ভবঘুরেকথা
এসব দেখি কানার হাটবাজার

এসব দেখি কানার হাটবাজার

মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ

-মূর্শেদূল মেরাজ

ভালো ভালো কথা তো অনেক হলো। অনেক আবেগের গুণগানই তো গাইলাম। মাঝে মধ্যেই ভাবি এভাবেই কি এগিয়ে যাবে ‘মাই ডিভাইন জার্নি’! নাকি আবেগের পালঙ্ক থেকে থেকে নেমে পা রাখবে বাস্তবতার মাটিতে!! রূঢ় বাস্তবতায়!!!

যেখানে আবেগের মোটা আস্তরণে চাপা পড়ে যাবে না বাস্তবতার ক্ষতচিহ্ন। কয়েক পর্ব আগেই ‘মাই ডিভাইন জার্নি’ তার ১৮তম পর্ব পার করেছে। এবারের পর্বের সংখ্যা তো ২১। চাইলে তো এবার বাস্তবতায় পা রাখাই যায়। যায় না?? সময়-কাল-ক্ষণ-লগ্ন-যোগ তো তাই বলে।

১৮ পার হলে তো অনেক কথাই বলা যায় স্পষ্ট করে। তাই তো? এই সময়ের মতামত গুরুত্বও পেতে শুরু করে সামাজিক বিচারে। যদিও সমাজে প্রচলিত ১৮+ মানেই যৌনতা-মাদক-গালাগালি-নির্মমতা। তবে আমার মনে হয় ১৮+ মানে অনেক বেশি দায়িত্বশীলতা। অনেক বেশি সচেতনতা।

নিজেকে… নিজের ভাবনাকে… নিজের মতামততে… নিজের মতো করে প্রকাশ করার স্বাধীনতা। তবে তা যেমন করতে হয় অপরের মতামতকে সম্মান দিয়ে এবং পাশাপাশি নিজের উপলব্ধিকে বিনীতভাবে অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে। অনেক বেশি সচেতনভাবে। অনেক বেশি নান্দনিকতার মধ্য দিয়ে।

এই সময়কাল থেকে ছেলেখেলার আর তেমন সুযোগ থাকে না। এই সময় থেকে নিজের কাছে প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হতে থাকে- ছলাকলায় অন্যকে ভোলানো গেলেও, নিজের কাছে হেরে যেতে হয়। তাই সাধু সাবধান।

১৮+’এর আইনে ক্ষমা শব্দটা দুর্লভ। এখানে আইন প্রয়োগে কোনো বাধা নেই। সাধুগুরুরা বলেন- সাধনপথের দায়িত্বশীলতা সর্বজনবিদিত। এই দায়িত্বশীলতা মাথায় নিয়ে নিজের ভাবনাকে গুছিয়ে উপস্থাপন করা আমার মতো ক্ষুদ্র বিবেক-বুদ্ধি-বোধের মানুষের পক্ষে সত্যিই বেশ কষ্টসাধ্য।

অধমের এমন ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা করো সাঁই। কিন্তু আমি কি করি? প্রশ্ন যে জাগে। যদিও আমি ভালোই জানি- প্রশ্ন নিবৃত হলেই প্রকৃত প্রেম জাগে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠি না প্রশ্নের নিবৃত করবো কি মতে? যদিও জ্ঞানীগুণীভক্ত জনরা বলেন- “সমর্পিত হও। তবেই সব প্রশ্ন নিবৃত হয়ে যাবে। তখন ভক্তিতে মগ্ন হয়ে উঠবে। তাতেই প্রশ্নরা পালিয়ে যাবে।”

মূর্খের কথায় কখন কি ভুল উচ্চারিত হয়। কখন কোন শব্দ ব্যবহারে অর্থ পাল্টে যায়। এসব ভাবতে গেলে লেখা কঠিন হয়ে উঠে। তারপরও কত কি মনের মাঝে উঁকি দেয়। কত সব কাহিনী-গল্প-কথামালা লেখায় ভাষা পায়। আবার কত স্বপ্ন-স্মৃতি-অভিজ্ঞতা লিখতে চাইলেও লেখা হয়ে উঠে না।

কত কি লিখতে শুরু করেও মুছে ফেলতে হয়। কত কি বলবো বলবো করেও আর বলা হয় না। কি বলতে গেলে কে কষ্ট পাবে। কি লিখতে গেলে কে কষ্ট পাবে সেটা ভাবায়। ভীষণ ভাবেই ভাবায়। তারপরও একটু আধটু করে বলতে শুরু না করলে পাঠকের কাছে যে দ্বায় তা থেকেই বা মুক্তি মিলবে কি রূপে?

এই সব ভাব-ভাবনা-ভাবের ভুবনে নানাবিধ জল্পনা-কল্পনার পর; এই দোলাচল নিয়েই দীর্ঘ বিরতির পর আবারও লিখতে শুরু করা-

কোথায় জানি ঘটনাটা পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই। এটা গল্প নাকি সত্য ঘটনা তাও আর খুঁজে দেখা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে কাহিনীটা মোটামুটি এইরকম- একবার একদল গবেষক নিভৃত এক জঙ্গলে এমন এক আদিবাসী গোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পেলো। যারা সুঠামদেহী হলেও সকলেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাচল করে।

গবেষক দল উৎসাহিত হয়ে উঠে। একটা গোটা গোষ্ঠীর সকলেই খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেনো? এটা কি শারীরিক সমস্যা? নাকি অন্য কিছু? নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাদের দেহে এমন কোনো সমস্যা পাওয়া গেলো না; যাতে তাদের খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে। তাহলে এমনটা হচ্ছে কেনো?

শেষে ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেলো- তাদের গোষ্ঠির এক পরাক্রমশালী বীরযোদ্ধা তীরের আঘাতে আহত হয়ে খোঁড়া হয়ে যায়। তার সম্মানার্থে অন্য সকলেও খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। তাদের প্রাণপুরুষ খুঁড়িয়ে হাঁটবে আর তারই সামনে কি সহজভাবে কি হাঁটা যায় আদৌ? এমনটা কি হতে পারে? হওয়া সমীচীন??

