ভবঘুরেকথা

নমস্কার

-লুৎফর রহমান

আর নমস্কার করো না, জগতের অত্যাচার মানুষের মাথাকে চরম অপমান করেছে। মানুষকে সে দাবিয়ে রাখতে, ছোট করতে চেষ্টা করেছে। তাকে বুক দিয়ে ভালোবাসে নি- তাকে মাত্র শাসিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে- প্রেমে কাছে ডাকে নি। তাকে ভ্রাতৃ সম্বোধন জানায় নি।

মানুষকে প্রেমে বুকের সঙ্গে বরং চেপে ধরতার হস্ত প্রেমে হৃদয়ের উপর রাখ। প্রেমের ছলনা কর না মিথ্যা নমস্কার করে; লজ্জায় ও ভয়ে, ঘৃণায় ও গোপন ক্রোধে। আত্মার সহজ নিঃসারিত শ্রদ্ধার নিবেদনের নাম নমস্কার। এ জিনিসটা বল প্রয়োগের দ্বারা বা অনিচ্ছায় হওয়া ভালো নয়।

মানুষের কাছে নত না হলে, নমস্কার না করলে মানুষ দাম্ভিক এবং বিদ্রোহী বলে সন্দেহ করে। সুতরাং সময় ও পাত্র বুঝে নমস্কার করা উচিত।

মোটের ওপর মানুষের কাছে নত হওয়া, মানুষকে অভিবাদন করা, ভদ্রতা দেখান অতীতকালের উচ্চস্তরের লোকদের প্রকৃতি ছিল। দুষ্টের হাতে নমস্কারের অপব্যবহারে এর সার্থকতা সম্বন্ধে বর্তমানে মনে সন্দেহ জাগে।

নমস্কারের দ্বারা অনেক পাপ ঢাকা পড়ে। কোনো কোনো দুরাচার নমস্কার করে জীবনের পাপ ঢেকে রাখে। তাদের দোষ পদস্থ লোকেরা তাদের তোষামোদ ও নমস্কারের মোহে ভুলে যান। এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান লোকদের খুব সাবধান হওয়া উচিত।

পরিবারের গুরুজনদের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধা নিবেদন ভালো। রাত্রিবেলা বিদায়কালে পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে নেওয়া ভালো, তাতে পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব জাগে।

নমস্কার অর্থ আনুগত্য, বশ্যতা- কোনো অমিল ও বিদ্রোহের ভাব নয়। পুত্র পিতাকে, স্ত্রী স্বামীকে, পুত্রবধূ শাশুড়ী ও শ্বশুরকে, ছোট বড়কে সময় ও শোভনমতো অভিবাদন করা মন্দ নয়। বাড়াবাড়ি জিনিসটা ভালো নয়।

জীবনের পাপ ও অন্যায় ঢাকার জন্য যারা হরদম বিনয় প্রকাশ করে এবং নমস্কার করে, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে সুখী হবে না, তাদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকবে।

হাত উঠিয়ে বা মাথা নাড়া দিয়ে অভিবাদন জানান হয়- তার অর্থ মুখের শব্দ অনেক সময় ভিড়ের মাঝে গোলমালে শোনা যায় না। অভিবাদনের ভাষা বিদেশী হওয়া মোটেই শোভন নয়। ”আচ্ছালামো”- ইত্যাদির পরিবর্তে আপনার মঙ্গল হোক, আপনি শান্তিতে থাকুন বলা ভালো।

ভাষার প্রতি মোহ কিছুই নয়- ভাব ও আত্মার চাইতে দেহ বড় নয়। পদ চুম্বন জিনিসটা সভ্য-জগতের মধ্যে নেই। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অমর্যাদা করবার অর্থ ঈশ্বরের অপমান। অতি নিকটবর্তী গুরুজন যারা এবং সঙ্গে সঙ্গে সে পদলোভী বাজে লোক ও শুধু “শান্তি সম্ভাষণে” অর্থাৎ “আচ্ছালামো”…ইত্যাদি অভিবাদন বলে মনে করেন। সভ্যজাতির মধ্যে গুরুজন ও ভদ্রলোকদেরকে একই ধারায় সম্মান দেখান হয়- এর নানা রকম ধারা নেই।

সমাজে যা চলে আসছে বা চলছে তার পরিবর্তন সহজে সম্ভব নয়। তবে উচ্চস্তরের লোকেরা যা করেন, সাধারণ লোক তাই অনুসরণ করে।

মোটের ওপর মানুষের কাছে নত হওয়া, মানুষকে অভিবাদন করা, ভদ্রতা দেখান অতীতকালের উচ্চস্তরের লোকদের প্রকৃতি ছিল। দুষ্টের হাতে নমস্কারের অপব্যবহারে এর সার্থকতা সম্বন্ধে বর্তমানে মনে সন্দেহ জাগে।

অন্তরে ভাব নেই- প্রাণে শ্রদ্ধা নেই- বাইরে ভয় ও লজ্জাজনিত এরূপ নমস্কারের অভিনয় কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। যোগ্য ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা না জানানোও ভালো নয়। হযরত নবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে- তাকে কেউ কোনো দিন আগে নমস্কার করতে পারে নি।

