ভবঘুরেকথা
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব

নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : দুই

-সুকুমারী ভট্টাচার্য

এই ভাবে মৃত ব্যক্তি নয়, পরলোকে মৃত ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে জীবিতের উদ্বেগকেই কাজে লাগানো হয়েছিল, এবং অজ্ঞাত ভবিষ্যৎ অবস্থানের সম্পর্কিত চিন্তাই সমাজ থেকে তার প্রাপ্য নিষ্কাশন করে নিত।

মহাকাব্য ও পুরাণের যুগে, লোকপ্রিয় এই সব শাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এক নূতন স্তরে, হিন্দুত্বের চরম গঠনমূলক স্তরে প্রবেশ করি। ইতোমধ্যে, বৈদিকযুগের যজ্ঞনির্ভর ধর্ম থেকে সমাজ বহু দূরে সরে এসেছে। যদিও রাজা এবং ধনবান পৃষ্ঠপোষকরা তখনও যজ্ঞানুষ্ঠান করতেন, তবুও বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ের পূর্বেই জনসাধারণ এই সব যজ্ঞমূলক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেতপ্রে কেবলমাত্র নিরপেক্ষ দর্শকের পর্যায়ে নেমে এসেছিল, কারণ এই সব যজ্ঞব্যয়ের ভার বহন করা যেমন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তেমনই এগুলি ছিল দুর্বোধ্য।

কৌমগত সমাজবিধি ভেঙে যাওয়ার ফলে প্রাচীন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল; মুখ্য সমষ্টিগত যজ্ঞগুলি হত রাজাদের ও সমাজ প্রধানদের জন্য এবং তাঁদের দ্বারাই এগুলি অনুষ্ঠিত হত। গুপ্ত আধ্যাত্ম রহস্যের জ্ঞান-যোগে মোক্ষলাভ–উপনিষদের এই মতবাদ ছিল সাধারণ লোকের বুদ্ধির অগম্য। সুতরাং তাদের আশ্রয়যোগ্য মতবাদ অতি অল্পই ছিল; এই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এল মহাকাব্য পুরাণের যুগের প্রকাশমান ধর্মযার নাম হিন্দু ধর্ম। এই ধর্ম তার মূলভিত্তি করে গ্রহণ করেছিল কর্মফল ও জন্মান্তরিবাদের তত্ত্বকে।

সাধারণ লোকের মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় তত্ত্বকে ফলপ্রসু ভাবে প্রচারের জন্য মহাকাব্য ও পুরাণগুলি, পুরাকথা কিংবদন্তী ও নানাবিধ আকর্ষণীয় গল্পের অবতারণা করেছিল। মহাভারত থেকে নেওয়া এমন একটি গল্পকে বিচার করা যাক (ত্রয়োদশ-১)-

‘গৌতমীর পুত্র সর্পাঘাতে মারা গেল। সে তার সন্তানের অকালমৃত্যুর জন্য সাপকে দোষারোপ করল। সাপ তা অস্বীকার করল এই বলে যে ওই বালকের সময় পূর্ণ হয়েছিল, অতএব দোষ কালের। কাল শব্দের অর্থসময় এবং মৃত্যু উভয়ই। অভিযুক্ত হয়ে কাল তখন বললেন তিনি নিমিত্তমাত্র, বালকের পূর্বজন্মার্জিত নিজকর্মই তার মৃত্যুর সময় ও উপায় নির্ধারণ করেছে।’

সুতরাং চরম বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের নিজ কর্মই তার জন্ম ও মৃত্যুর কারণস্বরূপ। কাল, অন্তক, যম এদের সবাইকেই, ভিন্ন ভিন্ন অংশে বলা হয়েছে ধর্মরাজ। অর্থপূর্ণভাবেই এই যুগে দেখা যায়, এই সব কল্পিত শক্তির কাছে দেবতারাও নতিস্বীকার করছেন। উদাহরণরূপে বলা যায়। ভবিষ্য পুরাণ-এ দেখা যাচ্ছে বিষ্ণু, কালের আজ্ঞাবহ রূপে কাজ করছেন।

