ভবঘুরেকথা
পাগল মস্তান

মহিমান্বিত জীবন

-লুৎফর রহমান

এই বিশ্বের যারা কল্যাণ কামনা করে, ঈশ্বরের রাজ্য ও মহিমা বিস্তারের জন্যে নিজের যাবতীয় শক্তি, অর্থ ও জ্ঞান উৎসর্গ করে- তাদেরই জীবন মহিমান্বিত। জেলখানায় দেখতে পাই, অপরাধী দুবৃত্তের প্রতি মানুষ কত হিংসা পোষণ করে।

মধ্যযুগে ইউরোপে কয়েদিদের ওপর যে ভীষণ অত্যাচার হতো, তা চিন্তা করতে আমরা ভয় পাই। যে খ্রিস্টান জগতে প্রেমের ধর্ম প্রচার করে, তাদের ভিতর মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মম ব্যবহার। নিতান্তই আশ্চর্য বলে মনে হয়।

মানুষ কি এখনও বোঝে নি, মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ঈশ্বর মানুষের কাছে কী চান? স্বার্থান্ধের স্বার্থ-বাসনা জড়িত উপাসনা ও তোষামোদ ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। মানব সংসারের কল্যাণ কামনা ত্যাগ করে যারা নিরন্তর ঈশ্বর উপাসনায় ব্যস্ত থাকে, তারা। নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব।

হৃদয়কে প্রেম উদ্বুদ্ধ করবার জন্যেই, আত্মার মহাজ্ঞানের আশীর্বাদ লাভ করবার জন্যেই মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করবে। উপাসনার আর কোনো বড় সার্থকতা। নেই। জগতে জীবনের উন্নততর, মহিমান্বিত প্রেমের ব্যবহার ত্যাগ করে নিরন্তর উপাসনার। কোনো মূল্য নেই।

মানুষের প্রতি হিংসা বর্জন কর। মানুষকে ঈশ্বরের পথে, মঙ্গল ও কল্যাণের পথে, সুখ ও শান্তির জীবনে আহ্বান কর। গায়ের বল, অর্থসম্পদ, উচ্চ রাজপদের গর্ব ত্যাগ কর। তুমি কি জান না, ঈশ্বরের শান্তি মুহূর্তের মধ্যে তোমাকে দুর্বল ও শক্তিহীন করতে পারে?

জীবনে সুখ-সম্পদে, বলে-গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হবার আকাঙ্ক্ষা তুমি কর?- যদি তোমার চিন্তায় মনুষ্য সমাজ, এই পৃথিবীর মঙ্গল তোমার গৌরব প্রতিষ্ঠার কোনো মূল্য নেই। তুমি কি পশুদের রাজা সিংহের প্রতাপ লাভ করতে চাও? তুমি কি উচ্চতরের পশু হতে চাও?

মানুষ তোমার কাছে না এসে অনন্ত দুঃখ ও জ্বালার পথে ছুটেছে। মানুষের দুর্গতিতে, হে প্রভু, তুমি পথে পথে কেঁদেছ- আকাশের বারিধারায় তোমার হৃদয়ে বেদনা উছলে উঠেছে। সারা রাতের শিশিরপাতে তোমার বেদনা অশ্রু ঝরেছে। হায়! বাঁশি বেজেছে তোমারই প্রেম ও মমতার গান গেয়ে।

না- না- ঈশ্বর তোমার কাছে সে আশা করেন না। তিনি গভীর রাতে, পীড়িতের আর্তকণ্ঠে তোমাকে ডেকেছেন পৃথিবীর সেবায়, ব্যাধিগ্রস্ত পীড়িত মৃতকল্প মানব সেবার কার্যে, পাপী, পতিত, দুঃখী নরনারীর উদ্ধারের জন্য।

জীবনের দান পেয়েছো কী জন্য? এর সার্থকতা কী? ঈশ্বরে তুমি মহিমান্বিত হও। ঈশ্বরকে বর্জন করে, সুখ-লালিত বিরাট বপুতে, সমুদ্রের গভীর রত্নভাণ্ডারে, চামচিৎকার অট্টালিকা বাসে, কুকুরের তৃপ্তিতে তুমি আত্মতৃপ্তি অনুসন্ধান করছো! মানুষের জীবনে ওতে তৃপ্তি নেই।

