিভে গেল বলে রোল তোলে?

পুনরায় সংযোগ না পাওয়া পর্যন্ত বাফারিং চলতে থাকে। এই ক্ষণকালটাই ঝামেলায় ফেলে দেয়। তখন এই সব ছাইপাস সভ্যতা-সভ্যসমাজ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঢুকে পরতে চায়। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে বাফারিং মোড থেকে পুনরায় চলমান ভাবনায় ঢুকতে যতটা সময় লাগে ততটা সময়ই সেই হাড়ুড়ির আঘাতটা টের পাই।

গ্যালিলিও বলেছিল, ‘জগতে যখন মূর্খের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন সত্য প্রকাশ দুরূহ হয়ে পড়ে।’

আমিও হয়তো সেই মূর্খের সংখ্যা বাড়িয়েই পৃথিবীতে এখনো টিকে আছি জন্মান্তরের এককে। হয়তো আমার ভাবনাকেও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। যারা আমাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়, আমি বিচ্ছিন্ন কেউ। আমি সবার দলে নই। আমি দলচূত্য… অচ্ছুৎ… চণ্ডাল…।

এতে আমার বিন্দুমাত্র আপসোস-অনুতাপ-পরিতাপ কিছুই নেই। আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগই তেমন নেই। কেবল তারা যখন জোর করে আমার মাথায় তাদের চিন্তার ধারাটা ঢুকিয়ে দিতে চায়। তখন যে আমার নিজের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে, সেটাতে কিঞ্চিৎ মনক্ষুন্ন হই।

মনো সংযোগ নষ্ট হলে যা হয় আর কি। বিষয়টা বাফারিং-এর মতো একটা জিনিস। যেমন- খুব মনোযোগ দিয়ে একটা জমাটি একটা ভাবনার মধ্যে ছিলাম। তখন চারপাশে এমন কিছু একটা ঘটলো। যার কারণে ভাবনাটা বাফারিং করতে শুরু করলো।

পুনরায় সংযোগ না পাওয়া পর্যন্ত বাফারিং চলতে থাকে। এই ক্ষণকালটাই ঝামেলায় ফেলে দেয়। তখন এই সব ছাইপাস সভ্যতা-সভ্যসমাজ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঢুকে পরতে চায়। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে বাফারিং মোড থেকে পুনরায় চলমান ভাবনায় ঢুকতে যতটা সময় লাগে ততটা সময়ই সেই হাড়ুড়ির আঘাতটা টের পাই।

তবে সেটাও খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। কারণ আমি ভালো করেই জানি আমি প্রতিযোগী নই। তাই কারো সাথেই আমার কোনো প্রতিযোগীতা চলছে না।

কারো সাথে প্রতিযোগীতা করার কোনো যোগ্যতাও অর্জিত হয় নাই। তাই ক্ষোভ পুষে রেখে লাভ কি? যাদের ভালো লাগে না তাদের এড়িয়ে চলি। ব্যাস এইটুকুই।

চিন্তার সেতুটা জুড়তে যখন সময়টা বেশি লেগে যায় তখন এই সভ্যতাকে এই সভ্যসমাজকে দেখে হজরতের মতো বলতে ইচ্ছে হয়- ‘এদের জ্ঞান দাও – এদের ক্ষমা করো।’

আমার কোনো আক্ষেপ নেই আমি ব্রাত্য, অচ্ছুৎ বা চণ্ডাল বলে। আমি আমার চণ্ডাল জীবনের কথাই লিখি। আমার ব্রাত্য ভাবনা নিয়েই লিখি।

যদিও এই সভ্যতা দয়াপরবশ হয়ে এখনো আমাকে নির্বাসনে পাঠায় নি ঘটা করে। তারপরও আমি নির্বাসনে থাকি, সেটা হয়তো আমার নিজস্ব পাপাচারের নিজের দেয়াই দণ্ড।

তবে এতোক্ষণ যে কথাগুলো বললাম সবই কি হতাশা থেকে? সবই কি আমার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে বলছি?? এগুলো কি আমার অভিযোগ-অনুযোগ?

আরে না মশাই আপনি তাহলে ভুল পথে যাচ্ছেন। এই সব সভ্যতার সকল ষড়যন্ত্র আমাকে আপাতমস্তক মুড়ে রাখতে চাইলেও আমি আসলে অনেক পশ্চাৎপদ।

আমি এখনো সেই দুই থেকে আড়াই’শ বছর আগে ফকির লালন কি বলতে চেয়েছেন তার মাঝেই বাস করি। এই কথার পরে যদি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে। তাহলে কি আমি সেই দুই থেকে আড়াই’শ বছর আগের কোনো ভাবনা দিয়ে বর্তমানকে বোঝার চেষ্টা করছি? তাই আমি সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেকটা পিছিয়ে আছি?

তাহলে আমি একটা পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই- আপনি কি লালনকে পিছিয়ে পড়া মানুষ ভাবেন? লালন ফকিরের ভাবনাকে কি আপনি সত্যি সত্যিই ব্রাত্য ভাবনা ভাবেন??