সম্মান প্রদর্শনের এই ভক্তি চলতে থাকে উত্তরপুরুষের হাত ধরে। পরে একটা সময় তারা ভুলে যায় সেইসব কথা-কাহিনী-গল্পমালা। কিন্তু সেই মতে হাঁটাচলা ততদিনে তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সেই বীর, সেই সম্মান সেসব কাহিনী ভুলে গেলেও; ঐতিহ্য ধরে রেখে তারা তখনো খুঁড়িয়েই হাঁটছিল।

আমার কেনো জানি আজকাল প্রায়শই লালন ঘরের অনেক সাধুগুরুর সাথে সাক্ষাতে এই কাহিনীটা বারংবার মনে পড়ে যায়। আমার কেবলই মনে হয়, লালনের মূল মতাদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসে; কিছু করণকারণ টিকিয়ে রাখাকেই যেন লালন মতাদর্শ ভাবা হচ্ছে সর্বত্র।

অধমের এমন ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা করো সাঁই। কিন্তু আমি কি করি? প্রশ্ন যে জাগে। যদিও আমি ভালোই জানি- প্রশ্ন নিবৃত হলেই প্রকৃত প্রেম জাগে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠি না প্রশ্নের নিবৃত করবো কি মতে? যদিও জ্ঞানীগুণীভক্ত জনরা বলেন- “সমর্পিত হও। তবেই সব প্রশ্ন নিবৃত হয়ে যাবে। তখন ভক্তিতে মগ্ন হয়ে উঠবে। তাতেই প্রশ্নরা পালিয়ে যাবে।”

সেই শৈশবে যখন স্কুল থেকে বাসার পথে হাঁটা দিতাম। প্রায় প্রতিদিনই চেষ্টা থাকতো নতুন নতুন পথ ধরে ফেরার। পুরান ঢাকার শিরা-উপশিরার মতো জটিল সব গলিপথে কতবার যে গোলকধাঁধায় পড়েছি। ঘুর পথে ফিরতে গিয়ে কত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন যে হয়েছি।

কিন্তু মনের মাঝে জেগে উঠা প্রশ্নের উত্তর না জেনে। তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে আমার ঠিক ভালো ঠেকে না। আমার ধারণা, এতে প্রশ্নমালা সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তারা যখন জেগে উঠবে তখন তার তেজ হবে অনেক গুণ বেশি।

আমার বিশ্বাস, জাগ্রত প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়কালেই জেনে নেয়ার চেষ্টা করা যৌক্তিক। যদিও প্রেমে যুক্তি খাঁটে না। যুক্তি করে শর্ত দিয়ে প্রেম হয়ও না। আবার এটাও ঠিক প্রশ্নবদ্ধ হলে প্রেম টেকেও না। তাই জেনে বুঝেই মজা ভালো। মজে জানতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

বিবিধ ধর্ম-মত-পথ সম্পর্কে জানার যে আগ্রহ তা সম্ভবত আমার মাঝে জেগেছিল সেই ‘প্রশ্নটা’ থেকে। যে প্রশ্নটা আমি হজম করতে পারি নি। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘এই মতই একমাত্র মত। এই পথই একমাত্র পথ। এই মতই শেষ মত। এই পথই শেষ পথ। এই কথাই শেষ কথা। এই কথাই একমাত্র কথা।’

আমার কাছে বরাবরই মনে হয়েছে গন্তব্য এক হলেও পথ-মত ভিন্ন হতেই পারে। আর সব পথ উন্মুক্ত রাখাই পথিকের ধর্ম। তুমি নির্দিষ্ট একটা পথ ব্যবহার করতেই পারো। তাই বলে অন্য পথকে অবজ্ঞা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অন্য মত-পথকে নিয়ে কটূক্তি করারও কোনো মানে নেই।

যদি না কোনো বিশেষ মত-পথ অন্যের ক্ষতি সাধিত করে; তাহলে সর্তক তো হতেই হয়। নতুবা সকল মত-পথই পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে। যার যে পথ পছন্দ সে যাতে তা বাছাই করে নিতে পারার স্বাধীনতা পায়। আবার যার ইচ্ছে সে বহুপথও যাতে ঘুরে দেখতে পারে সেই সুবিধাও থাকতে পারে।

কাউকে কোনো কানা গলি দেখিয়ে বলা হবে, সব পথই কানাগলি; তাই তোমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনটা কেউ বললেই সেখানে আমার আর মতি স্থির হয় না। আর কে না জানে, যতক্ষণ না মন মজে, ততক্ষণ প্রেম হয় না। যা হয় তা হলো প্রেমের অভিনয় মাত্র। আর সেটা আমার দ্বারা হবে বলে মনে হয় না।

সেই শৈশবে যখন স্কুল থেকে বাসার পথে হাঁটা দিতাম। প্রায় প্রতিদিনই চেষ্টা থাকতো নতুন নতুন পথ ধরে ফেরার। পুরান ঢাকার শিরা-উপশিরার মতো জটিল সব গলিপথে কতবার যে গোলকধাঁধায় পড়েছি। ঘুর পথে ফিরতে গিয়ে কত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন যে হয়েছি।

আবার নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে বাসায় ফেরায় নানান প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। কিন্তু নতুন পথ চিনবার-দেখবার আনন্দটা হারায়নি কখনো। ক্রমাগত সেটা বেড়েই চলেছে। শুভাকাঙ্খিরা বলেন, এই শত পথ দেখবার বাসনাই নাকি আমাকে কোনো মতে স্থির হতে দিলো না। সাঁইজি আমার জন্যই সম্ভবত রচনা করেছিলেন-

মনের হল মতি মন্দ।
তাইতে হয়ে রইলাম জন্ম অন্ধ।।

ত্যাজিয়ে সুধা রতন
গরল খেয়ে ঘটাই মরণ,
মানিনে সাধু গুরুর বচন
শেষে মূল হারায়ে হাইরে ধন্ধ।।

ভবরঙ্গে থাকি মজে
ভাব দাঁড়ায় না হৃদয় মাঝে,
গুরুর দয়া হবে কিসে
দেখি ভক্তিহীন এই পশুর ছন্দ।।

বালক বৃদ্ধ সকলি কয়
সাধু চিত্ত আনন্দময়,
লালন বলে তাইতে আমার
যায় না মনের নিরানন্দ।।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারাই মনের গহীনে জাগ্রত সব প্রশ্নকে লুকিয়ে রাখে অতি গোপনে। তাদের ভক্তিটা অনেক ক্ষেত্রেই হয় লোক দেখানো। উপরি উপরি। কল্পনাময়। মনে এক ভাব। আর প্রকাশ্যে ভিন্ন। আমার সেই মতেও মতি নাই।

আমার কাছে সাধন পথে জানার জন্য ভক্তিপূর্ণ-নিবেদনপূর্ণ বিনিত এক একটা প্রশ্ন, এক একটা সম্ভাবনার দুয়ার। যে প্রশ্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার জন্য নয়। তর্কে বিজয়ী হওয়ার জন্যেও নয়। যে প্রশ্ন নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য। যে প্রশ্ন নিজেকে নিষ্ঠাপূর্ণ এগিয়ে নেয়ার জন্য।

আর যে অহং ধরে রাখে সে যতই প্রেমের অভিনয় করুক। তার পক্ষে প্রেমের প্রেমিক হওয়া মোটেও সহজ নয়। অহং সব কিছুকেই কুলষিত করে। সব কিছুকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ঢেকে দেয়। তাই লালন সাঁইজি এক পদে স্পষ্ট করেই বলেছেন- ‘পণ্ডিত কানা অহংকারে’।

সেই মতে যে পথিক হাঁটে। সেই পথের অনুসন্ধান করে। তিনিও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। যিনি প্রেমে লীন হয়ে যান তার মতোই। উভয়ই আসলে প্রেমিকই হয়ে উঠতে চায় ভিন্ন ভিন্ন পথে। গন্তব্য আদৌতে একই থাকে।

