ভবঘুরেকথা
সৃষ্টিতত্ত্ব রহস্য ব্রহ্মাণ্ড জগৎ

মূল : স্টিফেন হকিং

যে ইউক্লিডীয় স্থান-কাল ব্যবহার করা হচ্ছে সে স্থান কালে সময়ের অভিমুখ এবং কালের অভিমুখ একই, সুতরাং স্থান-কালের বিস্তার সীমিত হলেও একটি অনন্যতা দিয়ে তার সীমানা কিম্বা কিনারা না হতে পারে। স্থান-কাল হতে ধরাপৃষ্ঠের মত, শুধুমাত্র দুটি মাত্রা (dimension) বেশি থাকবে।

ধরাপৃষ্ঠ বিস্তারের দিক দিয়ে সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা কিম্বা কিনারা নেই। আপনি যদি জাহাজে করে সূর্যাস্তের ভিতরে ঢুকে পড়েন তাহলে আপনি পৃথিবীর কিনারা দিয়ে পড়ে যাবেন না কিম্বা একটি অনন্যতায় ঢুকে পড়বেন না। (আমি সারা পৃথিবী ঘুরেছি,–সেজন্য আমি জানি।

ইউক্লিডীয় স্থান-কাল যদি কাল্পনিক সীমাহীন অতীত বিস্তৃত হয় কিম্বা যদি কাল্পনিক কালের একটি অনন্যতায় শুরু হয়, তাহলেও আমাদের চিরায়ত তত্ত্বের মত একই সমস্যা থেকে যায় অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা নির্দিষ্টরূপে নির্দেশ (specifying) করা :

ঈশ্বর হয়ত জানেন মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল কিন্তু মহাবিশ্ব একভাবে শুরু না হয়ে কেন অন্যভাবে শুরু হয়েছিল সেটা বিচার করার বিশেষ কোন কারণ আমরা দেখাতে পারব না। অন্যদিকে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব একটি নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে।

এ সম্ভাবনায় স্থান-কালের কোন সীমানা থাকবে না, সুতরাং সীমানার আচরণ নির্দিষ্ট করারও কোন প্রয়োজন থাকবে না।

সেক্ষেত্রে এমন কোন অনন্যতা থাকবে না যেখানে বিজ্ঞানের বিধি ভেঙে পড়েছিল এবং স্থান-কালের এমন কোন কিনারা (edge) থাকবে না যেখানে স্থান-কালের সীমানা স্থির করার জন্য ঈশ্বর কিম্বা অন্য কোন বিধির দ্বারস্থ হতে হবে। বলা যেতে পারে “মহাবিশ্বের সীমান্তের অবস্থা হল কোন সীমান্তের অনস্তিত্ব।”

মহাবিশ্ব হবে সম্পূর্ণ আত্ম-অন্তর্ভুক্ত (self-contained) এবং বাইরের কিছু দিয়ে প্রভাবিত নয়। এটা সৃষ্টিও হবে না ধ্বংসও হবে না। এটা শুধুমাত্র থাকবে।

ভ্যাটিক্যানের যে কনফারেন্সের কথা এর আগে উল্লেখ করেছি সেই কনফারেন্সে আমি প্রস্তাব উত্থাপন করি যে, হয়ত স্থান আর কাল মিলিয়ে এমন একটি তল (sur face) গঠন করেছে যেটা আয়তনে সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা কিম্বা কিনারা নাই।

আমার গবেষণাপত্রটি ছিল একটু গাণিতিক, সেজন্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা সম্পর্কে তার ফলশ্রুতি সে সময় সাধারণভাবে বোধগম্য হয় নি। (আমার পক্ষে ভালই হয়েছিল)।

ভ্যাটিক্যান কনফারেন্সের সময় মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভবিষৎদ্বাণী করার জন্য “সীমানাহীনতার চিন্তাধারা কি করে ব্যবহার করা যায় সেটা আমার জানা ছিল না। যাই হোক, পরবর্তী গ্রীষ্মকালটা আমি কাটাই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্টা বারবারায় (Santa Barbara)।

ইতিহাসগুলোর যোগফলের প্রতিটি ইতিহাস শুধু স্থান-কালের বিবরণই দেবে না বিবরণ দেবে তার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি জিনিসেরই। তার ভিতরে মানুষের মত জটিল জীবও থাকবে অর্থাৎ এমন জীব যারা মহাবিশ্বের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এটা নরত্বীয় নীতির সপক্ষে আর একটি যুক্তি হতে পারে।

সেখানে আমি এবং জিম হার্টল Jim Hartle) নামে আমার একজন বন্ধু এবং সহকর্মী একসঙ্গে গবেষণা করি। গবেষণার বিষয় ছিল : যদি স্থান-কালের সীমানা না থাকে তাহলে মহাবিশ্বের কি কি শর্ত পালন করতে হবে?

