ভবঘুরেকথা
যীশু খ্রীষ্ট ইশা বড়দিন খ্রিস্টান প্রভু

তাতে আমি দেখেছি যে, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার তুলনায় যাকে সৃষ্টি করা হয়নি সে-ই আমার কাছে বেশী ঈর্ষণীয়। ইসহাক ইব্‌ন বিশর. হাসান (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন হযরত ঈসা (আ) হবেন সংসার-বিমুখদের নেতা! তিনি আরও বলেছেন : কিয়ামতের দিন পাপ থেকে পলায়নকারী লোকদের হাশর হবে ঈসা। (আ)-এর সাথে।

রাবী আরও বলেন : একদিন হযরত ঈসা (আ) একটি পাথরের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। তিনি গভীর নিদ্ৰায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় ঐ স্থান দিয়ে ইবলিস যাচ্ছিল। সে বলল, ওহে ঈসা! তুমি কি বলে থাক না যে, দুনিয়ার কোন বস্তুর প্রতি তোমার আগ্রহ নেই? কিন্তু এই পাথরটি তো দুনিয়ার বস্তু।

তখন হযরত ঈসা (আ) পাথরটি ধরে তার দিকে ছুড়ে মারলেন এবং বললেন, দুনিয়ার সাথে এটিও তুই নিয়ে যা। মুতামির ইব্‌ন সুলায়মান বলেন, একদা হযরত ঈসা (আ) তাঁর শিষ্যদের সাথে নিয়ে বের হন। তাঁর পরিধানে ছিল পশমের জুব্বা, চাদর ও অন্তর্বাস। তাঁর পায়ে কোন জুতা ছিল না। তিনি ছিলেন ক্রন্দনরত।

তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো! ক্ষুধার তীব্রতায় চেহারা ছিল ফ্যাকাশে। পিপাসায় ঠোঁট দুটি শুষ্ক। এ অবস্থায় তিনি বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে সালাম দিয়ে বললেন : আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি দুনিয়াকে তারা সঠিক অবস্থানে রেখেছি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই এবং এর জন্যে আমার গৌরবেরও কিছু নেই।

তবে তার বর্ণনায় এইটুকু বেশী আছে যে, কামনা-বাসনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখে ফেলে। ঈসা (আ) বলতেন, হে দুর্বল আদম-সন্তান! যেখানেই থাক। আল্লাহকে ভয় কর, দুনিয়ায় মেহমান হিসেবে জীবন যাপন কর। মসজিদকে নিজের ঘর বানাও।

তোমরা কি জান, আমার ঘর কোথায়? তারা বলল, হে রুহুল্লাহ! কোথায় আপনার ঘর? তিনি বললেন, আমার ঘর হল মসজিদ, পানি দিয়েই আমার অঙ্গসজ্জা। ক্ষুধাই আমার ব্যঞ্জন। রাতের চাঁদ আমার বাতি, শীতকালে আমার সালাত পূবাঁচল, শাক-সজিই আমার জীবিকা, মোটা পশমই আমার পোষাক।

আল্লাহর ভয়ই আমার পরিচিতি, পঙ্গু ও নিঃস্বরা আমার সঙ্গী-সাথী। আমি যখন সকালে উঠি তখন আমার হাত শূন্য, যখন সন্ধ্যা হয় তখনও আমার হাতে কিছু থাকে না। এতে আমি সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন। সুতরাং আমার চাইতে ধনী ও সচ্ছল। আর কে আছে? বর্ণনাটি ইব্‌ন আসাকিরের।

আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে তিনি বর্ণনা করেছেন : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহ হযরত ঈসার নিকট এই মর্মে ওহী পাঠান যে, তোমাকে শত্রুরা যাতে চিনতে ও কষ্ট দিতে না পারে সে জন্যে তুমি সর্বদা স্থান পরিবর্তন করতে থাকবে। আমার সন্ত্রম ও প্রতিপত্তির কসম, আমি তোমাকে এক হাজার হুরের সাথে বিবাহ দিব এবং চারশ বছর যাবত ওলীমা খাওয়াব।

এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। এটা একটি ইসরাঈলী বর্ণনা। আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক, খালফ ইব্‌ন হাওশব থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন, রাজা-বাদশাহরা যেমন দীন ও হিকমত তোমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে, তোমরাও তেমন তাদের জন্যে দুনিয়া ছেড়ে দাও। কাতাদা বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেছিলেন : তোমরা আমার নিকট প্রশ্ন কর।

উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন : যবের রুটি আহার কর, খালিস পানি পান কর এবং দুনিয়া থেকে শান্তি ও নিরাপদের সাথে বের হয়ে যাও। আমি তোমাদেরকে নিগৃঢ় তত্ত্বকথা জানাচ্ছি যে, দুনিয়ায় যা সুস্বাদু, আখিরাতে তা বিস্বাদ আর দুনিয়ায় যা বিস্বাদ আখিরাতে তা-ই সুস্বাদু।

আল্লাহর প্রকৃত বান্দারা দুনিয়ায় ভোগ বিলাসের জীবন যাপন করতে পারে না। তোমাদেরকে আমি সঠিক বলছি যে, তোমাদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে সেই লোক, যে জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং চায় যে, সকলেই যেন তার মত হয়।

আবু হুরায়রা (রা) থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু মুসআব মালিকা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদেরকে বলতেন : খালিস পানি পান কর, তাজা সক্তি খাও এবং যবের রুটি আহার কর। গমের রুটি খেয়ো না যেন। কেননা তোমরা এর শোকর আদায় করতে পারবে না।

ইব্‌ন ওহাব …ইয়াহয়া ইব্‌ন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলতেন : তোমরা দুনিয়া অতিক্রম করে যাও। একে আবাদ করো না। তিনি বলতেন : দুনিয়ার মহব্বত সকল গুনাহের মূল এবং কুদৃষ্টি অন্তরের মধ্যে কাম-ভােব উৎপন্ন করে। উহায়ব ইব্‌ন ওয়ারদও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

তবে তার বর্ণনায় এইটুকু বেশী আছে যে, কামনা-বাসনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখে ফেলে। ঈসা (আ) বলতেন, হে দুর্বল আদম-সন্তান! যেখানেই থাক। আল্লাহকে ভয় কর, দুনিয়ায় মেহমান হিসেবে জীবন যাপন কর। মসজিদকে নিজের ঘর বানাও।

চক্ষুদ্বয়কে কাঁদতে শিখাও, দেহকে ধৈর্যধারণ করতে ও অন্তরকে চিন্তা করতে অভ্যস্ত কর। আগামী দিনের খাদ্যের জন্যে দুশ্চিন্তা করো না এটা পাপ। তিনি বলতেন, সমুদ্রের তরঙ্গের উপরে ঘর বানান যেমন সম্ভব নয় তেমনি দুনিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকাও সম্ভব নয়। কবি সাবিকুল বরাবরী এ প্রসংগে সুন্দর কথা বলেছেন যথাঃ

অর্থাৎ তলোয়ারের পথেই তোমাদের ঘর শোভা পায়। যে ঘরের ভিত্তি মাটির উপরে, তা কি পানির উপরে বানানো সম্ভব?

সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ঈসা (আ) বলেছেন : মুমিনের অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত ও আখিরাতের মহব্ববত একত্রে থাকতে পারে না- যেভাবে একত্রে থাকতে পারে না একই পাত্রে আগুন ও পানি। ইবরাহীম হারবী… আবু আবদুল্লাহ সূফী সূত্রে বলেন, ঈসা (আ) বলেছেন : দুনিয়া অন্বেষণকারী লোক সমুদ্রের পানি পানকারীর সাথে তুলনীয়। সমুদ্রের পানি যত বেশী পান করবে তত বেশী পিপাসা বৃদ্ধি পাবে এবং তা তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। ঈসা (আ) বলেছেন : শয়তান দুনিয়া অন্বেষণ ও কামনাকে আকর্ষণীয় করে এবং প্রবৃত্তির লালসার সময় শক্তি যোগায়।

ছাওরী… ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) তার সাথীদেরকে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে যথাৰ্থ বলছি, যে ব্যক্তি ফিরদাউস আশা করেন তার উচিত যবের রুটি আহার করা এবং আবর্জনা স্তুপের মধ্যে কুকুরদের সাথে বেশী বেশী ঘুমান। মালিক ইব্‌ন দীনার বলেন, ঈসা। (আ) বলেছেন, ছাইযুক্ত যাব আহার করা এবং আবর্জনার উপরে কুকুরের সাথে ঘুমানোর অভ্যাস ফিরদাউস প্রত্যাশীদের মধ্যে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

