ভবঘুরেকথা

পাপের চেতনা

-বার্ট্রান্ড রাসেল

পাপের চেতনা সম্পর্কে প্রথম অধ্যায়ে কিছু আলোচনার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। এবার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মূলগত মনস্তাত্ত্বিক কারণে অসন্তোষ দেখা দেয়, পাপের চেতনা তাদের মধ্যে অন্যতম।

পাপ নিয়ে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় মানসিকতা একটা রয়েছে, কিন্তু কোনও আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদ তা স্বীকার করেন না। মনে করা হত, বিশেষভাবে প্রোটেস্ট্যান্টরা, কেউ কোনও কাজ করতে প্রলুব্ধ হলে, বিবেকই তাকে বলে দেয় কোন্ কাজ পাপময়।

সে কাজ শেষ হলে তার দুটি বেদনাদায়ক অনুভূতি হয়– প্রথমটি হচ্ছে মর্মবেদনা, যার কোনও মূল্য নেই; অপরটি হচ্ছে অনুশোচনা, যা তার পাপকে মুছে ফেলতে পারে। প্রোটেস্ট্যান্ট দেশসমূহে যারা এই মতবাদে বিশ্বাস হারিয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেক কমবেশি পরিবর্তন করে পাপ বিষয়ে রক্ষণশীল মতটি গ্রহণ করেছে অবশ্য কিছুকালের জন্যে। আমাদের কালে অংশত মনঃসমীক্ষার ফলে সব বিপরীত হয়ে গেছে।

অরক্ষণশীলরাই যে শুধু প্রাচীন পাপ-তত্ত্ব মানেন না তা নয়, যারা এখনো নিজেদের রক্ষণশীল বলে বিশ্বাস করেন তারাও অনেকে মানেন না। বিবেককে এখন আর কোনও রহস্যময় কিছু বলে মনে করা হয় না। কারণ এতদিন তা রহস্যময় ছিল বলেই ঐশীবাণী বলে মনে করা হত।

আমরা জানি যে বিবেক বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করে এবং উদারভাবে বলতে গেলে সব জায়গায় উপজাতিদের সংস্কৃতির সাথে তা অঙ্গাঙ্গী জড়িত, তা হলে কোনও ব্যক্তিকে যখন বিবেক দংশন করে তখন প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে?

প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এর শিকড় লুকিয়ে আছে তার ছ’বছর বয়সের আগে তার জননী ও ধাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া নীতিশিক্ষার মধ্যে। ঐ সময়ের আগেই তিনি শিখেছে শপথ করা অন্যায় এবং যতদূর সম্ভব নারীসূলভ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা ব্যবহার না করা এবং খারাপ লোকেরাই মদ পান করে। ধূমপান উচ্চস্তরের গুণাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

‘বিবেক’ শব্দটি স্বাভাবিকভাবে কয়েকটি আলাদা অনুভূতির অর্থবোধক, যার সহজতমটি হচ্ছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। পাঠক, আপনি নিশ্চয় সম্পূর্ণ দোষহীন জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু আপনি যদি এমন কোনও মানুষের কাছে জানতে চান, যিনি কোনও সময় এমন অন্যায় কিছু করেছেন ধরা পড়লে যার শাস্তি হত। ধরা পড়া অবধারিত জানলেও অন্যায় কাজের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন।

আমি বলি না যে পেশাগত চোর সম্বন্ধেও একথা মিলে যাবে, কারণ কিছু পরিমাণ কারাবাসকে সে পেশাগত ঝুঁকি হিসাবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু একথা প্রযোজ্য হতে পারে সম্মানিত অপরাধীদের বেলায়। যেমন কোনও ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, যিনি অবস্থার চাপে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অথবা কোনও ধর্মযাজক যিনি প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে ইন্দ্রিয়কে সংযত করতে পারেননি।

ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকলে তারা অপরাধের কথা বিস্মৃত হতে পারেন। কিন্তু ধরা পড়লে অথবা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাদের মনে হয় ন্যায়ের পথেই তাঁদের থাকা উচিত ছিল এবং এই ইচ্ছা তাদের পাপের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের মনে প্রখর চেতনা জাগিয়ে তোলে। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ও এই অনুভূতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

