ভবঘুরেকথা
প্ল্যানচেট

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘প্ল্যানচেট’

চুরাশির ফের বুঝতে গেলে যে বিষয়টি বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘আত্মা’। আত্মা সম্পর্কে আগের পর্বগুলোতে অল্পবিস্তর ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আগামী কোনো পর্বে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে আছে।

এর আগে জন্মান্তর সম্পর্কিত আরেকটা বিষয় ‘প্ল্যানচেট’ সম্পর্কে সামান্য ধারণা নেয়া জরুরী। প্ল্যানচেটের সাধারণ অর্থ মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের ক্রিয়া। মানবজাতির ইতিহাসে মৃতের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা নতুন নয়। এর উৎপত্তি কবে তা সময়ের হিসেব কষে বলাও অসম্ভব।

ধারণা করা হয়, আদিকাল থেকেই মানুষ এই চেষ্টা করে আসছে। সত্যি কথা বলতে কি, অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও। এরমধ্যে যে দুর্নিবার আকর্ষণ আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তাই যুগে যুগে উৎসাহী মানুষ যেমন মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের নানা কলাকৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করেছে। তেমনি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে সমর্পিত হয়েও অনেকে তন্ত্র-মন্ত্র-তপস্যা-ধ্যান-ব্রত করেছে। আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছে নানা ক্রিয়া-কলা-কৌশল। মেনেছে বিধিবিধান-রীতিনীতি। পরিতাপের বিষয় হলো, এই বিদ্যা অর্জন করতে গিয়ে মানুষ শুদ্ধতার পাশাপাশি অশুদ্ধ চর্চাও করেছে।

বলতে গেলে এই বিদ্যার অশুদ্ধ বা নেতিবাচক চর্চাই অধিক হয়ে আসছে। এই বিষয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন সময়ে এতো বেশি ক্রিয়া-কলাপ-কৌশল প্রবর্তিত হয়েছে যে অল্পকথায় একে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। সেকারণে প্ল্যাটচেটকে বুঝতে যতটা প্রয়োজন তারই যৎসামান্য আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

এই বিদ্যায় সিদ্ধহস্তরা সাধারণভাবে ওঝা, ডাকি, তান্ত্রিক, কবিরাজ, জাদুকর, গুণীন, পুরোহিত, কিনডকি ইত্যাদি নামে পরিচিত। তারা এসব ক্রিয়া নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র-যন্ত্র উপকরণ-উপাচারের দিয়ে দিন-ক্ষণ-লগ্ন মেনে একক বা দলগত ভাবে করে থাকে।

মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুধু ব্যক্তিগত, দলগত, গোষ্ঠীগত অনুশীলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। একে ঘিরে আধুনিক বিশ্বে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সংগঠন-সমিতি; এমনকি সম্প্রদায় পর্যন্ত। তবে এসব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের বেশিভাগ জনরোষ থেকে বাঁচতে নিজেদের কার্যক্রম রেখেছে গুপ্ত।

পৃথিবীব্যাপী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা বিশাল বিশাল এসব সংগঠন কি করে গুপ্তভাবে তাদের চর্চা চালিয়ে গেছে বা যাচ্ছে সেসব কাহিনী কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। শুরুর দিকে নানা আদর্শ নিয়ে গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে এসব সংগঠনের বেশিভাগই কামনা-বাসনা-প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনে মনোযোগী হয়ে পরে বলে প্রচারিত আছে।

অপরদিকে এমন অনেক সংগঠন-সমিতি গড়ে উঠেছে। যারা প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। দেশে দেশে তাদের শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রকাশ করেছেন নানা প্রকাশনা। এরা মূলত আত্মা গতি-প্রকৃতি ও আত্মার সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমিত রেখেছে। এই তালিকায় বাঙালীও পিছিয়ে ছিল না। শুধু বাঙালী বললে ভুল হবে। রীতিমতো শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রপথিক বাঙালীরাও জড়িয়ে ছিল এই কলায়।

আত্মার সাথে যোগাযোগের ক্রিয়া আধুনিককালের বা সভ্যসমাজের কোনো নতুন খোঁজ নয়। আদিকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, সভ্যতার চূড়ামণি থেকে গহীন অরণ্যেও এর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। প্রচলিত বিভিন্ন মতাদর্শেও এর সরব উপস্থিতি আছে। তবে এ সকল ক্রিয়া সকলে চাইলেই করতে পারে এমনটা নয়। তার জন্য চাই দীর্ঘ প্রস্তুতি।

