ভবঘুরেকথা
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার

নাসির উদ্দিন সিপাহসালার

-মূর্শেদূল মেরাজ

হজরত আলীর পুত্র ইমাম হুসাইন (র)-এর দিক থেকে সৈয়দ পরিবারে বাগদাদ নগরীতে সিপাহসালার নাসির উদ্দিন (র) জন্মগ্রহণ করেন। অপর সূত্র মতে, ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম হয় মদীনা শহর। তবে বাগদাদে বসবাস করতেন। রাজ পরিবারের সাথে কলহের জেরে তার বংশের অনেকেই বাগাদাদ ছেড়ে ভারত এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

সে দলে সিপাহসালারও ছিলেন। এ সময় তিনি দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর অধীনে সৈনিক বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহী সেনার একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দকে প্রতিহত করতে দিল্লী থেকে সিলেটের দিকে রওনা হন।

আরবের বাগদাদ শহরে বসবাসরত হযরত আলীর বংশের অধস্তন পুরুষ সৈয়দ হাসান আরাবী ছিলেন সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের পিতা। তার ঊর্ধ্বতন বংশ পুরুষ যথাক্রমে-

১. হযরত আলী (রা)।
২. হজরত ঈমাম হোসাইন (রা)।
৩. হজরত ঈমাম জয়নুল আবেদীন।
৪. হজরত ঈমাম বাকের।
৫. হজরত ঈমাম জাফর আস সাদিক।
৬. হজরত ঈমাম মুসা আল কাযিম।
৭. হজরত ঈমাম মুসা আল রেযা।
৮. হজরত ঈমাম আলী আত তাকী।
৯. হজরত ঈমাম আলী আন নাকী।
১০. হজরত ঈমাম হাসান আল আসকারী।
১১. হজরত আলী আল মাহদী।
১২. হজরত আবুল ফজল।
১৩. হজরত আবুল ফাত্তাহ।
১৪. হজরত দাউদ আত তায়ী।
১৫. হজরত হাসান আল আরাবী।
১৬. নাসির উদ্দিন সিপাহসালার।

কথিত আছে, বুরহানুদ্দীন নামক জনৈক ব্যক্তি ছেলের নামকরণ উৎসব উপলক্ষে গরু জবাই করলে গৌড়ের রাজা গৌড় গোবিন্দ তার ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বুরহানুদ্দীন এ ঘটনার বিচার প্রার্থনা করলে বাংলার তৎকালীন রাজা শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ তার ভাগনে সিকান্দর গাজীকে সৈন্যসহ গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন।

কিন্তু সৈন্যদল ব্রহ্মপুত্র নদী পার হওয়ার সময় রাজা গৌবন্দের দৈবিক শক্তির অগ্নীবাণে পরাস্ত হয়। এই সংবাদ পেয়ে দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজী সেনাবাহিনীর সাথে আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন কাউকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

শাহজালাল আউলিয়ার নির্দেশে সিপাহসালার সহজেই সেই ধনুতে ছিলা সংযোগ করেন। কথিত আছে, সিলেট বিজয়ের সময় শাহজালালের আজানের ধ্বনিতে গৌড় গোবিন্দের প্রাসাদ ভেঙ্গে যায়। অবশ্য গৌড় গোবিন্দ আগেই তার রাজধানী পেঁচাগড়ে স্থানন্তরিত করেছিলেন।

কথিত আছে, জ্যোতিষদের কথামত ঝড়ের রাতে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হলেও সৈনিক নাসির উদ্দিনকে একাগ্র মনে কোরান পড়তে দেখে তিনিই সেই ব্যক্তি বলে অভিহিত করা হয়। এ খবর পেয়ে সম্রাট স্বয়ং উপস্থিত হয়ে নাসির উদ্দিনকে সিপাহসালার সনদ প্রদান করে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। সেই থেকে নাসির উদ্দিন ‘সিপাহসালার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

পথিমধ্যে পূর্বে প্রেরিত সিকান্দর গাজীর সাথে সোনারগাঁয় ও আরব থেকে আগত আউলিয়া হজরত শাহজালালের সাথে ত্রিবেণীতে সাক্ষাৎ হয়। সেখান থেকে দিল্লীর সুলতানী আদেশানুসারে হজরত শাহজালাল ও সিকান্দর গাজীর সম্মতিক্রমে সেনার প্রধান হয়ে সিলেট অভিযানে রওয়ানা হন সিপাহসালার।

কথিত আছে, সিলেটের চৌকি পরগনায় সেনা উপস্থিত হলে রাজা গৌড় গোবিন্দ তাদের আধ্যাত্মিকতা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে এক প্রকাণ্ড লৌহ ধনুক প্রেরণ করেন। শর্ত দেন কেউ যদি একা এই ধনুকের ‘ছিলা’ সংযোগ করতে পারে তবে গোবিন্দ নিজ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন।

হজরত শাহজালাল ধনুক দেখে বললেন, যে ব্যক্তি সারা জীবনে কখনো ফজরের নামাজ কাজা করেনি বা বাদ দেয়নি একমাত্র সেই পারবে এই ধনুকে ‘ছিলা’ পরাতে। অনুসন্ধানে দেখা গেলো সেবার মধ্যে সিপাহসালারই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনদিন ফজরের নামাজ কাজা করেন নি।