অথবা কোনও ব্যক্তি যদি কোনও নির্দোষের ক্ষতি করে, সে তাকে কোনও বিপদ, ক্ষতি, অঙ্গহানি নরকবাস বা অন্য কোনও দুঃখের অভিশাপ দেয়। এই সব আশীর্বাদ বা অভিশাপ এই জন্মে অথবা পরজন্মে সফল হয়। আবার এগুলি, বিশেষ করে অভিশাপ অনেক সময়ই সংশোধিত, সীমিত, লঘুকৃত বা বিলম্বিত করা হয়, যদি শাপদাতাকে সকাতর অনুনয়ে সদয় করা যায়।

এক কথায় কাল এবং অন্তক রূপে যম হয়ে দাঁড়িয়েছেন ন্যায়বিচার ও পাপের শাস্তি বিধানের প্রতিভূ। কিন্তু মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে যে অনির্দেশ্য ক্ষমতা তা মৃত্যু নয়, নিয়তি; মূল ধর্মধারা এবং প্রান্তিক ধর্মধারা উভয়ই একে সে ভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে গল্পের পর গল্প এই নিয়তির অনির্দেশ্যতা ও অনিবার্যতার কথা শুনিয়েছে।

আলোচ্য সময়ে রচিত বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাবলিতে, বিশেষ করে জাতক ও অবদানশতক-এ, পুনর্জন্মের বহু কাহিনি দেখা যায় যেখানে কোনও ব্যক্তিকে তার ইহজন্মের কাজের ফল হিসাবে পরজন্মে উন্নত বা অধোগামী অবস্থায় জন্ম নিয়ে পুরস্কার বা শাস্তিভোগ করতে হয়েছে। মহাকাব্যগুলিও এই প্রকার বিবরণে পূর্ণ।

মুখ্য চরিত্রগুলির বিষয়ই হোক আর গৌণ চরিত্রের বিষয়েই হোক কেবল কর্মফলবাদের তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাই হোক কর্মফলের মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ফল আছে, অস্পষ্ট ভাবে হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এ বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়া যায়। সুতরাং একে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়তির সমান সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কিন্তু আবশ্যিক ভাবে এটি নিয়তিবাদেরই জন্ম দেয়। এটা কী ভাবে হয়?

কর্মফলবাদের তত্ত্ব এই বিধান দেয় যে, প্রতিটি কাজের একটি সমান বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ফল পাওয়া যায়– সে ফল ভাল হতে পারে, মন্দও হতে পারে। উদিষ্ট ব্যক্তি সেটি এ জন্মে অথবা পরজন্মে ভোগ করেন। কিন্তু কখনওই এই মতবাদে কোনও বুদ্ধিমান বিচারক বা নিয়ন্তার অস্তিত্বের স্বীকৃত নেই যিনি স্থির করবেন কোন কাজের কী ফল হতে পারে।

বৌদ্ধ, জৈনশাস্ত্রে, ব্রাহ্মণ্য মহাকাব্য ও পুরাণে কাহিনির পর কাহিনিতে বর্ণনা করা হয়েছে কর্ম ও তার ফলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কল্পিত কারণাত্মক বন্ধনের কথা। এই সব গল্পে কল্পনা ও আবিষ্কার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সে গুণ যথাযথ সমানদর্শিতা বা অবিকল। প্রতিরূপের বিকল্প নয়, যা থাকলে এই কর্মফলবাদ যুক্তিগ্রাহ্য  হয়ে উঠতে পারত।

এই সব গল্পগুলি পড়লে বোঝা যায়। এই তত্ত্বে প্রচুর অসংগতি এবং বৈষম্য রয়েছে, কারণ প্রায়ই দেখা যায় একই ধরনের কাজে বিভিন্ন ফল হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সম্ভবত বৌদ্ধ গল্পসাহিত্যে অধিকতর সামঞ্জস্য বা ঐক্য দেখা যায়। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনীগুলি মনে হয় আরও বেশি বর্ণময় ও রোমাঞ্চকর। কিন্তু, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি সঙ্গতিপূর্ণ এবং একই প্রকারের সমীকরণের রীতি গড়ে তুলতে এগুলি ব্যর্থ।