কেম্ব্রিজে ফেরার পর জুলিয়ান লুট্টেল Julian Luttrel) এবং জোনাথান হ্যাঁলিওয়েল (Jonathan Halliwell) নামে আমার দুজন গবেষণাকারী ছাত্রের সঙ্গে আমি এই গবেষণা চালিয়ে যাই।

আমি জোরের সঙ্গে বলতে চাই স্থান এবং কাল সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা নেই এই ধারণা একটি প্রস্তাব মাত্রা : অন্য কোন নীতি থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।

যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতই প্রথমে এ প্রস্তাব হয়ত করা হয়েছিল সৌন্দর্য কিম্বা অধিবিদ্যামূলক কারণে কিন্তু পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কি না সেটাই তত্ত্বের আসল পরীক্ষা। তবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের ক্ষেত্রে দুটি কারণে এটা নির্ণয় করা কঠিন।

প্রথমত, (এটা ব্যাখ্যা করা হবে পরের অধ্যায়ে) কোন তত্ত্ব কণাবাদী বলবিদ্যা এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদ সাফল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে, সে বিষয়ে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। কিন্তু সেরকম একটি তত্ত্বের অবয়ব কি রকম হতেই হবে সে সম্পর্কে আমরা অনেকটা জানি।

দ্বিতীয়ত সমগ্র মহাবিশ্বের বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দিতে পারে এরকম প্রতিরূপ আমাদের পক্ষে গাণিতিকভাবে এমন জটিল হবে যে আমরা নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী গণনা করতে পারব না। সুতরাং আমাদের করতে হবে সরলীকরণ করতে পারে এরকম অনুমান এবং আন্নতা (approximation)।

কিন্তু তবুও ভবিষ্যদ্বাণী বার করা হবে অতীব দুরূহ।

ইতিহাসগুলোর যোগফলের প্রতিটি ইতিহাস শুধু স্থান-কালের বিবরণই দেবে না বিবরণ দেবে তার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি জিনিসেরই। তার ভিতরে মানুষের মত জটিল জীবও থাকবে অর্থাৎ এমন জীব যারা মহাবিশ্বের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এটা নরত্বীয় নীতির সপক্ষে আর একটি যুক্তি হতে পারে।

কিন্তু বাস্তব কালে মহাবিশ্বের ইতিহাস বেশ অন্যরকম দেখাবে। এক হাজার কিম্বা দু’হাজার কোটি বছর আগে এর আয়তন হত সর্বনিম্ন। সেটি হত কাল্পনিক কালের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধের সমান।

কারণ যদি সবকটি ইতিহাসই সম্ভব হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসগুলোর একটিতে আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মহাবিশ্ব যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা নরত্নীয় নীতি ব্যবহার করতে পারি।

যে ইতিহাসগুলোতে আমাদের অস্তিত্ব নেই সেগুলোতে ঠিক কি অর্থ আরোপ করা যেতে পারে সেটা স্পষ্ট নয়। যদি ইতিহাসগুলোর যোগফলের সাহায্যে দেখানো যেত যে আমাদের মহাবিশ্ব শুধুমাত্র সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর একটি নয়, এটা সবচাইতে সম্ভাব্যগুলোর একটি, তাহলে মহাকর্ষের কণাবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও অনেক বেশি সন্তোষজনক হত। এই কাজ করার জন্য সম্ভাব্য সমস্ত সীমানাবিহীন ইউক্লিডীয় স্থান-কালের ইতিহাসের যোগফল বার করতে হবে।

