ভবঘুরেকথা
মোহাম্মদ আলী ফকির

মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: তিন

-ফিরোজ এহতেশাম

মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে শিরোনামে ফকিরকুলের শিরোমনি ফকির লালন সাঁইজির রওজার প্রধান খাদেম মোহাম্মদ আলী ফকিরের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ফিরোজ এহতেশাম। আজ প্রকাশিত হচ্ছে সাক্ষাৎকারটির তৃতীয় পর্ব-

[ফকির মো. আলী শাহর সাক্ষাৎকার]

আলী: উনি সাধু ছিলেন না? যেহেতু উনি সাধু ছিলেন সাধুসঙ্গ করতেন। সাধুসঙ্গের ট্রেডিশন আছে সেই প্রথম থেকে। এর কাহিনী বলতে গেলে অনেক সময়ের ব্যাপার।

ফিরোজ: সংক্ষেপে বলেন।

আলী: সংক্ষেপ… সাধুসঙ্গ নিয়ে একটা বইতে পড়েছিলাম যে, সন্তান যখন মায়ের উদরে সাত মাসের হয় তখন পরমাত্মা উপস্থিত হয় জীবাত্মার কাছে। জীবাত্মার পাশে উপস্থিত হয়ে বলে যে, হে জীবাত্মা, তোমার এবারে জম্বুদ্বীপে যেতে হবে।

ফিরোজ: কোথায়?

আলী: জম্বুদ্বীপ। এই জম্বুদ্বীপ হলো পৃথিবী।

ফিরোজ: পৃথিবী হচ্ছে জম্বুদ্বীপ?

আলী: একটা নতুন ভাষা শিখলেন।

ফিরোজ: জম্বুদ্বীপ কেন বলা হয় পৃথিবীকে?

কিন্তু আমি আপনাকে পাব কোথায়? আপনাকে ছেড়ে তো আমার যেতে ইচ্ছে করে না। আপনাকে কোথায় পাব আমি? বলে, আমাকে পাবা। কোথায় পাব? সাধুসঙ্গে। সাধুসঙ্গে সাধুবেশে আমারে পাবা। তো কী করে চিনব আমি তোমারে?

আলী: এটাকে জম্বুদ্বীপই বলা হয়। এটা খুব খারাপ জায়গা না? তো যখন ওই সাত মাস বয়স তখন ওই পরমাত্মা এসে জিজ্ঞাসা করে জীবাত্মাকে, বলে যে, তোমাকে এবার যেতে হবে জম্বুদ্বীপে। এ বলে যে, না, আমি যাব না। ওখানে বহুত কষ্ট, বহুত লোভ, বহুত লালসা, আমি ওইখানে যাব না।

তো যদি না যেতে চাও তুমি মাতৃহন্তা হয়ে যাবা। তার মানে তুমি পেটের মধ্যে মরে যাবা। তো পেটের মধ্যে মরে গেলে মা বাঁচে? বাঁচে না। তুমি মাতৃহন্তা হয়ে যাবা। এত সব বোঝানোর পর জীবাত্মা বলছে যে, হ্যাঁ, ঠিক আছে আমি রাজি আছি।

কিন্তু আমি আপনাকে পাব কোথায়? আপনাকে ছেড়ে তো আমার যেতে ইচ্ছে করে না। আপনাকে কোথায় পাব আমি? বলে, আমাকে পাবা। কোথায় পাব? সাধুসঙ্গে। সাধুসঙ্গে সাধুবেশে আমারে পাবা। তো কী করে চিনব আমি তোমারে?

বলে, দিব্যচক্ষুতে চিনবা। তো দিব্যচক্ষু তো বুঝিনে। তোমার গুরু খুলে দিবে। তোমার গুরুই তোমার দিব্যচক্ষু খুলে দিবে। তখন তুমি আমাকে দেখতে পাবা। তো তারপরে তো ভূমিষ্ঠ হয়।

ফিরোজ: ও, ওইটা জানার পরে ভূমিষ্ঠ হয়? তারপর সাধুসঙ্গ…

আলী: সাধুসঙ্গটা হয় কিন্তু খুব নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে।

ফিরোজ: বাল্যসেবায় কী দেয়?

আলী: বাল্যসেবায় পায়েশ দেয়।

ফিরোজ: শুধু পায়েশ দেয়?