শাহজালাল আউলিয়ার নির্দেশে সিপাহসালার সহজেই সেই ধনুতে ছিলা সংযোগ করেন। কথিত আছে, সিলেট বিজয়ের সময় শাহজালালের আজানের ধ্বনিতে গৌড় গোবিন্দের প্রাসাদ ভেঙ্গে যায়। অবশ্য গৌড় গোবিন্দ আগেই তার রাজধানী পেঁচাগড়ে স্থানন্তরিত করেছিলেন।

কিন্তু দাফনের পর কবরস্থান থেকে ৪০ কদম দূরে আসা মাত্রই সকলে বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে গিয়ে দেখেন তার সমাধিটি নিজে নিজেই উত্তর-দক্ষিণের পরিবর্তে পূর্ব-পশ্চিমে হয়ে গেছে। যা এখনো সেভাবেই আছে। সেখানে সিপাহসালার সহ ১২০ আউলিয়া মুড়ারবন্দেপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ৫ শতাধিক জামগাছের সুশীতল ছায়ায় শায়িত আছেন।

৭০৩ হিজরি (১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ) শাহী সেনার হাতে সিলেট জয় হয়। এরপর শাহজালালের আদেশে সিপাহসালার বারজন সঙ্গী নিয়ে ১৩০৪ সালে রাজা আচানক নারায়ণকে শায়েস্তা করতে তরফ রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। জনশ্রুতি আছে, এ সময় সিপাহসালার সাথে তিন হাজার পদাতিক ও এক হাজার অশ্বারোহী সেনা ছিল।

ধারণা করা হয়, বর্তমান হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অংশাবশেষ ও পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর পূর্বাংশ সেসময় পরিচিত ছিল তরফ রাজ্য নামে। শাহী সেনাদের আগমন সংবাদ পেয়ে তরফ রাজ্য থেকে আচানক নারায়ণ পালিয়ে ত্রিপুরার রাজাদের আশ্রয়ে চলে যান। এভাবে তরফ রাজ্য সিপাহসালার অধিকারে আসে।

সিপাহসালার সৈন্য সহ তরফ রাজ্যের যে স্থানে বসবাস করতে শুরু করেন সে স্থানটি লস্করপুর নামে পরিচিতি পায়। সিপাহসালার মৃত্যুর পর তার পুত্র সিরাজউদ্দীন তরফের শাসনভার লাভ করেন। এই সিরাজউদ্দীনের থেকেই সিপাহসালার বংশ বিস্তৃত হয়।

সিপাহসালার নাসির উদ্দিন তার অনুসারীদের বলে গিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর নিয়মানুযায়ী দেহটাকে উত্তর দক্ষিণে না দিয়ে পূর্ব পশ্চিমে দেয়ার জন্য। কিন্তু স্থানীয় আলেমরা তা করতে না দিলে উত্তর দক্ষিণে মৃত দেহ দাফন করা হয়।

কিন্তু দাফনের পর কবরস্থান থেকে ৪০ কদম দূরে আসা মাত্রই সকলে বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে গিয়ে দেখেন তার সমাধিটি নিজে নিজেই উত্তর-দক্ষিণের পরিবর্তে পূর্ব-পশ্চিমে হয়ে গেছে। যা এখনো সেভাবেই আছে। সেখানে সিপাহসালার সহ ১২০ আউলিয়া মুড়ারবন্দেপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ৫ শতাধিক জামগাছের সুশীতল ছায়ায় শায়িত আছেন।

সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের শায়েস্তাঞ্জের পথে চুনারুঘাটের মুড়ারবন্দে তার মাজারে প্রতি বছরে ১৩-১৫ জানুয়ারি তিনদিন ব্যাপী পবিত্র বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ জানুয়ারি সকালে মাজারের গিলাপ ছড়ানোর মধ্য দিয়ে ওরসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ১৫ জানুয়ারি সকালে রওজা গোসল শেষে রাত ১টায় আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ওরসের সমাপ্তি ঘটে।

…………………
তথ্যসূত্র
উইকিডিয়াসমূহ
সিলেটঃ ইতিহাস ঐতিহ্য ড. শরিফ উদ্দীন আহমদ, (শামস উদ্দীন আহমদ লিখিত প্রবন্ধ – মুসলিম শাসন ব্যবস্থা), ২০৯ পৃঃ, গ্রন্থ প্রকাশনায়- বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, প্রকাশকাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ।
তরফ বিজেতা সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন ও মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। সৈয়দ মোস্তফা কামাল। প্রকাশনায়-সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন স্মৃতি পরিষদ মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। প্রকাশ কাল জানুয়ারি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, দরবেশ শাহজালাল অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়, তরফের কথা গ্রন্থকার – অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি, মুফতি আজহারুদ্দীন সিদ্দিকি, উৎস প্রকাশন ঢাকা, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০০২, পরিদর্শনের তারিখ: ২৯ আগষ্ঠ ২০১১

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!