যাক এই আলোচনা তো চলবেই। এই ফাঁকে এক সাধুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি বরঞ্চ।

এবারের মতো সেবারও গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। পকেটে টাকা পয়সাও বিশেষ নেই। কিন্তু গরমটাও আর সহ্য হচ্ছিল না। আসল কথা শহরে মন টিকছিল না আর। কাছেপিঠে কোথাও যাওয়া যায় কিনা ভাবছি। কিন্তু সেভাবে আবার বেড়িয়ে পরার তাড়নাটাও তীব্র ভাবে অনুভব করছিলাম না।

তখন ভাবলাম সাধুগুরুদের সাথে কথা বলেই না হয় একটু ভালো লাগা নিয়ে নেয়া যাক। বহুদিন আগে এক সাধুর নাম্বার সংগ্রহ করেছিলাম এক জনের কাছ থেকে। কিন্তু কথা বলা হয়নি কখনো। তাকে দিয়েই শুরু করলাম।

ফোন দিলাম সাধুকে। সাধু বললেন- দূর থেকে কি আর কথা হয়। চলে আসো বাপ।

আমিও আর ঘরে থাকতে পারলাম না। রওনা দিলাম সাধুর আখড়ায়। বেশ নিরিবিলি পরিবেশে সাধুর বাড়ি। দেখেই মন ভরে গেলো। কখন যে সন্ধ্যা ফাঁকি দিয়ে রাত আগ্রাসন চালিয়ে দিয়েছে খেয়াল করিনি।

আমি বললাম, ভাই বারবার কোথায় যাচ্ছেন… একটু সুস্থির হয়ে বসেন… গল্প করি…।

সাধুর শিষ্যটি বিনীত হাসি দিয়ে বললেন, গুরুর কখন কি লাগে-যাই একটু খোঁজ খবর নিয়ে আসি।

খেয়াল করছি ভদ্রলোক গল্প করলেও তার মন ঠিক গল্পের মধ্যে নেই। তার মন পরে আছে গুরুর কাছে। ভদ্রলোক এই আধ ঘণ্টার মধ্যেই কম করে হলেও দশ থেকে বারো বার উঠেছেন কথাবার্তা চলার মধ্যেই।

আমার পাশ থেকে উঠে, তাল গাছগুলো পেরিয়ে অনেকটা দূরে আখড়ার প্রধান ঘরের ভেতর যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন।

পুকুর পাড়ে আমি একা বসে আছি জ্যোৎস্নায় ভিজবো বলে। ভদ্রলোক তাই বিপদে পরেছেন। না পারছেন আমাকে একা পুকুর পাড়ে বসিয়ে রাখতে। না পারছেন গুরুর চরণে বসে থাকতে। আমি অবশ্য বলেছি উনাকে আমার একা থাকতে কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, বাঙালী অতিথিপরায়ণ জাতি। তার উপর সাধুগুরুর আখড়াবাড়ি বলে কথা। সেখানে তো অতিথি স্বয়ং নারায়ণ। তাকে কি আর একা পুকুরঘাটে ফেলে রাখা যায়?

আখড়ায় আজ আর কেউ নেই। গুরুজী সন্ধ্যা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে পরেছেন। প্রচণ্ড গরমে ঘরের ভেতর থাকা মুশকিল বিধায় আমি পুকুর পাড়ে আস্তানা গেড়েছি।

পায়ের শব্দে ফিরে তাকাতেই দেখি ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে দুই হাতে দুই মগ গরম গরম চা নিয়ে আমার দিকেই আসছেন।

আমিও হাসি বিনিময় করে বললাম, আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছি দাদা; তাই না?

ভদ্রলোক দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বললেন, আরে না না দাদা! কি যে বলেন। আজ আখড়ায় কেউ নাই বলে আপনার সেবা করতে পারছি না। সবাই গেছে গুরুজির ভাগ্নির মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে। গুরুজী আবার বিয়ে-শাদীতে যান না।

-তা আপনি গেলেন না?

-আমি গেলে গুরুজীকে দেখবে কে?

-হুমম, গুরুজী আপনাকে খুব ভালোবাসে…।

-বুঝলেন দাদা গুরু হইলো শিশুর মতোন। অবুঝ। তাকে বুঝ দিয়া রাখতে হয়। কখন কোন বিষয়ে কি নিয়া মন-অভিমান করে তার হিসাব-নিকাশ নাই। তা বোঝারও উপায় রাখে না। খুব সাবধানে থাকতে হয় গুরুর সেবায়। বিষয়বাসনায় ডুইবা গুরুর চরণ যদি স্মরণ না থাকে তাইলে বিপদ দাদা। মহাবিপদ।

গুরু অসন্তুষ্ট হলে সব সাধন-ভজনই শেষ দাদা। গুরুর চরণেই ভক্তের আসল আশ্রয় – আসল আশ্রম দাদা। সেই চরণের খেয়াল না রাখলে কি চলে। খেয়াল তো রাখতেই হবে। আবার গুরুর অতিথিও তো গুরুরই রূপ, তার সেবা না করলেও তো গুরুরই অকল্যাণ।

এ জগৎ বড়ই রহস্যময়। কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো আগে থেকে বলা যায় না। কে বলতে পারত যে ছেলেটা ছবি আঁকতো শহরের – প্রকৃতির, সেই ছেলেটা একদিন হিটলার হয়ে উঠবে। অগণিত মানুষের রক্তে হাত রাঙাবে? আবার যে জানতো ডাকাতি করা ছেলেটা একদিন বাল্মিকী হয়ে উঠবে?