তবে এ কথাও পাশাপাশি মানতেই হয়, যারা জ্ঞান অর্জন করে জাহির করার জন্যে। অহং প্রকাশ করার জন্যে। যারা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েও জ্ঞানের বড়াই পরিত্যাগ করতে পারে না; তারা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না।

আমার মনে হয়, আত্মজ্ঞান অনুসন্ধান করতে হয় সহযোগী-সমব্যাথী-নিবেদিত হয়ে। প্রতিবাদী হয়ে, উদ্ধত আচরণে, ঘৃণা-দ্বেষ-রাগ-ক্রোধ নিয়ে সেই উত্তরের সন্ধান করতে গেলে আরো বড় গোলে পড়তে হয়। ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞানকে জানতে গেলে প্রেমের পথই সবচেয়ে সহজ পথ। আর ভক্তি হলো সেই পথের চালিকা শক্তি। আর যার উদ্দেশ্যে হলো জ্ঞানার্জন।

তাই মনে প্রশ্ন পুষে উপরি উপরি ভক্তিপ্রাণ প্রদর্শন করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যদিও প্রশ্ন মনকে অস্থির করে। কিন্তু যথার্থ উত্তর পাওয়ার আশা যখন বিঘ্নিত হয় তখন মন হয় বিক্ষিপ্ত। যিনি নিজকে প্রশ্নের ঊর্দ্ধে রাখতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই অনেক প্রফুল্ল থাকেন। তাতে সন্দেহ নেই।

কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের মূল যে প্রশ্নগুলো মানুষের কাছে ফিরে ফিরে আসে। সে যদি তার উত্তর অবগত হতে না পারে তবে, জীবনের যে কোনো সময় সেই প্রফুল্লতা ফুঁৎকারে উবে যেতে পারে। আর তখন যে বিপর্যয় ঘটে তা নিজ ভিন্নে আর কেউ বুঝতে পারে না। বোঝানোও যায় না।

প্রজ্ঞাবান সাধুগুরুরা সেকারণেই শুধু ভক্ত-শিষ্য-অনুসারী-অনুগামীদেরই নয়; সকলকেই এমন ভাবে জিজ্ঞাসার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন। যাতে তারা কোথাও আটকে না যায়। যাতে চিন্তার দ্বার সদা উন্মুক্ত থাকে। এতে জ্ঞান কোথাও সীমাবদ্ধ হয় না। জ্ঞান তার সীমানা নির্ধারণ করে ফেললেই জটিলতায় আবদ্ধ হয়ে যায়। কারণ সীমাবদ্ধ জ্ঞানই মনে অহং-এর জন্ম দেয়।

আর যে অহং ধরে রাখে সে যতই প্রেমের অভিনয় করুক। তার পক্ষে প্রেমের প্রেমিক হওয়া মোটেও সহজ নয়। অহং সব কিছুকেই কুলষিত করে। সব কিছুকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ঢেকে দেয়। তাই লালন সাঁইজি এক পদে স্পষ্ট করেই বলেছেন- ‘পণ্ডিত কানা অহংকারে’।

ঘটনাগতিক দেখে মনে হয়, এখানে কেউ লালনকে তুলে ধরতে চাইছে না। সকলেই যেন লালনকে তুলনায় রেখে নিজেকে বড় করার প্রমাণে ব্যস্ত। ‘আমি লালনকে বুঝি তাই আমি বড়’-এটাই যেন বিষয়। এখানে সবাই যেন সবার নিজের নিজের মাল বিক্রিতে ব্যস্ত। কেবল সাইনবোর্ডে ফকিরকুলের শিরোমণি লালন সাঁইজির ছবি।

আর এই অহং’টা আমরা ছাড়তে পারছি না কিছুতেই। অনেক সাধুগুরুদের মাঝেও যখন এই ভাব স্পষ্ট হয়। তখন নিজের কাছে নিজেই হেরে যাই। যদিও আমি সর্বোচ্চ চেষ্টটাই করি মানুষের মাঝের সাধুত্বের অংশটুকুকেই দেখতে। আর যার মাঝে তার অংশটা খুঁজে পাই তার সাথেই সঙ্গ করার চেষ্টা করি।

যার মধ্যে সেই ভাব যতবেশি দৃশ্যমান হয়। তার সম্পর্কে ততবেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। তিনি আমাকে ততবেশি টানতে শুরু করেন। তার সাথে সঙ্গ করার জন্য মন আনচান আনচান করে।

আর যার মাঝে সাধুত্বের অংশটার সন্ধান পাই না কিছুতেই। তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায়ে চলি। আশায় থাকি কখনো তা খুঁজে পেলে কাছাকাছি গিয়ে আরো ভালো করে জানা যাবে তাকে। সেই মহাযোগের আশায় থাকি। যে যোগে তার অহং ভেঙ্গে… আমার অহং ভেঙ্গে… সেই সাধুত্বের কাছে পৌঁছাতে পারবো।

তাই যতক্ষণ না কারো মাঝে সাধুর অংশ সন্ধান করতে পারি নিজ ব্যর্থতায়; ততক্ষণ বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানির সেই অমর বাণীটা স্মরণ করেই প্রীত থাকি। তিনি বলেছেন- “কু-সঙ্গের চেয়ে নি:সঙ্গতা উত্তম”। যদিও বাংলা প্রবাদে এর সমকক্ষ বেশিকিছু প্রবাদ প্রচলিত আছে। তবে শব্দ চয়ণের কারণে এটিই বারবার মনে পরে।

আসলে এক হিসেবে দেখতে গেলে দেখা যায়। এতো কথার মানে ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম ১৮ পার হলে দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। জানি না তার কারণেই কিনা। নাকি নিজের অক্ষমতায় এখনো ঠিক সেই কথাগুলো লিখে উঠতে পারছি না। যে প্রশ্নগুলো আমাকে ডিভাইন জার্নির এই পর্যায়ে এসে অস্থির করে তুলছে।

তবে লেখা শুরু যখন করেছি আজ না হোক কাল সেই সব মন খারাপ করা কথাও তো লিখতেই হবে। তার কিছুটা আভাস যে শুরু হয়নি ইতিমধ্যে তাই বা বলি কি করে?