সম্ভবত ১৮৪৮ সালে ফক্স বোনদের আত্মার সাথে যোগাযোগের খবর সংবাদের মাধ্যমে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আমেরিকার শিক্ষিত সমাজে মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগ ক্রিয়া জনপ্রিয়তা পায়। যদিও রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে এর প্রচলন বহু পূর্ব থেকেই ছিল।

এই বিদ্যায় সিদ্ধহস্তরা সাধারণভাবে ওঝা, ডাকি, তান্ত্রিক, কবিরাজ, জাদুকর, গুণীন, পুরোহিত, কিনডকি ইত্যাদি নামে পরিচিত। তারা এসব ক্রিয়া নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র-যন্ত্র উপকরণ-উপাচারের দিয়ে দিন-ক্ষণ-লগ্ন মেনে একক বা দলগত ভাবে করে থাকে।

প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত আত্মার চর্চাকে প্রত্যক্ষ সমর্থন না করলেও; প্রায় প্রতিটি ধর্মেই ছোট-বড় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এর চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্ম কর্তৃক এসব চর্চাকারীদের কঠিন শাস্তি দেয়ার নানা লোমহর্ষক কাহিনীও পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। ডাইনী আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে মারার নানা ঘটনাও বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ঘটতে দেখা যায়।

কেবল ওঝা বা ডাকিয়ারা নয় আধুনিক সময়ে একে করার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কারের চেষ্টা করেছে গবেষকরা। যে পদ্ধতিতে কোনো মত-পথের বিশ্বাসী হওয়া বা ওঝা হয়ে উঠার কোনো বিধান থাকবে না। থাকবে না নানা আচার-উপাচার বা বলি-রক্ত ইত্যাদির ব্যবহার। এরই ফরশ্রুতিতে আদি প্ল্যানচেট পদ্ধতিকে আধুনিক রূপ দেয় আঠার শতকের গবেষকরা। পরবর্তী শতকে এর নতুন আরো সহজ পদ্ধতিও আবিস্কার হয়েছে।

আধুনিক পদ্ধতিতে ‘প্ল্যানচেট’ বা আত্মার সাথে যোগাযোগের রীতিকে ফরাসিতে বলা হয় ‘সেঅন্স’। অনেকে একে উল্লেখ করেছেন- চক্র, সার্কল, আসর, পিঠাসন, আত্মাযোগ, আত্মাবার্তা নামেও। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আধুনিক পদ্ধতিতে প্ল্যানচেট কোনো তন্ত্র-মন্ত্রে নয় বরঞ্চ গভীর ধ্যানের মাধ্যমে করতে হয়। একে মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আধুনিক পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে।

সম্ভবত ১৮৪৮ সালে ফক্স বোনদের আত্মার সাথে যোগাযোগের খবর সংবাদের মাধ্যমে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আমেরিকার শিক্ষিত সমাজে মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগ ক্রিয়া জনপ্রিয়তা পায়। যদিও রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে এর প্রচলন বহু পূর্ব থেকেই ছিল।

১০ জুন ১৮৫৩ সালের দিকে ফরাসি পরলোকতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এফএস প্ল্যাঁশেত দীর্ঘ গবেষণার পর আত্মার সাথে যোগাযোগের একটি যত্ন আবিস্কার করেন। সম্ভবত গবেষকের নাম থেকেই যন্ত্রটি প্ল্যানচেট নামে পরিচিতি পায়। অনেকে বলেন, প্ল্যানচেটের আদিনাম ছিল ‘রিয়েল ডিমোনিক’।

এরপর থেকেই ইউরোপের মানুষ মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর এটি এতোটাই জনপ্রিয়তা পায় যে এর প্রয়োগ রুখতে বিশপ প্যাস্টোরাল পর্যন্ত চিঠি পেশ করেন। আধ্যাত্মবিদ রবার্ট ডেল অউয়েন এবং ড এইচএফ গার্ডনার বন্ধুদ্বয় প্যারিসে এই ক্রিয়া দেখে ১৮৫৮ সালে আমেরিকায় গিয়ে এর বিস্তার ঘটান।

শুধু এতে বোর্ড ব্যবহৃত হয় না। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে একজন মনোনীত হন মিডিয়াম হিসেবে। আর একজন দলের প্রধান হিসেবে আত্মার সাথে আলাপচারিতা করে থাকে। অপর একজন সব কথা লিপিবদ্ধ করে রাখে।

