ভবঘুরেকথা
জালাল উদ্দিন খাঁ

জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩

-রব নেওয়াজ খোকন

আত্মতত্ত্ব:

উপমহাদেশীয় দর্শনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য আধ্যাত্মবাদ। আর আধ্যাত্মবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আত্মতত্ত্বের ওপর। আত্মা ও দেহের সমন্বিত প্রয়াসে গড়ে উঠা আমিত্বকে উপজীব্য করে, চর্চিত দর্শনের একটি মৌলিক শাখা হলো আত্মতত্ত্ব।

চৌদ্দপর্বে বিভক্ত জালাল গীতিকাসমগ্রর প্রথমপর্বটি হল ‘আত্মতত্ত্ব’। সাধক কবি জালাল উদ্দীন খাঁ ‘আত্মতত্ত্ব’ শব্দটি দিয়ে আপন বা নিজসত্ত্বা কেন্দ্রিক দর্শনকেই নির্দেশ করেছেন। তবে তিনি তাঁর গীতিকাব্যের ভেলায় চড়ে এ গণ্ডির বাইরেও গিয়েছেন। কিন্তু সে যাত্রা বেশিদূরের নয়।

আশপাশ ঘুরে বারবার প্রত্যাবর্তন করেছেন মূল জায়গাটিতে। আত্মতত্ত্বকে তিনি আধ্যাত্মবাদের চারণভূমি হিসেবে দেখিয়েছেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তথা ঐশীকোষগুলোতেও এ তত্ত্বের বিশেষত্ব দেখা যায়।

নিজেকে চেনার তাগিদ থেকে এ তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে সুফীবাদী, বৈষ্ণববাদী, বাউলবাদী ও অন্যান্য তরিকাপন্থীরা আত্মতত্ত্বের দিকেই লক্ষ্যস্থির করেন। কবি জালাল আত্মতত্ত্বে সন্নিবেশিত গানগুলোতে, জীবসত্ত্বা ও পরমসত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বিষয়টি যৌক্তিক বাক্যে শিল্পরূপ দিয়েছেন।

এখানে উল্লেখিত সত্তাদ্বয়কে আলাদা করা কঠিন। যেন একই সত্ত্বার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এ পর্বে বারবার বিশ্বজগতের সবকিছুর গোঁড়াকে এক করে দেখানো হয়েছে। এ পর্বের প্রথম ও জনপ্রিয় একটি গান-

আমার আমার কে কয় কারে
ভাবতে গেলো চিরকাল,
আমি আদি আমি অন্ত
আমার নামটি রূহুজ্জামাল।।

আমারই এশকের তুফান
আমার লাগি হয় পেরেশান,
আবাদ করলাম সারা জাহান
আবুল বাশার বিন্দু-জালাল।।

আমিময় অনন্ত বিশ্ব
আমি বাতিন আমি দৃশ্য,
আমি আমার গুরু-শিষ্য
ইহকাল কি পরকাল।।

আমার লাগি আমি খাড়া
আমার স্বভাব হয় অধরা,
আমি জ্যান্ত আমি মরা
আমার নাহি তাল-বেতাল।।

আমি লাইলি আমি মজনু
আমার ভাবনায় কাষ্ঠতনু,
আমি ইউসুফ মুই জোলেখা
শিরি-ফরহাদ কেঁদে বেহাল।।

আমি রোমের মাওলানা
শামছ-তবরেজ দিওয়ানা,
জুমলে-আলম মোর শাহানা
খাজা, সুলতান, শাহজালাল।।

আমার বান্দা কারাগারে
আমি বদ্ধ অন্ধকারে
মনের কথা বলবো নারে
কেঁদে কহে দীন জালাল।।

‘আমি’ চিহ্নিত অস্তিত্বকে কেন্দ্র করেই কবির দর্শন আবর্তিত। এ ভাবনা যেন চিরকালের। এ রহস্যই যেন সৃষ্টিতত্ত্বের মূল ধাঁধা। আমার এ রূহ্ বা আত্মার মূলউৎস কোথায়? কোন সত্ত্বা হতে উৎসারিত আমি? রচনাটিতে এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব মিলেছে।

তবে এ জবাবে একটা অদৃশ্য পর্দাও ঝুলিয়েছেন কবি। শেষ লাইনে এসে মনের কথা না বলার ভান করে, সাধারণ স্বল্পজ্ঞানীদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করেছেন। কিন্তু সাধকশ্রেণির জন্য তা স্বচ্ছ।