কেনো যেন আজকাল চারপাশের সবকিছুইকেই ‘কানার হাটবাজার’ মনে হয়। অনেক আলোচনাকেই ‘কুতর্কের দোকান’ মনে হয়। কেনো যেন প্রেমের প্রদীপের নিচেও স্বার্থের অপছায়া চোখে পড়ে যায়। কেনো যে এই চোখে ধরা পরে যায় জ্ঞানের অহং।

কেনো যেন বারংবার মনে হয় সাধুগুরুরা শিষ্যের সংখ্যা বাড়ানোতে মনোযোগী হলেও। শিষ্যকে যোগ্য করে গড়ে তোলায় তেমন সময় আর দিচ্ছেন না। এতে অনেকের ঝুলিতেই দীক্ষাগ্রহণের সার্টিফিকেট থাকলেও যোগ্যতর ভক্তকে পাওয়া যাচ্ছে না। সকল জায়গাতেই ক্ষরা।

ঘটনাগতিক দেখে মনে হয়, এখানে কেউ লালনকে তুলে ধরতে চাইছে না। সকলেই যেন লালনকে তুলনায় রেখে নিজেকে বড় করার প্রমাণে ব্যস্ত। ‘আমি লালনকে বুঝি তাই আমি বড়’-এটাই যেন বিষয়। এখানে সবাই যেন সবার নিজের নিজের মাল বিক্রিতে ব্যস্ত। কেবল সাইনবোর্ডে ফকিরকুলের শিরোমণি লালন সাঁইজির ছবি।

এসব দেখলে মাথা ঠিক রাখা বড্ড কঠিন। মেনে নেয়া তারচেয়ে কঠিন। বেশ কঠিন। আমরা যারা বিশ্বাস করি- ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে মনে/সেই সে রাঙ্গা চরণ পায়’। তাদের জন্য তো মহা মুশকিল। এসব ভাবতে গেলে সব যখন ঝাপসা হয়ে উঠে তখন স্মৃতিই পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়-

একবার এক সাধুসঙ্গে বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছি। সাধারণত এমনটা হয় না। যদিও সাধুসঙ্গে সকলেই এক ধ্যানে। এক মনে থাকে এমনটাও না। পরপর অনেকগুলো পর্ব অনুষ্ঠিত হয় বলে। যে যার কর্মে থাকে। সে সেই মতে মজে থাকে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। সাধুসঙ্গ শেষ পর্যন্ত হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

এই ফাঁকা সঙ্গে আমার পাশে এসে বসেছেন এক ভদ্রলোক। আসবার পর থেকেই এই লোককে দেখেছি এর ওর হাত দেখে বেড়াচ্ছেন। সম্ভবত আমার হাত দেখেও কয়টা টাকা উপর্জনের পথ খুঁজছেন। তবে আমি মুখ গুঁজে আছি সদ্য সাধুসঙ্গের মেলা থেকে কেনা পাতলা হিরহিরে একটা পুস্তিকার পানে।

মূল সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ মারাত্মক আহত না হলেও ট্রাক উল্টে কেলেঙ্কারি অবস্থা। চলাচলের একমাত্র রাস্তায় ঘটনাটি ঘটায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। লোকজন চেষ্টা চালাচ্ছে দুর্ঘটনা কবলিত ট্রাক সরিয়ে নিতে। কিন্তু এমন বেকায়দায় ট্রাকটা উল্টেছে যে সেটাকে সরানো সহজ নয় মোটেও।

তার উপর রাস্তার দুই পাশই অনেকটা খাড়া ঢালু নেমে, শেষে জল। সাধুসঙ্গের লোকজনও সেখানে গেছে হাত লাগতে। আগত অতিথি, শিল্পী এমনকি সাধুগুরুরাও আটকে পড়েছে পথে। আমরা বেলা থাকতে থাকতে চলে এসেছি। তাই আমাদের পথ রুদ্ধ করতে পারেনি ট্রাকখানা। আমরা এক পাক ঘুরে আখড়াতে চলে এসেছি।

আখড়ার সুপরিসর বারান্দার একটা কোণে আমাদের আশ্রয় হয়েছে। বসবার জায়গাটা বেশ মনে ধরেছে আমার। ঠিক সামনেই সাধুগুরুরা আসন নিয়েছেন। তাদের কাছাকাছি থাকলে অনেক ধরনের কথা শোনা যায়। টুকটাক অংশও নেয়া যায়। এই বিষয়টা আমার বেশ লাগে।

এখন অবশ্য আসনগুলো শূন্য পড়ে আছে; সাধুগুরুরা কেউ আসনে নেই। প্রহরের হিসেব কষলে এতোক্ষণে সাধুসঙ্গ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঐ যে বললাম সেই দুর্ঘটনা। তাতেই সব থমকে আছে। বেশিভাগ মানুষই সেই দুর্ঘটনা দেখতে গেছে। এমনকি সাধুগুরুরাও।

সর্বত্রই প্রায় ফাঁকা ফাঁকা ভাব। কেবল বিশাল লম্বা ছিপছিপে সাধুটি কিছু সময় পরপর ধুপধোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। ধুপের সৌরভে মৌ মৌ করছে চারপাশ। কেমন যেন একটা পবিত্র পবিত্র ভাব বিরাজ করছে সর্বত্র।

এই ফাঁকা সঙ্গে আমার পাশে এসে বসেছেন এক ভদ্রলোক। আসবার পর থেকেই এই লোককে দেখেছি এর ওর হাত দেখে বেড়াচ্ছেন। সম্ভবত আমার হাত দেখেও কয়টা টাকা উপর্জনের পথ খুঁজছেন। তবে আমি মুখ গুঁজে আছি সদ্য সাধুসঙ্গের মেলা থেকে কেনা পাতলা হিরহিরে একটা পুস্তিকার পানে।

উনি কিছুক্ষণ উনার নতুন লুঙ্গির খসখস শব্দ করে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। তারপর ঘাড়ের উপর দিয়ে পুস্তিকার পাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ্! এই বই পড়ছেন। এই বই তো ভুলে ভরা। রাবিশ! রাবিশ সব।”

আমি মুখ তুললাম বইয়ের পাতা থেকে। ভদ্রলোক হাতে ধরে রাখা পানখানা মুখে পুড়ে। কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে একটু চুন মুখে দিয়ে চোখ মুদলেন। আমি আবার বইয়ের পাতার দিকে মনোযোগ দিতেই ভদ্রলোক আমাকে চমকে বাজখাই গলায় বলে উঠলেন- তা আপনার নাম কি?

কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম -মেরাজ।

-আগে পিছে কিছু নেই নাকি?

-থাকাটা কি জরুরী?

-অবশ্যই। নইলে হবে কেনো। তা বলুন না নামটি কি?

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ।

এরপর তিনি কি প্রশ্ন করেন তার অপেক্ষা করছি। কিন্তু তিনি চোখ বন্ধ করে পান চিবিয়েই যাচ্ছেন। চিবিয়েই যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের মাধ্যে একটা নুরানী ভাব আছে। সম্ভবত চোখে সুরমা দেয়ার কারণে। গা থেকেও আতরের গন্ধ আসছে। এই সবই কি কারণ? নাকি ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গিতে বিশেষ কিছু আছে? নাকি এর জন্য তার পোশাক দায়ী?

আসলেই যারা হাত-টাত দেখেন তারা মানুষকে আকর্ষণ করার দুর্নিবার কৌশল নিয়েই চলেন। অল্পকথায় আমার ভেতরে একটা কৌতুহল সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তার উপর তিনি এরই মধ্যে কারো কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন আমার গুরু নেই।

আসলে পোশাক একটা বিশাল বিষয়। পোশাক দেখেই মানুষ চট করে সিদ্ধান্তে চলে আসে। আমি অবশ্য চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি। কিন্তু ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে পান চিবুচ্ছেন। অগত্যা আমি আবারো পুস্তিকার দিকে চোখ ডুবাতে যাব তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন।

-আপনার নামেই তো যোগ আছে, তাও আপনি গুরু পেলেন না কেনো এখনো!!! সেটাই তো বড় প্রশ্ন।

পুস্তিকাখানা ভাঁজ করে রেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। তিনি বলতে লাগলেন- মেরাজ অর্থ হইলো ‘সাক্ষাৎ’। মূর্শেদূল অর্থ হলো- ‘মুর্শিদের সাথে’। আর কাইয়ুম অর্থ হলো- আস্থাশীল/অভিভাবক/অনন্ত/আদি।

এই সব এক করলে কি দাঁড়ায়? মানে মুর্শিদের অনন্ত সাক্ষাৎ। তাই তো? তাই না??

