ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁইজি

লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ

-মূর্শেদূল মেরাজ

আসলে ভালোলাগা-ভালোবাসার বিষয়টাই এই রকম। যার সাথে যার মনের মিল হয়ে যায়। তার জন্য জীব তার সর্বস্ব ত্যাগ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। প্রেমে পরলে প্রেমিক তো লীন হবেই। সেটাই রীতি। সেটাই বিধি। সাঁইজি বলেছেন-

ভাবের উদয় যেদিন হবে।
হৃদকমলে সে রূপ ঝলক দিবে।।

ভাবশূন্য হইলে হৃদয়
বেদ পড়িলে কী ফল হয়,
ভাবের ভাবি থাকলে সদাই
গুপ্ত-ব্যক্ত নীলা সব জানা যাবে।।

দ্বিদলে সহস্র দল
একরূপে সাঁই করে আলো,
সেইরূপে যে নয়ন দিল
মহাকাল শমন তার কী করিবে।।

অদেখা ভজনা করা
আঁধার ঘরে সর্প ধরা,
লালন বলে, ভাবুক যারা
জ্ঞানের বাতি জ্বেলে চরণ পাবা।।

অনুরাগী শব্দের সহজতম অর্থ হতে পারে ‘প্রেমিক’। যদিও প্রেমিক শব্দটা শব্দজগতের সবচেয়ে জটিল ও রহস্যময় শব্দের একটি। প্রেমিক হওয়া মোটেও সহজ নয়। সাধারণ ভাবে আমরা এই শব্দটির বহুল ব্যবহার করলেও। এর রয়েছে গুঢ় অর্থ। যে সে প্রেমিক হতে পারে না।

প্রেমিক সেই হতে পারে, যে প্রেমকে ধারণ করতে পারে। আর প্রেম তো সাধারণ জিনিস নয়। আমরা সাধারণ মানুষ অনেক সময়ই আবেগ আর প্রেমকে গুলিয়ে ফেলি। আবেগ-বিবেকের ঊর্দ্ধে উঠে শুদ্ধচিত্তে কামনা-বাসনা রহিত হয়ে বৃহতের যে ভালোবাসা।

খুব সাধারণ অর্থে তাকে প্রেম বলা যায়। আর সেই প্রেমে যে ডুবতে পারে সেই তো হয় প্রেমিক। আর এমনি এক প্রেমের প্রেমিক হওয়ার পথের যাত্রী হলো অনুরাগী। যে অনুরাগ ধারণ করে। অভিধানে অনুরাগীর আরো অনেকগুলো অর্থ পাওয়া যায়-

অনুগত, অনুরত, অনুরক্ত, অনুরাগী, অনুবিদ্ধ, অনুরঁজিত, অভিরত, অত্যাসক্ত, আকৃষ্ট, আসক্ত, আশ্লিষ্ট, উৎসর্গীকৃত, উপাসক, একনিষ্ঠ, কৌতূহলী, জড়িত, নিযুক্ত, নিরত, নৈষ্ঠিক, স্বার্থসম্পন্ন, স্নেহময়, স্নেহশীল, স্নেহপূর্ণ, স্নেহব্যঞ্জক, পক্ষপাতপূর্ণ, প্রসক্ত, প্রীতিপূর্ণ, প্রণয়পূর্ণ, প্রেমপূর্ণ, প্রেমময়, বশীভূত,সম্বদ্ধ, ভক্ত, ভালবাসে এমন, নিবদ্ধ, সদয়, সংযুক্ত, সংসক্ত, ধর্মোপাসক, রত প্রভৃতি।

অনুরাগীকুলই সে সম্ভাবনার দুয়ার। যারা নিজেদের উজার করা প্রেম-ভক্তি-শ্রদ্ধা দিয়ে প্রেমের মানুষের জন্য প্রেম ধারণ করে ঘুরে বেড়ায় জগৎময়। আর যার জন্য থাকে না কোনো দলিল-দস্তাবেজ। থাকে না কোনো পদবী-উপাধি।