মানুষ ঈশ্বরের অংশ- যে বেদনা ও অশ্রুর সৃষ্টি, সে দেবতা। সে পশু নয়, রক্তপিপাসু সিংহ নয়, জীবনহীন রত্নময় সমুদ্রগর্ভ নয়, তুচ্ছ চামচিকাও নয়, নিকৃষ্ট কুকুরও নয়। তার প্রার্থনা অতি মহান- সে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে- ওগো মহারাজ! মানুষের জন্যে আমায় কাঁদতে দাও। মানব কল্যাণে আমায় চিন্তা করতে দাও। বিশ্বের পাপ ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমায় যুদ্ধ করতে দাও। তোমার রাজ্যে যেন অসত্য ও মিথ্যা জয়যুক্ত

হয়। যারা জগতে অশ্রু সৃষ্টি করে, যারা জগতে অন্ধকারের সংবর্ধনা করে, যারা সত্যের অপমানে লজ্জিত হয় না, তাদেরকে তুমি লজ্জিত কর। প্রভু আমার জাতিকে কাঙ্গাল করিও, তোমার বর্ণ ও গন্ধে আমাদের জীবন মহিমান্বিত কর।

অত্যাচারীর বজ্রসৃষ্টিতে, অবিচারের নির্মম দণ্ডে, উদ্ধতের নির্লজ্জ দাম্ভিকতায়, মানুষের অবহেলায় যারা দগ্ধ হয়েছে, যারা অকালে শুকিয়ে গেছে তাদেরকে তুমি আশীর্বাদ কর। প্রভু! তুমি চিরকাল আছ, তোমার ধর্মও চিরকাল আছে। মানুষ যে নামেই তাকে অভিহিত করুক। তোমার ধর্ম কী? তা মানুষ

বুঝুক, আমি বুঝেছি। তুমি পাপ, মিথ্যা অন্ধকার নও। তুমি আনন্দ, শান্তি সত্যময়, নির্মল নিপ সত্তা। তুমি মানুষকে তার স্বরচিত অসীম দুঃখ হতে রক্ষা করতে চাও। তোমার রাজ্যে দুঃখ নেই, তাপ নেই, জ্বালা নেই, কুৎসিত নেই। তুমি মানব-সন্তানকে প্রেমের আহ্বান জানিয়েছ।

মানুষ তোমার কাছে না এসে অনন্ত দুঃখ ও জ্বালার পথে ছুটেছে। মানুষের দুর্গতিতে, হে প্রভু, তুমি পথে পথে কেঁদেছ- আকাশের বারিধারায় তোমার হৃদয়ে বেদনা উছলে উঠেছে। সারা রাতের শিশিরপাতে তোমার বেদনা অশ্রু ঝরেছে। হায়! বাঁশি বেজেছে তোমারই প্রেম ও মমতার গান গেয়ে।

ওগো জননী! নরনারী যখন তোমাকে ভুলে বিপথে ছুটে চলল, যখন মানুষ তোমার মেঘে মেঘে ঝঞ্ঝা-ব্যাকুল সমুদ্রতরঙ্গের ভৈরব শাসন-গর্জনকে উপেক্ষা করে পাপ করল, হায় হায় দুঃখে তখন তুমি কাঁদলে। সে কাঁদন অনন্ত কালেও শেষ হবে না।

আমায় ঘৃণা দাও, যেন অধৰ্মচারী দুবৃত্তদেরকে আন্তরিক ঘৃণা করতে পারি, আমায় লজ্জা দাও, যেন পাপের পথে লজ্জা বোধ করি, আমায় আত্মমর্যাদা জ্ঞান দাও, যেন কোনোরূপে জীবনের অগৌরব না করি, আমায় সংযম দাও, যেন লোভে পড়ে পাপের পথে না হাঁটি।

ওরে মানুষ ওরে অবোধ প্রভুর ভুবন ভোলানো প্রেমের আহ্বান আসছে চিত্তে। জাগ, ওরে মন জাগ। ডাক এসেছে, বিলম্ব করো না। শয়তানের ছলনায় পড়ে পথহারা হয়ো না। প্রভুর পথ ভুলো না। ধন্য সেই, যে তোমাতে মহিমান্বিত হয়।

ধন্য সেই- যে তোমার গৌরবে গৌরব বোধ করে, যে দিবাকর প্রতি কাজে তোমার গৌরব রক্ষা করে, তোমার ইচ্ছা পালন করে, যে মানুষকে কোনো রকমে তুচ্ছ ও রূঢ় ব্যবহারে বেদনা, দেয় না, যে তোমার পতাকা ধারণ করে, যে তোমাতে মহৎ ও মহিমান্বিত।

কোন্ পাগল তোমাকে বর্জন করে নিজের বলে অর্থ ও জগতের প্রতাপে জীবনে মহিমার অন্বেষণ করছে?

