ভবঘুরেকথা
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা

মন্দতাকে ঘৃণা

-লুৎফর রহমান

যে যাবৎ না তোমাদের দেহের প্রতি শোণিতবিন্দু পাপকে ঘৃণা করতে শিখেছে, পাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছে,… তাবৎ তোমাদিগকে ঈশ্বর পথের পথিক বলা যায় না। পাপ ও কুৎসিত যা, যা মন্দ তাকে ঘৃণা কর, আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর।

মন্দ জীবন যেন কখনও তোমাদের কাছে সম্মানিত না হয়। যারা স্বাধীনতার উপাসক নয় যারা দায়িত্বহীন শাসনতন্ত্রের চাকর, সত্যের উপাসক যারা নয় স্বাধীন জীবনকে যারা সম্মানের চোখে দেখে না- তাদেরকে সম্মান করো না- তাদের গৃহে যেয়ো না- তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা না।

জীবন যার উন্নত নয়, সে জীবনের মন্দতা সম্বন্ধে সত্য ধারণা করতে পারে না। নিজের সুবিধামতো যুক্তিতে সে মন্দকে ভালো বলে। জীবনে একটা সান্ত্বনা না হলে মানুষ বাঁচে না। যে বেশ্যা তার জীবনেও যুক্তি এবং সান্ত্বনা আছে। কিন্তু সত্য ও বিচারের সম্মুখে মানুষের এই যুক্তি মোটেই টেকে না।

ঘুষখোরেরা সাধারণত বলে আমরা দুপয়সা নেই মানুষের উপকার করি। এক সেনাপতিকে এক সময় দেশীয় কোনো মন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের জন্য বহু লক্ষ টাকা ঘুষ সেধেছিলেন। তিনি জীবনের আগৌরব করতে চান নি। ঘুষ গ্রহণ করেন নি।

সঙ্গে তিনি রূঢ়, অভদ্র পৌরুষের কণ্ঠে কথা বলতে লাগলেন। অনেক এম. এ.-কে জানি যারা অতিশয় সম্মানের সঙ্গে লেখকের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। ইনি চাকরির প্রভাবেই নিজেকে দেশের মানুষের কাছে এতটা শ্রেষ্ঠ মনে করছিলেন। এ হচ্ছে চাকুরে জীবনের দুর্ভাগ্য।

এদেশের সর্বত্র ঘুষের চলন আছে। শিক্ষিত ছেলেরাও চাকরি পাওয়ার আগে বলে উপরি পাওনা আছে কিনা! এই ঘুষ গ্রহণ যে কত অধর্মের কাজ কতখানি ঘৃণিত নিন্দনীয়, তা বলবার নয়। অথচ এই ঘুষের ওপরই দেশের বহুলোকের উন্নত অবস্থা নির্ভর করে। লোভ, নীচতা ও মন্দতাকে পরিহার করে চলাই যে ধর্ম, তা যেন কেউ জানে না।

এক সিপাইকে একবার জিজ্ঞেস করা হল, দেখ, তোমরা কচি কচি দেশের স্বেচ্ছাসেবক ছেলেদের মাথায় লাঠির আঘাত কর। এরা কত সম্মানী লোকের ছেলে। তোমাদের প্রাণে মায়া হয় না? এদের হাতে কোনো অস্ত্র থাকে না। নিরস্ত্রের ওপর কেন লাঠির আঘাত কর?

সিপাই বলে : কি করি বাবু, যার নুন খাই তার গুণ গাইতে হয়। সরকারের নুন খেয়ে তাঁর ইচ্ছা অমান্য করতে পারি?

সিপাইয়ের ধারণা, সে সরকারের চাকর। তার বেতন সরকারই দেন। তার বেতন, তার নুন যে দেশের লোকেই যোগায়, এ ধারণা তার নেই। ন্যায়-অন্যায় না বুঝেই অনেক সময় জীবনের পথে এইভাবে চলে।

জীবনের ভুল ঠিকভাবে বুঝতে পারা সোজা কথা নয়। এই জন্য মনের বিচারযোগ্যতা থাকা চাই। এই জন্য জ্ঞান ও বিচারশক্তি থাকা দরকার। মন্দ কি, ভুল কি, অন্যায় কি- এ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান যার নেই সে কী করে ন্যায়পথে চলবে?

