ভবঘুরেকথা
শ্রীযুতের জীবনী দুলাল চাঁদ সতীমা কর্তাভজা

কর্তাভজা ধর্মের ইতিহাস

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু কর্তাভজা সত্যধর্ম বা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু ‘ফকির ঠাকুর’ নামেও ভক্তদের মাঝে বিশেষ পরিচিত, যিনি ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু তিনিই ফকির ঠাকুর’। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর জন্ম বৃত্তান্তের ঐতিহাসিক কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না-

যা কিছু পাওয়া যায় তা সবই অনুমান নির্ভর বা জনশ্রুতি, ঐসব জনশ্রুতি একটির সাথে অন্যটির মিল নেই তাই ঐসব ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি দ্বারা সঠিক তথ্যে উপনীত হওয়া যায় না।

তবে ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর চরিত্র, আচার-আচরণ দ্বারা প্রতীয়মান হয় তিনি ছিলেন জাত-পাত-বর্ণ নাম-গােত্র-ঠিকানা বিহীন শান্ত, সৌম্য, জাগতিক ভােগ বিলাসে উদাসীন এক মহামানব। কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের নিকট তিনি ঈশ্বরের অবতার স্বরূপ, সহজ মানুষ।

ভাবেরগীতে বলা হয়েছে-

আদ্যের অনাদি সে আপনি এসেছে।
সেই হরি এই জীবের ভাগ্যে আপনি সদয় হয়েছে।
সহজ ভাবের সহজ মানুষ, স্বরূপে রূপ মিশিয়েছে।।
(ভাবেরগীত, গীত নং- ৯০)

শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রি) বৈষম্যমূলক বর্ণবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজ ব্যবস্থার বংশগত জাতিভেদের বিপরীতে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের মাধ্যমে যে সাম্যবাদের সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, রক্ষণশীল ব্রাহ্মণসমাজ ও সমাজপতিদের প্রবল বিরােধিতার কারণে তার আদর্শ সমাজজীবনে পূর্ণ রূপে প্রতিফলিত না হওয়ায় পূণরায় তিনি আউলচাঁদ রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে ‘কর্তাভজা সত্যধর্ম’ প্রচার করেন।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের এই বিশ্বাসের মূল কারণ হচ্ছে শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ এবং ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আদর্শ এক এবং অভিন্ন। চৈতন্যদেবের উদ্দেশ্য ছিল সনাতন ধর্মালম্বীগণের সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক ৪ বর্ণ ৩৬ জাত বংশগত জাতিভেদের অবসান এবং প্রত্যেক মানুষের মাঝে পরমাত্মা রূপে ঈশ্বর বিরাজমান তাই-ধর্ম-কর্মে ও সমাজ ব্যবস্থায় সকলের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

(বলাবাহুল্য শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবের শত শত বছর পূর্বেই ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বী অগণিত মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল)

শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ- শ্রীচৈতন্যদেবের মুখঃ নিসৃত বাণী-

নিচ জাতি নহে কৃষ্ণ ভজনে অযােগ্য,
সৎ কুল বিপ্রনহে ভজনের যােগ্য।
যেই ভজে সেই বড়, অভক্ত হীন ছার,
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার।।
(চৈতন্য চরিতামৃত – অন্ত্যলীলা, ৫১২ পৃষ্ঠা)

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আদর্শ- ভাবেরগীতে বলা হয়েছে-

দেখ ছত্রিশ জাতি চার বর্ণ কারু খান না তিনি,
বর্ণ মধ্যে কোন বর্ণ তা শুনি হন্ মানুষে নিশানি,
যে তার হুকুমে মকাম করে স্বকাম করে ত্যাগ,
তারি হন্ তারি সেবা লন্ তাতেই অনুরাগ।।
(ভাবেরগীত- গীত নং- ৪২১, কলি- ৪)

চৈতন্যদেব পূরীধামে অবস্থানকালে নদীয়ায় বৈষ্ণব ধর্মের অবস্থা- চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ- চৈতন্যদেবের উদ্দেশ্যে-নদীয়া থেকে বৈষ্ণব চূড়ামণি অদ্বৈত আচার্য কর্তৃক পাঠানাে প্রহেলিকা-

