ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁই

লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই

-ডক্টর বেগম জাহার আরা

লালনের গানে বিশ্বাস, উপলব্ধি ও অনুভূতি যেখানে গাঢ়তর হয়েছে, সেখানে কবি হয়েছেন ভাবুক, আধ্যাত্মিক চেতনায় মগ্ন। দেহের মধ্যে তিনি অরূপ রতনকে পেয়েছেন সেখানে।

এই অরূপ রতনের গাঢ়বন্ধবোধই লালনের আধ্যাত্মচেতনা। ভাবের পরিমণ্ডলে সেই অরূপকে তিনি অনুভব করতে চেয়েছেন নানাভাবে। তিনি বলেছেন-

সাধ্য কিরে আমার সেরূপ দেখিতে।
অহোনিশি মায়া ঠুসি জ্ঞান-চোখেতে।।

অর্থ্যাৎ হৃদয়ের গহনে সেই অরূপ রতন আছে জেনেও লালনের তৃষ্ণা সদা কষ্টকর। তিনি আরো কাছে থেকে দেখতে চান তাঁকে। তিনি বলেন-

‘না জানি কেমন রূপ সে।’

লালন বিস্ময়ে অভিভূত হন এই ভেবে যে, এত কাছে যিনি থাকেন, এত দেহ-সম্পৃক্ত যাঁর উপলব্ধি, তাঁকে কেন আকার বা সাকারে অনুভব করা যাবে না?

তাঁর ধারণা- ‘লামে আলিফ লুকায় যেমন, মানুষে সাঁই আছে তেমন’।

সেই পরম অরূপ যে তাঁর সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি, এ ব্যাপারে লালনের দ্বিধা বা সংশয় নেই। তিনি বিলাপ করে তবু বলেন-

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
বাড়ির কাছে আরশী নগর
সেথায় এক পড়শি বসত করে।।

মরমী লালনের সেই অরূপ রতন পরম সত্তার খণ্ডরূপে দেহের মাঝেই বাস করে। তাঁকে জানার সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। কারণ তাঁকে চিনলে পরমকে চেনা যায়।

আচরণীয় জগতের মাঝে বাস করেও মুর্শিদ-ভজলে আত্মকে তথা ‘মূল ছাড়া সেই পরম ফুলকে’ জানা যায় না- এ আধ্যাত্ম কথা লালন-গীতিতে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে বারবার।

আত্মকে জানার ব্যাপারে তিনি বলেছেন- ‘আমি কি তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়’। এ আধ্যাত্মিক বাণীর সঙ্গে- ‘আত্মনং বিদ্ধি’ কিংবা ‘নো দাইসেলফ’ কথার কোনো পার্থক্য নেই।

এ ঘোরার শেষ নেই। ক্লান্তি এলেও মুক্তি নেই। মরমী কবি রবীন্দ্রনাথ যে বোধি তথা শক্তিকে স্মরণ করে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন- ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে, হে সুন্দরী’। প্রতিমুহূর্তে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নব নব উদ্ভাসে যার প্রকাশ, তাঁকে চিনে শেষ করা কি সম্ভব? কাছে থেকেও প্রবাসী তিনি।

আর এই আত্মকে জানলে সেই অখণ্ড আত্মার প্রচণ্ড জ্যোতি সম্পর্কে যে বোধি জন্মায়, তা মারেফাতের সর্বোচ্চ, যেখানে মনসুর হাল্লাজ প্রবেশ করেই উন্মাদ হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি সত্য’।

আত্ম সেখানে শুধু আবিষ্কৃত নয়, পরমাত্মার সঙ্গে মিশ্রিত। এ বিস্ময়কর দুর্গম বোধিতে পৌঁছানোর জন্যে লালন বলেন- ‘জানা যাবে মারেফতে, যদি মনের বিকার যায়’।

লালন-গীতির আধ্যাত্মচিন্তার বিচার প্রসঙ্গেই প্রশ্ন তোলা যায়- নিষ্কাম জগতের সেই দুর্গম বোধিতে কি লালন পৌঁছুতে পেরেছিলেন? তাঁর কি মনের বিকার বা স্বজ্ঞান-সত্তা বিলুপ্ত হয়েছিল? আত্মকে জানা সম্পন্ন হয়েছিল? যদি না হয়ে থাকে, তা হলে আধ্যাত্মিকতার কোন স্তরে তিনি বাস করতেন?