আমাশ খায়ছমা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) সংগী-সাথীদের সামনে আহার্য রেখে নিজে আহার থেকে বিরত থাকতেন এবং বলতেন, মেহমানদের সাথে তোমরাও এইরূপ আচরণ করবে। জনৈক মহিলা ঈসা (আ)-কে বলেছিল, ধন্য সেই লোক, যে আপনাকে ধারণ করেছিল এবং ধন্য সেই স্থান যে আপনাকে দুধ পান করিয়েছিল। উত্তরে ঈসা (আ) বলেছিলেন, ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে ও তার বিধান মেনে চলে।

ঈসা (আ) আরও বলেছেন, সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যের অধিকারী যে নিজের গুনাহ স্মরণ করে কান্নাকাটি করে, জিহবাকে সংযত রাখে এবং যার ঘরই তার জন্য যথেষ্ট হয়। তিনি বলেছেন, ঐ চক্ষুর জন্যে সুসংবাদ, যে গুনাহ থেকে চিন্তামুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যায় এবং জেগে উঠে গুনাহ বিহীন কাজে মনোনিবেশ করে। মালিক ইব্‌ন দীনার থেকে বর্ণিত। ঈসা (আ) আপন শিষ্যবর্গের সাথে কোথাও যাচ্ছিলেন।

পথে একটি মৃত দেহ দেখতে পেলেন। শিষ্যরা বলল, মৃত দেহ থেকে তীব্র দুৰ্গন্ধ বের হচ্ছে। ঈসা (আ) বললেন, তার দাঁতগুলো কত সাদা। এ কথা বলে তিনি শিষ্যদেরকে গীবত করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু বকর ইব্‌ন আবিদ দুনিয়া… যাকারিয়া ইব্‌ন আব্দী সূত্রে বর্ণনা করেন।

একদা ঈসা (আ) ইব্‌ন মারিয়াম বললেন, হে হাওয়ারীগণ! দীন নিরাপদ থাকলে দুনিয়ার নিম্নমান নিয়েই সন্তুষ্ট থাক; যেমন দুনিয়াদার ব্যক্তিরা দুনিয়ার জীবন নিরাপদ থাকলে দীনের নিম্নমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। এ প্রসংগে কবি বলেন :

আমি লক্ষ্য করেছি, এক শ্রেণীর লোক আছে যাদের মধ্যে দীন কম থাকলেও তাতেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু দুনিয়ার সংকীর্ণতায় তারা রাজী নয়। সুতরাং রাজা বাদশাহদের দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে দীন নিয়েই তুমি সন্তুষ্ট থাক, যেমন রাজা বাদশাহরা দীন থেকে বিমুখ হয়ে দুনিয়া পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে।

আবু মাসআব মালিক থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম বলেছেন : আল্লাহর যিকির ব্যতীত কথাবার্তা বেশী বল না; অন্যথায় তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে যাবে। আর কঠিন অন্তর আল্লাহ থেকে দূরে থাকে, কিন্তু তোমরা সে বিষয়ে অবগত নও।

মানুষের গুনাহের প্রতি এমনভাবে দৃষ্টি দিও না, যেন তুমিই প্রভু বরং নিজেকে দাসের ভূমিকায় রেখে সে দিকে লক্ষ্য কর। কেননা, মানুষ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। কেউ বিপদ থেকে মুক্ত, কেউ বিপদগ্ৰস্ত। বিপদগ্রস্তের প্রতি সদয় হও এবং বিপদমুক্তের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা কর।

ছাওরী… ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) তার সাথীদেরকে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে যথাৰ্থ বলছি, যে ব্যক্তি ফিরদাউস আশা করেন তার উচিত যবের রুটি আহার করা এবং আবর্জনা স্তুপের মধ্যে কুকুরদের সাথে বেশী বেশী ঘুমান। মালিক ইব্‌ন দীনার বলেন, ঈসা। (আ) বলেছেন, ছাইযুক্ত যাব আহার করা এবং আবর্জনার উপরে কুকুরের সাথে ঘুমানোর অভ্যাস ফিরদাউস প্রত্যাশীদের মধ্যে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

তোমার নদী-নালার কী হলো? তোমার প্রাসাদ-রাজির কী অবস্থা? তোমার বাসিন্দারা কোথায় গেল? উত্তরে শহর বলল, হে প্রিয় নবী! আল্লাহর ওয়াদা কার্যকরী হয়েছে। তাই আমার বৃক্ষরাজি শুকিয়ে গিয়েছে, নদী-নালা পানিশূন্য হয়ে গিয়েছে, প্রাসাদ।রাজি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে এবং আমার বাসিন্দারা সবাই মারা গিয়েছে। ঈসা (আ) বললেন, তবে তাদের ধন-সম্পদ কোথায়?