বাউল কে কহিও লােক হইল বাউল,
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল,
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল,
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।।
(চৈতন্য চরিতামৃত-অন্ত্যলীলা- উনবিংশ পরিচ্ছেদ, ৬১২ পৃষ্ঠা)

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ শ্রীচৈতন্যদেবকে কলিযুগের অবতার রূপে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা-ভক্তি নিবেদন করে কিন্তু তার প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের আদর্শ-আচার-আচরণ-উপদেশ গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের ব্যক্তি জীবন, পরিবার ও সমাজ জীবনে তার সামান্যতম অংশ প্রতিফলিত হয়নি, অন্তর্দৃষ্টি বা বহির্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের সময় বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থা ছিল এক অন্ধকারময় যুগ।

সনাতনধর্মালম্বী হিন্দু জাতি ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বৈষম্যমূলক বংশগত উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ জাতিভেদের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। শাসক শ্রেণীর কথিত কিছু উচ্চবর্ণ ব্যক্তিগণ দ্বারা কথিত অসংখ্য নিম্নবর্ণ মানুষেরা অবহেলিত নির্যাতিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হতেন, নিম্নবর্ণ মানুষদের সামাজিক কর্মকাণ্ড ও ধর্ম-কর্মে কোন অধিকার ছিল না।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর কুপায় সরস্বতী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও অতিমানবীয় গুণাবলীর অধিকারীণী হয়েছিলেন, চাকদহ থানাধীন গােবিন্দপুর নিবাসী গােবিন্দ ঘােষের কন্যা সরস্বতী পরবর্তীতে ‘সতীমা’ নামে খ্যাত হন, (সরস্বতী নামের আদ্যাক্ষর ‘স’ ও শেষ অক্ষর ‘তী’ = ‘সতী’ মা’) সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের নিকট ‘সতীমা’ পরম শ্রদ্ধেয় ও পূঁজনীয়।

জাতিভেদের অভিশাপ থেকে মুক্তি ও ধর্ম-কর্মে সকলের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা, মায়ামুগ্ধ কলির জীবের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মুক্তি পথের দিশারী স্বরূপ সহজ, উদার, একেশ্বরবাদ ও সাম্যবাদের প্রতীক ‘কর্তাভজা ধর্ম’ প্রচারের নিমিত্তে, বাংলা ১১৫৯-৬১, ইং ১৭৫২-৫৫ সালের কোন এক শুভক্ষণে নদীয়া জেলার ডুবােপাড়ার গহীন অরণ্যে (বর্তমানে নিত্যধাম ঘােষপাড়া, কল্যাণী, নদীয়া, পশ্চিম বাংলা, ভারত) তার আবির্ভাব।

কর্তাভজা ধর্মের দর্শন-উপাসনায় প্রার্থনায় এক জগৎকর্তার ভজনা করা এবং প্রত্যেক মানুষের মাঝে পরমাত্মারুপে ঈশ্বর বিরাজমান তাই ‘মানুষই ঠাকুর’। এই জ্ঞানে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি নিবেদন করা, বৈষম্যমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজ ব্যবস্থার বংশগত জাতিভেদের পরিবর্তে গুণ ও কর্মগত গুরুবাদের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়ায় আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা-বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন তবে উপযুক্ত ভক্ত না পাওয়ায় কোথাও তিনি নিজেকে প্রকাশ করেননি।

অবশেষে গঙ্গানদীর তীরবর্তী ডুবােপাড়ার গহীন অরণ্যে অলৌকিক ভাবে আবির্ভূত হন এবং সত্যের মূর্ত প্রতীক সরস্বতী (সতীমা) ও রামশরণের মাধ্যমে কর্তাভজা ধর্ম প্রচার করেন। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু প্রবর্তিত কর্তাভজা ধর্মের মূলতত্ত্ব- একসত্য কর সার, ভব নদী হও পার।