-তাহলে চলেন দাদা আপনার সমস্যা আর না বাড়িয়ে চা খেয়ে আখড়া ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

তবে সে রাতে আখড়া ঘরে আমাদের যেতে হয়নি। গুরুজী ঘরে মটকা মেরে ঘুমিয়ে থাকতে না পেরে চলে এসেছিলেন পুকুর পাড়ে। একতারা ডুগি নিয়ে বাকি রাতটা মহতের পদ গেয়ে পার করে দিয়েছিলেন।

সেদিন সেই গুরুজী সাঁইজির কোন কোন পদ করেছিলেন তা আজ সেভাবে মনে নেই। তবে সেই রাতের কথা মনে পরলে সাঁইজির এই পদটা কেনো যেন বারবার সামনে চলে আসে-

কে তোমার আর যাবে সাথে।
কোথায় রবে এ ভাই বন্ধু
পড়বি যেদিন কালের হাতে।।

নিকাশের দায় করে খাড়া
মারবে রে আতশের কোড়া,
সোজা করবে বেকা তেড়া
জোর খাটবে না তাতে।।

যে আশাতে ভবে আসা
হল না তার রতি মাসা,
ঘটাইলি মন কি দুর্দশা
কুরসে কুসঙ্গে মেতে।।

যারে ধরে পাবি নিস্তার
তারে সদাই ভাবলি রে পর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমার
ছাড় ভবের কুটুম্বিতে।।

এ জগৎ বড়ই রহস্যময়। কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো আগে থেকে বলা যায় না। কে বলতে পারত যে ছেলেটা ছবি আঁকতো শহরের – প্রকৃতির, সেই ছেলেটা একদিন হিটলার হয়ে উঠবে। অগণিত মানুষের রক্তে হাত রাঙাবে? আবার যে জানতো ডাকাতি করা ছেলেটা একদিন বাল্মিকী হয়ে উঠবে?

আগে থেকে ঠিকঠাক মতো কি আদৌ কিছু বলবার উপায় আসলেই আছে? কে জানে আপনার হাতে লাগানো একটা বীজ হয়তো হাজার বছর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে ধারীত্রির বুকে। আবার হাজার যত্নে যে বৃক্ষকে প্রতিক্ষণ নজরে রাখা হচ্ছে সে হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না।

কোন বেড়ালটা আদরে আহ্লাদে সকলের ভালোবাসার পরশে বেঁচে উঠবে। আবার কোন বেড়ালটা খাবারের খোঁজে খোঁজে আজন্ম পথে পথে ঘুরে বেড়াবে; তা কে বলতে পারে?

আমরা কি আসলেই কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারি? নিশ্চিত-অনিশ্চিতের দোলাচলে শেক্সপিয়ারের সেই লাইন ফিরে ফিরে আসে- ‘to be or not to be that is the question’।

এই মার্চ মাসের কথা বলছি। তখনো করোনাটা এদেশে আসতে শুরু করেনি। আমরা চলেছি সাঁইজির দোল উৎসবের সাধুসঙ্গে। বাসা থেকে গাবতলী। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাট। লঞ্চে ঘাট পেরিয়ে দৌলতদিয়া রেলস্টেশন।

আগের কথা মতোই বিভিন্ন স্টপিজ থেকে লোকজন জুড়ে জুড়ে ততক্ষণে আমরা পাঁচ জনে গিয়ে ঠেকেছি। ট্রেন আসতে অনেকটা সময় আছে। টিকেট কেটে দুপুরের সেবাটা নিয়ে নিলাম সদ্য গজিয়ে উঠা ছোট্ট চকচকে হোটেলখানায়।

হাতে তখনো কিছুটা সময় আছে, তাও আমরা এদিক সেদিক না ঘুরে ট্রেনে উঠে বসাই ধার্য করলাম। আসলে খাবারটা বেশিই হয়ে গেছে। একটু গা এলিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না। তাই সকলেই একমত হয়ে হাঁটা দিলাম নির্দিষ্ট কামরার দিকে।

দৌলতদিয়া প্লাটফর্মটা অনেকটাই নেড়া, গাছপালা নেই তেমন। দুই একটা যা আছে তাও অনেকটা ছড়ানো নয়। অল্পকিছু ডালপালা নিয়ে নিজের মতো আছে তারা। তাই খা খা রোদ্দুরটা মাথায় নিয়ে ঘোরাঘুরিটা সুখকরও না।

ব্যাগপত্র নিয়ে ট্রেনের দরজা ধরে উঠতে গিয়ে দেখা হুমায়ুন সাধুর ভক্ত নাজিমউদ্দিন সাধুর সাথে। সকলের যাত্রাই যখন একই গন্তব্যে তখন আর পৃথক কামরা কেনো?