অনুরাগ-অনুরাগী কি তা এক কথায় বোঝানো অসম্ভব। এতো সব প্রতিশব্দের ভেতর দিয়ে যদি যৎকিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায় তাই এই শব্দগুলো উল্লেখ করা হলো। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, অনুরাগ এমন এক প্রেমের কথা বলে।

যে প্রেম চাওয়া পাওয়ার অনেক ঊর্দ্ধে। যে প্রেমে, প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম-ভালোবাসা না পেলেও অকাতরে ভালোবেসে যাওয়ার মনোভাব বহন করে। সে জন্য জীবনও বাজি রাখে। নিরবে ভালোবেসে যায়। প্রয়োজনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতেও পিছপা হয় না।

তবে ভক্তের যেমন শ্রেণীভেদ আছে। তেমনি অনুরাগীরও আছে নানান শ্রেণীভেদ। সকলেই রাধার হতো অনুরাগী আর হতে পারে কই? তবে অনুরাগীদের মধ্যে সে সম্ভাবনা থেকেই যায়। যারা প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে ভালোবাসতে পারে। প্রেম করতে পারে।

অনুরাগীকুলই সে সম্ভাবনার দুয়ার। যারা নিজেদের উজার করা প্রেম-ভক্তি-শ্রদ্ধা দিয়ে প্রেমের মানুষের জন্য প্রেম ধারণ করে ঘুরে বেড়ায় জগৎময়। আর যার জন্য থাকে না কোনো দলিল-দস্তাবেজ। থাকে না কোনো পদবী-উপাধি।

লালন ফকিরকে বেশিভাগ মানুষ চেনে-জানে-ভালোবাসে তার গানের জন্য। যদিও ভক্তকুলের কাছে তা গান নয় ‘জ্ঞান’। তবে সাধারণ অনুরাগী শ্রেণীর কাছে লালন ফকিরের গান অনেকক্ষেত্রেই বিনোদনের মাধ্যম মাত্র। তাই লালন ফকির বলেছেন-

প্রেম পিরিতের উপাসনা।
না জানলে সে রসিক হয় না।।

প্রেম প্রকৃতি স্বরূপশক্তি
কামগুরু হয় নিজপতি,
মন রসনা অনুরাগী না হলে
ভজন সাধন হবে না।।

হরে যোগী-ঋষি মুণিগণে
বসে আছে যোগ সাধনে,
শুদ্ধ অনুরাগী বলে
পেয়েছে কেলে সোনা।।

প্রেমের বাণে মধু চেনে সাধুজন
শুদ্ধ অনুরাগী যারা ঊর্ধ্বদেশে করে গমন,
লালন বলে জ্ঞানী না হলে
নিগূঢ় তত্ত্ব জানবে না।।

একবার এক সাধক বলেছিল, “বাপ! ভালোলাগা থেকেই তো ভালোবাসা হয়। আবার রাগ-ক্ষোভ-হিংসা-ঘৃণা থেকেও ভালোবাসা হয়। আসলে সংস্পর্শে আসলেই ভালোবাসা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সংস্পর্শ মানে বুঝো তো বাপ? সংস্পর্শ হইলো পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয় দিয়া অনুভব আর মন-বুদ্ধি-অহঙ্কার দিয়ে বিবেচনা।

এর মাঝে কেউ বা কোনো তত্ত্ব আসলে তার প্রেমে পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমার কথাই ধরো। আমার যিনি গুরু। আমার মুর্শিদ। তার নাম-ডাক শুইন্যা গেলাম বেটারে পিডাইতে। আমার এলাকায় শরিয়ত মানবো না এমন হইতে দিমু কেন?