নিঃসন্দেহে বলা যায়, মনোময় জগতের পুষ্পিত পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেও বিশ্বাস আর অনুভূতির প্রগাঢ় আচ্ছন্নতায় তিনি কখনো পুরোপুরি নিমজ্জিত হতে পারেন নি। এই না পারার কারণ তাঁর দার্শনিক সত্তা। তাঁর যুক্তি ও আবেগহীন প্রখর বোধি তাকে স্থি’তি দেয়নি। বিশ্বচরাচরব্যাপী তিনি ঘুরেছেন মনে মনে।

এ ঘোরার শেষ নেই। ক্লান্তি এলেও মুক্তি নেই। মরমী কবি রবীন্দ্রনাথ যে বোধি তথা শক্তিকে স্মরণ করে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন- ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে, হে সুন্দরী’। প্রতিমুহূর্তে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নব নব উদ্ভাসে যার প্রকাশ, তাঁকে চিনে শেষ করা কি সম্ভব? কাছে থেকেও প্রবাসী তিনি।

রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন-

তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর,
তোমার অন্ত নাই গো, অন্ত নাই।।

কিন্তু তবু কবির হৃদয় তাতে শান্ত হয় না। অস্পষ্টতায় হাঁফ ধরে যায়। ছটফটিয়ে বলে ওঠেন- ‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।’

লালন বোঝা না বোঝার মধ্যে দোল খেয়েছেন। অরূপকে প্রকাশের এবং ইন্দ্রিয়ের আওতায় পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন বারবার। পরক্ষণেই বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে বলেছেন-

হায় চিরদিন পুষলাম
এক অচিন পাখি,
পাখি ভেদ পরিচয় দেয় না মোরে
ঐ খেদে ঝরে আঁখি।

আগেই বলা হয়েছে, লালনের আধ্যাত্মিক চেতনা গভীর। স্রষ্টার প্রকাশ তিনি সর্বত্র দেখতে পান। আত্মসমর্পণের বিষয়ও তাঁর মধ্যে আছে। কিন্তু কখনো পরমের সঙ্গে বিলীন হওয়া বা আত্মবিলুপ্তির অবোধ আকুলতা তাঁর নেই। তিনি চান পরম সত্তা বা তাঁর খণ্ডরূপে চিনতে ও বুঝতে।

এই স্বজ্ঞান বোধিই লালনের ঋজু দার্শনিকতা। বৌদ্ধ-তত্ত্বে নির্বাণ বা শূন্য লাভ তাঁর কাম্য ছিল না। লালন সংযমী, যুক্তিবাদী, চিন্তাশীল, মানবতাবাদী ও রিপুসচেতন সাধক।

নিষ্কাম প্রেমে লালনের মনোভাব কেমন, তা তাঁর ভাষাতেই বলা যায়-

কাম হলো সেই প্রেমের লতা,
কাম ছাড়া প্রেম পায় কি গতি।

আর এক গানে তিনি বলেছেন-

চিনি হওয়া মজা কি খাওয়া মজা।
দেখ দেখি মন কোনটা মজা।।

এ থেকে বোঝা যায়, নিষ্কাম প্রেম বা নির্জন শূন্য-চেতনা ছিল লালনের আদর্শ-বিরুদ্ধ দর্শন। অতএব বলা যায়, লালনের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা এবং অনুসন্ধিৎসা থাকলেও দার্শনিক লালনের পরিচয় এবং প্রকাশ অনেকগুণ বড় ও পরিব্যাপ্ত।

দার্শনিক লালনের কাছে পরম সত্তা মানবদেহে বাস করেও পৃথক সত্তারূপে পরিচিত। খণ্ড সত্তা যদি হয় মন, তাহলে পরম সত্তা সেই মনের ‘মানুষ’। খণ্ড সত্তা যদি হয় ফুল, তাহলে পরম সত্তা তার বেহেস্তি সুবাস। একটাতে আছে ইন্দ্রিয়ের স্বাদ, অন্যটাতে আছে অনুভবের তৃপ্তি।

লালন কোনোটাকেই তুচ্ছ করেন নি। তিনি দুটো চিন্তাকে একাকার করতে পারেন নি, দুটো সত্তার স্বরূপ খুঁজেছেন পাগলের মতো। বহু গানে বহুভাবে বলেছেন- ‘লালন ভেবে দিশে নাহি পেল’।

ঠিক এই কারণেই লালন-গীতির মধ্যে যে দর্শন ও অধ্যাত্মচেতনা আছে, তাকে পৃথক করা যায় না। ফুল আর সুবাসের উপমা আগেই দেওয়া হয়েছে, আবারও বলতে হচ্ছে- লালনের দর্শন হলো ফুল, তাঁর আধ্যাত্মচেতনা হলো সুবাস।