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক… সালিম ইব্‌ন আবিল জাদ সূত্রে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা। (আ) বলেছেন : তোমরা কাজ করা আল্লাহর জন্যে, পেটের জন্যে নয়। পাখীদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা সকালে বের হয়। সন্ধ্যায় ফিরে তারা চাষাবাদও করে না, ফসলও ফলায় না; আল্লাহ-ই তাদেরকে খাওয়ান। যদি বল যে, পাখীদের চেয়ে আমাদের পেট বড়। তা হলে গরু ও গাধার দিকে তাকাও।

সকালে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এরাও না ক্ষেত করে, না ফসল ফলায়; আল্লাহ-ই এদেরকে রিযিক দান করেন। সাফওয়ান ইব্‌ন আমার…ইয়াখীদ ইব্‌ন মায়সারা থেকে বর্ণনা করেন, একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আ)-কে বললেন, হে মাসীহুল্লাহ! দেখুন, আল্লাহর মসজিদ কতই না। সুন্দর। মাসীহ বললেন, ঠিক ঠিক, তবে আমি তোমাদেরকে যথার্থ জানাচ্ছি, আল্লাহ এ মসজিদের পাথরগুলোকে স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান রাখবেন না।

বরং তার সাথে সংশ্লিষ্টদের গুনাহের কারণে ধ্বংস করে দিবেন। তোমাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ও পছন্দনীয় ধন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর কোন কোজ নেই। এই দুনিয়ায় আল্লাহর নিকট প্রিয় বস্তু হচ্ছে সৎ অন্তর। এর সাহায্যেই আল্লাহ দুনিয়াকে আবাদ রেখেছেন এবং এর জন্য তিনি দুনিয়া ধ্বংস করে দিবেন, যখন তা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

ইব্‌ন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে মুজাহিদের সূত্রে ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী আকরম (সা) বলেছেন : একদা হযরত ঈসা (আ) একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শহরের বিধ্বস্ত প্রাসাদ।রাজি দেখে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

কিছু সময় পর তিনি আল্লাহর নিকট আবেদন করেন, হে আল্লাহ! এই শহরকে আমার কতিপয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার অনুমতি দিন। আল্লাহ তাআলা বিধ্বস্ত শহরটিকে ঈসার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তখন শহরটি ঈসা (আ)-কে ডেকে বলল, হে প্রিয় নবী ঈসা। (আ)! আপনি আমার নিকট কী জানতে চান? ঈসা (আ) বললেন, তোমার বৃক্ষরাজি কোথায় গেল?

তোমার নদী-নালার কী হলো? তোমার প্রাসাদ-রাজির কী অবস্থা? তোমার বাসিন্দারা কোথায় গেল? উত্তরে শহর বলল, হে প্রিয় নবী! আল্লাহর ওয়াদা কার্যকরী হয়েছে। তাই আমার বৃক্ষরাজি শুকিয়ে গিয়েছে, নদী-নালা পানিশূন্য হয়ে গিয়েছে, প্রাসাদ।রাজি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে এবং আমার বাসিন্দারা সবাই মারা গিয়েছে। ঈসা (আ) বললেন, তবে তাদের ধন-সম্পদ কোথায়?