সাধক কবির মতে, আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কেবল ‘আমি’ রূপ মহাসত্ত্বারই বহুধা প্রকাশ। মহাসত্ত্বাটিকে আল্লাহ্, ঈশ্বর, ভগবান যাই বলা হোক না কেন, তাঁরই বিভাজিত খণ্ডাংশগুলো সাধারণসত্ত্বা হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সর্বত্র প্রকাশিত। প্রকাশ-অপ্রকাশ, গুরু-শিষ্য, ইহকাল-পরকাল, জীবিত-মৃত, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, বান্দা-স্রষ্টা ইত্যাদি মূলত আলাদা আলাদা ব্যাপার নয়। এসবই এক ঈশ্বরের বহুরূপতা।

তবু আমরা কেন যে আমার আমার বলে নিজেদের আলাদা আলাদা পরিচয় দিই, সেটি কবির বোধগম্য নয়। একক সত্ত্বার বহুধা বিভক্তির কারণেই একটি অংশ অন্য একটি অংশের জন্য এতোটা প্রেমকাতর। এতোটা মিলনমুখি। লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ প্রভৃতি জাগতিক সত্ত্বাগুলোর পারস্পরিক প্রেমাসক্তিই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ পর্বের জনপ্রিয় আরেকটি গান-

আমারে কেউ চিনতে গেলে
সোজা রাস্তা হয় বাঁকা,
বয়সে খোদ খোদার বড়
নামটি কিন্তু নিচে লেখা।।

একং দশং শতং হাজার
চুরাশি লাখের বাজার,
সকল ঘরে রয় দোকানদার
আমি মাত্র আছি একা।।

দেখতে আমার মুখের হাসি
কতো বেটা জঙ্গলবাসি,
লইয়াছে পিরিতের ফাঁসি
তবু নাহি পাইলো দেখা।।

মুনশি আর মাওলানা কাজী
আমি সবার নায়ের মাঝি,
আমার ছিফাত লিখতে আজি
অন্ত পায় না হাদিস ফেকাহ্।।

আমি রাখলাম খোদার নাম
খোদা করেন আমার কাম,
জালালে কয় সব বুঝিলাম
ভুল ভাঙিতেই বিষম ঠেকা।।

এখানে খোদ বলতে জীবাত্মাকে বোঝানো হয়েছে। জালাল বলতে চেয়েছেন, বয়সের মাপকাঠিতে জীবাত্মা পরমাত্মার চেয়েও বড়। আর এ সত্য প্রকাশ করতে গেলে সোজা রাস্তা বাঁকা হয়ে যায়। কারণ, কথাটি সাধারণের ক্ষেত্রে শ্রবণকটু। সূফী মতবাদীদের মধ্যে কারো কারো বিশ্বাস জীবাত্মার জন্মান্তর রয়েছে।

“চুরাশির বাজার” কথাটি দিয়ে চুরাশি লক্ষবার যোনিভ্রমনের ইতিহাসকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ চুরাশি লক্ষবার যোনি ভ্রমণের পর একবার মানবরূপে জন্ম হয় জীবাত্মার। আর মানবজন্মে নিজেকে চিনে সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে একাত্ম বা একাকার হতে পারলে জন্ম-মৃত্যু বারণ হয়।

সৃষ্টি আর স্রষ্টার বৈষম্য ঘুঁচে যায়। সাধনায় ব্যর্থ হলে জন্মান্তরের চক্রে পরে অনন্তকাল জৈবনিক যাতনা ভোগ করে যেতে হয়। জন্মান্তরের এই বিপর্যয় প্রক্রিয়াকে “চুরাশির ফের” বলা হয়। জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী জীবাত্মা অসীম। তাছাড়া জীবাত্মার উৎস পরমাত্মা। সহজ কথায় জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশবিশেষ।

এ দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবাত্মা মহাকালের। অতএব এর ব্যাপকতা পরমাত্মার সমপর্যায়ের। তাই কবি মজা করে বলেছেন, ‘আমি রাখলাম খোদার নাম, খোদা করেন আমার কাম।’ আমি যার নাম রাখলাম, নিশ্চয়ই আমি তার চেয়ে বয়সে বড়। আমাকে নিয়ে যিনি চর্চা করেন নিশ্চয়ই আমি তার জন্য মূখ্য। অতএব আমার সংকীর্ণতাবোধ মানেই আমার অজ্ঞতা। সে দৃষ্টিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই।

