ভবঘুরেকথা
মুজাদ্দিদে আলফে সানী

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

-মূর্শেদূল মেরাজ

যেহেতু নবী-রাসূলদের পর সাহাবী আবু বকর থেকে নকশবন্দী তরিকার উৎপত্তি এবং এই তরিকার মধ্যে অন্য তরিকার চাইতে দৃঢ়তার সাথে সুন্নতের অনুসরণ ও বেদাত বর্জনে লক্ষ্য রাখা হয়, সে জন্য এ তরিকাই দ্বীনের সংস্কার ও পূনরুজ্জীবনের জন্য অধিক সহায়ক।’

এর ফলে পূর্ববর্তী সকল তরিকার সমন্বয়ে সৃষ্টি হল নতুন এক তরিকা। যার সিলসিলার নাম ‘তরিকায়ে মুজাদ্দেদীয়া’।

 

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মতে মুজাদ্দিদ

এই তরিকার অনুসারিদের মতে, ১০ই রবিউল আউয়াল ১০১০ হিজরি স্বয়ং নবীজী রূহানীভাবে আলফে সানীকে ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মানুষ ধর্ম বিমুখ হয়ে গেলে স্রষ্টার তরফ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়। নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের আগমন ঘটেছে। এ ধারা বন্ধ হয়ে গেলে, নবী চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলীর অধিকারী নায়েবে নবীদের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়। মুজাদ্দিদ শব্দের অর্থ সংস্কারক।

‘মুজাদ্দিদ’ পদটি অন্য সব উপাধি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ। কাউকে ‘মুজাদ্দিদ’ রূপে গ্রহণ করার হলো মানে- ‘জ্ঞান ও চরিত্র উভয় ক্ষেত্রে তার মহত্ব স্বীকার করা।’

চেষ্টা চরিতার্থ করলে শিক্ষিত হওয়া যায় কিন্তু মুজাদ্দিদ হওয়া যায় না। যেমন চেষ্টা, সাধনা বা কারো সমর্থনে নবুয়ত লাভ করা করা যায় না। নবুয়ত ও মূজাদ্দেদীয়াত উভয়ের মনোনয়ন কেবল স্রষ্টার পক্ষ থেকেই হয়।

মুজাদ্দিদের মূল কাজ হলো বেদাত রহিত, বিপথগামীকে সংশোধন ও নবীজীর সুন্নতের পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা এবং এই বিশেষ কর্তব্য পালনে কোন প্রতিবন্ধকতার পরোয়া না করা। -মাকতুবাত, ২য় খণ্ড

নবীজী তার অনুসারীদের উপর পাঁচশো এবং হাজার বছর পর দু’বার দুর্যোগ নেমে আসবে বলে জীবদ্দশায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। মুজাদ্দেদীয়ারা নবীজীর পাঁচশো বছর পর মুসলিম বিশ্বে তাতারী হামলা এবং হাজার বছর পর আকবরের দ্বীন-এ-ইসলামকে এই দুই দুর্যোগ বলে চিহ্নিত করেন।

প্রথম দুর্যোগে ‘উসমানিয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। যার ফলে ৬ষ্ঠ শতকে ইসলাম ও মুসলিম জাহান নতুন খাতে প্রবাহিত থেকে থাকে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নতুন যুগের সূচনা হয়। এই ধারা পাঁচশো বছর ধরে অব্যাহত থাকে।

আর দ্বিতীয় দুর্যোগকালে আলফে সানী স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত হন। অনুসারিরা বলেন, তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে নবীজী বলেছিলেন-

একাদশ শতকের শুরুতে আল্লাহ্ দুনিয়ায় এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি উজ্জ্বল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন। তার নামকরণ করা হবে আমারই নামানুসারে। তার প্রদর্শিত পথে অসংখ্য লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। -মাওলানা হাসান কাশ্মী; রওজাতুল কাইয়ুমিয়া পৃ: ৩৭-৩৮

মুজাদ্দিদে আলফে সানী আরো লিখেছেন- জেনে রাখ যে, শত ও হাজার বছরের মুজাদ্দিদ এক নয়। শত ও হাজারের মধ্যে যে পরিমাণ প্রভেদ, ঐ পরিমাণ, বরং তারচেয়েও অধিক প্রভেদ উভয় মুজাদ্দিদের মধ্যে বিদ্যমান।

নবীজী সমস্ত নবী-রাসূলের মাধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তার পর আর কোন নবী-রাসূল আসবে না। এ জন্য খোদা তার দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়াতে জারি রাখার জন্য ‘মুজাদ্দিদ’ প্রেরণের ব্যবস্থা করেছেন। হাদিসে নবীজী বলেছেন-

নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক শতকের শুরুতেই উম্মতের দ্বীনের সংস্কারের জন্য একজন ‘মুজাদ্দিদ’ প্রেরণ করবেন। -আবু দাউদ