সুতরাং পরিকল্পনা বহির্ভূত ভাবে কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায় এবং বোধসীমার বাইরে অবস্থিত অনির্দেশ্য শক্তিকে বলা হয়ে থাকে। অ-দৃষ্ট–ভাগ্যের একটি প্রতিশব্দ।

মহাকাব্য ও পুরাণের গল্পগুলি আর্শিবাদ এবং অভিশাপের উপাখ্যানের মাধ্যমে ভাগ্যের ক্রিয়াকলাপকে স্পষ্ট করে দেখায়। কোনও ব্যক্তি, কোনও সাধু, ছদ্মবেশী দেবতা অথবা শুধুমাত্র কোনও বিপন্ন ব্যক্তির প্রতি ভাল ব্যবহার করে। পরিবর্তে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে সেই উপকৃত ব্যক্তি উপকারীকে সৌভাগ্যের দীর্ঘ জীবন, রোগমুক্তি, নিঃসন্তান ব্যক্তির জন্য সন্তানলাভ, সম্পদ, স্বর্গসুখ বা অন্য আনন্দের বর দান করে।

অথবা কোনও ব্যক্তি যদি কোনও নির্দোষের ক্ষতি করে, সে তাকে কোনও বিপদ, ক্ষতি, অঙ্গহানি নরকবাস বা অন্য কোনও দুঃখের অভিশাপ দেয়। এই সব আশীর্বাদ বা অভিশাপ এই জন্মে অথবা পরজন্মে সফল হয়। আবার এগুলি, বিশেষ করে অভিশাপ অনেক সময়ই সংশোধিত, সীমিত, লঘুকৃত বা বিলম্বিত করা হয়, যদি শাপদাতাকে সকাতর অনুনয়ে সদয় করা যায়।

জ্যোতিষবাদের চর্চাও এই যুগে নিয়তিবাদের বিকাশকে সাহায্য করেছিল। জ্যোতিষীদের সম্পূর্ণ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল এবং এই ছদ্মবিজ্ঞান সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট গভীর ভাবে ভীত ও প্রভাবিত করেছিল। এর উৎপত্তির অন্যতম কারণ ছিল গ্রহ-নক্ষতপ্রের উপর দেবত্ব আরোপ করা এবং মানুষের ভাগ্যের উপর তাদের গতিবিধি অবস্থান ও প্রভাব সম্পর্কে সমীহপূর্ণ বিচার।

এই সব ঘটনাতে দেখা যায় শাপ বা বর একবার উচ্চারিত হলে এক বিচিত্র। রহস্যময় নিজস্ব শক্তি তাতে সঞ্চারিত হয়। যেমন যথাবিধি অনুষ্ঠিত যজ্ঞের মাধ্যমে অপূর্ব জন্ম নেয় তেমনই শাপ বা বরের মাধ্যমে সঞ্জাত শক্তিও অপ্রতিরোধ্য। এ যেন জ্যা-মুক্ত তীরের মতো; কিন্তু কদাচিৎ একে ঈষৎ পরিবর্তিত করা যায়। এই সম্ভাবনা অভিশপ্ত ব্যক্তিকে, সেই সব ব্রাহ্মণ বা ঋষি, যাঁরা কখনও তপোবল কখনও বা যথাবিহিত ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতা রাখেন, তাদের কাছে ত্রস্ত বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে এই রূপ অভিশাপ বা বরপ্রাপ্তি অনেক অংশেই বোধের অতীত ভাগ্যের লীলা, ছদ্মবেশী দেবতা বা ঋষিদের দ্বারা এগুলি উচ্চারিত; তাই অনুরূপ ফল দিয়ে থাকে। এই সব বর বা শাপের শব্দগুলি, মানুষের মুখে উচ্চারিত হলেও এগুলি প্রকৃতপক্ষে অতিলৌকিক শক্তি সমন্বিত, দৈবী হস্তক্ষেপের একটি মাধ্যম। প্রায়ই শাপগুলি অপ্রত্যাশিত হয়ে থাকে।