১৮৬৮ সালে আমেরিকার খেলনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এই ধারণার ভিত্তিতে বেশ কিছু প্ল্যানচেট যন্ত্র তৈরি করে এবং বাজারজাত করে। অনেকটা হৃদয়াকৃতির তেপায়া টেবিলের মতো ছিল ছোট্ট যন্ত্রটি। এর পেছনের নাতিদীর্ঘ দুই পায়ে লাগালো থাকতো ধাতব চাকা।

সামনের অংশের ছিদ্রতে একটি পেন্সিল জুড়ে তিন পা সমান করতে হতো। এবার হৃদয় আকৃতির সমতল বোর্ডের উপর হাত রেখে আত্মাকে আহ্বান করা হতো। আত্মা উপস্থিত হলে যন্ত্রটি নিজে নিজে চলতে শুরু করতো। আর প্রশ্ন করলে বোর্ডটি ঘুরে ঘুরে সামনের পেন্সিলের নিচে রাখা কাগজের উপর লিখে লিখে উত্তর দিতো।

১৮৮২ সালে লন্ডনে গড়ে ওঠে আত্মীক সমিতি। এর সভাপতি ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসর হেনরি সি জুইক, তার সহকারীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আর্থার জে ব্যালফুর। রাশিয়ান বংশোদ্ভূত হেলেনা পেত্রোভনা ব্লাভাৎস্কি এবং অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার কর্নেল হেনরি অলকট সহ আরো বেশ কয়েকজন মিলে ১৮৭৫ সালে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’।

১৮৭৮ সালে ব্লাভাৎস্কি আর অলকট ভারতবর্ষে চলে আসলে ভারতের বিভিন্ন অংশে এই সমিতির বেশ কয়েকটি শাখা গড়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮০ সালে ভারতবর্ষে ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েসন অভ স্পিরিচুয়ালিষ্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল, অতিপ্রাকৃত বিষয় আর মানুষের মধ্যে গুপ্ত শক্তি খুঁজে বের করা।

উনিশ শতকের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ এবং ভারতে ৩০০টির অধিক শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অ্যানি বেসান্ত সমিতির সভাপতি হওয়ার পর ১৮৮২ সালে কলকাতায় এর শাখা ‘বেঙ্গল থিওসফিকাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, এ সমিতির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দিদি স্বর্ণকুমারী।

লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র আর তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়ালিজম’।

ভারতবর্ষে আত্মাকে আহ্বান করার জন্য প্ল্যানচেট বোর্ডের বদলে প্ল্যানচেট বৈঠক বা প্রেত বৈঠক পদ্ধতির কথাই বেশি জানা যায়। এই পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতির মতোই রাতেরবেলা অন্ধকার কক্ষে মোমবাতি বা হ্যারিকেনের অল্প আলোতে টেবিলে গোল হয়ে আত্মার সাথে যোগাযোগে আগ্রহীরা মিলিত হতো।

শুধু এতে বোর্ড ব্যবহৃত হয় না। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে একজন মনোনীত হন মিডিয়াম হিসেবে। আর একজন দলের প্রধান হিসেবে আত্মার সাথে আলাপচারিতা করে থাকে। অপর একজন সব কথা লিপিবদ্ধ করে রাখে।

কার আত্মাকে ডাকা হবে সেটা ঠিক করে নেয়া হয় সবার আগে। সাধারণত সকলের পরিচিত কাউকে নির্বাচন করা হয়। এক্ষেত্রে সদ্য প্রয়াতরা অগ্রাধিকার পায়। নতুন অনুশীলনকারীরা সাধারণত অপঘাতে মৃত উপস্থিত সকলের পরিচিত সত্য প্রয়াত কাউকে মনোনীত করে থাকে। অনেকের বিশ্বাস এতে আত্মা দ্রুত সাড়া দেয়।

১৯২৯ সালে রাণী মহলানবিশকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে, পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলাবাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলাম, বললুম- আচ্ছা দেখা যাক।’’

উপস্থিত সকলে টেবিলের উপর হাত রাখা অবস্থায় প্রত্যেকে একে অপরে হাত ধরে বসে। চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে বসবাস পর সকলের মন স্থির হলে মিডিয়াম মনোনীত আত্মার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে।

এভাবে ডাকতে ডাকতে যদি কক্ষে কোনো পরিবর্তন, কোনো শব্দ বা আলো-বাতাস ধরা পরে। বা টেবিল নড়ে উঠে তাহলে ধরে নেয়া হয় আত্মা চলে এসেছে। তখন দলপতি মিডিয়ামকে প্রশ্ন করে। মিডিয়াম তখন আত্মার হয়ে তার উত্তর দিয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে যাকে মিডিয়াম নির্বাচন করা হয়। তার বদলে আত্মা অন্য কারো উপরও ভর করে ফেলে।