যে ব্যক্তি তাস খেলায় প্রতারণা করে অথবা প্রতিশ্রুত ঋণ পরিশোধ করে না সে যদি ধরা পড়ে, তাহলে দলবদ্ধ লোকের তিরস্কারের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে নিজের মধ্যে কিছুই খুঁজে পায় না। এ বিষয়ে সে ধর্মসংস্কারক, রাজদ্রোহী বা বিপ্লবীর সাথে তুলনীয় নয়। কারণ তারা মনে করেন বর্তমানে যেভাবে তাদের পরিত্যাগ করছে, আগামীদিন তাদের সেভাবেই শ্রদ্ধা জানাবে।

বর্তমানে তাদের ভাগ্যে যাই ঘটুক আগামীদিন তাদের সমর্থন করবে। এই ব্যক্তিবর্গ জনগণের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের অপরাধী মনে করেন না। কিন্তু যারা প্রচলিত নৈতিকতা সম্পূর্ণ স্বীকার করেও তার বিরুদ্ধচারণ করেন, তারা খুবই দুঃখ ভোগ করেন। যদি সমাজ তাদের বহিষ্কৃত করেন এবং এই বিপদের ভয়ে অথবা বিপদ ঘটে গেলে যে দুঃখ পান, তাতে সহজেই তাঁরা মনে করতে পারেন যে তাদের কাজই ছিল পাপ-পূর্ণ।

কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্ববাহী যে পাপের চেতনা তার মূল খুব গভীরে। এই মূল খুঁজতে হবে অবচেতনের ভিতর। জনগণের অননুমোদনের ভয়ে তা চেতনের ভিতর দেখা দেয় না। চেতন অবস্থায় কিছু কাজ পাপরূপে চিহ্নিত হয় কিন্তু অন্তদৃষ্টির সাহায্যে তাকে দেখা যায় না। যখন একজন মানুষ এই ধরনের কাজ করেন তখন তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারেন না।

তাঁর ইচ্ছা হয় এইরকম লোক হওয়াই তার উচিত ছিল যিনি পাপ বলে যা বিশ্বাস করেন তা থেকে দূরে থাকতে পারেন। তিনি নৈতিকতার দিক থেকে শুধু তাদেরই শ্রদ্ধা করেন, যাদের অন্তর তিনি পবিত্র বলে মনে করেন। তিনি কমবেশি দুঃখের সাথে বুঝতে পারেন যে তাঁর পক্ষে সন্ত হওয়া সম্ভব নয়। এই সাধুত্ব সম্পর্কে তাঁর যা ধারণা তা সম্ভবত এই যে, তা সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে পালন করা প্রায় অসম্ভব।

ফলে একটা পাপবোধ নিয়েই তিনি জীবন কাটিয়ে দেন। মনে করেন যা কিছু মহৎ তা তার জন্যে নয় এবং মনে করেন ভাবাবেগপূর্ণ অনুতাপের মুহূর্তগুলিই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।

প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এর শিকড় লুকিয়ে আছে তার ছ’বছর বয়সের আগে তার জননী ও ধাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া নীতিশিক্ষার মধ্যে। ঐ সময়ের আগেই তিনি শিখেছে শপথ করা অন্যায় এবং যতদূর সম্ভব নারীসূলভ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা ব্যবহার না করা এবং খারাপ লোকেরাই মদ পান করে। ধূমপান উচ্চস্তরের গুণাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

মিথ্যাভাষণের প্রশ্ন আবার তোলা যাক। আমি অস্বীকার করি না পৃথিবীতে মিথ্যার আধিক্য রয়েছে এবং সত্যতা বৃদ্ধি পেলে আমরা আরো উন্নত থাকতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, একথা আমি অবশ্যই অস্বীকার করি এবং আমার মনে হয় প্রতিটি যুক্তিবাদী তা করবেন। একদা গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণকালীন একটি ক্লান্ত খেকশিয়াল দেখেছিলাম যার তখন শেষ অবস্থা।

তিনি শিখেছেন মিথ্যা কথা কখনো বলা উচিত নয়। সবার উপরে যৌনাঙ্গ নিয়ে যে কোনওরকম কৌতূহল ঘৃণা কাজ। এইসব তিনি মায়ের মতো বলেই জেনেছেন এবং সেই মতো তার সৃষ্টিকর্তার মত বলেই মনে করেছেন। মায়ের স্নেহভরা ব্যবহার অথবা মা যদি অবহেলা করেন তাহলে ধাত্রীর স্নেহ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ এবং তা লাভ করেছেন যখন পর্যন্ত তিনি নৈতিক-বিধান ভাঙ্গার পাপী বলে পরিচিত হননি।