প্রস্তাবনা পেয়ে নাজিম সাধু আমাদের সহযাত্রী হতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। নাজিম সাধুকে এভাবে একা আমি আগে কখনো দেখিনি। সব সময়ই দেখেছি দলেবলে। যদিও তার সাথে আমার বহু বহু আড্ডা হয়েছে-সফর হয়েছে এমনটা মোটেও নয়।

লালন সাঁইজির আখড়ায় তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর বেশ কয়েকবার হুমায়ুন সাধুর নরসিংদী খানাবাড়ির আখড়ায়, ভাবনগর মাধবদী আখড়া ছাড়াও এদিক সেদিক দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে।

গুরুবাদীদের মাঝে বরাবরই মানুষকে আপন করে নেয়ার একটা অসামান্য ক্ষমতা থাকে। তার উপর লালন সাঁইজির ঘারানায় সেটার সাথে একটা মায়াময় বিনয়ও যুক্ত থাকে।

তবে এর ব্যাতিক্রমও আছে।

আবার অনেকে এমনো আছে, যার সাথে একবার চোখাচোখি হলেই প্রেম হয়ে যায়। ভালবাসার বিনিময় কালেই বোঝা যায় পরিচয়টা মাত্র হলেও সম্পর্কটা জন্মান্তরের।

তাদের ভালোবাসাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। তারা ভালোবাসা যেমন বিলিয়ে বেড়ায়; তেমনি ভালোবাসা আবার আদায় করে নিতেও কোনো প্রকার ছাড় দেয় না। এমনি বেশকিছু মানুষের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি আমার যাত্রা পথে।

তাদের মধ্যে নাজিম সাধুও একজন। তার সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া হয়নি কখনো। কিন্তু আলাপ হয়েছে-আলোচনা হয়েছে। ভাবের আদান প্রদান হয়েছে। মনের মানুষ হয়ে মনে রয়ে গেছেন। দেখা হলেই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে দুই হাত জড়ো করে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে আসতেন।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন হুমায়ুন সাধুর আখড়া বাড়ি এলাকা। কোনো কিছু লাগবে কিনা। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা বার বার খবর নিতেন। সেই নিজাম সাধু আমাদের সাথে এক কামরায় চলেছেন সাঁইজির দেশে। লম্বা সিটে আমার পাশেই বসলেন।

চুল কেটে ফেলার পর সাধুকে অন্যরকম লাগছিল। প্রথমটায় বুঝে নিতে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তবে এটুকু বুঝতে সময় লাগেনি তিনি এখন দলছুট মানুষ। আসলেই তাই। চোখের দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছিল অনেক কিছু বলতে চাইছেন।

এক ফাঁকে কিছু কথা শুরুও করেছিলেন, কিন্তু ট্রেনের উপচে পরা ভিড় আর আমাদের নানা প্রসঙ্গের আলোচনার মাঝে তিনি নিচু গলায় আমায় বলেছিলেন, নিরিবিলিতে আলাপ করমুনে মেরাজ ভাই।

একটু সময় করে কি নিজাম সাধুর কথাগুলো শুনে নেয়া যেত না? কি জানি হয়তো যেতো। হয়তো যেতো না। যা হয়নি তা নিয়ে ভাবছি না। আমার কেবলই বার বার ঘুরে ফিরে মনে পরছে একটা কথা, দলছুট পাখি বেশি দিন বাঁচে না।

কুষ্টিয়ার সাঁইজির ধামে ঘুরে ফিরে বার বার নিজাম সাধু যার আরেক নাম খড়ম সাধু তার সাথে আমার বা আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে বেশ কয়েকবারই। আড্ডা হয়েছে, চা-বিস্কুট খেয়েছি। কিন্তু সেই নিরিবিলি পরিবেশটা আর পাওয়া যায় নি।

আমি কিছু মুখ ফুটে বলবার আগেই আশিক আমাকে বলেছিল, মেরাজ ভাই! ব্যাপারটা খেয়াল করছেন? নিজামউদ্দিন ভাইরে কেমন ছাড়া ছাড়া লাগছে না?

কেনো ছাড়া ছাড়া লাগছে ততক্ষণে একটা আন্দাজ আমি করে নিয়েছি; বাকিটা নিজাম সাধুর কিছু কথা আর চোখের ভাষায় বুঝে নিয়েছি। কিন্তু সে প্রসঙ্গে আমরা আর কথা বাড়াইনি। হয়তো একটা নিরিবিলি সময়ে নিজাম সাধুর সেই সব কথা শুনবো বলে।

তারপর সপ্তাহ পার করে ঢাকায় যখন প্রবেশ করলাম ততদিন লকডাউন গ্রাস করতে শুরু করেছে বিশ্বের মতো আমার দেশকেও।

নিরিবিলি পরিবেশ পেলে নিজাম সাধু আমাকে কি বলতেন, কতটা বলতে পারতেন বা আমি কতটা বুঝতে পারতাম কিংবা আমি যা আন্দাজ করেছি তার কতটা সত্য বা অসত্য সেসব এখন আর কোনো মানে রাখে না।

এখন সত্য একটাই তিনি এই মাসের অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ দেহত্যাগ করেছেন। আসলে আমরা কেনো যে একটা নিরিবিলি পরিবেশ তৈরি করে কাজের কথাটা শুনে নিতে পারি না সেটাই প্রশ্নের। আমরা কি আদৌ এতোই ব্যস্ত? এত্তো এত্তো কাজ আমাদের??