শহরটি উত্তর দিল, তারা হালাল ও হারাম পন্থায় নির্বিচারে সম্পদ সঞ্চয় করেছিল, সে সবই আমার অভ্যন্তরে রক্ষিত আছে। আসমান ও যমীনের সব কিছুর সত্ত্বাধিকারী তো আল্লাহই।

অতঃপর ঈসা (আ) বললেন : তিন ব্যক্তির ব্যাপারে আমার অবাক লাগে। তারা হল-

১. যে ব্যক্তি দুনিয়ার সন্ধানে মত্ত। অথচ মৃত্যু তার পশ্চাতে লেগে আছে।
২. যে ব্যক্তি প্রাসাদ নির্মাণ করছে; অথচ কবর তার ঠিকানা;
৩. যে ব্যক্তি অট্টহাসিতে মজে থাকে, অথচ তার সম্মুখে আগুন।

আদম-সন্তানের অবস্থা এই যে, অধিক পেয়েও সে তৃপ্ত হয় না; আর কম। পেলেও তুষ্ট থাকে না। হে আদম সন্তান! তুমি তোমার ধন-সম্পদ এমন লোকদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখে যোচ্ছ, যারা তোমার প্রশংসা করবে না। তুমি এমন প্রভুর পানে এগিয়ে চলছ, যিনি তোমার কোন ওযর শুনবেন না। তুমি তো তোমার পেট ও প্রবৃত্তির গােলাম হয়ে রয়েছে।

কিন্তু তোমার পেট সেই দিন পূর্ণ হবে, যে দিন তুমি কবরে প্রবেশ করবে। হে আদম-সন্তান! অচিরেই তুমি কবরে প্রবশ করবে। হে আদম সন্তান! অচিরেই তুমি দেখতে পাবে, তোমার সঞ্চিত ধন-রত্ন অন্যের পাল্লাকে ভারী করছে। এ হাদীসটি সনদের বিচারে খুবই গরীব পর্যায়ের। কিন্তু উত্তম উপদেশপূর্ণ হওয়ায় উল্লেখিত হলো।

আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট মানুষ সেই জ্ঞানী ব্যক্তি, যে তার জ্ঞানের বিনিময়ে দুনিয়া অর্জন করে। মাকতুল বর্ণনা করেন, একবার ঈসার সাথে ইয়াইয়া (আ)-এর সাক্ষাত হয়। ঈসা (আ) হাসিমুখে তার সাথে মুসাফাহা করেন। ইয়াহয়া (আ) বললেন, কি খালাত ভাই! হাসছেন যে, মনে হচ্ছে আপনি নিরাপদ হয়ে গেছেন? ঈসা (আ) বললেন, তোমাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন, নৈরাশ্যে ভুগছি না কি?

সুফিয়ান ছাওরী ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেন : হে হাওয়ারীগণ! তোমরা তোমাদের মূল্যরান সম্পদ আসমানে রােখ। কেননা, মানুষের অন্তর সেই দিকেই আকৃষ্ট থাকে, যেখানে তার মূল্যবান সম্পদ সঞ্চিত থাকে।

ছাওর ইব্‌ন ইয়ায়ীদ আবদুল আষীয ইব্‌ন যুবয়ান থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইলম শিখে অন্যকে শিখায় এবং সে মতে আমল করে, উর্ধজগতে তাকে বিরাট সম্মানে ভূষিত করা হয়।

আবু কুরায়ব বলেন, বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা (আ) বলেছেন : যেই ইলম তোমাকে কাজের ময্যদানে নিয়ে যায় না, কেবল মজলিস মাহফিলে নিয়ে যায়, তাতে কোন কল্যাণ নেই। ইব্‌ন আসাকির এক গরীব সনদে ইব্‌ন আব্বাস থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদের মাঝে গিয়ে এক ভাষণে বলেন : হে হাওয়ারীগণ!

অযোগ্য লোকদের নিকট হিকমতের কথা বলিও না। এরূপ করলে হিকমত ও প্রজ্ঞাকে হেয় করা হবে। কিন্তু যোগ্য লোকদের নিকট তা বলতে কৃপণতা কর না। তা হলে তাদের উপর অবিচার করা হবে। যে কোন বিষয়ের তিনটি অবস্থা হতে পারে-

১. যার উত্তম হওয়া স্পষ্ট; এগুলোর অনুসরণ করা।
২. যার মন্দ হওয়া স্পষ্ট; এর থেকে দূরে থাক;
৩. যার ভাল বা মন্দ হওয়া সন্দেহযুক্ত; তার ফয়সালা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও।