যে মাথা তোমার কাছে নত করেছি, তা যেন মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে নত না হয়। আমার রক্ত-মাংসের মাথা নয়, আমার মাংসের শরীর নয়, আমার হৃদয় তোমাকে দিয়েছি। যে হৃদয় তোমার আসন হল, তাতে শয়তান কী প্রকারে কর্তৃত্ব করবে? অসত্য, অন্ধকার ও অন্যায়ের সাথে মুসলমানদের চিরজীবনের যুদ্ধ।

আমি কি তোমাকে ভুলে জীবিকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করব? শয়তানি ও নিষিদ্ধ (হারামি) পথের পথিক হব? তবে আর কী নামাজ পড়লাম? জীবনভরই কি তোমার সাথে আমার প্রতারণা চলবে? আমার ভূমিষ্ঠ হবার কালে যে মহাগান তোমার ভক্তেরা আমায় শুনিয়েছে-

সেই মহা আল্লাহে আকবার ধ্বনি (আল্লাই শ্রেষ্ঠ সত্য ও ন্যায়ই শ্রেষ্ঠ) আমি ভুলি নি। আমি তোমাকে জীবন ভরে সেজদা করলাম। যেন জীবনে, প্রতিদিনকার জীবনে, কার্যক্ষেত্রে মানুষের সাথে ব্যবহারে শয়তানের কাছে মাথা নত না করি।

হায় পৃথিবীতে কত মানুষ পথহারা হয়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য আমি কী করেছি? তোমার সমাচার আমি কারো কাছে বহন করি নি-ব্যর্থ আমার জীবন। শুধু নিজের মুক্তির জন্যই কেঁদেছি। কত পৌত্তলিক, কত পাপী, কত মানুষ মহাপাপে বিনাশের পথে চলেছে, তাদের জন্য আমি কিছুই করলাম না।

শুধু আত্মসুখেই তৃপ্ত রইলাম, শুধু নিজেকে বাঁচাবার জন্যই ব্যস্ত রইলাম। প্রভু, আমাকে জ্ঞান দাও, শক্তি দাও, স্বাস্থ্য দাও, যৌবন দাও, রূপ দাও, ঐশ্বর্য দাও, যেন তোমার পথে যুদ্ধ করবার যোগ্য হই। আমাকে সিংহের বিক্রম দাও, যেন তোমার শত্রু যারা, তাদের হৃদয়ের রক্তপান করতে পারি।

আমায় ঘৃণা দাও, যেন অধৰ্মচারী দুবৃত্তদেরকে আন্তরিক ঘৃণা করতে পারি, আমায় লজ্জা দাও, যেন পাপের পথে লজ্জা বোধ করি, আমায় আত্মমর্যাদা জ্ঞান দাও, যেন কোনোরূপে জীবনের অগৌরব না করি, আমায় সংযম দাও, যেন লোভে পড়ে পাপের পথে না হাঁটি।

এক আমলা দরিদ্রের সন্তান- তার এক বিঘা জমি বলতে ছিল না। সে চাকরি পেয়ে জীবনে কঠিন পাপ ও অন্যায়ের সেবা করে বড় মানুষ হয়েছে। সেজন্য মানুষ তাকে প্রশংসাই করে, তার বুদ্ধির প্রশংসা করে- তা হলে তার পাপের জন্য শুধু সেই কি দায়ী?