এগুলি কোপনস্বভাব ঋষিদের অন্যায্য, অযৌক্তিক ক্রোধ ও অহঙ্কারের প্রকাশ। এই সব সময়ে, সেগুলিকে কেবলমাত্র ভাগ্য বলেই মেনে নেওয়া সম্ভব, কারণ এই সবের পিছনে যে সব ভ্রান্তি বা কর্তব্য চুতি থাকে তার অনুপাতে অভিশাপগুলি খুবই সঙ্গতিহীন অনিশ্চয়তা, আঘাত ও বিস্ময়ের এই সব উপাদান এই সব অভিশাপকে তাই অপরাধীর আয়ত্ত বহির্ভুত এক অনির্দেশ্য শক্তির, ভাগ্যের বহিঃপ্রকাশেই পর্যবসিত করে।

যদিও কর্মফলবাদ সম্পূর্ণভাবে ভাগ্য নির্ভর নয়, তবুও কার্যক্ষেত্রে এটি অনিবার্য ভাবে নিয়তিবাদী রূপ ধারণ করে। দেখা যাক, কী ভাবে তা হয়।

উপনিষদ ও পুরাণ-এর এই মধ্যবর্তী সময়ে, ভারতবর্ষের ধর্মমতগুলি এক বিশেষ অপরিণত অবস্থায় ছিল; ভারতবর্ষে কোনও সংগঠিত ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মপ্রতিষ্ঠান ছিল না। প্রাথমিক বৈদিক ধর্মে ছিল ধর্মমত ও অনুষ্ঠানের মধ্যে এক প্রকার সংযুক্তি গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় মতবাদের সামঞ্জস্য। এর কারণ অনেকটাই এই প্রকার যে, ধর্মমতের অনুগামী সমাজের প্রকৃতি ছিল মূলত গোষ্ঠী নির্ভর এবং একটি অপেক্ষাকৃত দৃঢ় সংবদ্ধ সমাজ এখানে একত্রে পুরাকল্প ও ধর্মানুষ্ঠানকে অনুসরণ করত।

এই বিশাল উপমহাদেশে দূরবর্তী প্রান্তে এই ধর্মমত বিস্তার লাভ করার পরে যখন জাতিসংকর সৃষ্টির ফলে এই ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল এবং পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক সংগঠনগুলি অত্যুত্থানের ফলে গোষ্ঠীনির্ভর সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, তখন এই প্রকার ধর্ম তার উৎপত্তির যথার্থ উদ্দেশ্য হারাল। প্রধান যজ্ঞগুলির অনুষ্ঠান করতে লাগলেন রাজা ও সমাজ প্রধানরা।

পারিবারিক সংগঠনগুলি গৌণ ধারার গৃহ্য অনুষ্ঠান ও মঙ্গলাচরণকে আশ্রয় করল। এই গৌণ ধারা এই সময় পুনরুজজীবিত হল বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মাণ্য মতের মাধ্যমে। এই গৌণ ধারার অন্তর্নিহিত সর্ব্রাণবাদ মূল ও গৌণ ধর্মধারাকে বিভিন্ন প্রকার প্রেত ও আত্মার তত্ত্বে ভরিয়ে তুলল।

কর্মফলবাদের অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়ভাবের ফলে স্বর্গ নরক সংকপ্রান্ত তত্ত্ব ছিল চুড়ান্ত ভাবে পৃথক। মানুষের মৃত্যুর পরে তার পরিণতি কী হয়? যদি সে পবিত্র জীবনযাপন করে থাকে আর পূর্ব জন্মের পাপভার মোচন করে থাকে, তবে সে-

ক. হয় স্বর্গে যায়; অথবা
খ. সুখী আনন্দময় পরিবেশে পুনর্জন্ম লাভ করে অথবা
গ. নরকে যায়; সেখানে অল্পকাল যন্ত্রণা ভোগের পর স্বর্গপ্রাপ্ত হয়;
ঘ. যদি পার্থিব বন্ধন আর বাসনা মুক্ত হতে পারে তবে সে ব্রহ্মা-সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়।