মুখে বলার বদলে লিখে লিখে উত্তর দেয়ার বিধানও দেখা যায় প্ল্যানচেট আসরে। এক্ষেত্রে আহ্বানকারী প্রশ্ন করে আর মিডিয়াম মুখে বলার পরিবর্তে লিখে লিখে তার উত্তর দেয়। আহ্বানকারী তা পড়ে সকলকে শোয়ান।

অতি উৎসাহী ও নব্য অনুশীলনকারীরা বেশিভাগ ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে যায় নিজেদের নড়াচড়াতেই। দুর্বলচিত্তের কেউ হলে বিপদও ঘটে যায়। এর নজিরও কম নেই। প্ল্যানচেটে মিডিয়ামের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক আচরণ সাধারণ ব্যাপার।

প্ল্যানচেটে কেবল রবীন্দ্রনাথের দাদা-দিদিরই আগ্রহ ছিল এমন নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নামও জড়িয়ে আছে প্ল্যানচেটের সাথে। সুধিমহলের অবিশ্বাস হলেও রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিঠিপত্র এর সাক্ষর বহন করে। জানা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনও প্ল্যানচেট করতেন।

অমিতাভ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ লেখনি থেকে জানা যায়-

প্রথমদিকে মিডিয়াম নিয়ে সন্দেহ পোষন করলেও আত্মাদের উত্তরের প্রকৃতি দেখে রবীন্দ্রনাথের এ বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়। কবির সাথে প্ল্যানচেটে উপস্থিত থাকতেন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, মীরা দেবী প্রমুখ। মিডিয়াম হতেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা দেবী। আহ্বায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। লেখার কাজটি করতেন অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী আর মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়।

১৯২৯ সালে রাণী মহলানবিশকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে, পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলাবাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলাম, বললুম- আচ্ছা দেখা যাক।’’

কবির প্ল্যানচেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, ছোট বউ মৃণালিনী, বৌঠান কাদম্বরী দেবী, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ, অজিত চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়সহ আরো অনেকে।

আত্মীয় ছাড়া আগত অন্যান্য আত্মাদের রবীন্দ্রনাথ মূলত এই তিনটি প্রশ্ন করতেন-

১. ধর্মবিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
২. নারী-পুরুষের আনন্দের সম্বন্ধ আর ‘মিলনের আকাঙ্ক্ষা’ পরলোকেও কি দেখা যায়?
৩. নতুন জন্ম নিতে ইচ্ছে হয়?

১৯২৯ সালের পর রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। সম্ভবত কবির প্ল্যানচেটের সবচেয়ে পছন্দের মিডিয়াম উমা দেবী ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালে মারা গেলে তার প্ল্যানচেট চর্চার যবনিকা পতন ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেটে অন্যদের আত্মাদের ডেকেছিলেন তাই নয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৪৫ সালে রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য প্ল্যানচেটে ডেকে আনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে। কবি নাকি জানিয়েছিলেন, “জনাকয়েক অবাঙালির হাত ধরে পরলোকে কুয়াশাচ্ছন্ন, অন্ধকার এক এলাকা থেকে ক্রমশ এসেছেন তীব্র আলোয় ধুয়ে যাওয়া স্থানে।

দিলীপকুমার রায় আর রজনীকান্ত নতুন গান লিখে কবিকে পরলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেখা হয়েছে বাবা মহর্ষিদেবের সঙ্গেও। চারপাশে আশ্চর্য সুন্দর সব ফুল আর পাখি। রাজেন্দ্রলাল পরলোক নিয়ে বই লিখবেন শুনে রবীন্দ্রনাথের আত্মা বলছিল, ‘‘তুমি তোমার বইতে লিখে রেখো যে এইখানে ভয় পাবার কিছুমাত্র নেই। …‘অবশ্য আমি যে স্তরে আছি নিজের সুকৃতির ফলেই লোক সেখানে আসতে পারে।”

প্রেত ও পরলোকচর্চায় প্রগতীশীল বাঙালীর মধ্যে অন্যান্য উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে আছেন- সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখ।