মিথ্যা সেবার জন্য কোমরে সোনা ও রূপা ধারণ করে আমি অপেক্ষায় দাঁড়াব না, স্বাধীন কৃষক হয়ে আমি বৈধ অন্ন খাব, পর্ণকুটিরে বাস করব, নিজ হস্তে বস্ত্র বয়ন করব, তথাপি চাকচিক্যময় পাপেভরা জীবনে মিথ্যা পদলেহন করব না।

আমার ও আমার মুসলিম ভ্রাতার প্রাণে প্রেম দাও, যেন আমরা পরস্পরকে রোগে-শোকে, দুঃখে-বেদনায়, অভাব-দৈন্যে প্রেম ও সেবা করতে পারি। আমাদেরকে ঐশ্বর্য দাও, মুসলমানকে হতভাগ্য গরিব করো না, যেন দরিদ্র ভ্রাতার সেবার জন্য প্রচুর দান করতে পারি।

ধিক, ধিক সেই জীবনে, যে জীবন তোমার গৌরব আকাক্ষা করে না, যে জীবনের একটি দিনও তোমাকে বর্জন করে চলে, তোমাকে ভুলে থাকে, অত্যাচারীকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর, সেখানে মিথ্যা ও অত্যাচার সম্মানিত হয়, ওরে অবোধ উপাসকের দল, তোমরা কী জান, সেখানে তোমাদের নামাজ সিদ্ধ হয় না।

বন্ধুদের সাথে মিশে সারাদিন হেসে-খেলে সারাটা দিনই চলে গেল, একটিবারও প্রভুর কথা তোমার মনে হল না। নিজের ক্ষমতার বড়াই তোমার মনে খুব বেশি। যে মানুষের জীবন, যে জাতির জীবন ঈশ্বরবর্জিত, তারা জগতে কোন্ কাজ করতে সক্ষম? তারা জগতে কখনও শক্তির উত্তরাধিকারি হবে না, কখনও তারা মহিমান্বিত হবে না।

জীবনে ঈশ্বরের বশ্যতা চাই- ঈশ্বরের বশ্যতার অর্থ সত্য, ন্যায়, জ্ঞানের বশ্যতা। এজন্য আলখেল্লা ধারণ করবার দরকার নেই। তিলক কেটে সন্ন্যাসী সাজবারও প্রয়োজন নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো মুসলমান ধর্মের আদর্শ নয়।

সংসারে সংসারী সাজ কর নিত্য নিজ কাজ ভবের উন্নতি যাতে হয়। এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ।

মহিমান্বিত জীবনের আদর্শ কী- তার নমুনা দুই-একটি মাত্র এখানে দিচ্ছি। মানুষ নিজ থেকেই বুঝতে পারে অমানুষের স্বরূপ কী, জীবনে অপবিত্রতা কী, কদর্য জীবন কী? জেনেশুনেও মানুষ জীবনে মন্দ হয়। হয়তো সমস্ত সমাজের মন অপবিত্র ও পতিত, তাই মানুষ কদর্য জীবন বরণ করতে লজ্জাবোধ করে না।

ঈশ্বরের কাছে কিন্তু মানুষের পাগ সমানভাবে সমাজকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ মানুষ তাদের পাপের জন্য শুধু নিজেই দায়ী নয়। বেশ্যাকে যদি মানব সমাজ না চাইত, তবে কি নারী এই মহাপাপের পথে হাঁটত? নারী দেখে এই পথে ধিক্কার নেই, অভাব নেই, লজ্জা নেই, মানুষ তাকে এইভাবে চায়। তা হলে তার আর একার দোষ কী? বেশ্যা জীবনের লজ্জা তাকে অন্তজ্বালা দেবে কেন? সে তত বেশ থাকে!

এক আমলা দরিদ্রের সন্তান- তার এক বিঘা জমি বলতে ছিল না। সে চাকরি পেয়ে জীবনে কঠিন পাপ ও অন্যায়ের সেবা করে বড় মানুষ হয়েছে। সেজন্য মানুষ তাকে প্রশংসাই করে, তার বুদ্ধির প্রশংসা করে- তা হলে তার পাপের জন্য শুধু সেই কি দায়ী?