যদি সে দুষ্ট, পাপী জীবনযাপন করে থাকে, তবে সে:

ক. এই ঘৃণ্য দুষ্ট আত্মায় পরিণত হয় এবং ঊর্ধ্বলোকে ঘুরে বেড়ায়।
খ. স্বর্গের যায় ও অল্প কিছুদিন তার প্রাপ্য সামান্য সুখ ভোগের পর নরকে নিক্ষিপ্ত হয়; এবং
গ. পরজন্মে এক অকাম্য হতাশাজনক অবস্থা প্রাপ্ত হয়।

এই সব জটিলতা দ্বিগুণ হয়ে পড়ে, কারণ-

১. ভাল ও মন্দের বিধিগুলির অস্থিতিশীল ভােব কারণ ভারতবর্ষ কখনওই ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে নীতিবাদ চর্চা করেনি;
২. কোন কাজের কোন প্রতিফল হবে সে বিষয়ে সমপূর্ণ অনিশ্চয়তা;
৩. একজন পক্ষপাতহীন সর্বজ্ঞ বিচারক যিনি নিরপেক্ষ ভাবে শাস্তি আর পুরস্কার দেবেন তাঁর অভাব;
৪. পারলৌকিক জগতের হস্তক্ষেপ এবং সর্বশেষে শাপ ও বর যদিও তার প্রাপকের আচরণ অনুসারেই নেমে আসত, তবু প্রায়ই সেগুলি অপ্রত্যাশিত আর অসঙ্গত। এইগুলি যাঁরা নিতেন তারা ভাগ্যের প্রবক্তা রূপেই কাজ করতেন।

কোনও ব্যক্তির কর্মফলের বিবিধ বিকল্প কোথাও নির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি এবং তার উৎপাদক কাজের সঙ্গে সঠিক ভাবে তার সম্পর্কও নির্ধারণ করা হয়নি। বৈদিক যজ্ঞের যথাবিধি অনুষ্ঠান করলে অপূর্ব উৎপাদিত হয় এবং এই অপূর্ব কাম্যবস্তুর জনক। কিন্তু ‘কর্মফলবাদ’ অ-পূর্বতত্ত্বের চেয়েও অনিশ্চিত, অবোধ্য।

তত্ত্বগতভাবে তাই বৈদিক ধর্মতত্ত্বের উপলব্ধি ‘পৌরাণিক হিন্দু কর্মফলবাদ’-এর চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। এই যুগের নিয়তিবাদতত্ত্বের অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলা অবশ্য এই যুগের ধর্মীয় বাতাবরণের পক্ষে কেবল যথাযথ নয়, এমনকী, অপরিহার্য ছিল।

জ্যোতিষবাদের চর্চাও এই যুগে নিয়তিবাদের বিকাশকে সাহায্য করেছিল। জ্যোতিষীদের সম্পূর্ণ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল এবং এই ছদ্মবিজ্ঞান সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট গভীরভাবে ভীত ও প্রভাবিত করেছিল। এর উৎপত্তির অন্যতম কারণ ছিল গ্রহ-নক্ষতপ্রের উপর দেবত্ব আরোপ করা এবং মানুষের ভাগ্যের উপর তাদের গতিবিধি অবস্থান ও প্রভাব সম্পর্কে সমীহপূর্ণ বিচার।

মহাকাব্য ও পুরাণ যুগের ধর্মমতে ‘কর্মফলবাদ’ জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব ছাড়াও বহু নূতন বেদ-পরবর্তী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে আছে মন্দির, বিগ্রহ, তীর্থ, সংকল্প, শিবের মতো পবিত্রাতার স্বরূপ কল্পনা; বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের রূপ পরিকল্পনা; পরিবারগত পুরোহিতের মাধ্যমে পূজাপ্রথা এবং পারিবারিক বিগ্রহের প্রবর্তন; এবং আবহাওয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবতাব তত্ত্ব।