মূলমন্ত্র বীজমন্ত্র-

সত্যনাম- জয় সত্য/কর্তা তােমার, বলি/তুমি, নাই/গুরু অনিত্য/জয় সত্য।

সর্বমােট = ৫১টি অক্ষর, মােট ২১টি শব্দ, সত্যনামে সর্বপ্রথম সরস্বতী (সতীমা) ও রামশরণ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে দীক্ষা গ্রহণ করেন, তাই সরস্বতী ও রামশরণ কর্তাভজা সত্যধর্মের ধারক।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু সম্প্রদায়ের প্রধান হিসাবে রামশরণকে কর্তাবাবা ও সতীমাকে কর্তামা নিযুক্ত করে কর্তাভজা ধর্মের নীতি-আদর্শ ভক্তগণের মাঝে প্রচারের আজ্ঞা দিয়েছিলেন। ইং ১৭৮৩ সালে স্বামী রামশরণের দেহত্যাগের পর ইং ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৮ বছর সতীমা ধর্মীয় নীতি-আদর্শ পালনে ও প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন এবং ভক্তগণের মাঝে প্রচার করেছিলেন।

সতীমা’র মাধ্যমেই ‘কর্তাভজা সত্যধর্ম’ প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল তাই এই ধর্মীয় মতাদর্শ সতীমার মত নামেও বিশেষ পরিচিত। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু সরস্বতী (সতীমা)কে (সতীমার স্বহস্তে রোপিত) একটি ডালিমগাছের তলে বসে জপ-তপ-ধ্যান-সাধন-ভজন করতে আজ্ঞা দিয়েছিলেন, সরস্বতী ঐ ডালিম তলায় বসে জপ-তপ-সাধন-ভজন করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

সরস্বতী (সতীমার) স্বহস্তে রােপিত ডালিম গাছটি আজও (প্রায় ৩০০ বছর) নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়ায় বিদ্যমান। কর্তাভজা ধর্মের মূলকেন্দ্র নিত্যধাম, কল্যাণী ঘোষপাড়া। এখানে হিমসাগর নামে একটি সরোেবর ও পরম পূঁজনীয় সতীমায়ের সমাধি মন্দির আছে, তা ছাড়াও এখানে কর্তাভজা-ধর্মের অনেক নিদর্শন আছে।

ধর্ম-গােত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ আপদে বিপদে ভিন্ন ভিন্ন মনােবাসনা নিয়ে নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়ায় মায়ের ধামে মানত করে, মালিকের অপার মহিমায় সতীমায়ের কৃপায় বহু ভক্তের মনােবাসনা পূর্ণ হয়। এখানে ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমায় লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর কুপায় সরস্বতী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও অতিমানবীয় গুণাবলীর অধিকারীণী হয়েছিলেন, চাকদহ থানাধীন গােবিন্দপুর নিবাসী গােবিন্দ ঘােষের কন্যা সরস্বতী পরবর্তীতে ‘সতীমা’ নামে খ্যাত হন, (সরস্বতী নামের আদ্যাক্ষর ‘স’ ও শেষ অক্ষর ‘তী’ = ‘সতী’ মা’) সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের নিকট ‘সতীমা’ পরম শ্রদ্ধেয় ও পূঁজনীয়।

তিনি ১৬ বছর বয়সে সম্প্রদায়ের হাল ধরেন এবং তার মাধ্যমে কর্তাভজা ধর্ম বাংলা (বর্তমানে বাংলাদেশ সহ), বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসার লাভ করে।

সতীমা ও রামশরণ ছাড়াও আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য মানুষ তাঁর ভক্ত হয়েছিলেন এর মধ্যে ২২ জন প্রধান ভক্তছিল, এরা বাইশ ফকির নামে পরিচিত। ঠাকুর তার ভক্তদের নিয়ে শুক্রবারে প্রথম ধর্মীয় ‘মহতী বৈঠক’ অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং ভক্তদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতি শুক্রবারে নিরামিষ ভোজন করত:

(প্রাণীজ আমিষ মাছ-মাংস-ডিম বর্জিত) সন্ধ্যায় সকলে একত্রে বসে মালিকের নাম গুণগান শ্রবণ-কীর্তন-উপাসনা-প্রার্থনার মাধ্যমে মালিকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, সেই অবধি কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তদের নিকট শুক্রবার অতীব পবিত্র দিন। ঠাকুরের আজ্ঞা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণ অদ্যাবধি মেনে চলে।