গভীর রাত্রিতে সেই জ্বলোক আশ্রিত যুবকের নিকট এসে বল্লেন,-বন্ধু তোমাকে আমি আমার আস্তাবলের সর্বাপেক্ষা বলবান অশ্বটি এবং একখানি তরবারি দিচ্ছি। যে যুবককে তুমি গত সন্ধ্যায় হত্যা করেছ, সে আমারই পুত্র। কী জানি, পিতার মন যদি দুর্বল হয়, এজন্য আত্মরক্ষার্থে তোমাকে অশ্ব ও তরবারি দিলাম। তুমি সত্বর এই স্থান হতে পলায়ন কর।

আমাদের জাতির জীবন এবং মানসিকতা কদর্য হয়েছে। তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও কদর্য। জীবনের মহিমা কীসে হয়- একথা কেউ তাকে শোনায় নি। কার্যক্ষেত্রে মানুষের জীবন মন্দ বলে সে জানতেও চায় না।

মহিমান্বিত জীবনের সমস্ত আদর্শের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। উচ্চ মহাজীবনের ধারণা মানুষ করতে শিখলে, জাতির চিন্তাধারা বদলাতে জাতির ভিতর মহৎ চরিত্রের আবির্ভাব হবে। মানুষ সবই জানে, সবই বুঝে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে সে পশু, মূঢ় ও হীন হয়ে থাকে।

কতদিন বাঙালি মুসলমান গৌরবময় জীবন সম্বন্ধে ধারণা করতে শিখবে? সমস্ত অন্তর দিয়ে জীবনে যা কিছু কদর্য ও হীন তাতে লজ্জা বোধ করবে? নিজের শক্তিকে পশুর মতো নয়, মানুষের মতো ব্যবহার করবে? জনৈক মূঢ় ভদ্রলোক আপন প্রাচীরবেষ্টিত বাগানে বসে আল্লাহর মহিমা অনুভব করছিলেন।

এমন সময় জনৈক খ্রিষ্টান বাইরে থেকে প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। খ্রিষ্টান যুবক নতজানু হয়ে মূঢ় ভদ্রলোকের সম্মুখে পতিত হয়ে নিবেদন করল- মহাশয়, আমি বড়ই বিপদগ্রস্ত। যদিও আমি খ্রিষ্টান তবুও আমি আপনার ন্যায় মূঢ় মুসলমান আমীরের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে কিছুমাত্র সন্দেহ পোষণ করছি না। আমি আপনার আশ্রিত।

আশ্রিতকে রক্ষা করে মহত্ত্বের পরিচয় দিন। আমি এইমাত্র জনৈক মুসলমান যুবককে হত্যা করেছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে ধরে এখনই শক্তহস্তে অর্পণ করতে পারেন। ইচ্ছা করলে জীবন রক্ষা করতেও পারেন। আমার বাঁচবার কোনো উপায় ছিল না, সে জন্য আপনার এ বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।

মূঢ় ভদ্রলোক বলেন, তোমার কোনো ভয় নেই। যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, ততক্ষণ তোমার শরীরে কেউ সামান্য আঘাতও করতে পারবে না। মুসলমানের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা সম্ভব নয়।

যুবক হৃষ্টচিত্তে এক গুপ্তঘরে আবদ্ধ রইল। ইত্যবসরে বাইরে কাঁদের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা গেল। যুবককে সেই স্থানে নিরাপদে থাকতে বলে ভদ্রলোক সদর দরজায় এসে দেখলেন, যে যুবককে তিনি এইমাত্র আশ্রয় দিয়েছেন সে তারই একমাত্র যুবক পুত্রকে হত্যা করে এসেছে। ভদ্রলোকের ললাট শোকে মলিন হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কাউকেও কিছু বললেন না।

গভীর রাত্রিতে সেই জ্বলোক আশ্রিত যুবকের নিকট এসে বল্লেন,-বন্ধু তোমাকে আমি আমার আস্তাবলের সর্বাপেক্ষা বলবান অশ্বটি এবং একখানি তরবারি দিচ্ছি। যে যুবককে তুমি গত সন্ধ্যায় হত্যা করেছ, সে আমারই পুত্র। কী জানি, পিতার মন যদি দুর্বল হয়, এজন্য আত্মরক্ষার্থে তোমাকে অশ্ব ও তরবারি দিলাম। তুমি সত্বর এই স্থান হতে পলায়ন কর।

খ্রিষ্টান যুবক তনুহূর্তে তরবারিখানি নিয়ে সেই অশ্বপৃষ্ঠেই পলায়ন করল। এই মহত্ত্ব- এর কি তুলনা আছে? মানব-সমাজে এর মূল্য কত বেশি! এটা কি মহান আদর্শ! কতবড় মহাপ্রাণ এই মূঢ় ভদ্রলোকের। এই ক্ষমাশীলতা, এই ক্রোধসংযম, এই প্রেম- স্বর্গীয়। শত্রুর প্রতি এতদৃশ্য ব্যবহার কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব হয় কি?