এমন কথা আগে কখনো শুনিনি। এভাবে ভাবিও নি। মনে পড়লো, আরে আমি তো আমার নামের অর্থই খুঁজে দেখেনি! উনি এই সব শব্দের যথাযথ অর্থ বলেছেন কিনা তাতে সন্দেহ থাকলেও বিষয়টা বেশ মজাদার মনে হলো।

আসলেই যারা হাত-টাত দেখেন তারা মানুষকে আকর্ষণ করার দুর্নিবার কৌশল নিয়েই চলেন। অল্পকথায় আমার ভেতরে একটা কৌতুহল সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তার উপর তিনি এরই মধ্যে কারো কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন আমার গুরু নেই।

সেটা জানা বিশাল কোনো ঘটনা না। আখড়ায় আসার পর বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকজন সাধুগুরুর কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হয়েছে অনেকের সম্মুখে। আমি ভদ্রলোককে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

ভদ্রলোক বেশ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন- তবে ভাইজান কাইয়ুম শব্দের আরেকটা অর্থ আছে। তা কি জানেন?

-কি?

-সেটা হলো ‘স্বতন্ত্র’। তার মানে নামের অর্থ কি দাঁড়াইলো?

-কি দাঁড়াইলো?

-দাঁড়াইলো মুর্শিদের সাথে স্বতন্ত্র সাক্ষাৎ। তার মানে বিষয়টা সহজ না। আপনার মুর্শিদ বা মোর্শেদ পাইতে তাই দেরি হইতেছে। যেই সেইকে আপনি গুরু মানতে পারবেন না। আপনার গুরু হবে স্বতন্ত্র। মানে আলাদা। বুঝলেন?

-বুঝলাম।

-কিছুই বুঝলেন না।

-কিছুই বুঝলাম না!!!

-না। বুঝলে কি আর এই কথা বলতেন? শোনেন আপনার একটা পাথর ধারণ করতে হবে। আপনারা শহরের মানুষ তো এই সব বিশ্বাস করতে চান না। আমার কথা শোনেন, একটা পাথর ধারণ করেন। দেখবেন সব ঠিকঠাক।

-ঠিকঠাক মানে কি। সকালে উঠে দেখবো আমার নাম পাল্টে গেছে? কাইয়ুম উঠে গেছে?

-আরে আপনি তো এখনো শয়তানি করতেছেন। এসব তো আপনি করতেছেন না। আপনি বলতেছেন না। বলছে আপনার ভেতরের শয়তায়। জানেন তো ‘যার গুরু নাই তার গুরু হইলো শয়তায়’। শীঘ্রই পাথরটা নিয়া নেন। দেখবেন কেমনে ফল ফলে।

স্বভাবগুণেই আমার পাথর নেয়া হয় নাই। সেই লোকের সাথেও আর পুনরায় সাক্ষাৎ হয় নি। সেই ইতিহাসও ভুলে গেছি কবেই। কয়েকদিন আগে এক পুরানো বন্ধু ফোন দিয়ে বলে- তুই ফেসবুকে মূর্শেদূল মেরাজ নামে আইডি খুলছিস কেন? তোর নামের কাইয়ুম কই গেলো? আমি তো তাই খুঁজেই পাই না। তার উপর নাই ছবি।

পুরানো বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে সেই হাত দেখা বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। পাথর ছাড়াই আমার নামের ‘কাইয়ুম’ শব্দটা অনেক জায়গাতেই উঠে গেছে। তার সাথে সাক্ষাৎ হলে জমাটি আড্ডা দিয়ে বলা যেত-

“মশাই আপনার এলেম আছে। পাথরের নাম নিতেই দেখেন কাজ হয়ে গেছে। যদিও পাথর না নেওয়ায় সেটা অনেক বছর লেগে গেছে। কিন্তু আজো গুরু মেলে নাই।” সাঁইজি বলেছেন-

কে বোঝে সাঁইর লীলা খেলা।
ও সে আপনি গুরু আপনি চেলা।।

সপ্ততলার উপরে সে
নিরূপে রয় অচিন দেশে,
প্রকাশ্য রূপ লীলাবাসে
চেনা যায় না বেদের ঘোলা।।

অঙ্গের আভায় সবে সৃষ্টি
করিল সে পরম ইষ্টি,
তবে কেন আকার নাস্তি
বলি না জেনে সে ভেদ নিরালা।।

যদি কারো হয় চক্ষুদান
সেই দেখে সেরূপ বর্তমান,
লালন বলে তার ধ্যানজ্ঞান
হারে দেখি এ সব পুঁথির পালা।।

আসলে মুক্তির আশায় বদ্ধ হওয়া কঠিন। বেশ কঠিন। যারা পারে তারা নমস্য। যারা মনে না নিতে পারলেও মেনে নিতে পারে তাদের পক্ষে অবশ্য সহজ। আর সবচেয়ে সহজ হলো যারা প্রকৃতপক্ষেই সহজ। সহজ হলেই কেবল সহজ মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়; এ কথা কে না স্বীকার করবে।

কিন্তু আমার পক্ষে কি আর সহজ হওয়া সম্ভব? বা মেনে নেয়া সম্ভব?? যদি না প্রেম জাগে? যদি না প্রেমে পড়ি?? প্রেমে না পড়লে প্রেমে পড়ার অভিনয় করা মুশকিল। এই কথা শুনে একসাধু বলেছিলেন- “বাপু বিয়ার পরেও তো প্রেম হয়। হয় না? একসাথে থাকতে থাকতে প্রেম তো হইবারও পারে? পারে না?

তাইলে একজন গুণী গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে দোষ কি? তারে দেখো, বুঝো, শিখো। দেখো একদিন প্রেম ঠিকই হইয়া যাইবো? যাইবো না??”

আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম- যদি না হয়?

সাধুটি একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন- “এই ‘যদি-কিন্তু’ এইসব থাকলে তো চলবো না বাপু। এইসব আগে ছাড়। আর এইসব ছাড়তে না পারলে ছাড় পাবা না। আর ছাড় না পাইলে মন সহজ হইবো না। আর সহজ না হইলে সহজ মানুষ পাইবে কি মতে??”