তা ছাড়াও প্রত্যহ চার বার, (ব্রহ্মমুহূর্ত, মধ্যাহ্ন, সন্ধ্যা, মধ্যরাত) বা কমপক্ষে দুইবার (দিনে-রাতে) নিয়মানুসারে ‘সত্যনাম’ স্মরণ পূর্বক, মালিকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ধর্মের ১০টি মূলনীতি ও ৩০ ধারা যথাযথ ভাবে পালনের আজ্ঞা দেন।

‘কর্তাভজা ধর্ম’ সম্পূর্ণ রূপে গার্হস্থ্য আশ্রমের মাধ্যমে পালন করতে হয়, এখানে সন্ন্যাসের কোন বিধান নেই। ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আবির্ভাবে ‘কল্যাণী ঘােষপাড়া’ ভক্তদের নিকট পূণ্যভূমি, মিলনমেলা, তীর্থস্থানে পরিণত হয়।

ঠাকুর একদিন সতীমা ও রামশরণসহ অন্যান্য ভক্তদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বিভিন্ন স্থানের ভক্তদের সাথে মিলনের জন্য কল্যাণী ঘােষপাড়া থেকে অন্যত্র ভ্রমণে যান। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পূণ্যভূমি আজও বিদ্যমান।

বাংলা ১১৭৬ সালের কোন এক শুভক্ষণে সকলের অজান্তেই ঠাকুর আউলচাঁদ অন্তর্ধান করেন। ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাব ও তিরােভাবের নির্দিষ্ট কোন স্থান-দিন-তারিখ নেই, তাই কোন নির্দিষ্ট দিনে ভক্তদের মাঝে আবির্ভাব ও তিরােভাব দিবসটি নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়াসহ কোথাও পালিত হয় না,

এই কারণেই কোন কোন ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঠাকুরের সমাধী আছে বলে দাবি করলেও তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য বা সত্যতা নেই, এ বিষয়ে ভক্তদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে।

সতীমা-রামশরণের সুযােগ্য পুত্র ঠাকুর দুলালচাঁদ (লালশশী), যিনি দুলালচাঁদ তিনিই লালশশী। দুলালচাঁদ সপ্তম বছর বয়সে পিতৃহীন হন এবং মায়ের স্লেহে-আদর্শে বড় হয়ে উঠেন। দুলালচাঁদ ছিলেন শিক্ষিত-বহুভাষী-তীক্ষ্ণ জ্ঞান সম্পন্ন-মহাজ্ঞানী, ‘ভাবেরগীত’ রচনা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তিনি ১৬ বছর বয়সে সম্প্রদায়ের হাল ধরেন এবং তার মাধ্যমে কর্তাভজা ধর্ম বাংলা (বর্তমানে বাংলাদেশ সহ), বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসার লাভ করে।

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু অদ্বৈত আচার্য্য কর্তক প্রেরিত এই তরজা প্রহেলিকাটি শুনে মুদুভাবে একটু হাসলেন এবং চুপ করে থাকলেন। ঐ প্রহেলিকার সারমর্ম গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ব্যতিরেকে তখন আর কেউ বুঝতে পারেনি, সেই দিন থেকেই মহাপ্রভু চিন্তা করতে লাগলেন সত্যিই তাে আমি সংসারে মায়ামুগ্ধ জীবের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য কিছু করিনি বিবাহিত স্ত্রী ও মাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমি ডাের কৌপিন পরে সন্ন্যাসী হয়ে, যে ধর্মমত প্রচার করেছি তাত সবাই গ্রহণ করতে পারবে না, সত্যিই আমার এটা ভুল হয়েছে।

ঠাকুর দুলালচাঁদ কর্তাভজা ধর্মের নীতি-আদর্শসমূহ গীত আকারে প্রকাশ করেন, লালশশী রচিত গীতগুলাে ‘ভাবেরগীত’ নামে খ্যাত, পবিত্র ‘ভাবেরগীত’ কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু কর্তাভজা ধর্মের বীজ রােপন করেছিলেন, সতীমা পরিচর্যার মাধ্যমে একটি বৃহৎ বটবৃক্ষে পরিণত করেছিলেন আর ঠাকুর দুলালচাঁদ সেই বৃক্ষ ফুলে ফলে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুর দুলালচাঁদ ছিলেন কর্তাভজা ধর্মের প্রাণপুরুষ।