আলী: আরও অনেক কিছু দেয়ার কথা, কিন্তু সংকুলান হয়ে ওঠে না।

ফিরোজ: মূলত পায়েশ তারপর অন্য কিছু…

আলী: অনেক মানুষ তো। পায়েশ দেয়, ফল দেয়, তারপর ধরেন…

ফিরোজ: মধু…

আলী: মধু দেয়।

ফিরোজ: আর দুপুরে মানে পূর্ণসেবায়?

আলী: দুপুরে মাছ-ভাত, সবজি, ডাইল, দধি।

ফিরোজ: বাউলদের টার্গেটের কথা বলতেছিলাম। বাউলধর্মের টার্গেটটা কী আসলে? বাউলরা কী করতে চায়?

আলী: ওই যে বললাম না, বাউলের সাধনা। বাউল… বা মানে বাতাস, উল মানে সন্ধান…

ফিরোজ: বাতাসের সন্ধান।

আলী: বাতাসের সন্ধান।

ফিরোজ: এটা করলে কী হয়?

আলী: আপনি বাউল। সাধারণ দৃষ্টিতে বলি। আপনি মুসলমান। নামাজ পড়লে কী হয়? সোয়াব আছে না? না পড়লে?

ফিরোজ: গুনাহ।

আলী: ওই রকম।

ফিরোজ: আপনার সম্পর্কে জানতে চাই, আপনার শৈশবকাল কীভাবে কাটছে? পড়াশুনা?

আলী: আমার শৈশব কী আমি ভালো বলতে পারব?

ফিরোজ: আপনার যতটুকু মনে আছে…

আলী: আমার শৈশব তো আমার বাবা-মা বলতে পারবে। তাই না?

ফিরোজ: হ্যাঁ। আপনার যতটা মনে আছে। কোন স্কুলে পড়ছেন?

আলী: আমি প্রথম আমাদের গ্রামে একটা প্রাইমেরি স্কুল আছে। সেটা ধরেন উনিশশ’ বায়ান্ন-টায়ান্ন মনে হয়। বায়ান্ন সালে মনে হয়, আমার মনে আছে। আমার জন্ম হচ্ছে উনিশ’শ সাতচল্লিশ কী আটচল্লিশ সালে।

ফিরোজ: কত দূর পড়াশুনা করলেন?

আলী: আমি পড়লাম, ১৯৬৮ সালে আমি ডিগ্রি পাস করলাম।

ফিরোজ: কোথা থেকে?

আলী: কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে। এর মাঝে আমাদের গ্রামে একটা প্রাইমেরি স্কুল ছিল, সেখান থেকে আমি পড়েছি। তারপরে মোহিনীমোহন বিদ্যাপীঠ, মিলপাড়াতে অবস্থিত, এখান থেকে আমি মেট্রিক পাস করেছি।

তারপরে আমি কুষ্টিয়ায় তখন সরকারি কলেজ হইছিল না, তখন ওই কলেজে পা দেই। পা দিয়ে আইএ ভর্তি হই।

ফিরোজ: কোন কলেজ?

আমার ছোটবেলায় গানের প্রতি আগ্রহ ছিল। কারণ আমার বাবা গান গাইতেন। আমার বাবার নাম ফকির গোলাম ইয়াসিন শাহ। আমার মা গোলজান ফকিরানী। উনিও দেহ রাখছেন। উনি বাড়িতেই আছেন। উনার সমাধি বাড়িতেই করা হয়েছে আরকি।

আলী: কুষ্টিয়া কলেজ, এখন তো সরকারি হয়েছে, তখন সরকারি ছিল না। দুই বছর লাগে আমার ইন্টারমিডিয়েট পাস করতে। তারপর আমি থার্ড ইয়ারে ভর্তি হই। এক বছর যেতে না যেতেই ওটা সরকারিকরণ করা হয়। এর ফলে আমি যে ডিগ্রি নেই সেটা সরকারিকরণ হয়ে গেল।

ফিরোজ: ছোটবেলায় আপনার গানের প্রতি আগ্রহ ছিল?

আলী: আমার ছোটবেলায় গানের প্রতি আগ্রহ ছিল। কারণ আমার বাবা গান গাইতেন। আমার বাবার নাম ফকির গোলাম ইয়াসিন শাহ। আমার মা গোলজান ফকিরানী। উনিও দেহ রাখছেন। উনি বাড়িতেই আছেন। উনার সমাধি বাড়িতেই করা হয়েছে আরকি।

আর আমার গান গাওয়ার প্রবণতা ছিল, গান গাইতাম ছোটবেলায়। আমি প্রাইমেরি স্কুলে গান গাইনি। তবে হাই স্কুলে, কলেজে আমি গান গাইতাম। বাবার একটা শখ ছিল, উনি বেহালা বাজাতেন। বেহালা বাজিয়ে গান গাইতেন উনি।

আমি বেহালা মোটামুটি বাজাতে পারতাম। এখন অবশ্য চর্চা নেই খুব একটা। কলেজে গিয়েও গান-টান গেয়েছি, নাটক-টাটকে অংশগ্রহণ করেছি। মোটামুটি আমি সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলতে হয়।

ফিরোজ: লালন কখন আপনাকে গ্রাস করল?