সম্পূরক চেতন হিসেবে লালন-গীতিতে উভয় চিন্তাধারা বাঙময়। তবে লালনের দর্শন কখনো কখনো গূঢ় আধ্যাত্মিক রহস্যের বাইরে রয়ে গেছে।

সেখানে শুধু কোরান ও হাদিসের বাণীর মাধ্যমেই ইসলামী আদর্শানুগত মৌলিক মূল্যবোধ এবং খোদার প্রেরিত পুরুষ ও তাঁর বাণী-ভিত্তিক আচার-আচরণের প্রতি মানুষকে সচেতন করে দেওয়া হয়েছে। যেমন-

আল্লা বল মনরে পাখি,
ভবে কেউ হবে না সাথের সাথী।।

এসব ক্ষেত্রে লালনের দর্শন সুবাসযুক্ত ফুল-কমলের মতো, যার প্রতিটি পাঁপড়িতে জীবনের প্রসন্নতা এবং আকর্ষণ। এ ধরনের গান অধিক জীবন-সম্পৃক্ত। আর তাই আপামর সবার কাছে লালনের সঙ্গীত অতি প্রিয়। দুর্বোধ্য আধ্যাত্মিকতা লালন-গীতিকে গ্রাস করতে পারে নি প্রাচীন সাহিত্যের বৌদ্ধ সাধনগীতি তথা সেই চর্যাগীতির মতো।

পূর্বসূত্রের জের ধরেই বলছি, অনেকের মতে লালন অনেকগুলো ধর্মমতকে সমন্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। অল্প পরিসরে এ কথা প্রমাণ করা বা না করা কোনোটাই সম্ভব নয়। তবে তাঁর গানে একেশ্বরবাদ, দ্বৈতবাদ, বহুত্ববাদ সব ধারণাই পাওয়া যায়। এ তাঁর উপলব্ধির ফসল।

লালনের আধ্যাত্মিকতা তাঁর একান্ত একটি জগৎ, কিন্তু লালনের দর্শন সবার জন্যে, লালন-গীতির অমৃত সকলের জন্যে। লালন-গীতির অমিয়ধারা যেন চৌম্বক শক্তিতে হৃদয়ের মূল ধরে টান দিতে পারে।

লালনের জ্ঞানের পরিধিও ছিল বিশাল-এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। হয়তো সে কারণেই তিনি ব্রহ্মবাদ বা বৈষ্ণবতত্ত্ব আলোচনা করে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, ধর্ম ও ভাবের কথা সব ধর্মেই আছে। সব ধর্মেই বলে- মানুষ হলো ধর্মের আধার।

তারই জন্যে ধর্ম, অর্থাৎ মানুষকে ভালোবেসেই স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করতে হবে। আর এসব তত্ত্বের অবতারণা তিনি করেছেন দার্শনিক বিশ্লেষণের জন্যে, সমন্বয় সাধনের প্রসঙ্গ এখানে হয়তোবা ছিল নগণ্য।

পরিশেষে বলবো, লালন ছিলেন আমরণ জ্ঞানান্বেষী। দর্শন ছিল তাঁর বুদ্ধির সামগ্রী, স্বজ্ঞান বোধির নন্দন-চেতনা। আনন্দমূর্তি আর আধ্যাত্মিকতা ছিল তাঁর হৃদয়ের সামগ্রী, স্বজ্ঞান বোধির দুর্বোধ্য জগতের পরম বিস্ময়।

লালনের আধ্যাত্মিকতা তাঁর একান্ত একটি জগৎ, কিন্তু লালনের দর্শন সবার জন্যে, লালন-গীতির অমৃত সকলের জন্যে। লালন-গীতির অমিয়ধারা যেন চৌম্বক শক্তিতে হৃদয়ের মূল ধরে টান দিতে পারে।

তাই আমাদের অনেকের বিচারে লালন-গীতির আধ্যাত্মিকতার চেয়ে লালন-গীতির দর্শন বহুগুণে অনুসৃত, প্রসারিত ও জীবন-সম্পৃক্ত।

(সমাপ্ত)

<<লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক

…………………………
আরো পড়ুন:
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই

…………………………………..
লালন মৃত্যু-শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ- ১৯৯২, পৃ ১১২-১১৯।

…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Rashidul Islam , সোমবার ৩১ আগস্ট ২০২০ @ ৯:৫৭ অপরাহ্ণ

    লালন ছিলেন আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ। জয়গুরু।

    • ভবঘুরে , সোমবার ৩১ আগস্ট ২০২০ @ ১০:১৮ অপরাহ্ণ

      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!