অর্থাৎ- বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করা অনেকের ইচ্ছা ছিল বটে কিন্তু জাত্যাভিমান ত্যাগ করে ছােটজাতের সাথে মিশে এক সাথে হরিনাম সংকীর্ত্তন করতে হবে, এজন্য কেউ বৈষ্ণব হতে চাচ্ছে না। তুমি বলেছিলে- যে নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি, নামের সহিত আছে আপনি ‘শ্রী হরি’ অর্থাৎ- কৃষ্ণনাম ও কৃষ্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, তােমরা নিষ্ঠার সাথে কৃষ্ণকে ভজনা কর।

মানুষ কৃষ্ণ নামের মহিমায় ক্ষণেকের জন্য নামের আনন্দে আপ্লূত হচ্ছে বটে কিন্তু মানুষের মধ্যে সেই নিষ্ঠাভাবের অভাব। সবাই কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছে কিন্তু আচার ভ্রষ্ট হয়ে ক্রমে ক্রমে আবার অনাচারে ভরে যাচ্ছে।

তােমার আদর্শের অনুসারী বৈষ্ণবগণ উদাসীনের ন্যায় হরিনাম সংকীর্ত্তন করতে করতে দুবাহু তুলে নাচলেও পারিবারিক ও সমাজ জীবনে এর কোন প্রভাব পড়ছে না, কারণ সংসারাবদ্ধ জীবের জন্য এতে কোন বিধান নেই। ডাের কৌপিন পড়ে মাথায় চৈতন্য রেখে বৈষ্ণব হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

‘বাউল কে কহিও কাজে নাহিক আউল’ অর্থাৎ- উদাসীনতার আর প্রয়ােজন নেই, তুমি মায়ামুগ্ধ সংসারাবদ্ধ জীব নারী পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই যাতে এক সাথে ঈশ্বরের ভজন পূজন করতে পারে তার বিহিত ব্যবস্থা একটা কর।

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু অদ্বৈত আচার্য্য কর্তক প্রেরিত এই তরজা প্রহেলিকাটি শুনে মুদুভাবে একটু হাসলেন এবং চুপ করে থাকলেন। ঐ প্রহেলিকার সারমর্ম গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ব্যতিরেকে তখন আর কেউ বুঝতে পারেনি, সেই দিন থেকেই মহাপ্রভু চিন্তা করতে লাগলেন সত্যিই তাে আমি সংসারে মায়ামুগ্ধ জীবের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য কিছু করিনি বিবাহিত স্ত্রী ও মাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমি ডাের কৌপিন পরে সন্ন্যাসী হয়ে, যে ধর্মমত প্রচার করেছি তাত সবাই গ্রহণ করতে পারবে না, সত্যিই আমার এটা ভুল হয়েছে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতি বছর পণ্ডিত জগদানন্দকে নদীয়ায় পাঠিয়ে মায়ের খোঁজ খবর নিতেন এবং মায়ের জন্য বস্ত্র ও জগন্নাথদেবের প্রসাদ পাঠাতেন-

এসব বস্তব মাতাকে দিও, এসব প্রসাদ। দণ্ডবৎ করি ক্ষমাইহ অপরাধ। তার সেবা ছাড়ি করিয়াছি সন্ন্যাস। ধর্ম নহে কৈল আমি নিজ ধর্ম নাশ। তার প্রেমাবস আমি তারি সেবা ধর্ম। তাহা ছাড়ি করিয়াছি বাতুলের কর্ম। বাতুল বালকের মাতা নাহি লই দোষ। এত জানি মাতা মােরাে মানিবে সন্তোষ। কি কার্যে সন্ন্যাসে মোর প্রেম নিজ ধন। যে কালে সন্ন্যাস লইনু ছন্ন হইল মন।
(চৈতন্য চরিতামৃত-মধ্যলীলা)

সন্ন্যাসী হওয়া যে ভুল হয়েছিল, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তা নিজেই স্বীকার করে গেছেন।