একটু সময় করে কি নিজাম সাধুর কথাগুলো শুনে নেয়া যেত না? কি জানি হয়তো যেতো। হয়তো যেতো না। যা হয়নি তা নিয়ে ভাবছি না। আমার কেবলই বার বার ঘুরে ফিরে মনে পরছে একটা কথা, দলছুট পাখি বেশি দিন বাঁচে না।

দলছুটের জন্য তার নিজেরও দোষ থাকতে পারে বা হতে পারে ভুল। বা ঘটনার স্বীকারও হতে পারে। সেসব কেউ বিচার বিবেচনা করে না। দলছুট হলেই লোকে মন্দ বলে। কলঙ্ক দেয়। দলছুটেরা অন্যের কথায় নয় নিজের দলহীন হয়ে যাওয়ার বেদনাতেই একদিন চলে যায় নিভৃতে।

আমি দেখেছি দলছুট পাখিকে বড় পাখিরা যখন ক্রমাগত আক্রমণ করে চলে। প্রথম প্রথম সে পালানোর অনেক চেষ্টা করে। মারামারিও করে। তারপর অনেকটা সময় যাওয়ার পর, অনেক সময় বড় পাখিরাও তাকে আর বিরক্ত করে না। চলে যায় তাকে একা করে।

আমি দেখেছি একা একা এক জায়গায় ঠায় বসে থেকে থেকে দলছুট পাখিদের মরে যাওয়া। আমার অনেক সময়ই মনে হয়েছে- সে একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করছে। এমন অনেক পাখিকেই আমি খাবার-জল দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা সেগুলো মুখেও তুলে নি।

অনেক সময় দেখে মনে হয়নি তারা মারাত্মক শারীরিকভাবে আহত। ঠায় এক জায়গায় বসে বসে স্রেফ মরে যায়। এ দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি। দেখে দেখে অস্থির হয়েছি। বুঝবার চেষ্টা করেও কুল পাইনি। প্রথম প্রথম ভাবতাম দলছুট পাখিটা মনে হয় খুব ক্লান্ত।

অনেক সময় তাদের ধরবার চেষ্টাও করেছি জোড় করে খাওয়াবো বলে। সদ্য দলছুটরা বিশেষ করে যারা পথহারা তারা ধরা দেয়। খাবার খায়। বেঁচে থাকে। কিন্তু যারা দল থেকে পরিত্যক্ত হয় তারা এমন একটা দূরত্বে বসে থাকে যেখান থেকে তাদের ধরে এনে খাবার জল কিছুই খাওয়ানোর উপায় থাকে না।

এই সমস্ত কথার সাথে নিজাম সাধুর হয়তো কোনো সম্পর্কই নেই। হয়তো এসবই আমার অহেতুক ভাবনা। অতিকল্পনার ফসল। হয়তো সাধুগুরুদের বেশি ভালোবাসি বলেই এমন সব ভাবনা মাথায় আসে।

তারপরও সুমন ক্বারী যখন জানালো নিজাম দেহত্যাগ করেছেন। তখন প্রথমেই আমার এই কথাটাই মনে পরেছে- দলছুট পাখিরা আর ঘরে ফেরে না।

সাঁইজি বলেছেন-

মন তোমার হল না দিশে।
এবার মানুষের করণ হবে কিসে।।

যখন আসবে যমের চেলা
ভেঙ্গে যাবে ভবের খেলা,
সেদিন হিসাব দিতে বিষম জ্বালা
ঘটবে শেষে।।

উজান ভেটেন দুটি পথ
ভক্তি মুক্তির করণ সেত,
তাতে যায় না জরামৃত
যমের ঘর সে।।

যে পরশে পরশ হবি
সে করণ আর কবে করবি,
সিরাজ সাঁই কয় লালন র’লি
ফাঁকে বসে।।

তখন আমরা যে বাসার একতলায় ভাড়া থাকতাম সে বাসার চার তলার ফ্ল্যাটে থাকতো সোহেল ভাইরা। তাদের সাথে তাদের এক মামাও থাকতেন। ঢাকায় ছোটখাটো একটা চাকরি করতেন। ভদ্রলোকের নাম ঠাণ্ডা। আমাদের ‘ঠাণ্ডা মামা’।

ঠাণ্ডা মামার প্রথম সন্তান হয়েছে কিন্তু ছুটি ব্যবস্থা করতে পারেন নি বলে গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। এই কথা প্রতিদিন আমাদের বলে যান। সামনে ঈদ কিছুতেই ছুটির কথা জোড় দিয়ে অফিসে বলা যাচ্ছে না। তার উপর ঠাণ্ডা মামা জোড় দিয়ে কথা বলবেন কি করে? সেটা যে তার স্বভাবেই নেই।

সোহেল ভাইরা পাবনা জেলার মানুষ। তখন আমরা জানতাম পাবনা জেলার মানুষ খুব নরম স্বভাবের হয়। একথা কেনো আমাদের মাথায় ঢুকেছিল এখন আর মনে করতে পারি না। তবে ঠাণ্ডা মামার নাম যে তার অতি অতি অতি কোমল স্বভাব ও স্বরের জন্য হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কোন মানুষ এতো ধীরে ধীরে টেনে টেনে কথা বলতে পারেন তা ঠাণ্ডা মামাকে না দেখলে বিশ্বাস করাই মুশকিল ছিল। সকল কিছুইতেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড নরম ও ধীর প্রকৃতির। তাই সম্ভবত তার নাম হয়েছিল ঠাণ্ডা। সকলে তাকে সেই নামেই ডাকতো।

তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তিনি এতো ধীরে সদর দরজা টোকা দিতেন যে ভালো করে কান না পাতলে তা শোনা যেত না। এভাবে তিনি অনেক সময় ধরে টোকা দিতেই থাকতেন কিন্তু কখনোই জোড়ে টোকা দিতেন না।

তখনো এই শহরের মানুষের হাতে ছিল প্রচুর অবসর। চাকরি-ব্যবসা করেও একে অন্যকে দেয়ার মতো সময় ছিল। ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেওয়ার রেওয়াজও।

ঠাণ্ডা মামার প্রথম সন্তান হয়েছে কিন্তু ছুটি ব্যবস্থা করতে পারেন নি বলে গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। এই কথা প্রতিদিন আমাদের বলে যান। সামনে ঈদ কিছুতেই ছুটির কথা জোড় দিয়ে অফিসে বলা যাচ্ছে না। তার উপর ঠাণ্ডা মামা জোড় দিয়ে কথা বলবেন কি করে? সেটা যে তার স্বভাবেই নেই।

যাক, তার যৎসামান্য সামর্থ্য দিয়ে বৌ-সন্তান, মা-বাবা সহ পরিবারের সকলের জন্য এটা সেটা কিনলেন সারা রোজার মাস জুড়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেসব এনে আমাদের দেখিয়ে নিয়ে যান। বাচ্চার জন্য কেনা জামাকাপড়জুতা দেখাবার সময় প্রতিবার তার চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠতো।

বৌ বা পরিবারের জন্য যাই কিনতেন তা দেখাতে খুবই লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলতেন। আর বইলেন না, আপনাদের বৌমা বললো ঘরে একটা সুপারি কাটার শর্তা কেনার কথা, তাই কিনলাম।

ঈদের ঠিক আগে আগে এক সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা মামা বিশাল সাইজের একটা শিলপাটা নিয়ে হাজির।

পাবনায় নাকি ভালো মসলা বাটার শিলপাটা পাওয়া যায় না। বৌ বলেছে, ঢাকা থেকে নিয়ে আসতে তাই কিনেছেন। এই বিশাল সাইজের শিলপাটা তিনি বহন করে গ্রামে নিয়ে যাবেন, এটা শুনে কে সেই চরম বোকা লোক, তাকে দেখতে আমাদের বাসার সামনে সেই সন্ধ্যায় অনেকেই ভীড় করলো।

সকলেই হাসাহাসি করলো, তার এই বোকামির জন্য। কিন্তু ঠাণ্ডা মামা ব্যাপক পুলকিত। মন মতো একটা শিলপাটা কম দামে কিনতে পারার খুশি তিনি বিগলিত হয়ে প্রকাশ করতে লাগলেন সকলের কাছে। আজো স্পষ্ট মনে আছে, ঠাণ্ডা মামা সকলের কাছে গ্রামে যাওয়ার আগের রাতে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে গেলেন।

ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলাম, খুব ভোরেই নাকি ঠাণ্ডা মামা বিশাল সাইজের ব্যাগে সকল কিছু নিয়ে সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে, দুই হাতে সেই বিশাল পাটাখানা নিয়ে হাসি মুখে রওনা দিয়েছেন ভোরের আলো ফোটার কালেই। যারা সেই দৃশ্য দেখেছে তারা ডেকে ডেকে সারাদিন সেই কাহিনী একে অন্যেকে বলতে লাগলো।

মহল্লার অনেকে তাকে নিয়ে নানান হাসি-তামাসায় ফেঁটে পরলো। অনেকে নকল করে তার হাঁটার ভঙ্গি করে দেখাতে দেখাতে মাটিতে লুটিঁয়ে পরলো। এমন বোকা মানুষ কি করে হয় সংসারে তাই নিজে কত ঠাট্টা-মশকরা। সারাদিন সকলে তা নিয়েই মেতে রইলো। আমরাও তাদের অনুসরণ করতে ছাড়লাম না।

তবে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় খেলা শেষে বাসায় ফেরার মুখে দেখি পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সারাদিনের সেই চাঙ্গা ভাবটা আর নেই সকলের। সকলেই একটু মনমরা। ঘরে ঢুকে জানতে পারলাম, ঠাণ্ডা মামা তার বিশাল পাটাখানা হাতে ফিরে এসেছেন।

গাবতলীতে যাওয়ার পথে রাস্তায় ছিনতাইকারীরা পথ রোধ করে তার সবকিছু নিয়ে গেছে। ব্যাগপত্র-টাকা-পয়সা সবকিছু। কিন্তু ওজনে বেশি হওয়ায় পাটাখানা নিয়ে যায় নি। শূন্য পকেটে বিশাল পাটাখানা নিয়ে তিনি সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছেন।