যতক্ষণ পর্যন্ত মানবজীবনে প্রায় কোনও কিছুই অব্যাখ্যাত রইল না। ততক্ষণ এই ভাবে অক্লান্ত বিচার চলতে লাগল। প্রত্যেকটি দেশেই জ্যোতিষের চর্চা হত। কারণ মোটামুটি ভাবে ধারণা করা যায় যে দৈনিক জীবনযাতপ্রা ও বিশ্বাসের সঙ্গে এর কিছু কিছু সম্পর্ক রয়েছে। এই সমীক্ষার থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির সঙ্গে মানব জীবনের নিমিত্তগত সম্পর্ক রয়েছে, যদিও সিদ্ধান্তটি সমর্থনযোগ্য নয়।

কালক্রমে ভারতবর্ষে জ্যোতিষ্ক নামাঙ্কিত বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল এবং রাজধানী, দূর্গ, কোষাগার, নগর তোরণ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এগুলি প্রতিষ্ঠিত হল। এই সব দেবতার পূজার বিধি সম্বলিত শাস্ত্র তাদের বিশেষ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং ভক্তদের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুত বরদানের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে লাগল।

বঙ্গ দেশে শনিপূজার সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে প্রায় এক দশক আগে। এই অশুভকারী দেবতার ছোট একটি ছবি, থালাতে ফুল, ইত্যাদি উপাচারে সাজিয়ে একটি ঠেলাগাড়িতে রাখা হয়। মানুষ প্রণাম করে আর থালাতে প্রণামী দেয়। এই ধর্মানুষ্ঠানটির সুস্পষ্ট এক আর্থসামাজিক মূল্য রয়েছে। কারখানার শ্রমিকদের একটি বৃহদংশই অস্থায়ী শ্রমিক, তাই কাজ হারাবার আশঙ্কায় তারা সর্বদাই ত্রস্ত–যাকে পুরাকল্পের ভাষায় বলা হয় শনির অশুভ দৃষ্টির সামনে পড়া’।

এই অতি বাস্তব বিপদ থেকে পরিতপ্রাণ পেতে স্বভাবতই তারা শনিকে পূজা করতে প্রলুব্ধ হয়। এই সমস্ত বিষয়টিরই এক প্রকৃত অমঙ্গলজনক ও করুণ এক তাৎপর্য রয়েছে, তা হল এই সব শ্রমিকদের মাইনে শনিবারেই হয়ে থাকে, আর এই ভীতি্রদ দেবতাটির কোপ থেকে মুক্তি পেতে তারা আতঙ্কিত ভাবে দেবতাকে সস্তুষ্ট করতে চায়।

এই ভাবে যে বিপদ অর্থাৎ ব্যয় সংকোচের বিরুদ্ধে এক সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধিতার মাধ্যমে প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল তার বিরুদ্ধে দেখা যাচ্ছে এই শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা, যার ব্যয়ভার বহন করা এই দরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষে কঠিন। অন্যান্য গ্রহদেবতারা জীবনের অন্যান্য নিরাপত্তাহীন ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রিত করেন এবং নিজ নিজ দক্ষিণা আকর্ষণ করেন, যা মন্দিরের কোষ পূর্ণ করে অথবা যে দক্ষিণার গতি হয় পুরোহিতের থলিতে।

স্বাভাবিক ভাবেই এই সব গ্রহদের ঘিরে বিশদ পুরাণকথা আর স্তোত্র, ইত্যাদি গড়ে উঠেছে, কারণ, এই সব দেবতার নিয়ন্ত্রণে যে আতঙ্কের উদপ্রেক হয় তা এক অর্থে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

যে মানুষ দুর্দশার হীন গ্লানিতে ডুবে আছে তার বিরুদ্ধ মনোভাব আর প্রতিবাদ, প্রকৃত যে শত্রুর বিরুদ্ধে হওয়ার কথা সেই উৎসবে তাকেই সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে; পুরোহিত এবং শাস্ত্রকাররা এর প্রকৃত লক্ষ্যকে লুকিয়ে রাখছে। এই ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান আন্দোলনকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং ফলস্বরূপ সাময়িক ভাবে হলেও বিকাশের পথ রুদ্ধ হচেছ।