চৈতন্য মহাপ্রভু নিত্যানন্দকে আরও বলেছিলেন-

এতেক আমার বাক্য সত্য যদি চাও। তবে তুমি অবিলম্বে গৌড় দেশে যাও। দেখি স্থান সুঠান সুন্দর খড়দহ। নিত্যানন্দেরে কহিলেন এথা তুমি রহ। রহ অধিকারী হই তারহ জগতে। ইচ্ছা যে করিও বিভা মিলব পশ্চাতে। বসুধা-জাহ্নবী নামে লক্ষ্মী-স্বরসতী। করিহ দুহারে বিভা পূর্বের রেবতি। শুন শুন নিত্যানন্দ প্রভুর বচন। পরিণয় করি কর অপত্য সৃজন।
(চৈতন্য ভাগবত অন্ত্য)

অর্থাৎ- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিত্যানন্দকে বিবাহ করে সংসারী হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ সমাজ জীবনে প্রতিফলিত না হওয়ার কারণ- পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্য্য কর্তৃক প্রেরিত তরজা প্রহেলিকাটি শুনে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হঠাৎ একদিন সকলের অজান্তে-ই অন্তর্ধান (মতান্তরে আত্মগােপন) করলেন।

কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ অনুসারে যদি ব্রাহ্মণ্যবাদ জাতিভেদ, বর্ণভেদ, কৌলিন্য প্রথা, অস্পৃশ্যতা বিলুপ্ত হত, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যদি মানুষের অধিকার নিয়ে ধর্ম-কর্মে অধিকার পেত, তাহলে ইংরেজ শাসনামলে খৃষ্টান মিশনারীরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দলে দলে খৃষ্টান বানাতে পারত না এবং কর্তাভজা ধর্মের আবির্ভাব ও প্রচারের প্রয়ােজন হত না।

মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বা রহস্যময় আত্মগােপনের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে হিন্দুর ধর্মীয় ও সমাজ ব্যবস্থা কতক গুলি কারণে- যথা পূর্বং- তথা পরং অর্থাৎ যা ছিল তাই হয়ে গেল। কারণসমূহ-

১. স্মার্ত, মায়াবাদী ও গােড়া ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা শুরুতেই মহাপ্রভুর আদর্শ ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিরূপ ধারণা পােষণ করে এর বিরােধিতা করত, আর মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর পুনরায় তারা আরও বেশি বিরােধিতা করতে থাকে।

গােড়া ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা সহযােগিতা না করে বিরােধিতা করায় সমাজ জীবনে তার খুব একটা প্রতিফলন হয়নি। গােড়া ব্রাহ্মণরা যে মহাপ্রভুর বিরােধিতা করত শ্রীমদ্ভাগবতে তার উল্লেখ আছে। চাপাল, গােপাল নামে বিপ্র ব্রাক্ষণ দূরাচার, মহা অপরাধী নিন্দা করিত তােমার।
-শ্রীমদ্ভাগবত ১১ স্কন্ধ, ৮৯১ পৃষ্ঠা, বেণী, মাঃ, শীঃ প্রকাশিত।

২. মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করায় সংসারী মানুষের সাথে তার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল এবং তার আদর্শে অনুপ্রাণিত বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বিশেষ বিশেষ একনিষ্ঠ ভক্ত রূপ- সনাতন প্রমুখ গোঁসাইরা ছিল সংসার ত্যাগী, তাই সমাজে এদের কোন প্রভাব ছিল না, এজন্য মহাপ্রভুর লীলা অবসানের পর সমাজ জীবনে মহাপ্রভুর আদর্শ বাস্তবায়নে এরা খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনি।

৩. মহাপ্রভু তার ভক্তদের বলতেন- ‘ঘরে ঘরে গিয়া আজ কর এই ভিক্ষা, লহ কৃষ্ণ, কহ কৃষ্ণ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা। -চৈতন্য চরিতামৃত মধ্য।

কিন্তু মহাপ্রভুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ভক্তরা স্থান বিশেষে মনের আনন্দে হরির নাম সংকীর্তন করলেও পারিবারিক জীবনে ছিল তারা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সমাজপতিদের আধিপত্যের কারণে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত ব্যক্তিগণ বৈদিক আচারে পূজা পার্বণে ব্যস্ত থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদকেই গ্রহণ করেছিল, তাই সমাজ জীবনে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রমাণ তৎকালীন সময়ে নিম্ন ও উচ্চবর্ণ হিন্দু যারা কৃষ্ণমন্ত্র গ্রহণ করে বৈষ্ণব হয়েছিল, মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর তারাও ব্রাহ্মণের ন্যায় নিম্নবর্ণের হিন্দু শূদ্রদের অস্পৃশ্য মনে করে ঘূনা করতে লাগল।