আমার অবশ্য সহজ মানুষ হওয়া হয়ে উঠেনি। আমি জটিল-কুটিল মানুষ হয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি। চলাচল করছি। কি আর করা-

“কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার,
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।।”

যাক কি আর করা। এই আক্ষেপটা তো থাকবেই। এই আক্ষেপ নিয়েই পথ চলা। আমার তো সাঁইজির মতো ঘোড়া নাই। তাই পরের গাড়িতেই ঘোরাঘুরি। শুনেছি লালন সাঁইজি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছেঁউড়িয়ায় চলাচল করতেন। সেই থেকে মাঝে মাঝেই একটা কল্পনা জাগে মনে।

কোন এক সাধুসঙ্গে যদি দেখা যেতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধুগুরুরা রংবেরঙের ঘোড়ায় চড়ে লালন আখড়ায় আসছে দৃশ্যটা কেমন হতো? কুয়াশা ভেদ করে একে একে সাধুগুরুরা আসছেন লালন আখড়ায়। যদিও আমার এই কল্পনায় পশুপ্রেমীরা রেগে যাবেন কিনা জানি না। ঘোড়ায় চড়া নিশ্চিয়ই অন্যায় নয়!!!

আখড়া প্রাঙ্গণের টং দোকানের সামনে বসে চা পান করতে করতে কতবার যে দৃশ্যটা কল্পনা করেছি; তার শেষ নেই। এক এক করে সাধুগুরুরা আসছেন ঘোড়ায় চড়ে। আমি নিজের কল্পনায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই। যদিও এমন দৃশ্য দেখবার মতো সৌভাগ্য বাস্তবে হবে বলে মনে হয় না।

তীর্থ থেকে ফেরার পথে একদল লোক সঙ্গের বসন্ত রোগীকে ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে বাড়ি ফিরা গেছে। ভেসে আসা মানুষকে নিয়ে এমন গল্প ফাঁদা বেশ সহজ। কিন্তু তিনি আদতেই এমন একটা স্মৃতি পেছনে রেখে এসেছিলেন নাকি গল্পটা একেবারেই ভিন্ন অভিনব কিছু ছিল তা নিয়ে আর বিশেষ ভাবা হয়নি।

আসলে লালন ফকিরকে নিয়ে সেভাবে ভাববার লোক তো খুঁজে পাওয়া যায় না। সকলেই লালনকে ঘিড়ে নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকে পরেছে। নিজেকে প্রমাণ করার জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে লালন। হয়তো আমিও করছি একই কাজ।

ঘটনাগতিক দেখে মনে হয়, আমরা কেহই লালনকে খুঁজতে চাই না। হয়তো এই অনন্ত রহস্যে ডুবে যাওয়ার ভয় থেকেই এই কাজে কেউ রাজি নয়। তাই আমরা সত্যে প্রবেশ না করে কেবল ‘তানা নানা করছি’।

আদিতে লালন ফকিরকে প্রথমে বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল হিন্দু। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তা মানতে চায়নি। তারা বলেছে লালন যবন-ম্লেচ্ছ। লালন মুসলমান। অন্যদিকে মুসলমানরাও তা মানতে চায়নি। বলেছিল লালন ‘বে-শরা’। অর্থাৎ তিনি শরিয়ত মানেন না।

এই টানাটানিটা গিয়ে ঠেকেছিল সুধিজন-বুদ্ধিজীবী মহল পর্যন্ত। তারাও নিজেদের সুবিধার জন্য লালনকে কখনো মুসলমান। কখনো হিন্দু বানানোর ক্রিয়াটা চালিয়েছিল এবং চালাচ্ছেন। ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে ফকির হয়েছে সেই গল্পটা কেউ মানবে না। তাই লালনকে জাত প্রথার নিম্নবর্গ বানিয়ে জমিদারের বদন্যতায় বেঁচে থাকার গল্পটা ফাঁদা হয়েছিল বেশ কায়দা করেই।

আসলে লালন ফকির এমন একটা চরিত্র। যাকে ঠিক ভদ্রলোকে গ্রহণও করতে পারে না। আবার তাকে অন্যরা নিজেদের বলে দাবী করবে সেটা মানতেও পারে না। তাই যা-তা একটা গল্প ফেঁদে গরীব-দুস্থ-অসহায় ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করে যদি নিজ বিশ্বাসের অন্ধকার কোনো কোণে রেখে দেয়া যায়; তাতে মন্দ হয় না।

তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সরকার নিযুক্ত মুসলমান গবেষকরাও লালনকে মুসলমান বানানোর চেষ্টায় হাজির করেছেন নানান পুঁথি-পুস্তিকা-কেচ্ছা। উভয়পক্ষই লালন ফকিরের আলাদা আলাদা গ্রাম-পিতা-মাতা-স্ত্রীর নাম উদ্ধার করেছেন। তবে গল্পটা ঘুরে ফিরে প্রচলিত ছুঁৎ-অছুঁৎ এর বাইরে কিছু লেখা হয়নি।

তীর্থ থেকে ফেরার পথে একদল লোক সঙ্গের বসন্ত রোগীকে ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে বাড়ি ফিরা গেছে। ভেসে আসা মানুষকে নিয়ে এমন গল্প ফাঁদা বেশ সহজ। কিন্তু তিনি আদতেই এমন একটা স্মৃতি পেছনে রেখে এসেছিলেন নাকি গল্পটা একেবারেই ভিন্ন অভিনব কিছু ছিল তা নিয়ে আর বিশেষ ভাবা হয়নি।

লক্ষণ রেখার বাইরে গেলেই রাবণ ধরে নিয়ে চলে যাবে লঙ্কায়। তাই লক্ষণরেখার ভেতরেই থাকো। তাই যারা লক্ষণরেখায় ঢুকে গেছে। তারা নানা নিয়মশৃঙ্খলের খোলস গায়ে ঠিকই চাপিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু লক্ষণরেখার বাইরেও যে দুনিয়া আছে। সেখান থেকেও যে অধরকে ধরা সম্ভব তা ভুলে যায়।

এই গল্পটারই বাজারদর ভাল। লোকে খায়। আসলে এই গল্পটা আদতে ছিল এই অঞ্চলের পুতুল-নাচ, পুঁথি, যাত্রা, নাটকের প্রচলিত বা জনপ্রিয় ধারা। ভেসে আসা যুবকের নতুন জীবন। এই ছিল গল্পের নায়কের আর্বিভাব চিত্রকল্প। এমন একজন আমাদের উদ্ধার করবে যিনি বাইরে থেকে আসবেন। এমন ধারণা বহু প্রাচীন।

যদিও এসব ক্ষেত্রে নায়ক চরিত্রের অধিকারীকে শেষ দৃশ্যে রাজপুত্র বলে প্রতিয়মান করা হয়। কিন্তু ফকির লালনকে শেষ পর্যন্ত সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় নি; সেটিই রক্ষা। নইলে অনেক অবতারকে যেমন ব্রাহ্মণ প্রমাণ করে জাতে তোলার একটা অপচেষ্টা কিছু মানুষ করেই চলে।

অথচ সহজ একটা বিষয় তারা কিছুতেই বুঝতে চায় না। জাতে তোলার জন্য ব্রাহ্মণ-আসরাফ এমন কোনো কিছু হওয়া জরুরী নয়। সমাজে প্রচলিত সভ্যতার চিহ্নিত ধারার উচ্চজাত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। একে বড়-ছোট বা উঁচু-নিচু দিয়ে নয় বিশালতা-গভীরতা দিয়ে মাপতে হয়।