সীমানাহীনতার প্রস্তাব থেকে জানা যায় মহাবিশ্বের সম্ভাব্য প্রতিটি ইতিহাস অনুসরণ করার সম্ভাবনা অতি সামান্য, তবে ইতিহাসগুলোর একটি বিশেষ গোষ্ঠী আছে যার সম্ভাবনা অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।

এই ইতিহাসগুলোকে অনেকটা কল্পনা করা যায় ভূপৃষ্ঠের মত উত্তর মেরু থেকে দূরত্ব কাল্পনিক কালের প্রতিরূপ এবং উত্তর মেরু থেকে স্থির দূরত্ব বিশিষ্ট একটি বৃত্তের আয়তন মহাবিশ্বের স্থানিক আয়তনের প্রতিরূপ। উত্তর মেরুতে একক একটি বিন্দুরূপে মহাবিশ্বের আরম্ভ।

সেখান থেকে যত দক্ষিণে যাওয়া যাবে উত্তর মেরু থেকে স্থির দূরত্বে অক্ষাংশের (latitude) বৃত্তগুলো ততই বৃহত্তর হবে। এটা হবে কাল্পনিক সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের অনুরূপ (চিত্র : ৮.১)।

বিষুবরেখায় মহাবিশ্বের আয়তন হবে বৃহত্তম এবং কাল্পনিক সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্কুচিত হতে হতে দক্ষিণ মেরুতে এসে একটি মাত্র বিন্দুতে পরিণত হবে। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুতে মহাবিশ্বের আয়তন শূন্য হলেও এই বিন্দুগুলো অনন্য (singularities) হত না।

পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু যতটা অনন্য তার চাইতে বেশি কিছু নয়। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু সাপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো যেমন সত্য, ওগুলো বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো তেমনি সত্য হবে।

কিন্তু বাস্তব কালে মহাবিশ্বের ইতিহাস বেশ অন্যরকম দেখাবে। এক হাজার কিম্বা দু’হাজার কোটি বছর আগে এর আয়তন হত সর্বনিম্ন। সেটি হত কাল্পনিক কালের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধের সমান।

পরবর্তী বাস্তব কালে মহাবিশ্ব লিন্ডে (Linde) প্রস্তাবিত শৃঙ্খলাহীন অতি স্ফীতিমান প্রতিরূপের অনুরূপ সম্প্রসারিত হবে (কিন্তু মহাবিশ্ব কোনক্রমে সঠিক অবস্থায় সৃষ্ট হয়েছিল এরকম অনুমান করার প্রয়োজন এক্ষেত্রে হবে না)।

কিন্তু কাল্পনিক কালে কোন অনন্যতা কিম্বা সীমানা নেই। সেজন্য আমরা যাকে কাল্পনিক কাল বলি হয়ত সেটাই আরো বেশি মূলগত (more basic), হয়ত যাকে আমরা বাস্তব বলি সেটা একটি চিন্তন মাত্র। সে চিন্তনকে আমরা আবিষ্কার করি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তনের বিবরণ দেয়ার জন্য।

মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে হতে বিরাট আয়তন প্রাপ্ত হবে এবং তারপর আবার চুপসে যাবে। সেটি দেখাবে অনেকটা বাস্তব কালের অনন্যতার মত। সুতরাং এক অর্থে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে দূরে থাকলেও আমাদের সবারই মৃত্যু অবধারিত।

মহাবিশ্ব শুধুমাত্র যদি কাল্পনিক কালের বাগ্বিধিতে কল্পিত হয় তাহলেই কোন অনন্যতা থাকবে না।

মহাবিশ্ব যদি বাস্তবিকই এরকম একটি কণাবাদী অবস্থায় থাকে তাহলে কাল্পনিক কালে মহাবিশ্বের ইতিহাসে কোন অনন্যতা থাকবে না। সুতরাং মনে হতে পারে আমার আধুনিকতর গবেষণা আমার অনন্যতা বিষয়ে পূর্বতন গবেষণাগুলোকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছে।

কিন্তু অনন্যতা উপপাদ্যগুলোর বাস্তব গুরুত্ব ছিল : তারা দেখিয়েছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রগুলো অবশ্যই এত শক্তিশালী হত যে কণাবাদী মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়াকে quantum gravitational effect) অগ্রাহ্য করা যেত না। এরকম ইঙ্গিত আগে দেয়া হয়েছে।