মানুষকে কোনো রকমে দুঃখ দিও না, জীবনকে মহাগৌরবের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা কর। মানুষ তো অনেকেই জগতে জন্মে। যারা হীন কুকুরের জীবন জগতে কাটিয়ে গেল, যারা অত্যাচারে জগতের বুকে হাহাকার ধ্বনি জাগিয়ে গেল, তাদের শেষ মাটি, আর যারা দরিদ্র, অশ্রু পূজাই যাদের জীবনের শেষ পূজা, দরিদ্র, অবহেলিত, অপমানিত- তাদেরও শেষ মাটি।

মহিমায় জীবন-জগতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় মানব হৃদয়ে বিস্ময় ও আনন্দ উৎপাদন করে।

একদা জনৈক সেনাপতি তার সৈন্যগণের রসদ সংগ্রহের জন্য এক পল্লীতে এসে এক কৃষকের দরজায় আঘাত করলেন। কৃষক দরজা খুলে দেখল, সেনাপতি তার দুয়ারে দণ্ডায়মান। কৃষক সেনাপতিকে আসন গ্রহণ করতে বলে তার এতদৃশ আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

সেনাপতি বল্লেন- হে কৃষক! আমার সৈন্যদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। কোনো ভালো শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে দাও আমাকে। ক্ষেতের শস্য আমরা কেটে নেব।

বলাবাহুল্য সৈন্যরা যে সব খাদ্য সংগ্রহ করে, তা জোর করেই নেয়। সেজন্য মালিককে কোনো দাম তারা দেয় না। জাতির মহাবিপদকালে নাকি বিনামূল্যে লুট করে নিলে কোনো দোষ হয় না।

বৃদ্ধ কৃষক বল্লেন- “আসুন আমার সঙ্গে” এই কথা বলে কৃষক সেনাপতি আর তার সৈন্যগণকে নিয়ে এক মাঠের ভিতর দিয়ে চলতে লাগলেন। পথে বহু উত্তম শস্যের ক্ষেত। দেখা গেল কিন্তু কৃষক সেসব ক্ষেত উপেক্ষা করে দূরে একখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে বল্লেন; এই ক্ষেত থেকে আপনার শস্য সংগ্রহ করুন।

সেনাপতি সেই ক্ষেত থেকে সমস্ত ফসল কেটে নিতে আপন সৈন্যগণকে আদেশ দিলেন। তারা কৃষককে জিজ্ঞেস করলেন- এর আগেও কয়েকখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখলাম। সেগুলি বাদ দিয়ে তুমি এ পর্যন্ত আমাদিগকে ডেকে আনলে কেন? কৃষক বলেন, সেনাপতি, সেগুলো আমার নিজের ক্ষেত নয়, এইটা আমার নিজের ক্ষেত।

সেনাপতি কৃষকের মনুষ্যত্বে চমৎকৃত হয়ে তাকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। বল্লেন, যে দেশে এমন মহানুভব কৃষক বাস করেন, তাদের পরাজয় কখনও হবে না। মনুষ্য জীবনের এইসব মহত্ত্বপূর্ণ পরিচয় বাস্তবিকই প্রাণকে মুগ্ধ ও আনন্দিত করে। মানুষ সাধারণত নীচ, নিজের কাজের চিন্তায় সে বেশি পাগল। যখন সে পরের কথা ভাবে অপরের সুখের পথে সে আঘাত করে না, তখন সে দেবতা।

আমি আশা করি, মনুষ্যত্ব জয়যুক্ত হোক। মানুষের মনে উন্নত মহাজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগুক। সে নিজের এবং পরের হীনতাকে ঘৃণা করতে শিখুক। মানুষ যেন তার নির্মম পেষণে দুঃখ পেয়ে খোদাতালার কাছে ফরিয়াদ না জানায়।

