ভবঘুরেকথা
মুজাদ্দিদে আলফে সানী

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই

-মূর্শেদূল মেরাজ

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর দিল্লীতে অবস্থান

দিল্লী আসার অল্পদিনেই মুজাদ্দিদে আলফে সানীর খ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে। এমনকি শাহী দরবারের দর্শন ও তর্কশাস্ত্রে খ্যাতিমান আলেমরাও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি সম্রাট আকবরের সর্বধর্ম সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত দ্বীন-এ-ইলাহীর বিরোধীতায় জড়িয়ে পরেন।

এ কারণে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরোহনের পর মুজাদ্দিদে আলফে সানীকে কারাবন্দি করেন। কথিত আছে, জাহাঙ্গীর ভীষণ অসুস্থতার মাঝে স্বপ্নে দেখেন নবীজী তাকে বলছেন, ‘তুমি এ যুগের ইমামকে কষ্ট দিয়েছ। তুমি এ জন্যই অসুস্থ হয়েছ।’

এ ঘটনার পর জাহাঙ্গীর সকল শর্ত মেনে আলফে সানীকে মুক্তি দেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং আলফে সানীর কাছে বায়াত হন।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সংস্কার ভাবনা

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মন্তব্য ছিল- একটি বৃক্ষ যত বড়ই হোক মূলের সাথে তাকে সংযোগ বজায় রাখতেই হবে। …মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ ঊর্ধ্বকাশ থেকে যত খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য।

…ইসলাম ও মুসলমানদের মূল হলো কোরান ও নবীজী সুন্নাহ। ইসলাম রূপ বৃক্ষটির সাথে যদি এর মূলের নিবিড় সংযোগ থাকে তবে সে এই মূল থেকেই জীবনী শক্তি আহরণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথিবীর অন্যান্য মতবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ করবে, অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিত্যাগ করবে।

…ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। কোরান সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু ইসলামে অনুপ্রবেশ করলে বা করানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ বিধি বর্হিভুত।

…পীরবাদ দ্বারা আল্লাহর খলিফারা মানুষের খলিফায় পরিণত হয়। আলাদা হয়ে যায় শরিয়ত থেকে তরিকত। শরিয়তের অধীন না হলে সকল তরিকতই পথভ্রষ্ট হয়। আর পথভ্রষ্ট সুফিবাদের মাধ্যমে মুসলমানরা হয়ে যায় মহাধ্যানী, মহাযোগী বা বৈরাগী।

শরিয়তের তিন অংশ- জ্ঞান, কর্ম ও নিষ্ঠা। এ তিনটির সম্মিলন না হলে শরিয়ত হয় না। শরিয়ত প্রমাণিত ও বাস্তবায়িত হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিথ হয়। ইঅহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি একমাত্র শরিয়ত।

তরিকত ও হাকিকত (আধ্যাত্মিকতা) সুফিদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ দুটি শরিয়তের তৃতীয় অংশ অর্থাৎ ইসলামের পূর্ণতার জন্য শরিয়তের খাদেম বিশেষ। শরিয়তের পূর্ণতা বিধানই হচ্ছে তরিকত ও হাকিকতের উদ্দেশ্য।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মতে, সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। মন বিগড়ে গেলে দেহ বিপথগামী হয়। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন।

তিনি দ্বীনের সঠিক রূপ তুলে ধরাকে গুরুত্ব দিতেন। যারা তা গ্রহণ করতো তাদের সংঘবদ্ধ করে ঈমান ও আচার-আচরণ সংশোধনে সচেষ্ট হতেন।

তিনি বলতেন, ‘বন্দেগীর সকল প্রকার হক আদায় করা এবং আল্লাহর প্রতি সদাসর্বদা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থা ঠিক তখনি সৃষ্টির হবে- মানুষ যখন দুনিয়া ও আখেরাতের নেতার আদর্শকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে।’

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর জীবনে বড়পীরের ভূমিকা

রওযাতুল কাউইমিয়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে, বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী বাগদাদের কোন এক জঙ্গলে মোরাকাবা অবস্থায় শুনতে পান, ‘পাঁচশ বছর পর যখন দুনিয়ায় শিরক ও বেদাত ছড়িয়ে পড়বে, তখন একজন অলির আবির্ভাব ঘটবে।’

এরপর বড়পীর তার বিশেষ পোশাককে নিজ পুত্র তাজুদ্দীন আব্দুর রাজ্জাককে দিয়ে নির্দেশ দেন, ‘যখন ঐ অলি প্রকাশ হবে, তখন যেন এটা তাকে প্রদান করা হয়।’