বৈষ্ণব ধর্ম তথা কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ গােত্রের যে মিলন হয়নি তার জলন্ত প্রমাণ হচ্ছে- ১৫৩৩ খ্রীঃ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর হতে সতীমা আবির্ভাব কাল ১৭৩৫খ্রীঃ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০২ বছর, তার পর বৃটিশ খৃষ্টানদের শাসনাধীন থেকে ১৯৪৭ খ্রীঃ পাক-ভারত স্বাধীন হওয়া, ভারতবর্ষ থেকে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত দুই শতাধিক বছর, মােট ৪০০শত বছরেরও অধিককাল পর্যন্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অস্পৃশ্য ভাবে দেখা হত।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার পর পাঁচশতাধিক বছর অতিবাহিত হয়েছে, সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুদের প্রচেষ্টায় যতগুলি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশ-ই শিব মন্দির, দূর্গা মন্দির, কালী মন্দির কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, গৌরাঙ্গ মন্দির নেই বললেই চলে, তার প্রমাণ গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে মন্দির পরিক্রমা করলে সহজেই বােঝা যায়।

নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, সাত্বিকভাবে জীবন যাপন ও সাত্ত্বিক খাদ্য গ্রহণ করে, এক-ই কৃষ্ণনাম (১৬ নাম বত্রিশ অক্ষর) জপ, কীর্তন করা সত্বেও উচ্চবর্ণ হিন্দুরা তাদেরকে নামযজ্ঞের আঙ্গিনায় কীর্তন করতে দিত না এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর বিগ্রহ এমনকি মন্দিরও স্পর্শ করতে দিত না কিন্তু বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শের পরিপন্থী, কারণ বংশগত ব্রাহ্মণ দিয়ে দেব-দেবীর পূজা করার অর্থ হল ব্রাহ্মণ্যবাদকেই গ্রহণ করা।

কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ অনুসারে যদি ব্রাহ্মণ্যবাদ জাতিভেদ, বর্ণভেদ, কৌলিন্য প্রথা, অস্পৃশ্যতা বিলুপ্ত হত, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যদি মানুষের অধিকার নিয়ে ধর্ম-কর্মে অধিকার পেত, তাহলে ইংরেজ শাসনামলে খৃষ্টান মিশনারীরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দলে দলে খৃষ্টান বানাতে পারত না এবং কর্তাভজা ধর্মের আবির্ভাব ও প্রচারের প্রয়ােজন হত না।

বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও জাতীয়তা বােধ এবং আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর কারণে জাতিভেদ অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। পাক-ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারী প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হওয়ায় সমাজে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের একছত্র আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে গেছে, এ কারণেও জাতিভেদ প্রথা শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

স্রোতে গা ভাসান দিয়ে যেথা খুশি সেথা যা, এরূপ মনভাবাপন্ন দরিদ্র-অশিক্ষিত-স্বধর্ম সম্মন্ধে অজ্ঞ-বহুদেবতাবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বংশগত জাতিভেদের অভিশাপে জর্জরিত হিন্দু জাতিকে ইংরেজ শাসনামলে খৃষ্টান মিশনারীরা যখন খৃষ্টান বানানাের কাজে তৎপর ছিল-

তখনও গােড়া ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা ছিল নির্বাক, তখন এর বিরুদ্ধে যে সকল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি ও তরুণের দল এগিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে অক্ষয় কুমার দত্ত, রাজা রামমােহন রায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিরাই অন্যতম।

স্বামী বিবেকানন্দসহ বেশ কিছু তরুণ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের উপদেশ মত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের সাথে মিশে প্রমাণ করেছিলেন এরাও মানুষ, এদের মধ্যেও সেই এক-ই পরমাত্মা রূপী ঈশ্বর আছে। আর অক্ষয় কুমার দত্ত, রাজা রামমােহন রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রচলিত বেদ বিধানের বিপরীতে বেদ-বেদান্তের আলােকে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে বিরত করার জন্য সর্বাঙ্গীন ভাবে চেষ্টা করেছিলেন।