মানুষকে কোনো রকমে দুঃখ দিও না, জীবনকে মহাগৌরবের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা কর। মানুষ তো অনেকেই জগতে জন্মে। যারা হীন কুকুরের জীবন জগতে কাটিয়ে গেল, যারা অত্যাচারে জগতের বুকে হাহাকার ধ্বনি জাগিয়ে গেল, তাদের শেষ মাটি, আর যারা দরিদ্র, অশ্রু পূজাই যাদের জীবনের শেষ পূজা, দরিদ্র, অবহেলিত, অপমানিত- তাদেরও শেষ মাটি।

এই অপমানের জীবন! উবার্টো যুবকের মালিককে বহু মিলিয়ন (Million) ক্রাউন মূল্য দিয়ে যুবককে উদ্ধার করলেন। যুবক এই অপরিচিত ব্যক্তির মহানুভবতায় অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি উবার্টোর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। উবার্টো বল্লেন, আপনাকে শীঘ্র দেশে পাঠাবো। আপনার পিতার কাছে আমার পরিচয় পাবেন।

এই পৃথিবীই আমাদের শেষ নয়। মানুষের জন্য এক মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ আছে- যেখানে আমাদের জীবনের অবস্থা আমাদের কৃতকর্মের ফল অনুসারেই হবে।

জেনোয়াতে (Genoa) যখন গণ-শাসনতন্ত্র একটি সামান্য বণিকের সন্তান একটি গৃহস্থ ঘরের যুবকের হাতে এল, তখন জেনোয়ার ধনী ও কুলীন সম্প্রদায় মর্মে মর্মে চটে গেলেন। উবাটো (Uberto) নামক জনৈক যুবক আপন স্বভাবের অমায়িকতা, মহত্ত্ব ও আত্মশক্তিতে দেশের সমস্ত ক্ষমতা অধিকার করলেন। .

কিন্তু এ কর্তৃত্ব বেশি দিন তিনি করতে পারলেন না। দেশের আমীর সম্প্রদায় এই নীচ নিম্নশ্রেণীর লোকটার কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারলেন না। তারা সত্বরই সংঘবদ্ধ হয়ে উবার্টো (Uberto)-কে দূরদেশে নির্বাসিত করলেন। তার প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হতো, কিন্তু নগরের বিচারক এডর্নো (ইমরভম) দয়া করে তাকে মাত্র নির্বাসন দণ্ড দিলেন।

উবার্টো (Uberto) আপন দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে বিদেশে বহু বৎসর আপন প্রিয়জন বিচ্ছেদ দুঃখের মর্মযাতনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন। কিন্তু বিদেশেও আপন মহৎ স্বভাবের গুণে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ধনী বলে পরিগণিত হলেন। পরিশ্রম, সৎ-সাহস, সততা, মহত্ত্ব এসব গুণই মানব জীবনকে সর্ব অবস্থায় উন্নত করে।

উবার্টের অর্থাভাব নেই, কিন্তু স্বদেশের বিরহ যাতনা সদাই তার বুকে লেগে থাকত। একদিন বিদেশে টিউনিস (Tunis) নগরে হঠাৎ তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ এক যুবককে দেখতে পেলেন। যুবককে সদ্বংশজাত বলে মনে হল। কুলির কঠিন জীবন তাকে বহন করতে হচ্ছে।

কাছে যেয়ে অনুসন্ধানে জানতে পারলেন- যুবক জেনোয়া শহরের প্রধান বিচারপতি এডর্নোর (Adorno) সন্তান। বন্দি হয়ে দাসরূপে বিক্রিত হয়ে বর্তমানে এই কঠিন দুঃখের জীবন যাপন করছে। এডর্নো!- যিনি পদ ও বংশ মর্যাদার গর্বে দরিদ্র নীচ বংশের উবার্টোকে চিরনির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন, সেই এডর্নোর পুত্রের এই দুরবস্থা!