আর এরজন্যে প্রয়োজন হয় বড় মনের-বিবেকের-বিবেচনা বোধের-বিচক্ষণার-প্রেমের মানুষ হওয়ার। যাক সে কথাও। লালন-ফকিরকে নিয়ে এই হিন্দু-মুসলমান টানাটানির ভেতর দিয়ে একটা বিষয় বহুদিন মানুষ মিস করে গেলো।

সেটা হলো গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কথা। যিনি নদীয়া অঞ্চলে নতুন ভাব এনেছিলেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নদীয়ায় নতুন ভাব আনলেও এই অঞ্চল পূর্ব থেকেই ভাবের ভুবন। এখানে নানাভাব বিরাজ করেছে। শিক্ষায় অনন্য নদীয়ায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু জাত-পাত ভেঙ্গে দিয়ে নতুন ভাব প্রচারে নামলেন।

লালন ফকির সেই গৌরাঙ্গকে অন্যতম পাগল বলে আখ্যা দিয়েছেন। চিহ্নিত করেছেন ফকির হিসেব। নদীয়ার ফকির হিসেবে। তাকে বহু সুধিজন মিস করে গেলেও। ফকিররা তাকে মিস করেনি। তাদের অনেকেই তাকে গ্রহণ করেছেন।

তবে আক্ষেপের বিষয় হলো যে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু পূর্বের ভাব বাতিল করে দিয়ে নতুন ভাব এনেছিলেন। তার অনুসারীরাও নতুন ভাবকে গ্রহণ না করে বেশিভাগক্ষেত্রে তন্ত্রের ধারাতেই আবদ্ধ থেকেছে। ফকিরদের অনেকেও একই কাজে মত্ত্ব হলেন। তারাও ফকিরি না করে বাউল মতে মেতে রইলেন।

তারা লালন মতকে বৈষ্ণব-বাউল মতে আটকে রাখলেন। হয়তো এটাই সবচেয়ে সহজ সাধন বলে। এতেই মজে গেলেন। একটা অনুশীলনকেই লালনের পূর্ণাঙ্গ সাধন ভেবে আটকে গেলেন। আটকে রাখলের। আমাদের চারপাশে সীমানা কেটে বুঝিয়ে দিয়ার চেষ্টা করলেন।

লক্ষণ রেখার বাইরে গেলেই রাবণ ধরে নিয়ে চলে যাবে লঙ্কায়। তাই লক্ষণরেখার ভেতরেই থাকো। তাই যারা লক্ষণরেখায় ঢুকে গেছে। তারা নানা নিয়মশৃঙ্খলের খোলস গায়ে ঠিকই চাপিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু লক্ষণরেখার বাইরেও যে দুনিয়া আছে। সেখান থেকেও যে অধরকে ধরা সম্ভব তা ভুলে যায়।

ফকিরি করতে হইলে ফকিরির গর্বও ছাড়োন দেওন লাগবো গো বাপ। ফকিরি করে আমি এই হয়ে গেছি-ঐ হয়ে গেছি এমন ভাবলেও ফকিরি নষ্ট হয়। ফকিরি এমন কোনো নিয়ামক না বাপ। একবার পাইলেই চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার হইয়া যাইবো। ফকিরি হইলো এমন ভাব। যা ধইরা রাখতে হয়। ব্যাভিচারে ফকিরি নষ্ট হয়। ধ্বংস হয়।

ভুলে গেলে ক্ষতি নেই। ক্ষতি কেবল অস্বীকার করলে। মৌলবাদী মনোভাব ধারণ করলে। পথ সংকোচণ করলে। চিন্তার ধারাকে আবধ্য করে ফেললে। চিন্তাকে উন্মুক্ত রাখতে না পারলে, সৃষ্টির সকল কিছুকে অনুধাবণ করা সহজ হয় না। তখন সাঁইজির ভাষায় কূপজল হয়ে থাকতে হয়।

কূপজলও ‘জল’ সেটা কেউ অস্বীকার করবে না। তবে কূপজলের জলই ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র জল সেটা ভাবতে শুরু করতে লাগলেই গোলমাল বাঁধে। আমি কূপজলে আছি-আমি কূপজল সম্পর্কে সব কিছু জানি। তাই আমি সমগ্র জলকে জানি। এমন ভাবনা ভাবা যেতেই পারে।

কিন্তু কেউ কূপজল না হলে। কূপজলে না ডুবলে বা আমি যে কূপজলে ডুবে আছি সেই কূপজলে না ডুবলে জলকে কেউ বুঝতেই পারবে না এমনটা ভাবা গোঁড়ামির নামান্তর। তারপরও এমন করেই অনেকে ভাবতে চায়। এমন ভাবতে থেকেই ফকির লালনের রহস্যময় বিশাল মতাদর্শকে সংকীর্ণ পরিমণ্ডলে পিষ্ট করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে সর্বত্র। তারা বীরের কাহিনী ভুলে খুঁড়িয়ে হাটাতেই প্রশান্তি বোধ করে।

কোনো কোনো সাধুগুরু আজও আফসোস করে বলেন, “বাপ! আমাদের কথা কে শোনে বলো। যাদের ভক্ত বেশি। পাকা আখড়া আছে। ঢাকার ভক্ত আছে। দেশ-বিদেশের ভক্ত আছে। বড়লোক ভক্ত আছে। প্রভাবশালী ভক্ত আছে। সুন্দরী ভক্ত আছে। তারা যা বলে তাই সত্য বলে মনে করে মানুষ।

একমাত্র বলে মনে করে। তাদের কথাই বিধান হয় যায়। তাদের রীতিই বৈধ হয়ে যায়। তাদের ভাষাই আইন হয়ে যায়। আসলে কার কয়টা ভক্ত তা দিয়ে কি আর সাধুত্ব বিবেচনা করা যায়? নাকি উচিত! তুমি যদি তোমার ভক্তের সংখ্যা নিয়ে গর্ব করো। যদি তোমার কাদের সাথে পরিচয় আছে তা নিয়ে গর্ব করো।

যদি তোমার বড়লোক ভক্ত আছে তার জন্য গর্ব করো। যদি তোমার বড় শিল্পী ভক্ত আছে তা নিয়ে গর্বে থাকো। যদি তোমার দেশ-বিদেশী ভ্ক্ত আছে বলে গর্ব করো। যদি তোমাকে এই অনুষ্ঠানে ডাকা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে ডাকা হয় তা নিয়ে গর্ব করো। তোমার আখড়ায় সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় বলে গর্ব করো।

তোমাকে মন্ত্রী চিনে, আমলা চিনে, সচিব চিনে, ইএনও চিনে, টিএনও চিনে, উকিল চিনে, ব্যারিস্টার চিনে, চেয়ারম্যান চিনে, মেম্বর চিনে এইসব গল্প নিয়া যদি তুমি গর্ব করো, ব্যস্ত থাকো তাহলে তুমি ফকির হইতে আসছো কেনো বাপু? তুমি চেয়ারম্যানিতে দাঁড়াও। মেম্বর হও।