এক সাব-ডেপুটি গ্রামে এসে একদিন সাধারণ লোকের সঙ্গে অত্যন্ত দাম্ভিক ব্যবহার আরম্ভ করলেন। তিনি একজন এম. এ.। চৌকিদারকে তো তিনি একটা কুকুর-বিশেষ মনে করে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি এক হাকিম এ কথাও বল্লেন। লেখক একজন সাহিত্যিক এ জেনেও তার।

সঙ্গে তিনি রূঢ়, অভদ্র পৌরুষের কণ্ঠে কথা বলতে লাগলেন। অনেক এম. এ.-কে জানি যারা অতিশয় সম্মানের সঙ্গে লেখকের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। ইনি চাকরির প্রভাবেই নিজেকে দেশের মানুষের কাছে এতটা শ্রেষ্ঠ মনে করছিলেন। এ হচ্ছে চাকুরে জীবনের দুর্ভাগ্য।

মানুষের দৃষ্টির অগোচরে, নিজের মনে জীবনের মন্দতা ধরতে শেখাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। যেখানে শিক্ষিত হয়েও মানুষ অন্ধ, সে শিক্ষার উদ্দেশ্য চৌর্যবৃত্তি। নাচওয়ালীর গান-বাদ্য শিক্ষার জন্যে অক্ষর পরিচয় লাভের মতো তা নিরর্থক।

সেই একদিন কোনো বিশেষ কারণে আমাকে রাজপুরুষের সঙ্গে মিলিতে হয়েছিল, সেই অবধি বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া কোনো সরকারি চাকুরের সঙ্গে কথা বলবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। এই ভদ্রলোকের ধারণা, তিনি দেশের লোকের প্রভু, তিনি সাধারণের চাকর নন।

চাকরির দিক দিয়ে নয়, সাধারণভাবে জীবনের কদর্যতা সম্বন্ধে তাঁর এখনও দৃষ্টি জাগে নি- তাই সাধারণের সঙ্গে এরূপ রূঢ় ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। অনেক চাকুরেই ক্ষমতার গর্বে সাধারণের সঙ্গে রূঢ় অভদ্র ব্যবহার করেন। তাতে তাদের জীবনের মতা কতখানি প্রকাশ পায় তা তারা বুঝতে পারেন না।

মহাজনের কথা বাদ দিয়ে, যাবতীয় ভদ্রলোকেই জীবনের মন্দ প্রকাশে লজ্জাবোধ করেন। কথায়, ব্যবহারে-চিন্তায় সুন্দর হওয়াই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। যে জীবনে মন্দের প্রতি ঘৃণা নেই সে জীবন কি অপবিত্র নয়? পাপের প্রতি, কুৎসিতের প্রতি সুবিপুল ঘৃণাই মানুষকে মহত্ত্বের পথে অগ্রগতি দান করে।

কলকাতায় একজন কোটিপতি ভদ্রলোক আমাদের খেতে দিয়ে করজোড়ে নিজেদের টি স্বীকার করতে লাগলেন। তার এই বিনয়ে তাঁর জীবনের কত সৌন্দর্যের প্রকাশ পেয়েছিল। তার এই বিনয় প্রকাশ না করলেও তো ক্ষতি ছিল না।

এক ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক একদিন আমার কাছে এসেছিলেন। আমি ভিতর থেকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, কে? তিনি স্কুলের বালকের মতো অতি তুচ্ছ, ক্ষুদ্র করে নিজের নামটি বলেন। আমি ভেবেছিলাম কোনো স্কুলের বালক হবে। বাইরে এসে দেখি সেই মান্যবর ভদ্রলোকটি।

এই বিনয় তাঁকে কুৎসিত ও ছোট করে নি। অথচ প্রায়ই দেখতে পাই, একশ্রেণীর নিম্নস্তরের লোকেরা ক্ষমতার বলে সাধারণের সঙ্গে কথায় কথায় অভদ্র ব্যবহার করে। তাতে তাদের জীবনের জঘন্য কুৎসিত চিত্রই নগ্ন হয়ে দেখা দেয়।

মানুষের দৃষ্টির অগোচরে, নিজের মনে জীবনের মন্দতা ধরতে শেখাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। যেখানে শিক্ষিত হয়েও মানুষ অন্ধ, সে শিক্ষার উদ্দেশ্য চৌর্যবৃত্তি। নাচওয়ালীর গান-বাদ্য শিক্ষার জন্যে অক্ষর পরিচয় লাভের মতো তা নিরর্থক।

প্রভুর আশীর্বাদ মানবসমাজের জন্যে বর্ষিত হোক এই প্রার্থনা।

<<মনুষ্য পূজা ।। মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়>>

……………………
মহা জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!