ভবঘুরেকথা
মুজাদ্দিদে আলফে সানী

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক

-মূর্শেদূল মেরাজ

মুজাদ্দিদে আলফে সানী ওরফে আহমেদ আল ফারুকি সিরহিন্দি ছিলেন ফিকহের হানাফি ধারা ও নকশবন্দী তরিকার অনুসারী। তাকে ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানী’ বলা হয় যার অর্থ ‘দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক’। মুঘল সম্রাট আকবরের দ্বীন-এ-ইলাহী ধর্মের বিরোধীতার জন্য তিনি অধিক পরিচিত। তার পিতার নাম শায়খ আব্দুল আহাদ।

আলফে সানী ১৪ শাওয়াল, শুক্রবার দিনগত রাতে ৯৭১ হিজরি (১৫৬১ সাল) পাঞ্জাবের পাতিয়ালা রাজ্যের সারহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুকের ২৮তম অধঃস্তন বংশধর।

তার মা গায়েবী ভাবে জানতে পারেন, প্রসিদ্ধ অলি শায়খ আহমদ জাম প্রায় চারশ বছর আগে তার সন্তানের নামকরণ করেছেন ‘আহমদ’। সেই মোতাবেক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার নাম রাখা হয় ‘শায়খ আহমদ’।

অন্যদিকে জন্মের কয়েকদিন আগে তার পিতা স্বপ্ন দেখেন, এক ব্যক্তি তরবারি দিয়ে একের পর এক ভেড়া-ছাগল জবাই করছে আর অদৃশ্য থেকে ভেসে আসছে ‘সত্য এসেছে মিথ্যা দূরীভূত হচ্ছে।’

স্বপ্নের এই বর্ণনা শুনে কাদেরিয়া তরিকার বিশিষ্ট আলেম কামাল কায়থালী বললেন, ‘আপনার বংশে একজন অলি আসবেন যিনি সকল কুফরী, শিরক, বেদাত নিশ্চিহ্ন করে ইসলামের পুনজাগরণ ঘটাবেন। এর কিছুদিন পরই আলফে সানী জন্মগ্রহণ করেন।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর শৈশব কাল

আলভে সানী ছোটবেলাতেও কখনো নগ্ন থাকতেন না। কখনো তার দেহ অনাবৃত হলে, সাথে সাথে তা ঢেকে নিতেন। সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও হাসি মুখে থাকতেন। শিশু অবস্থাতেই একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পিতা তাকে কামাল কায়থিলীর কাছে নিয়ে যান।

কায়থিলী তাকে দেখেই বলে উঠেন, ‘এই শিশুর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। পরিণত বয়সে সে আলেমে হাক্কানী ও আরিফে কামিল হবে এবং আমার মত হাজার হাজার লোক তার আত্মিক শিক্ষায় উপকৃত হবে। তার মাধ্যমে আল্লাহ প্রাপ্তির যে আলো সারা দুনিয়াতে ছড়াবে, তা কেয়ামত পর্যন্ত কখনো নিষ্প্রভ হবে না।’

এরপর কায়থিলী শিশুটির মুখে নিজ জিহবা দিলে সানী অনেকক্ষণ জিহবা লেহন করতে থাকে। শাহ সাহেব বলেন, ‘চিন্তা করবেন না, এই শিশু দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। শিশুটি এখন কাদেরিয়া তরিকার সব নিয়ামত লাভ করলো। আল্লাহর দ্বারা তার দ্বীনের খিদমত নিবেন।’

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর শিক্ষা

আলফে সানী অল্প বয়সে পবিত্র কোরান কণ্ঠস্থ করেন। পিতার কাছে আরো অনেক ধর্মীয় গ্রন্থও পাঠ করেন। সিরহিন্দের অন্যান্য খ্যাতিমান আলেমের কাছেও তিনি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন। শায়খ ইয়াকুব কাশ্মিরী, মাওলানা কাযী বাহ্লুল, স্বনামধন্য তর্কশাস্ত্রবিদ মাওলানা কামাল প্রমুখ তার শিক্ষক ছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জাহেরী ও বাতেনী শিক্ষার ভাণ্ডারে পরিণত হন।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর বিয়ে

কথিত আছে, দিল্লীর বাদশার পক্ষে থানেশ্বরের শাসনকর্তা শায়খ সুলতান স্বপ্নে দেখেন, নবীজী তাকে বলছেন- ‘তুমি তোমার মেয়েকে শায়খ আহমদ সিরহিন্দীর সাথে বিয়ে দাও।’

পিতার সাথে সিরহিন্দ যাওয়ার পথিমধ্যে খানেশ্বরে শায়খ সুলতানের সাথে আলফে সানীর সাক্ষাৎ হয়। সুলতান তাকে নিজ কন্যার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে, তিনি তার পিতার সম্মতিতে এ বিয়েতে রাজি হন। বিয়ের ফলে তার স্বচ্ছলতা আসে। যাতে করে তিনি বসবাসের জন্য সিরহিন্দে বসতবাড়ি ও ইবাদাতের জন্য খানকাহ নির্মাণ করেন, যা এখন ও বিদ্যমান।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সুফিবাদের সাধনা

তাসাউফের জ্ঞানার্জনের পর পিতার কাছে থেকেই তিনি প্রথমে চিশতিয়া তরিকায় খেলাফত প্রাপ্ত হন। এরপর কাদেরিয়া তরিকায় শ্রেষ্ঠ শাহ সিকান্দারের কাছ থেকে কাদেরিয়া তরিকায় খেলাফত লাভ করেন। তৎকালীন আরেক প্রসিদ্ধ তরিকা ‘কুব্রাবিয়া’তেও খেলাফত লাভ করেন প্রসিদ্ধ মাওলানা ইয়াকুবের কাছ থেকে।

সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজা বাকীবিল্লাহ নকশবন্দী তরিকা ভারতে নিয়ে আসলে তিনি তার প্রধান মুরিদ হন। মৃত্যুর আগে আলফে সানীর পিতা তাকে তার সমস্ত বাতেনী শক্তি দান করে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। ১০০৭ হিজরিতে পিতার মৃত্যুর পর আলফে সানী একই বছর হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

আলফে সানী তৎকালীন সমস্ত তরিকায় খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে পিতার নির্দেশ মতো নক্শবন্দী তরিকায় আত্মনিয়োগ করেন। তার সময় এই তরিকা ‘নক্শবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া আলীয়া’ নামে পরিচিত পায়।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সিরহিন্দে আগমন

খাজা বাকীবিল্লাহ আলফে সানীকে নকশবন্দী তরিকায় খিলাফাত দিয়ে সিরহিন্দ যাওয়ার নির্দেশ দেন। আলফে সানী সিরহিন্দ ফিরে আসলে দলে দলে লোক তার হাতে বায়াত হতে থাকে। এ সময় একদিন তিনি নামাজের পর মোরাকাবায় থাকা অবস্থায় দেখতে পান-

নবীজী তাকে একটি পোশাক পরিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘মুজাদ্দিদের প্রতীক স্বরূপ এই পোশাক দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। আমার উম্মাতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ থেকে তোমার উপর অর্পিত হলো।’

আলফে সানী এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমার উপর মুজাদ্দেদীয়াত বা সংস্কারকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মুরিদদের মারফতের শিক্ষাদেয়া আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে, যা অনেক ব্যাপক। -শায়খ আহমদ সিরহিন্দী, মাকতূবাতে ২য় খণ্ড

(চলবে…)

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই>>

………………………..
আরো পড়ুন:
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!