ফকিরি করতে হইলে ফকিরির গর্বও ছাড়োন দেওন লাগবো গো বাপ। ফকিরি করে আমি এই হয়ে গেছি-ঐ হয়ে গেছি এমন ভাবলেও ফকিরি নষ্ট হয়। ফকিরি এমন কোনো নিয়ামক না বাপ। একবার পাইলেই চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার হইয়া যাইবো। ফকিরি হইলো এমন ভাব। যা ধইরা রাখতে হয়। ব্যাভিচারে ফকিরি নষ্ট হয়। ধ্বংস হয়।

গর্ববোধ থাকলে, অহংকার থাকলে, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, রেষারেষি, চাওয়া-পাওয়া থাকলে সে তো আর জিন্দামরা হইলো না। আর জিন্দামরার ভাব না রাখতে পারলে তো ফকিরি হয় না। ফকিরি তো আর গাছের গোটা না বাপ। ফকিরি সাধ্য-সাধনের ব্যাপার। বুঝলা নি?”

এই দোলাচলে অনেক ফকির ফকিরি নিলেও আদোতে তারা থেকে গেলেন বাউল হয়ে। তন্ত্র, সহজিয়া বৈষ্ণব মতকেই লালন মত বলে বিবেচনায় নিলেন। কালক্রমে বাউলের তন্ত্র আর সহজিয়া বৈষ্ণবের সাধন-ভজনই লালনের সাধন-ভজনের একমাত্র অঙ্গ বলে প্রচার করা হয়েছে।

জানি না এ সবই আমার অতি ভাবনার ফল কিনা। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে প্রশান্তির পথ কিনা। কিন্তু আমি সত্য সত্যই এটাই মানতে চাই। কারণ এটাই ঘটছে বলে আমার মনে হয়। নইলে লালন ফকিরের দরজার ভক্তদের জন্য বন্ধ করে কার সাধ্য? যদি তিনি স্বয়ং তাতে সম্মত না হন?

অন্যদিকে মুসলমান ফকিররা এই তন্ত্র-সহজিয়া মতের রসতত্ত্বকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করলেও পাশাপাশি মুসলমান সত্ত্বটাকে অস্বীকার করতে পারছিলেন না। তাই তারা তন্ত্র-সহজিয়ায় সাধন-ভজন গ্রহণ করে। নিজেদেরকে চিশতিয়া তরিকার বলেও দাবী করতে লাগলেন।

অনেকে নির্দিষ্ট করে বলেন, লালন ফকির চিশতিয়া তরিকার নিজামুদ্দিন খান্দানের সিলসিলা। এই হিসেবে একটা গুরুবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার দিকে তারা এগিয়েছেন। আসলেই লালনের গুরুবাদ কি সমাজে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের গুরুবাদ!!

লালন ফকির নিজে কয়জনকে শিষ্য করেছিলেন? কয়জনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন? কয়জনকে ভেক-খেলাফত দিয়েছিলেন?? লালন ফকির কোন গুরুকে গুরু বলেছেন? কোন সাধন-ভজনকে কতর্ব্যজ্ঞান করেছেন? সেসব নিয়ে আলোচনা হয় না।

এখন আলোচনা হয় রসতত্ত্ব-লীলা নিয়ে। সিদ্ধি গ্রহণ নিয়ে। যেখানে ‘লালন’ হারিয়ে যায় বস্তুতে। রস-রতিতে সব কিছু ডুবে যায়। যেখানে সমাজ সচেতনতা। মানুষের মনুষ্যত্ব। এসব কিছু্ই আর থাকে না। সেখানে সকল কিছুর শেষ হয় দৈহিক ত্রিবেণীতে।

এর বাইরে কোনো কিছু ভাববার সক্ষমতা হারিয়েছে অনেকেই। চর্চার অভাবে। স্বভাবের দোষে। ঐ যে গল্পটা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। সেই আদিবাসীর গল্পটা মনে আছে এখনো? তারা ততদিনে ভুলে গিয়েছিল কেনো তারা খুঁড়িয়ে হাঁটে।

তারা আর বীরের সম্মানে খুঁড়িয়ে হাঁটে না, সেটা তারা অভ্যাস যোগ করে নিয়েছিল ততদিনে। এখানেও এমনটাই হচ্ছে। তাই হয়তো ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজির ধামের সদর দরজা আজ বন্ধ। যেখানে ভক্তরা প্রবেশ করতে পারে না।

যদিও অতিমারীর এই ক্রান্তিকালের বাহানা দেয়া হয়। কিন্তু আমরা সকলেই জানি। অতিমারীতে দেশের প্রায় সকল দরবারই খোলা থাকে ভক্তদের জন্য। বা খুলে দেয়া হয় ভক্তদের জন্য। কেবল লালন সাঁইজি তার দরজা এটে বসে আছেন। হয়তো আমাদেরকে বার্তা দিচ্ছেন সংকোচণের পথ ছেড়ে প্রসারণে ফিরতে।

জানি না এ সবই আমার অতি ভাবনার ফল কিনা। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে প্রশান্তির পথ কিনা। কিন্তু আমি সত্য সত্যই এটাই মানতে চাই। কারণ এটাই ঘটছে বলে আমার মনে হয়। নইলে লালন ফকিরের দরজার ভক্তদের জন্য বন্ধ করে কার সাধ্য? যদি তিনি স্বয়ং তাতে সম্মত না হন?

এই সব ভাবতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব কিছু মিথ্যা মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় এই বাণিজ্যিক সভ্যতা আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে চারপাশে নৃত্য করতে করতে বলছে-

“লাল পাহাড়ির দেশে যা
রাঙ্গামটির দেশে যা
ইত্থাক তুকে মানাইছে না গো
ইক্কেবারে মানাইছে না গো”

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
মাই ডিভাইন জার্নি : আঠার:: রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই
মাই ডিভাইন জার্নি : বিশ :: কোন মানুষের করি ভজনা
মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ :: এসব দেখি কানার হাটবাজার

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Sahomananda Anandanath , মঙ্গলবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ @ ৩:১১ অপরাহ্ণ

    আমার খুব ভাল লাগল। যা সত্য তা কঠিন হলেও চিরন্তন।

  • গৌতম দত্ত , শনিবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ @ ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

    পড়লাম। সুপাঠ্য। বেশ কিছু পুনরাবৃত্তি রয়েছে। বাউল আর ফকিরির পার্থক্য সংক্ষেপে স্পষ্ট করে বললে পাঠক উপকৃত হতো। এছাড়াও তন্ত্র, সহজিয়া ইত্যাদি প্রবণতাগুলোও কোনটা কী তা সবাই জানে বলে মনে হয় না, টীকা দেয়া যেতো। মুক্তি, সাধন এসব বলতে কী বোঝায়, কেন কেন কোন লক্ষ্য থাকা দরকার , আলোচনা হতে পারে। প্রতিকী উপমা উদাহরণগুলো ভালো, তবে বাস্তবতার মাটিতে নামা হয় নি , শুরুতে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!