অর্থাৎ প্রতি হিজরি শতকের শুরুতে একজন করে মুজাদ্দিদ শ্রেণীর অলির আগমন ঘটবে, যার উছিলায় আল্লাহ দ্বীন ইসলামকে সুরক্ষিত করবেন। অনুসারীদের মতে, আলফে সানী শুধু শতকের ‘মুজাদ্দিদ’ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাজার বছরের মুজাদ্দিদ।

খ্যাতিমান মুহাদ্দিস হাফিজ ইবন হাজার আস্কালানী বলেন, ‘প্রত্যেক শতকের জন্য একজন মুজাদ্দিদই যথেষ্ট। অবশ্য কারো কারো মতে, একের অধিক মুজাদ্দিদও থেকে পারে। শাহ্ অলিউল্লাহ এ মতের অনুসারী।

তিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানী সম্বন্ধে বলেন, তার আগে সাধারণতঃ শতকের মুজাদ্দিদ প্রেরিত হয়েছে; কিন্তু হাজার বছরের মুজাদ্দিদ কেউ হননি। কেননা, এ হিজরি দ্বিতীয় হাজার বছর শুরু হয়নি। আর প্রথম হাজার বছরের মধ্যে স্বয়ং নবীজীর পবিত্র অস্তিত্বই বিদ্যমান ছিল।

বলা হয়, মুজাদ্দিদে আলফে সানীর পূর্ববর্তী মুজাদ্দিদদের প্রভাব ছিল এক শতকের জন্য। কিন্তু তার মুজাদ্দেদীয়াতের প্রভাব হলো আগামী এক হাজার বছরের জন্য। আলফে সানী লিখেছেন, ‘এই গভীর মারফত সাধারণ অলিরা, জাহিরী আলেমদের মত বুঝতে অক্ষম। কেননা, এই জ্ঞান নবুয়তের প্রদীপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য প্রকাশ হয়েছে।’ -মাকতুবাত, ২য় খণ্ড

মুজাদ্দিদে আলফে সানী আরো লিখেছেন- জেনে রাখ যে, শত ও হাজার বছরের মুজাদ্দিদ এক নয়। শত ও হাজারের মধ্যে যে পরিমাণ প্রভেদ, ঐ পরিমাণ, বরং তারচেয়েও অধিক প্রভেদ উভয় মুজাদ্দিদের মধ্যে বিদ্যমান।

 

মুজাদ্দিদে আলফে সানীরমুজাদ্দেদি তরিকা

পূর্বের অলিদের উন্নতি বেলায়েতের স্তর পর্যন্ত ছিল। আলফে সানীই প্রথম ‘বেলায়েতের’ উপরে এবং ‘নবুয়তের’ নীচে ‘কাইউমিয়াতের’ মাকামের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, তার নিজের মাকামগত উন্নতি চার খলিফার মতো বেলায়েত থেকে নবুয়ত পর্যন্ত হয়েছিল এবং বেলায়েতের উপরে কাইউমিয়াতের স্তর তার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। তাই তিনি নবীজীর উম্মতের প্রথম কাইউম রূপে আখ্যায়িত হন।

তার বংশের অন্য তিনজন কাইউম হলেন-

১. খাজা মুহাম্মাদ মাসুম (দ্বিতীয় কাইউম)।
২. ছিলেন খাজা মুহাম্মদ নকশবন্দ (তৃতীয় কাইউম)।
৩. খাজা মুহাম্মদ জুবাইর (চতুর্থ কাইউম)।

তিনি আরো বলেন, শেষ জামানায় যখন ইমাম মেহেদি আসবেন, তখন তিনি তার তরিকার খলিফাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। কেয়ামত পর্যন্ত তার তরিকাভুক্ত মুরিদদের পরিচয় তাকে জানানো হয়েছে।

‘ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিন’ আলফে সানীর উপাধি। এ ছাড়া তাকে ‘খাজিনাতুর রহমত’ বা রহমতের ভাণ্ডার উপধিতে ভূষিত করা হয়। অনুসারীরা বলেন, তিনি মাধ্যম ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার কাছে কোরানের ‘হরুফে মুকাত্তিয়াতের’ ভেদ প্রকাশ করা হয়।

আলী তাকে আসমানের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং খিজির (আ) ও ইলিয়াস (আ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে হায়াত ও মউতের গুপ্ত রহস্য জানিয়ে দেন। তাকে অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাসমূহ জানানো হয়েছিল।

 

মৃত্যু

ইমামে শায়খ রাব্বানী মুজাদ্দিন মুজাদ্দিদে আলফে সানী ১৬২৪ সালে ৬০ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বস ত্যাগ করেন। ভারতের সিরহিন্দে তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই তার মাজার অবস্থিত। বিশ্ব জুড়ে আজ তার অগনতি ভক্ত অনুসারী তার তরিকা প্রচারে রত আছে।

(সমাপ্ত)

<<মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক

………………………..
আরো পড়ুন:
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

…………..
সূত্র:
মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী জীবন ও কর্ম: ডক্টর আ. ফ. ম. আবু বকর সিদ্দিক।
মুজাদ্দিদই-ই-আলফেসানীর সংস্কার আন্দোলন, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ১ম প্রকাশ, ইফাবা প্রকাশনী।

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!