কাল্পনিক কালে মহাবিশ্ব সীমানাহীন কিম্বা অনন্যতাহীন হলেও সীমিত হতে পারে এই ধারণার পথিকৃৎ পূর্বোক্ত চিন্তাধারা। যে বাস্তব কালে আমরা বাস করি সেই বাস্তব কালে ফিরে এলে কিন্তু তখনও অনন্যতার অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয়।

যে মহাকাশচারী বেচারা কৃষ্ণগহ্বরে পড়বে তখনও তার চটচটে (sticky) মৃত্যুই হবে। শুধুমাত্র কাল্পনিক কালে বাস করলেই তার কোন অনন্যতার সঙ্গে দেখা হবে না।

এ থেকে মনে হতে পারে তথাকথিত কাল্পনিক কালই আসলে বাস্তব কাল আর যাকে আমরা বাস্তব কাল বলি সেটা আমাদের কল্পনার উদ্ভাবন। বাস্তব কালে অনন্যতাগুলোর ভিতরে মহাবিশ্বের শুরু আর শেষ রয়েছে। এ অনন্যতাগুলোই স্থান কালের সীমানা এবং এখানে বিজ্ঞানের বিধিগুলো ভেঙ্গে পড়ে।

কিন্তু কাল্পনিক কালে কোন অনন্যতা কিম্বা সীমানা নেই। সেজন্য আমরা যাকে কাল্পনিক কাল বলি হয়ত সেটাই আরো বেশি মূলগত (more basic), হয়ত যাকে আমরা বাস্তব বলি সেটা একটি চিন্তন মাত্র। সে চিন্তনকে আমরা আবিষ্কার করি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তনের বিবরণ দেয়ার জন্য।

সীমানাহীন অবস্থা সাপেক্ষ অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। আদিম মহাবিশ্বের একরূপ ঘনত্ব থেকে যে সমস্ত সামান্য বিচ্যুতির ফলে প্রথমে নীহারিকা, তার পর তারকা এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোর পরিমাণ এক বিশেষ আকর্ষণীয় সমস্যা।

কিন্তু প্রথম অধ্যায়ে বিবৃত প্রথম মত অনুসারে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব একটি গাণিতিক প্রতিরূপ মাত্র। এগুলো আমরা তৈরি করি আমাদের পর্যবেক্ষণের বিবরণ দেয়ার জন্য। তত্ত্বের অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের মনে। সুতরাং কোনটা বাস্তব কোনটা বাস্তব কাল কিম্বা কোনটা কাল্পনিক কাল–এসমস্ত প্রশ্ন অর্থহীন।

কোন বিবরণটি বেশি কার্যকর সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয়।

মহাবিশ্বের কোন কোন ধর্ম একসঙ্গে বর্তমান থাকতে পারে সেটা নির্ধারণ করার জন্য সীমানাহীনতার প্রস্তাবের সঙ্গে ইতিহাসগুলোর যোগফল একসঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে।

উদাহরণ : যখন মহাবিশ্বের ঘনত্বের বর্তমান মূল্যাঙ্ক রয়েছে তখন মহাবিশ্বের প্রায় এক হারে প্রত্যেক বিভিন্ন দিকে যুগপৎ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা গণনা করা যেতে পারে। এ পর্যন্ত যে কটা সরলীকৃত প্রতিরূপ নিয়ে গবেষণা হয়েছে সে সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এ সম্ভাবনা বেশি।

অর্থাৎ মহাবিশ্বের বর্তমান সম্প্রসারণের হার সর্বদিকেই প্রায় সমান হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পথিকৃৎ হল প্রস্তাবিত সীমানাহীনতার অবস্থা। এ সম্ভাবনার সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পশ্চাৎপটের সঙ্গতি রয়েছে।

এ থেকে দেখা যায় : যে কোন অভিমুখেই এই বিকিরণের তীব্রতা প্রায় নির্ভুলভাবে সমান। যদি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কতকগুলো অভিমুখের তুলনায় অন্য কোন কোন অভিমুখে দ্রুততর হত তাহলে ঐ সমস্ত অভিমুখে বিকিরণের তীব্রতা কম হত।