সন্ধ্যার মুখে ফিরেছেন। অনেক চেষ্টা করেও আর টাকা জোগার করতে পারেন নি। তাই আর গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি ঠাণ্ডা মামার। সারাদিন যারা হাসি-তামাশা করেছে তাদের সকলেই এখন ঠাণ্ডা মামার ব্যাথায় কাতর। ঐদিকে ঠাণ্ডা মামা নাকি ঘর বন্ধ বাতি নিভিয়ে করে শুয়ে পরেছেন।

সেই যাত্রায় ঠাণ্ডা মামার আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। ঈদের দিন আমাদের বাসায় ছলছল চোখে সেমাই খেতে খেতে সেই ছিনতাইয়ের ঘটনা বলেছিল আমাদের।

পরে বড়দের কাছে শুনেছিলাম কেউ কেউ তাকে গ্রামে যাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু বোকা হলেও ঠাণ্ডা মামার আত্মসম্মানবোধ ছিল অটুট। তিনি করো সাহায্য নেন নি।

সেই ঈদের দিন আমাদের ছোটদের কয়েকজনকে নিয়ে তিনি ধুপখোলা মাঠে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির বড়দের অনুমতি নিয়ে। আমার মনে আছে। আমরা যখন মাঠে তখন তিনি দূরে বসে ছলছল চোখে অন্য কোনো খানে তাকিয়ে ছিলেন।

‘এসব বাজে কথা। এমনই যদি হয় তাহলে যারা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয় না। তারা কি করে বহাল তবিয়তে থাকে? যারা প্রকৃত আইন ভাঙছে তাদের কয়জন সাজা পায়? শহরের এই যে সব বিশার বিশাল ভবন সেগুলো কি খুব সৎ উপার্জনে হয়েছে?’

একজন অসহায় বাবার দৃষ্টির কি অসহ্য যন্ত্রণা ঠাণ্ডা মামার চোখে ছিল আমি সেদিনও বুঝে উঠতে পারিনি। এতো বছর পর ভাবলেও বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু সেই ছলছল চোখ আর কেঁপে কেঁপে উঠা মানুষটার সেই দৃশ্যগুলো যখন মনে পরে তখন একটা হাহাকার কাজ করে খুব গভীরে।

ঠাণ্ডা মামার মতো হেরে যাওয়া মানুষরাই আমার হিরো। আমি আমার চারপাশের শত-সহস্র সফল মানুষকে নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবিনি। আমার স্মৃতিপটে হাতড়ালে বেশিভাগ হেরে যাওয়া-পোড় খাওয়া মানুষের চিত্রই ফুটে উঠে।

হয়তো আমিও তাদেরই দলে বলে তাদেরই ভালোবাসি। তাদের কথাই স্মৃতিপটে চিত্রিত করে রাখি। খুব গোপনে নিজেকেই নিজে সংরক্ষণ করি অন্যের ভেতর দিয়ে।

এক শুভ্রবস্ত্রধারী ফকির বলেছিল- ‘যার যেমন করণ তার তেমন বরণ।’

শুনে আমার সহযাত্রীটি গরম গলায় বলেছিল, ‘এসব বাজে কথা। এমনই যদি হয় তাহলে যারা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয় না। তারা কি করে বহাল তবিয়তে থাকে?

যারা প্রকৃত আইন ভাঙছে তাদের কয়জন সাজা পায়? শহরের এই যে সব বিশার বিশাল ভবন সেগুলো কি খুব সৎ উপার্জনে হয়েছে?’

ফকির হাসি হাসি ঠোঁটে বলেছিল, ‘বাজান গরমে সরম থাকে না।’

বন্ধুটি আরো রেগে বলেছিল, ‘আপনি শব্দ মিলিয়ে মিলিয়ে বাক্য বললেই কোনো সমাধান হয় না। আপনি কি বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।’

ফকির হাসির ঝলকটা আরেকটু বাড়িয়ে বলেছিল, ‘বাজান কথার মধ্যেই কথা লুকিয়ে থাকে। সেই কথার সন্ধান করতে হয়। সব ভাইঙ্গা বললে আর মাথা রাইখা লাভ কি। এতো শক্ত শক্ত কথা কইতে পারেন। ফকিরের দুইটা শব্দ না বুঝলে কেমনে হইবো।

আমরার তো জ্ঞান-বুদ্ধি নাই। পড়ালেখা করি নাই। আমাগো কথা তো সহজ কথা। সহজ মন হইলেই ধরবার পারবেন। গমর হইলে হইবো না। শান্ত হয়ে ভাববার লাগবো। তয় বোঝা যাইবো।’

ফকিরের কথায় কি ছিল জানি না। আমার তরুণ তুর্কি বন্ধুটি বেশ নরম হয়ে গেলো। শান্ত গলায় বলেছিল, ‘আরেক কাপ চা খাবেন বাজান’।

আসলে ফকিরের মাধুর্যই তাই। তারা প্রেমের জাদুকর। প্রেম দিয়ে সব চূড়মার করে দেয়। ঠিক কবি ত্রিদিব দস্তিদার যেমন বলেছিল- ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দিব’।

ফকিররাও তেমনি প্রেমের মায়াডোরে মনের উত্তেজনা-উগ্রতা সব ধুয়ে মুছে তকতকে চকচকে করে তোলে। তবে অবশ্য তার জন্য ফকিরের মতো ফকির হতে হয়। সাজোনের ফকির হইলে হয় না।