এক ব্যক্তিকে জানি, তাকে কোনোদিন কেউ আগে নমস্কার করতে পারত না- কিন্তু তার গোপন জীবন অতি কুৎসিত পাপে পূর্ণ ছিল অথচ নমস্কারের জোরে তিনি জীবনের সর্বস্তরে জয়ী হয়েছেন। এতে মনে হয়েছে, মানুষ মানুষের ভিতরের স্বভাবকে বিশ্লেষণ করে দেখতে যায় না। সে তোষামোদেই মোটের উপর তুষ্ট হয়। সেজন্য অতিরিক্ত নমস্কারে তুষ্ট হওয়া ভালো নয়, অতিরিক্ত নমস্কার করাও যেন ঠিক নয়।

প্রণাম, অভিবাদন, নমস্কার এসব মনুষ্যসমাজ থেকে একেবারে তুলে দেওয়া ভালো। এরমধ্যে যেন পৌত্তলিকতা আছে। রাজা-প্রজা, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, বন্ধুতে-বন্ধুতে প্রতিবেশী প্রতিবেশীতে প্রণতি না হওয়াই ভালো, কারণ এর দ্বারা জগতে অনেক পাপ ঢাকা পড়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, মানুষের দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দেয়।

এক যুদ্ধক্ষেত্রে জনৈক শত্রু (বোধ হয় ফরাশি) সেনাপতি ইংরেজের সুসজ্জিত কামান শ্রেণীর ভিতর এসে পড়েন। নিকটেই পাহাড়ের ধারে জঙ্গলের অন্তরালে যে সহস্র বন্দুকধারী সৈন্যদল অপেক্ষা করছে, এ তিনি বুঝতে পারেন নি। ইচ্ছা করলে, তখনই তাকে হত্যা করে ফেলা যেতো।

কিন্তু শত্রু সেনাপতি ভদ্রতায় মাত্র একটা বন্দুকের শব্দ করে তার বিপদ সম্বন্ধে সজাগ করে দিলেন। ফরাশি সেনাপতি শত্রুর এই ভদ্রতার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ একটি অভিবাদন জানিয়ে মৃদু হেসে অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনটি তার পক্ষে তখন খুবই শোভন হয়েছিল।

এক বিচারপতি এক মহানুভব ব্যক্তির উপর অন্যায় করে জেনে-শুনে গুরুতর শাস্তির দণ্ড দিলেন। এই ব্যক্তি রাজাসনকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে এই দণ্ড নত মাথায় গ্রহণ করে বিচারালয় ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনের মূল্য অনেক বেশি। বিনয়ে নত হওয়া মানুষের স্বভাব। মানুষ ঈশ্বরজাত- ঐশ্বরিকভাবে তাই সে নত হয়।

ঈশ্বর ছাড়া কোনো মানুষকে নমস্কার, প্রণাম বা অভিবাদন করা ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ। একমাত্র ঈশ্বরই প্রণামের পাত্র। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদা ইসলাম এইভাবে রক্ষা করেছে। কিন্তু তবু মানুষ মানুষের সামনে মাথা নত করে মানুষকে মানুষ ঈশ্বর জ্ঞান করে। মোগল এবং মুসলমান বাদশাহকে মানুষ কি কুৎসিতভাবে সেজদা। করতো!

যে মানুষ এইভাবে সম্মান লাভ করে এবং যে এইভাবে সম্মান করে উভয়েই পাপী। একবার মি. জুসেনকে কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম; মি. জুসেন, আপনি আপনার রাজাকে সম্মান দেখানোর জন্যে তাঁর সামনে জানু পেতে বসে, তাকে নমস্কার করবেন, না তার সামনে করমর্দন করবেন? তিনি বল্লেন; আমি তাঁর সঙ্গে করমর্দন করবো।

প্রণাম- যে সর্বহারা রিক্ত, তার পক্ষে জানা বড় কষ্টকর। যে বড় সেই ছোট হতে পারে। যে ছোট তাঁর ছোট হওয়া শোভা পায় না।

প্রণাম, অভিবাদন, নমস্কার এসব মনুষ্যসমাজ থেকে একেবারে তুলে দেওয়া ভালো। এরমধ্যে যেন পৌত্তলিকতা আছে। রাজা-প্রজা, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, বন্ধুতে-বন্ধুতে প্রতিবেশী প্রতিবেশীতে প্রণতি না হওয়াই ভালো, কারণ এর দ্বারা জগতে অনেক পাপ ঢাকা পড়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, মানুষের দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দেয়।

মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা ও ব্যবহারেই জানা যায় সে ভালো কি মন্দ। তার হৃদয়ে প্রেম আছে, না সে নিষ্ঠুর।

ইসলামের শান্তি সম্ভাষণ জিনিসটা খুবই ভালো। এতে কারো স্বাধীনতা নষ্ট হয় না, অথচ পরস্পরে প্রেমের ভাব বর্ধিত হয়। মানুষের জন্যে ঈশ্বরের কাছে কল্যাণ এবং শান্তি কামনা আরবি বাক্য ‘আচ্ছালামো আলায়কুমের অর্থ না বুঝার দরুনই বিদঘুঁটে লাগে। মাতৃভাষায় ওর অনুবাদ”শান্তি লাভ করুন- আপনার মঙ্গল হউক।”

<<উপাসনা ।। তপস্যা>>

……………………
মহা জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!