মহাকাব্য ও পুরাণ যুগের ধর্মমতে ‘কর্মফলবাদ’ জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব ছাড়াও বহু নূতন বেদ-পরবর্তী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে আছে মন্দির, বিগ্রহ, তীর্থ, সংকল্প, শিবের মতো পবিত্রাতার স্বরূপ কল্পনা; বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের রূপ পরিকল্পনা; পরিবারগত পুরোহিতের মাধ্যমে পূজাপ্রথা এবং পারিবারিক বিগ্রহের প্রবর্তন; এবং আবহাওয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবতাব তত্ত্ব।

আদর্শগত ভাবে কর্মবাদের তত্ত্বের সঙ্গে নিয়তিবাদকে যুক্ত করা যায় না, কারণ কর্মবাদ একটি কার্যকারণ সূত্রের ফলশ্রুতি। নিয়তিবাদকে সঠিক ভাবে কোনও ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত করা যায় না, কেননা, মঙ্গলময় দেবতারা, যাঁরা এখন অধিকাংশই মোক্ষদাতা, যথাযথ পূজার দ্বারা তাদের প্রসন্ন করা যেত। তাঁদের তুষ্ট করার এক অপেক্ষাকৃত নুতন আবেগনির্ভর উপায় দেখা দিল- ভক্তিমােগ।

আধ্যাত্ম জীবনে আশঙ্কার প্রসার হল, সামগ্রিকভাবে ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্যে অবহেলার ফল কী হতে পারে এই সংশয়; অথবা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মন্দিরে অধিষ্ঠিত বা পারিবারিক দেবতার প্রতি অবহেলা কিংবা ঈশ্বর ও সাধারণ মানুষের মধ্যস্থ যে পুরোহিত বিশেষ গৌরবভাজন তাঁর প্রতি অবহেলা, ইত্যাদির ফল নিয়ে আশঙ্কা।

অন্তরীক্ষে অবস্থিত অদৃশ্য সব শক্তি- দানব, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা আর অতৃপ্ত আত্মারা, এরা সকলেই মানুষের শান্তি আর সুস্থতাকে বিঘ্নিত করতে পারতেন। আবার অনিচ্ছাকৃত ভাবে সাধুদের কাছেও মানুষ অপরাধী হয়ে পড়ত এবং ইহ বা পরজন্মে অভিশাপগ্রস্ত হত।

পুরাণগুলিতে বহু কাহিনি এ বিষয়ে সংযোজিত হল: বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মন্দিরের পুরোহিত্যুবর্গ ছিলেন এ সবের রচয়িতা। তারা বিভিন্ন মতবাদের আনুষ্ঠানিক বিধি প্রবর্তন করলেন এবং সম্ভাব্য সর্বপ্রকার দুঃখদুর্দশার প্রতিকারমূলক অসংখ্য নৈতিক কর্তব্য, সম্প্রদায়গত ভাবে এবং ঋতু-অনুযায়ী নির্ধারণ করলেন; এমনকী প্রায়শ্চিত্ত বিধিরও ব্যবস্থা করলেন।

এই প্রকার ধর্ম এক দিকে সর্বপ্রকার গার্হস্থ্য ও সামাজিক প্রথার দায়িত্ব নিয়েছিল এবং সেগুলির জন্য আচার অনুষ্ঠানের বিধান দিয়ে সন্দেহ এবং অপাত্রে দান হ্রাস করেছিল, অন্য দিকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনযাতপ্রাকে অসংখ্য অনুষ্ঠানের জন্য দায়বদ্ধ করেছিল। বৈদিক শপ্রেীতি ও গৃহ্যকর্মের একর্ত্রীকৃত তালিকার চেয়েও এই সব প্রথার সংখ্যা অনেক বেশি।