একদিন মুজাদ্দিদে আলফে সানী মোরাকাবা অবস্থায় তার কাঁধে কাপড়ের স্পর্শ পেয়ে সজাগ হয়ে উঠেন। চোখ খুলে দেখেন সামনে তার পীর কায়থিলীর দৌহিত্র শাহ্ সেকান্দার দাঁড়িয়ে। শাহ্ সেকেন্দার বলেন, ‘আমি আপনার কাঁধের উপর যে পোশাকটি রেখেছি, তা বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীর স্মৃতির নিদর্শন।

এটা আমাদের বংশের কাছে দীর্ঘদিন থেকে আছে। আমার পিতামহ পোশাকটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আমানত হিসেবে তোমার কাছে রাখ, আমি যখন এটা কাউকে দিতে বলি, তখন তাকে দিয়ে দিও।’

সব শুনে শেষে নবীজী বলেন, ‘শায়খের যেহেতু নকশবন্দীতে পূর্ণতা লাভ হয়েছে, সেহেতু এ তরিকারই প্রচলন হোক। অন্যান্য তরিকার মূলতত্ত্ব তাকে প্রদান করা হোক। যার ফলে, তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দেদীয়া তরিকা সকল তরিকার সার হিসেবে পরিণত হবে এবং তোমরাও সকলে সমভাবে সওয়াবের অধিকারী হবে।

কিছুদিন থেকে তিনি পোশাকটি আপনাকে দেওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু কাদেরিয়া খান্দানের এ অমূল্য সম্পদ হস্তান্তর করতে আমার মন করছিল না। পিতামহ বলেন তার নির্দেশ অমান্য করলে, তিনি আমার কামালাত ও নিসবত ছিনিয়ে নেবেন; তখন আমি বাধ্য হয়ে এ দুর্লভ আমানত আপনাকে দেয়ার জন্য এসেছি।

পোশাকটি পড়তে গিয়ে আলফে সানী দেখতে পান- হযরত আলীর সাথে সমুদয় খলিফা, কামাল কায়থিলী, বড়পীর এমনকি হযরত আবু বকর, আব্দুল খালেক গাজদেওয়ানী থেকে শুরু করে, খাজা বাকীবিল্লাহ পর্যন্ত সমস্ত নকশবন্দী তরিকার মাশায়েখরও তার সামনে উপস্থিত।

বড়পীর তাকে কাদেরিয়া তরিকার সম্পূর্ণ জ্ঞানে পূর্ণ করে দিতে শুরু করেন। তখন সানীর মনে সংশয় দেখা দেয়। কারণ তার প্রতিপালন হয়েছে নকশবন্দীয়া তরিকার, সে তো সেই দলভুক্ত! এরূপ চিন্তা করতে করতে তিনি শুনতে পান নকশবন্দী মাশায়েখরা বড়পীরকে বলছেন- ‘শায়েখ আহমদ সিরহিন্দী আমাদের, আপনি অনর্থক তাকে আপনার দলভুক্ত করার চেষ্টা করছেন।’

বড়পীর বললেন, ‘শায়খ আহমদ প্রথমে আমাদের তরিকা থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে, কাজেই সে আমাদের রূহানী সন্তান।’

এক পর্যায়ে চিশতিয়া, কুব্রাবিয়া, ও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার মাশায়েখরাও আলফে সানীকে তাদের তরিকাভুক্ত ও রূহানী সন্তান বলে দাবী করতে শুরু করেন।

সব শুনে শেষে নবীজী বলেন, ‘শায়খের যেহেতু নকশবন্দীতে পূর্ণতা লাভ হয়েছে, সেহেতু এ তরিকারই প্রচলন হোক। অন্যান্য তরিকার মূলতত্ত্ব তাকে প্রদান করা হোক। যার ফলে, তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দেদীয়া তরিকা সকল তরিকার সার হিসেবে পরিণত হবে এবং তোমরাও সকলে সমভাবে সওয়াবের অধিকারী হবে।

(চলবে…)

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন>>

………………………..
আরো পড়ুন:
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

…………..
সূত্র:
মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী জীবন ও কর্ম: ডক্টর আ. ফ. ম. আবু বকর সিদ্দিক।
মুজাদ্দিদই-ই-আলফেসানীর সংস্কার আন্দোলন, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ১ম প্রকাশ, ইফাবা প্রকাশনী।

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!