আবার আমার মতো দলিতের পক্ষে কে যর্থাথ ফকির আর কে সাজোনের ফকির তার বিভেদ করা সম্ভব নয়। আমি সেই বিভেদে যাইও না। আমি মনে করি, ফকির লালন এমন এক ধারা দিয়ে গেছেন তাতে বিষ ঢুকে পরলেও তা এক সময় মধু হয়ে যাবে।

যারা সাধু পথে এসেও উগ্রতা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, লোভ, কামনা, বাসনা থেকে এখনো বের হতে পারেন নি। আমি তাদের খুব কাছাকাছি থাকতে চাইনা কখনো। তাদের সঙ্গও আমাকে আনন্দিত করে না। তাদের দেখলে মন ভরে উঠে না।

কিন্তু তাদেরকে ঘৃণা করি না। তাদের নিয়ে আমার তীব্র বিদ্বেষ কাজ করে না। আমার কেবলই মনে হয় তাদের আরো একটু সময় লাগবে বিনয়ভাব গ্রহণ করতে। সর্বক্ষণ অন্য লোকে কি কি খারাপ কাজ করলো আর আমি কি কি মহান কাজ করেছি তার আলাপ থেকে তারা এক সময় ঠিক ঠিক বেড়িয়ে আসবে।

আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অনেকে তার জীবনের ষোল আনার চৌদ্দ আনাই সাধুপথে খরচ করেছেন। কিন্তু সেই চৌদ্দ আনার বারো আনাই খরচ করে ফেলেছেন অন্যর দোষত্রুটি ধরতে দিয়ে।

আমার তাদের জন্য খুবই আফসোস হয় এই ভেবে যে, তারা যদি অন্যের ভুল-ত্রুটি খুঁজতে না গিয়ে সাধনে সময় দিতো তাহলে হয়তো লালন ধারার অনেক উপকার হতো।

তাদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনার বিকাশ হয়নি কেবল অন্যের খুঁত ধরতে গিয়ে। কোন সাধু ভালো। কোনো সাধু প্রকৃত সাধু না। কার কোনো ইতিহাস। কে কি করেছে। লালন এইটা বলছে। বা লালন কি এইটা বলছে? তারা কিচ্ছুই বোঝে না। আমি সব বুঝি।

এই সব ভাবনা থেকে বের হয়ে যদি তারা একটু সার্বজনীন ভাবে ভাবতে পারতো তাহলে হয়তো লালনকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কাজ আমরা পেতাম। আমার মতো, অভাজন, চণ্ডালরা হয়তো কিছুটা শিখতে পারতো।

অবশ্য এক ফকির বলেছিল, আরে এসব মানুষ আছে বলেই তো সাধুর বাজারে মজা আছে। এদের দেখে অনেকেই এ পথে আসে না। এরা হচ্ছে সেই আগাছা। যারা নিজে গজিয়ে অন্য আগাছাকে বাগানে প্রবেশ করতে দেয় না।

চানক্য তার এক বাণীতে বলেছিল- ‘অসন্তুষ্ট ব্রাহ্মণের আত্মিক উন্নতি হয় না’। হয়তো তাই। হয়তো বা না। আবারো সেই টুবি অর নট টুবি। যাক সে কথা। এ যাত্রায় শেষ করা দরকার। আমি আসলে আমার সেই ব্রাত্য ভাবনা থেকেই ভাবি। চণ্ডাল মানুষিকতা নিয়েই ভাবি।

এর বেশি ভাববার ক্ষমতা আসলেই আমার নেই। আমাকে এভাবেই ভাবায়। আর আমি যেভাবে ভাবি তাই লিখি। এই লেখা কখনোই সকলকে খুশি করতে পারবে না। সকলকে খুশি করার দায়ও আমার নেই। এই সাজানো সভ্যতা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।

কিন্তু ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা কোনো কিছুই নেই। আমি লালনের কাছে এটুকুই কেবল শিখেছি- কু-তর্কের দোকান সে করে না। তাই তুমি নোংরা ঘাটায় মনোযোগী হবে নাকি শুদ্ধতার সন্ধান করবে সেটা স্রেফ তোমার সিদ্ধান্ত। সাধুগুরুর সর্বচরণে পাপী মস্তক দণ্ডপাত। জয়গুরু।।

সদা মন থাকো বা হুঁশ
ধরো মানুষ রূপ নেহারে,
আয়না আঁটা রূপের ছটা
চিলেকোঠায় ঝলক মারে।।

বর্তমানে দেখো ধরি
নরদেহে অটলবিহারী,
মরো কেন হড়িবড়ি
কাঠের মালা টিপে হারে।।

স্বরূপ রূপে রূপকে জানা
সেই তো বটে উপাসনা,
গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা
ব্যোমকালী আর বলিস নারে।।

দেল ঢুঁড়ে দরবেশ যাঁরা
রূপ নিহারে সিদ্ধ তাঁরা,
লালন কয় আমার ফেরা
ডেংগুলিটি সার হলোরে।।

(চলবে…)

…………………………..
প্রচ্ছদ চিত্র: মাহামুদুল হাসান

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!