এই অপমানের জীবন! উবার্টো যুবকের মালিককে বহু মিলিয়ন (Million) ক্রাউন মূল্য দিয়ে যুবককে উদ্ধার করলেন। যুবক এই অপরিচিত ব্যক্তির মহানুভবতায় অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি উবার্টোর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। উবার্টো বল্লেন, আপনাকে শীঘ্র দেশে পাঠাবো। আপনার পিতার কাছে আমার পরিচয় পাবেন।

সর্ব দুঃখ সয়ে যাও, প্রভুর পতাকাই ধরে থাক; তথাপি অসত্যের কাছে, মিথ্যার কাছে। ভয় পেয়ে ধৈর্যহীন হয়ে পতাকা ফেলে দিয়ে পালিও না। সব দুঃখ সহ্য করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। জয়ের দিন আসবে। মহাজীবনের মহিমা জাগবে। এইভাবে তো মহিমার। জয় হয়।

কিছুদিনের মধ্যে বহু উপঢৌকন সহ উবোটো নিজ জীবনের পরম শত্রু পুত্রকে স্বদেশে পাঠিয়ে দিলেন। এডনো বহুঁকাল পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পুত্রকে পেয়ে হাতে স্বর্গ পেলেন। উবার্টোর পরিচয় তিনি পুত্রের কাছে পেয়ে তার গত কৃতকর্মের জন্য বহু অনুশোচনা করলেন।

এবং দেশে বহু আন্দোলন করে উবার্টোকে দেশে ফিরিয়ে আনবার পূর্ব আদেশ প্রত্যাহার করলেন। মহিমার কাছে বংশ গৌরবের কোনো মূল্য নেই। বংশ গৌরবের অর্থ দাম্ভিকতা, অত্যাচার, অপ্রেম ও . নিষ্ঠুরতা- তা অহঙ্কারের মতো মানুষের হৃদয়কে তাপিত করে তা কখনও দরিদ্র, পতিত ও মূঢ়কে স্বর্গের আলো দেখাতে সমর্থ নয়।

যে আপনাকে ভুলেছে, জীবনের বা বংশের গৌরব-গর্ব যার প্রাণে স্বপ্নেও জাগে না, সেই জগতে আদর্শ মহাপুরুষ হয়ে মানুষের অন্তরকে স্বর্গের অমৃতধারায় অভিষিক্ত করে দুর্বলকে পথ দেখায়, দুঃখীকে সান্ত্বনা দেয়, পতিতকে উন্নত করে, অপরিচিতকে পরম আত্মীয় করে।

মানুষ অহঙ্কারকে ভালবাসে না, যা অগ্নির ন্যায় দূর হতে সুন্দর দেখায় সুশীতল বারির মতো তা তৃষিত, তাপিত মানুষের জীবন ঠাণ্ডা সরস করে না। আমরা চাই দরিদ্রের আদর্শ-মহামহিমার জীবন।

“হে প্রভু, কাফেরদিগের উপর আমাদিগকে কর্তৃত্ব দাও।” (কোরান) যারা কদাচারী, নীচ, ধর্মহীন, বিধর্মী, তাদের কাছে নত হবার মতো লজ্জা আর নেই। যারা জ্ঞানে, দৃষ্টিতে হীন এবং সঙ্কীর্ণ, তাদের কাছে জ্ঞানীর মতো দৃষ্টি মানুষের মনে শোক সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও সত্যের স্বাধীনতা চাই, সম্মান চাই। মানুষ কি কখনও অমানুষের জুতা বহন করতে পারে? কখনও না- তার আগে তার মৃত্যুই ভালো।

ক্ষমতা অধিকারের যোগ্য কে? যে জ্ঞানী, যে মানুষ, যে সাধু, যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। প্রতাপের রাজা কে?- যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। জগতের ধন-সম্পদের অধিকারী কে হবে? যে ঈশ্বরের শক্তিতে বলবান, সেই। হিন্দু-চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ নমস্য চিত্র মা আদ্যাশক্তির দুই কন্যা-লক্ষ্মী (ধনৈশ্বর্য) আর সরস্বতী (জ্ঞান)।

সর্ব দুঃখ সয়ে যাও, প্রভুর পতাকাই ধরে থাক; তথাপি অসত্যের কাছে, মিথ্যার কাছে। ভয় পেয়ে ধৈর্যহীন হয়ে পতাকা ফেলে দিয়ে পালিও না। সব দুঃখ সহ্য করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। জয়ের দিন আসবে। মহাজীবনের মহিমা জাগবে। এইভাবে তো মহিমার। জয় হয়।

<<মহামানুষ … মহামানুষ কোথায় ।। মহামানুষ>>

……………………
মহা জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!