জানা যায়, প্রয়াত স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে কথা বলতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্ল্যানচেটের আসর বসানোর কারণে দ্বারকানাথ হাইস্কুলের চাকরি পর্যন্ত হারাতে হয়েছিল তাকে। শুধু তাই নয়, প্ল্যানচেটে মায়ের সম্মতি পেয়ে সাতাশ বছরের ছোট কল্যাণীর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হয়ে যান।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘তোর সেজদিকে দেখেছি রে… আমিও এবার তার কাছেই যাব।’’

রাজা দিগম্বর মিত্র ছিলেন পরলোকবাদী। ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেনও আমেরিকায় গিয়ে পরলোকবাদীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। ১৯২৭সালে প্রকাশিত হয়েছিল কেশবচন্দ্র সেনের বই ‘পরলোকের সন্ধানে’।

সমাজের প্রগতীশীল মানুষজন সাধারণত, আগত আত্মাদের কাছে পরলোকের কথা, রোগ নিরামনের চিকিৎসা, হারানো সম্পত্তির হদিশ, ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চাইতেন।

অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় আসা এক ফরাসি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের বাড়িতে প্রেতচক্রের আসরে যেতেন লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। তার বউ আর ছেলেদের ‘মিডিয়াম’ করেও চলত প্রেত-আহ্বানের অধিবেশন।

‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-র উদ্যোগে প্রকাশিত হতো সমিতির মুখপত্র ‘দ্য থিওজফিস্ট’।

১৯৩৩-এই লেড বিটারের বই ‘অন দ্য আদার সাইড অব ডেথ’ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের অনুপ্রেরণায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন হরিদাস বিদ্যাবিনোদ।

স্বামী অভেদানন্দ আঠেরো শতকের শেষ দিকে প্রায় দুই দশকে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত পরলোকচর্চা কেন্দ্রগুলোতে এ বক্তৃতা দিয়ে বেশ সমাদৃত হন। অভেদানন্দ এক সভায় বলেছিলেন, মৃত্যুর পর পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির মতো সতেরোটা উপাদানে তৈরি সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে আত্মা যায় স্বপ্নলোকের মতোই মনলোকে।

কল্প-কাহিনী, আত্মজীবনী, গল্প-সাহিত্যে, কবিতায় শুধু নয় বাঙালীর প্রেতচর্চা একক বই প্রকাশের সংখ্যাও কম নয়। ধর্মীয় বা মত-পথের সাধকরাই নয় এসব গ্রন্থের প্রণেতা প্রগতীশীল সমাজকে নেতৃত্বদানকারীদের সংখ্যাও কম নয়।

‘থিওসফিকাল সোসাইটি’র পত্রিকা ‘পন্থা’ সম্পাদক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “১৮৮১ সাল থেকে শুরু করে ডাক্তার পিবলস, এগলিনটনের মতো বিখ্যাত প্রেততাত্ত্বিকরা কলকাতায় এসে আশ্চর্য সব কাণ্ড দেখিয়েছিলেন। …স্বনামধন্য প্যারীচাঁদ মিত্র, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেশপূজ্য শিশিরকুমার ঘোষ প্রভৃতি ঐ সকল ঘটনার প্রত্যক্ষকারী। অতএব ঐ ঐ ঘটনা ভোজবাজি বলিয়া উড়াইয়া দিবার সম্ভাবনা নাই।”

সমাজের প্রগতীশীল মানুষজন সাধারণত, আগত আত্মাদের কাছে পরলোকের কথা, রোগ নিরামনের চিকিৎসা, হারানো সম্পত্তির হদিশ, ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চাইতেন।

তবে কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় এইসব ক্রিয়াকলাপ ‘বুজরুকি’ আখ্যা দিয়ে বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। অন্যদিকে ফণিভূষণ লিখছেন, “ইহাতে পরলোকবাসীর অদ্ভুত ক্রিয়া দেখিয়া চক্র করিবার আকাঙ্খা হইবে এবং চক্র করিলে দেখিতে পাইবেন ইহা কত সত্য।”

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
মরণের পরে: স্বামী অভেদানন্দ।
পরলোক ও প্রেততত্ত্ব: স্বামী দিব্যানন্দ।
অনন্তের লুকোচুরি: সুভাষ ঘোষাল।
পথের কবি: কিশলয় ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা: অমিতাভ চৌধুরী।
প্ল্যানচেটে পরলোকের কথা: সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।
পরলোকের কথা: মৃণালকান্তি ঘোষ।
মানুষ চিত্তরঞ্জন: অপর্ণা দেবী।
পরলোকবিচিত্রা: সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়।
Theosophy and the Theosophical Society : Annie Besant.

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!