হ্রাসের পরিমাণ হত একটি বাড়তি লোহিত বিচ্যুতি (by an additional red shift)।

সীমানাহীন অবস্থা সাপেক্ষ অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। আদিম মহাবিশ্বের একরূপ ঘনত্ব থেকে যে সমস্ত সামান্য বিচ্যুতির ফলে প্রথমে নীহারিকা, তার পর তারকা এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোর পরিমাণ এক বিশেষ আকর্ষণীয় সমস্যা।

ঘটনাবলি ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সাফল্যের ফলে অধিকাংশ লোকই এখন বিশ্বাস করেন ঈশ্বর একগুচ্ছ বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের বিবর্তন অনুমোদন করেন এবং এই বিধি ভঙ্গ করে তিনি মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু শুরুতে মহাবিশ্বের চেহারা কি রকম ছিল সে বিষয়ে বিধিগুলো কিছুই বলে না।

আদিম মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ একরূপ হতে পারত না, তার কারণ কণিকাগুলোর অবস্থান এবং গতিবেগে (velocity) কিছু অনিশ্চয়তা এবং হ্রাস-বৃদ্ধি থাকতেই হত : অনিশ্চয়তার নীতির ভিতরেই এ তথ্য নিহিত আছে। সীমানাহীন অবস্থা বিচার করে আমরা জানতে পারি আসলে মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই শুরু হয়েছিল অনিশ্চয়তার নীতি অনুমোদিত সম্ভাব্য সর্বনিম্ন বিচ্যুতি দিয়ে।

তারপর মহাবিশ্ব কিছুকাল অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপে যে রকম অনুমান করা হয়েছে সে রকম দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছিল।

এ যুগে মহাবিশ্বের প্রাথমিক একরূপত্বের অভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা আমাদের সর্বদিকে পর্যবেক্ষণ করা গঠনগুলোর উদ্ভব (origin of the structures) ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।

যে সম্প্রসারণমান মহাবিশ্বে স্থান থেকে স্থানান্তরে পদার্থের ঘনত্বের সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, সেখানে মহাকর্ষের ক্রিয়ায় ঘনতর অঞ্চলের সম্প্রসারণ শ্লথতর হবে এবং সে অঞ্চলগুলোর সঙ্কোচন শুরু হবে। এর ফলে গঠিত হবে নীহারিকা, তারকা এবং শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হবে আমাদের মত নগণ্য জীব?

সেজন্য আমরা যে সমস্ত জটিল গঠন দেখতে পাই সেগুলো মহাবিশ্বের সীমানাহীন অবস্থা এবং কণাবদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

স্থান এবং কাল একটি সীমানাহীন বদ্ধ পৃষ্ঠ (closed surface) গঠন করতে পারে: মহাবিশ্বের ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা বিষয়ে এই চিন্তনের ফলশ্রুতি হতে পারে গভীর।

ঘটনাবলি ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সাফল্যের ফলে অধিকাংশ লোকই এখন বিশ্বাস করেন ঈশ্বর একগুচ্ছ বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের বিবর্তন অনুমোদন করেন এবং এই বিধি ভঙ্গ করে তিনি মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু শুরুতে মহাবিশ্বের চেহারা কি রকম ছিল সে বিষয়ে বিধিগুলো কিছুই বলে না।

এই ঘড়ির মত গতি বন্ধ করা ঈশ্বরেরই দায়িত্ব এবং কি করে এটি আবার শুরু করবেন সে পদ্ধতি নির্বাচনের দায়িত্বও ঈশ্বরেরই। যতক্ষণ পর্যন্ত মহাবিশ্বের শুরু ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অনুমান করতে পারতাম মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টাও ছিল।

কিন্তু মহাবিশ্ব যদি সত্যিই পূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় এবং যদি এর কোন সীমানা কিম্বা কিনারা না থাকে, তাহলে এর আদিও থাকবে না, অন্তও থাকবে না– থাকবে শুধু অস্তিত্ব। তাহলে স্রষ্টার স্থান কোথায়?

 

(চলবে…)

<<মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি ।। মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি>>

……………………….
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি
মূল : স্টিফেন ডব্রু হকিং
অনুবাদক মো: রিয়াজ উদ্দিন খান

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : প্রথম কিস্তি

মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : তৃতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : চতুর্থ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : পঞ্চম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : সপ্তম কিস্তি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!