আবদুর রাযযাক ….ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেছেন শূকরের কাছে মুক্তা ছড়ায়ো না। কেননা মুক্তা দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না, আর জ্ঞানপূর্ণ কথা ঐ ব্যক্তিকে বলো না, যে তা শুনতে চায় না। কেননা জ্ঞানপূর্ণ কথা মুক্তার চাইতেও মূল্যবান আর যে তা চায় না, সে শূকরের চাইতেও অধম। ওহাব প্রমুখ রাবী ইকরিম থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইকরিম আরও বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছেনঃ তোমরা হচ্ছে পৃথিবীতে লবণ তুল্য। যদি নষ্ট হয়ে যাও তবে তোমাদের জন্য কোন ঔষধ নেই। তোমাদের মধ্যে মূর্খতার দুটি অভ্যাস আছে (১) বিনা কারণে হাসা এবং (২) রাত্রি জাগরণ না করে সকালে উঠা। ইকরিম থেকে বর্ণিত, ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ব্যক্তির ফিৎনা সবচাইতে মারাত্মক?

তিনি বললেন- আলিমের পদস্থলন। কেননা আলিমের পদস্থলনে আরও বহু লোক বিপথগামী হয়ে যায়। রাবী আরও বলেন, হযরত ঈসা (আ) বলেছেনঃ হে জ্ঞান পাপীরা! দুনিয়াকে তোমরা মাথার উপরে রেখেছ, আর আখিরাতকে রেখেছ পায়ের নীচে। তোমাদের কথাবার্তা যেন সর্বরোগের নিরাময় হয়।

কিন্তু তোমাদের কার্যকলাপ হচ্ছে মহাব্যাধি। তোমাদের উপমা হচ্ছে সেই মাকাল গাছ যা দেখলে মানুষ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তার ফল খেলে মারা যায়। ওহাব থেকে বর্ণিত, ঈসা (আ) বলেছেনঃ হে নিকৃষ্ট জ্ঞান পাপীরা! তোমরা জান্নাতের দরজায় বসে আছ, কিন্তু তাতে প্রবেশ করছে না। আর নিঃস্বদেরকে তাতে প্রবেশ করার জন্যে আহবানও করছ না।

আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট মানুষ সেই জ্ঞানী ব্যক্তি, যে তার জ্ঞানের বিনিময়ে দুনিয়া অর্জন করে। মাকতুল বর্ণনা করেন, একবার ঈসার সাথে ইয়াইয়া (আ)-এর সাক্ষাত হয়। ঈসা (আ) হাসিমুখে তার সাথে মুসাফাহা করেন। ইয়াহয়া (আ) বললেন, কি খালাত ভাই! হাসছেন যে, মনে হচ্ছে আপনি নিরাপদ হয়ে গেছেন? ঈসা (আ) বললেন, তোমাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন, নৈরাশ্যে ভুগছি না কি?

তখন আল্লাহ উভয়ের নিকট ওহী প্রেরণ করে জানালেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে সে-ই আমার নিকট প্রিয়তর, যে তার সঙ্গীর সাথে অধিকতর হাসিমুখে মিলিত হয়।

ওহাব ইব্‌ন মুনাববিহ বর্ণনা করেছেন, একদা হযরত ঈসা ও তার সংগীরা একটি কবরের পাশে থামলেন। ঐ কবরবাসী সংকটপূর্ণ অবস্থায় ছিল। তখন সংগীরা কবরের সংকীর্ণতা নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। তাদের কথা শুনে ঈসা (আ) বললেনঃ তোমরা মায়ের পেটে এর চেয়ে সংকীর্ণ স্থানে ছিলে।

তারপরে আল্লাহ যখন চাইলেন প্রশস্ত জায়গায় নিয়ে আসলেন। আবু উমর বলেন, ঈসা (আ) যখন মৃত্যুর কথা আলোচনা করতেন, তখন তার চামড়া ভেদ করে রক্ত ঝরে পড়ত। হযরত ঈসা (আ)-এর থেকে এ জাতীয় অনেক উক্তি বর্ণিত আছে। হাফিজ ইব্‌ন আসাকির তাঁর গ্রন্থে বহু উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু উল্লেখ করলাম।

*টীকা : শামাইলে তিরমিয়ীর ১ম অধ্যায়ের দ্বিতীয় হাদীসের বর্ণনা মতে তার চুল না ছিল অত্যধিক কুঞ্চিত, না ছিল একেবারে সোজা।

<<হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : চার ।। হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : এক>>

………………..
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইসলামের ইতিহাস : আদি-অন্ত।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………….
আরও পড়ুন-
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : এক
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : দুই
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : তিন
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : চার
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা : পাঁচ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!