তবে প্রাথমিক ভাবে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা থেকে কিছুটা বিরত করতে পারলেও জাতিভেদ ও বহুদেবতাবাদ বিষয়ে বেশীদূর এগােতে পারেননি, কারণ- জাতিভেদ, হিন্দুদের সহজাত প্রবৃত্তি, হিন্দুর ঘরে জন্ম হলে-ই জাতিভেদ যেন আপনা আপনিই এসে যায়, এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় যেন হিন্দুদের জানা নেই।

জাতিভেদ শিথিল হওয়ার প্রধান কারণ- বর্তমান কালে কতকগুলি কারণে জাতিভেদ অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে, তবে এটা কোন বর্ণ বা ব্যক্তির অবদান নয়, কারণসমূহ গুলি হচ্ছে- গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই জাতিভেদ শিথিল হওয়ার প্রধান কারণ।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ‘সবার জন্য শিক্ষা এই নীতি গ্রহণ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরকারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অতিদ্রত বিদ্যাশিক্ষার প্রসার ঘটছে, শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কার মুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের আধিপত্যবাদ ও জাতিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে মানুষ মানুষের কাছাকাছি হচ্ছে।

বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও জাতীয়তা বােধ এবং আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর কারণে জাতিভেদ অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। পাক-ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারী প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হওয়ায় সমাজে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের একছত্র আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে গেছে, এ কারণেও জাতিভেদ প্রথা শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত যৌতুক প্রথার কারণে বর্তমানে কন্যা সন্তান বিয়ে দেওয়া একটি সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, এ জন্য কন্যা সন্তানের অভিভাবকগণ অসমবর্ণে কন্যা সন্তান বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, এ কারণেও জাতিভেদ প্রথা ক্রমে ক্রমে শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

উপরােক্ত কারণ গুলাে ছাড়াও, ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পরম পূজনীয় মহাপুরুষগণের আবির্ভাব হয়েছিল ঐ সব মহাপুরুষগণ জাতিভেদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং জাতিভেদ প্রথা নিরসনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

যেমন- রামানুজ, তুলসী দাস, গুরুনানক, মহাবীর, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রবর্তক ঠাকুর আউলচাঁদ এবং আরও অনেকে। এসব আদর্শ পুরুষগণ জাতিভেদ নিরসনের জন্য যে আদর্শ রেখে গেছেন তার ধারাবাহিকতায় ক্রমে ক্রমে জাতিভেদ প্রথা শিখিল হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা ধর্মের আদর্শ তৎকালীন সময়ে জাতিভেদ ও কু-সংস্কার নিরসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সে ধারা এখনও অব্যহত আছে।

ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাব>>

……………..
‘সতীমা ও সত্যদর্শন’ বই থেকে সংগৃহীত

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা ধর্মের ইতিহাস
ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাব
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তদের বিশ্বাস
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষা গ্রহণ
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দশ আজ্ঞা
সতীমা কে?
শূদ্র কারা?
ঘোষপাড়ার ডালিম তলা ও হিমসাগরের মাহাত্ম্য
কর্তাভজার বাইশ ফকির
আউলচাঁদের তিরােধান
দুলালচাঁদ
সতীমায়ের উপদেশ বাণী
ঘোষপাড়ার রথযাত্রা উৎসব
সতীমার তিরােধান
কর্তাভজা ধর্মের মূলস্তম্ভ

ত্রিশ ধারা

Related Articles

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • অমিতাভ বিশ্বাস মণিরামপুর পৌরসভা যশোর। , বৃহস্পতিবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ @ ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

    জয় গুরু সত্য ঢ়

    • ভবঘুরে , শনিবার ১২ মার্চ ২০২২ @ ৬:৪৫ অপরাহ্ণ

      জয়গুরু

      • অমিতাভ বিশ্বাস মণিরামপুর পৌরসভা যশোর। , শুক্রবার ২৭ মে ২০২২ @ ১২:৫০ অপরাহ্ণ

        জয় কর্ত্তামা জয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!