আমিত্বের স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে জালাল সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একাকার করে ফেলেছেন। এ কাজটি কেবল একজন উচ্চ পর্যায়ের সাধকের দ্বারাই সম্ভব। তাই দুঃসাহস দেখিয়ে এ পর্বের আরেকটি গানে তিনি বলেছেন-

আমি বিনে কে বা তুমি দয়াল সাঁই,
যদি আমি নাহি থাকি
তোমার জায়গা ভবে নাই।।

যা করেছ আমায় নিয়ে
সৃষ্টিকে সৌন্দর্য দিয়ে,
প্রাণে প্রাণে মিশে গিয়ে
মহাপ্রাণে করেছ ঠাঁই।।

বিশ্বপ্রাণের স্বরূপ-ছায়া
আমাতে তোমারই মায়া,
ছেড়ে দিলে এসব কায়া
তুমি বলতে কিছুই নাই।।

তুমি যে অনন্ত অসীম
আমাতে হয়েছো সসীম,
কালী-কৃষ্ণ, করিম-রহিম
কতো নামে ডাকছি তাই।।

যথায় বাগান তথায় কলি
যথায় আগুন তথায় ছালি,
কথায় শুধু ভিন্ন বলি
আসলে এক বুঝতে পাই।।

মস্ত বড় প্রেম শিখিয়ে
তুমি গেছ আমি হয়ে,
ভুলের জালে ঘেরাও দিয়ে
ঘুম পাড়ায়ে খেলছো লাই।।

জালালে কয় ঘুমে থেকে
ঘর পোড়া যায় স্বপ্নে দেখে,
গলা ভাঙছি ডেকে ডেকে
শক্তি নাই যে উঠে পালাই।।

জীব আছে বলেই পরমত্বের প্রসঙ্গটি স্বার্থকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। জীব না থাকলে পরমের মূল্য অর্থহীন। জীবের মূল্যায়নে পরম মূল্যায়িত। অতএব পরমের জন্য জীব মুখ্য। বিপরীত অর্থে জীব পরমের অনুগামী, অনুসারী ও পূজারী বলে, পরম মুখ্য। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক।

আর জীব-পরমের মাঝখানের পর্দা সরিয়ে নিলে উভয়েই একাকার। যে পর্দাটিকে জালাল ‘ভুলের জাল’ বলে অভিহিত করেছেন। ভিন্ন-অভিন্নতার রহস্য নিয়ে জালাল গীতিকার আত্মতত্ত্ব পর্বটি নির্মিত।

সুফীসাধকদের ‘ফানা’ বা ‘বাক্কা’ স্তরটির সাথে তাঁর এ-বোধের মিল রয়েছে। যে স্তরে এসে প্রেমিক-জীবের উন্মাদনা, প্রচলিত নিয়ম-বিধি অতিক্রম করে পরম-প্রেমাষ্পদের সাথে মিলন-উন্মুখ হয়ে পরে এবং মিলনের মাধ্যমে পারস্পরিক দূরত্ব, বৈষম্য, বৈসাদৃশ্য প্রভৃতি মিটে যায়। বিদ্রোহী কবিতার শেষাংশে প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্ভবত সেকারণেই লিখেছিলেন-

‘আমি সহসা আমারে চিনেছি
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’

বস্তুত নিজেকে চেনার উত্তরণ ঘটিত চূড়ান্ত ফলাফল এটি। এ পর্যায়ে সকল বাঁধ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে সাধক সিদ্ধি লাভ করেন।

 

মূল্যবোধ:

আত্মতত্ত্ব জুড়ে সাধক যে যুক্তির বীজ বপন করেছেন, তা সাধারণ শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে স্ফরণ ঘটাতে যথেষ্ট সহায়ক। এ থেকে সাধকের প্রতি বিতৃষ্ণ কিংবা বিরূপ মনোভাব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ শ্রেণিকে মনে রাখতে হবে, এসবই পরমপ্রেমে আসক্ত, মহাপ্রেমিকের দিশাশূন্য, প্রেমময় হৃদয়ের স্বগত প্রলাপ।

মূলত সামাজিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তাঁর উদ্দেশ্য নয়। ধর্মীয় ইতিহাসে এমন বহু মহাপ্রমিকের নাম শোনা যায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, রাবেয়া বসরি, হাসান বসরি, মনসুর হাল্লাজ প্রমুখ প্রেমিকবৃন্দ।

(চলবে)

জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪>>

…………………………………………….
আরো পড়ুন-
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!