আলী: লালন তরিকায় উদ্বুদ্ধ হলাম যখন আমার বয়স ত্রিশ বৎসর। বাবার প্রেরণাতেই আমি সাঁইজির তরিকাতে আসি। আমার বাবা যেহেতু সাঁইজির তরিকাতে ছিলেন। ওই সুবাদেই আমার লালন তরিকাতে আসা।

ফিরোজ: তারপরে তো ৩৫ বৎসর…

আলী: হ্যাঁ, তারপরে তো ৩৫ বৎসর আমি কী করলাম আমি জানি না, সাঁইজি জানেন। তারপরে আমার গুরু আমাকে খেলাফত প্রদান করলেন। তার কিছুদিন পরেই আমি সাঁইজির সেবার উদ্দেশ্যে তার মাজারে আমার আসা।

ফিরোজ: আপনি তো খাদেম এখানকার…

আলী: হ্যাঁ, আমি মোটামুটি খাদেম বলেই পরিচিত।

ফিরোজ: মূল খাদেম…

আলী: মূল খাদেম, প্রধান খাদেম বলে পরিচিত। তবে আমি এটা মনুষ্য সমাজে বলি না। যারা দর্শক আসেন তাদের বলি না। খাদেম অনেক বড় মাপের কথা। আমি সাঁইজির চরণের একজন ঝাড়ুদার।

ফিরোজ: এটা আপনার বিনয়। লালনের সাধনায় কী আধ্যাত্মিকতার বিষয় আছে?

আলী: সবই আধ্যাত্মিকতা।

ফিরোজ: পুরোটাই?

আলী: পুরোটাই আধ্যাত্মিকতা। ১৬ আনার জায়গায় ১৭ আনাই আধ্যাত্মিকতা।

যেহেতু আমাদের নবীজিও অনেক বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। এই দৃষ্টিতে আমার মনে হয় উনি (লালন) তার কাজ ঠিকমতো করে চলে গেছেন। সাধনা করে গেছেন। এখন তো আমরা অনেক মুক্ত। যদিও সামাজিক চাপ আমাদের কিছুটা আসে বা আছে। কিন্তু তারপরেও আমরা সেই তুলনায় অনেক ভালো আছি।

ফিরোজ: এই আধ্যাত্মিকতাকে তিনি সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সাথে কীভাবে মিলাইতেন?

আলী: সামাজিক ক্ষেত্রে এই আধ্যাত্মিকতার বাণী পৌঁছাইতে, এই আধ্যাত্মিকতার জগতে বিচরণ করতে সামাজিক চাপ তো এসেছে। উনাকে অনেক বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই বাঁধা-বিপত্তিটা উনি কিছু মনে করেননি।

যেহেতু আমাদের নবীজিও অনেক বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। এই দৃষ্টিতে আমার মনে হয় উনি (লালন) তার কাজ ঠিকমতো করে চলে গেছেন। সাধনা করে গেছেন। এখন তো আমরা অনেক মুক্ত। যদিও সামাজিক চাপ আমাদের কিছুটা আসে বা আছে। কিন্তু তারপরেও আমরা সেই তুলনায় অনেক ভালো আছি।

ফিরোজ: আত্মিক সাধনা আর বাহ্যিক কর্মের মধ্যে তার যোগসূত্রটা কী ছিল?

আলী: আত্মিক সাধনা আর বাহ্যিক কর্ম… আপনি বারবার কিন্তু একটা কথায় আসতে চাচ্ছেন যে, সাধনার জগতটা। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ গোপন তত্ত্ব।

ফিরোজ: সাধনার কাঠামোটাও কী বলা যাবে না?

(চলবে…)

মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: চার>>

………………
সাক্ষাৎকারটি ফিরোজ এহতেশামের ‘সাধুকথা: ১৩ বাউল-ফকিরের সাথে কথাবার্তা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রিত

……………………….
আরো পড়ুন:
মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: এক
মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: দুই
মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: তিন
মানুষের ভিতরে অসীম মানুষ বাস করে: চার

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!