প্রত্যেক অনুষ্ঠানে একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত পৌরোহিত্য করতেন এবং এ জন্য তিনি দক্ষিণা পেতেন। অবশ্যই এই সব উচ্চবর্ণের স্বার্থেই অজ্ঞ সাধারণ মানুষকে বিশদভাবে বোঝানো হত যে, ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে দূর্জেয়। কারণ তা হলেই যে সব বাস্তব ও কাল্পনিক বিপদ চারদিকে ঘনিয়ে রয়েছে, যে সব আত্মারা, আশেপাশে আক্রমণের অপেক্ষা করছে।

তারা মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ধ্বংস করতে চাইছে। সেই সব বিপদের প্রতিষেধক অনুষ্ঠান করার জন্য আরও আরও বেশি দক্ষিণা আদায় করা যাবে। পূর্বজন্মের যে সব অভিশাপ ইহজন্মে ফল দিচ্ছে অথবা ইহজন্মের যে সব অজ্ঞানকৃত অপরাধ পরজন্মে কষ্ট দেবে সেই সব দূর করার জন্য পুরোহিতেরা পারিশ্রমিক পাবেন। এই ভাবে ভাগ্যের এক প্রধান শক্তির প্রকাশ হল অভিশাপ।

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যেও অনুরূপ চিন্তাধারা দেখা যায়। হোমারের লেখায় এরিনিয়েস (Erinyes) প্রায়ই তাদের নিজস্ব ক্ষমতা হারিয়েছে, এবং তখন তারা কেবল কোনও অভিশাপ বা কোনও ব্যক্তির উচ্চারিত অভিশাপের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিশাপ ও আশীর্বাদের পক্ষে স্বতন্ত্র ভাবে ফলপ্রসূ হওয়ার ধারণাকে এই ভাবে নৈর্ব্যক্তিক করে দেওয়াতে সেগুলি হয়ে দাঁড়াল সমীহ উদ্রেককারী আধিদৈবিক শক্তিস্বরূপ।

এর যুক্তিনির্ভর পরিণতি হল। এই যে, সেগুলি কেবল মানুষী শক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রইল না, কখনও কখনও দেবতাদেরও আয়ত্তে রইল না; এই ভাবে পুরাণ কথা, আখ্যান ও ধর্মতত্ত্ব ভাগ্যের অদৃশ্য শক্তির কাছে বশীভূত হতে হল। সাধারণ মানুষের পক্ষে তার দুঃখ, রোগ, ক্ষতি, মৃত্যু, ইত্যাদির অসংখ্য সম্ভাব্য কারণ বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠল।

নিজের দুর্দশার সঠিক কারণ সে কখনওই অনুমান করতে পারল না, কার্যকরণ সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারল না ও সমস্ত ঘটনাই তার কাছে মনে হল ভাগ্যের লীলা। তার চারপাশ ব্যাপ্ত করে এই যে অতিলৌকিক শক্তির সর্বগ্রাসী জাল, তার কাছে মানুষ আত্মসমর্পণ করল। এই শক্তির নিজস্ব গতি সম্পর্কে তার জানার, অনুমান করার অথবা একে নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ কোনও সম্ভাবনাই তার ছিল না, কেবল খোলা ছিল বহু-বিচিত্র আচারবিধির মাধ্যমে ভাগ্যকে প্রসন্ন করার বা প্রায়শ্চিত্ত করার পথ।

আদর্শগত ভাবে কর্মবাদের তত্ত্বের সঙ্গে নিয়তিবাদকে যুক্ত করা যায় না, কারণ কর্মবাদ একটি কার্যকারণ সূত্রের ফলশ্রুতি। নিয়তিবাদকে সঠিক ভাবে কোনও ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত করা যায় না, কেননা, মঙ্গলময় দেবতারা, যাঁরা এখন অধিকাংশই মোক্ষদাতা, যথাযথ পূজার দ্বারা তাদের প্রসন্ন করা যেত। তাঁদের তুষ্ট করার এক অপেক্ষাকৃত নুতন আবেগনির্ভর উপায় দেখা দিল- ভক্তিমােগ।

(চলবে…)

<<নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : এক ।। নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : তিন>>

………………..
প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ : সুকুমারী ভট্টাচার্য।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরও পড়ুন-
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : এক
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : দুই
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!