গিয়া তো তার দরবার প্রায় ভাইঙ্গা সারছি। সব দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেলো। আমার তখন বিশাল প্রতাপ এলাকায়। বেটারে মাইরাই ফালামু সিদ্ধান্ত নিয়াই গেছিলাম। কিন্তু কি থেইক্কা কি হইলো বাপ। তার চরণ ধরেই জীবন কাইটা গেলো।

তার গোলামী কইরাই কেবল ক্ষমা-ভিক্ষা চাই। জীবনে যা যা কইরা ফেলছি তার তো আর ক্ষমা নাই বাপ। তাই সাঁইরে বলি, এমন শাস্তি দিও গো সাঁই যাতে সইতে পারি। তাই বাপ আগে থেইক্ক্যা কিছুই বলা যায় না। কার সাথে তার পিরিত হইবো। এই জগতে তা কে কইতে পারে।”

ধরুন, কোন চিত্র নায়ক/নায়িকা বা গ্ল্যামার জগতের কেউ মারা গেলো। সেই শোক সাইতে না পেরে কত জন আত্মহত্যা করে বসলো। আমরা সেই সব খবর পরে খিল্লি উড়ালাম। হাসি-তামাসা করলাম। ভাবলাম, পাগল। আসলেই পাগল। প্রেমের পাগল।

এমন কি যারা এই সকল প্রথা-মত-পথ মানেন না-বিশ্বাস করেন না তারাও লালনে আশ্রয় খোঁজেন। ফকির লালন আসলে অবারিত দ্বার। সর্বসময় প্রাসঙ্গিক। সমকালীন। এবং তাঁর সহজ ভাষার অন্তনির্হিত গভীর লুকায়িত তত্ত্ব। তাকে আরো বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।

যার সাথে কোনোরূপ দেখা নেই, জানা নেই, পরিচয় নেই। হয়তো জীবনে কখনো দেখাই হবে না। জানাই হবে না। তারপরও কি গভীর অনুরাগ। সেই অনুরাগে নিজের এতো সাধের জীবনও ন্যাশ করে দিতে দ্বিধা করে না। আবার সেই অনুরাগীদের যারা সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারে।

তারাই হয়তো অন্য কোনো সেলেব্রেটির প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে। তাই সাধারণ অনুরাগীদের উপর সকল সময় আস্থা রাখা যায় না। বাজারে নতুন পণ্য আসলে যেমন পুরানো পণ্য বাতিল করে অনেকেই নতুন মোড়কের চকচকে-ঝকঝকে পণ্যে মনোনিবেশ করে থাকে।

তেমনি সাধারণ অনুরাগীকুলও প্রেমিকা পাল্টাতে বিশেষ সময় নেয় না। আবার অনেকে সাধারণ অনুরাগী থেকে ধাপে ধাপে হয়ে উঠে প্রকৃত অনুরাগী। যারা কেবল আবেগের বশে নয় মন-প্রাণ দিয়েই প্রেমিকার জন্য সকল কিছু করতে পারে।

বিষয়টা বললে বিশেষ দম্ভ হবে না, ফকির লালন সাঁইজির আখড়ায় যত সৃজনশীল ও বিভিন্ন মাধ্যমের মানুষ একত্রিত হয়। তা অন্য কোনো দরবারে বিরল। বিরল বলছি এই কারণে যে, এখানে বাংলা অঞ্চলের অন্যান্য প্রায় সকল তরিকার, মতাদর্শের মানুষই জড়ো হন।

এমন কি যারা এই সকল প্রথা-মত-পথ মানেন না-বিশ্বাস করেন না তারাও লালনে আশ্রয় খোঁজেন। ফকির লালন আসলে অবারিত দ্বার। সর্বসময় প্রাসঙ্গিক। সমকালীন। এবং তাঁর সহজ ভাষার অন্তনির্হিত গভীর লুকায়িত তত্ত্ব। তাকে আরো বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।

আর এই রহস্য তাঁর প্রতি আকর্ষণ চির অম্লান করে তুলেছে। এই রহস্যের ভেদ বুঝতে গিয়ে অনেকেই অনুরাগী থেকে অনুসারী হয়ে যায়। হয়ে যায় ভক্ত-শিষ্য। আবার অনেকে অনুরাগী থেকেই দূর থেকে প্রেম নিবেদন করে যায়।

(চলবে…)

<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!