অতএব তিনি সেইসব অস্বচ্ছ আচরণের সাথে যুক্ত হয়েছেন যা তার জননী এবং ধাত্রী অনুমোদন করেন না। ক্রমে তিনি বড় হয়েছেন এবং তাঁর এই নীতি-বিধান কোথায় থেকে এসেছে তা ভুলে গেছেন। আর ভুলে গেছেন এইসব বিধি-বিধান না মানলে তাকে প্রথম জীবনে কী কী শাস্তি পেতে হত।

কিন্তু তারপরও তিনি সেসব ছুঁড়ে ফেলে দেননি এবং এসব অমান্য করলে তার ভাগ্যে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে, সেই অনুভূতিও তার নষ্ট হয়নি। এইসব শিশুসুলভ নীতিশিক্ষার অধিকাংশের কোনও যৌক্তিক ভিত্তি নেই এবং এই শিক্ষা এমন যে, সাধারণ মানুষের সাধারণ আচরণে তা প্রয়োগ করাও চলে না।

কোনও লোক যদি, যাকে খারাপ ভাষা বলে তা ব্যবহার করে, উদাহরণস্বরূপ যুক্তিপূর্ণ দিক থেকে এমন কথা বলা চলে না যে, সে তেমন ভাষা ব্যবহার করে না তার চেয়ে যে নিকৃষ্ট। তা সত্ত্বেও বাস্তবে প্রত্যেকটি লোক সন্ত সম্পর্কে কল্পনা করতে গিয়ে শপথ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজনীয় গুণ বলে মনে করে। যুক্তির আলোয় দেখলে এটি বুদ্ধিহীনতা ছাড়া অন্য কিছু নয়, মদ এবং তামাক সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য।

মদ সম্পর্কে দক্ষিণের দেশসমূহে এই মনোভাব দেখা যায় না, বরঞ্চ সেখানে এই মনোভাবে কিছু অপবিত্রতা রয়েছে। কারণ আমাদের প্রভু এবং তার প্রধান শিষ্যরা মদ্যপান করতেন। তামাক সম্পর্কে কোনও ধারণা না রাখাই ভাল, যেহেতু তামাকের ব্যবহার জানার অনেক আগে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তদের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু এখানে যুক্তিপূর্ণ বিচার সম্ভব নয়।

তামাক পেলেও কোনও সন্ত তা খেতেন না। এই পর্যবেক্ষণের মূলে রয়েছে, কোনও সন্তের পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব ছিল না যা তাকে আনন্দ দান করতে পারে। এটাই সর্বশেষ বিশ্লেষণ। সাধারণ নীতিবোধের মধ্যে এই তাপসিক উপাদান সবার মনে অচেতনভাবেই প্রবেশ করেছে কিন্তু আমাদের নৈতিকতার বিধানকে যুক্তিহীন করে তুলতে এই বোধ সবদিক থেকেই প্রভাব বিস্তার করেছে।

যুক্তিপূর্ণ নৈতিকবোধে যে কোনও লোকের আনন্দ লাভ প্রশংসনীয় এবং এমন কী নিজেরও, যদি না তাকে নষ্ট করতে নিজেকে বা অপরকে একই সাথে সমভারাক্রান্ত বেদনা দেওয়া না হয়। তাপসিকতার ধারণা থেকে যদি আমরা অব্যাহতি পাই, তবে আদর্শ ধার্মিক মানুষ তিনি-ই হবেন, যিনি সবরকম ভাল জিনিস উপভোগ করার অনুমতি দেবেন, যদি না কোনও খারাপ কাজ সেই উপভোগকে লঙ্ঘন করে না যায়।

মিথ্যাভাষণের প্রশ্ন আবার তোলা যাক। আমি অস্বীকার করি না পৃথিবীতে মিথ্যার আধিক্য রয়েছে এবং সত্যতা বৃদ্ধি পেলে আমরা আরো উন্নত থাকতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, একথা আমি অবশ্যই অস্বীকার করি এবং আমার মনে হয় প্রতিটি যুক্তিবাদী তা করবেন। একদা গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণকালীন একটি ক্লান্ত খেকশিয়াল দেখেছিলাম যার তখন শেষ অবস্থা।

নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার সময় যখন এগিয়ে আসবে, তখন মনে রাখতে হবে সেই শিক্ষা যেন যুক্তিপূর্ণ হয় এবং প্রত্যেক বিষয় তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমান গ্রন্থে আমি শিক্ষা বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। এই গ্রন্থে আমি বরং যুক্তিহীন পাপের চেতনা জাগানো অবিজ্ঞজনোচিত শিক্ষা থেকে যে সব কুফল দেখা দেয়, তা বয়স্করা কীভাবে দূর করতে পারে তা নিয়েই বলতে চাই।

তবুও জোর করে দৌড়াচ্ছে প্রাণের ভয়ে। কয়েক মিনিট পরেই শিকারীদের সাথে দেখা হল। তারা জানতে চাইল আমি শিয়ালটিকে দেখেছি কি না। আমি বললাম, দেখেছি। তারা এরপর প্রশ্ন করল, শিয়ালটি কোন দিকে গেছে। তখন আমি মিথ্যা কথা বললাম। এখানে সত্য উচ্চারণ করলে আমি আরো ভাল লোক হতাম বলে আমি মনে করি না।

কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে শৈশবের নৈতিক শিক্ষা সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়। যদি কোনও কঠোর বাবা-মা কিংবা ধাত্রীর কাছে কোনও শিশু এই বিষয়ে প্রথাগত শিক্ষা পেয়ে থাকে, তা হলে ছ’বছরের মধ্যেই তার মনে যৌনাঙ্গ এবং পাপের যোগাযোগ নিয়ে এমন ধারণা দৃঢ়প্রোথিত হয়ে যাবে যে, জীবনভর সেই শিক্ষা আর বিস্মৃত হবে না।

এই বোধ অবশ্য ঈডিপাস কমপ্লেক্সে আরো দৃঢ় হয়, কারণ যে নারীকে সে শৈশবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে তার সঙ্গে সবরকম স্বাধীন যৌনতা অসম্ভব। তার ফলে অনেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নারীকে যৌন সম্পর্কে হীন মনে করে এবং নিজেদের পত্নীরা যদি যৌন-সঙ্গমকে ঘৃণা না করে তবে তাদের সম্মান করতে পারে না। অথচ স্ত্রী যদি কামশীতল হয়, তাহলে সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই সে তৃপ্তির সন্ধান করবে অন্য জায়গায়।

তার ক্ষণিকের যৌনতৃপ্তি তাকে অপরাধবোধে বিষাক্ত করে তোলে। তাই সে বিবাহ বা বিবাহ-বহির্ভুত কোনও নারীর সাথেই সম্পর্ক নিয়ে সুখী হতে পারে না। আবার নারীদের বেলায় পবিত্র হওয়ার শিক্ষায় জোর দিলে একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। নারী তখন সংস্কারবোধ থেকেই স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে এবং তা থেকে আনন্দলাভ করতে ভয় পাবে।

বর্তমানে অবশ্য এ বিষয়ে পঞ্চাশ বছর আগে নারীর যে অবস্থান ছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে। একথা অবশ্য বলা যায় যে, বর্তমানে শিক্ষিতদের ভিতর পুরুষদের যৌনজীবন আরো বেশি বিকৃত এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে নারীদের পাপবোধের তুলনায়।

খুব ছোটদের যৌনতা বিষয়ে যে প্রাচীন শিক্ষা চলে আসছে তার কুফল নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে একটা ব্যাপক সচেতনতা এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই বিষয়ে পালনীয় সঠিক নিয়ম সরল। শিশু বয়ঃসন্ধিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে, যেই হোক তাকে যৌনতার ব্যাপারে কোনও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যাবে না এবং একই সাথে স্বাভাবিক দৈহিক ক্রিয়া ঘৃণার যোগ্য এমন কোনও ধারণা তার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।

নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার সময় যখন এগিয়ে আসবে, তখন মনে রাখতে হবে সেই শিক্ষা যেন যুক্তিপূর্ণ হয় এবং প্রত্যেক বিষয় তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমান গ্রন্থে আমি শিক্ষা বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। এই গ্রন্থে আমি বরং যুক্তিহীন পাপের চেতনা জাগানো অবিজ্ঞজনোচিত শিক্ষা থেকে যে সব কুফল দেখা দেয়, তা বয়স্করা কীভাবে দূর করতে পারে তা নিয়েই বলতে চাই।

ছোটদের ঐতিহ্য পরম্পরায় যে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে পৃথিবীর কোনও উপকার হয়েছে কিনা এই প্রশ্ন গুরুত্ব সহকারে নিজেকে করুন। ভেবে দেখুন একজন আচার-স্বীকৃত ধার্মিক ব্যক্তির মনন-সৃষ্টিতে কতটুকু বিশুদ্ধ কুসংস্কারের উপকরণ প্রয়োজন হয়েছে এবং আরো ভেবে দেখুন, অবিশ্বাস্য সব নিষেধবিধি দিয়ে কাল্পনিক নৈতিক বিপদসমূহ কীভাবে ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী অধ্যায় সমূহে আমাদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এখানেও তাই। সমস্যাটি হল আমাদের সচেতন চিন্তা যে যুক্তিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তার দিকে অবচেতনভাবে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করা। কোনও মানুষের কখনো নিজের মানসিক অবস্থায় ভেসে যাওয়া উচিত নয়। তাতে বারবার এই মুহূর্তে আবার পরক্ষণেই কোনও না কোনও জিনিসে বিশ্বাসের বদল হয়।

ক্লান্তিতে, রোগে, মদ্যপানে এবং অন্যান্য কারণে পাপের চেতনা বেড়ে যায় সচেতন ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে বলে। এইসব মুহূর্তে (মদ্যপান করার সময় ছাড়া) মানুষ যা অনুভব করে তা তার নিজের উচ্চতর সত্ত্বার প্রত্যাদেশরূপে মনে করা হয়, “শয়তানটা রুগ্ন ছিল, শয়তানটা সন্ত হয়ে যাবে।” কিন্তু এটা ভাবা অযৌক্তিক যে সবল থেকে দুর্বল মুহূর্তে অতিরিক্ত অর্ন্তদৃষ্টি লাভ হয়।

দুর্বল মুহূর্তে শিশুসুলভ সব কল্পনাকে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কিন্তু তার জন্যে প্রাপ্তবয়স্ক লোকের, যে নিজের দক্ষতার ওপর পূর্ণ আস্থাশীল, তার বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে সেই শিশুসুলভ বিশ্বাসকে গ্রহণযোগ্য মনে করার কোনও কারণ নেই। পক্ষান্তরে কোনও ব্যক্তি যদি তার পূর্ণ বিচারশক্তিতে আস্থাশীল হয়ে কিছু বিশ্বাস করে, তাহলে সেই বিশ্বাস তার কাছে সবসময়ের মানদণ্ডরূপে গণ্য হওয়া উচিত।

সঠিক কৌশল প্রয়োগ করতে পারলে অবচেতনতার উৎস থেকে উৎসারিত শিশুসুলভ অভিভাবনাগুলিকে দমন করা সম্পূর্ণভাবেই সম্ভব, এমন কী তার আধেয়কেও পরিবর্তন করা যায়। যখনই আপনি, যুক্তি খারাপ ভাবছে না, এমন কাজের জন্যে দুঃখ অনুভব করতে আরম্ভ করবেন, তখনই আপনি দুঃখের যে অনুভূতি তার কারণ কী তা পরীক্ষা করে দেখবেন এবং সেসব যে অবাস্তব তা নিজেকে বিস্তারিতভাবে বোঝাবেন।

আপনার সচেতন বিশ্বাস এমন শক্ত এবং জোরালো হবে, যাতে তা আপনার মনের অবচেতনায় ছাপ রেখে যায়, যা আবার এত শক্ত হবে যাতে আপনার শৈশবে জননী বা ধাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ছাপকে অতিক্রম করে যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে একবার যুক্তি এবং পরক্ষণেই আবার অযুক্তির মুহূর্তে ফিরে গিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন না।

অযৌক্তিকতাকে কাছ থেকে দেখুন, দৃঢ়সংকল্প হোন যে তাকে আপনি সম্মান করবেন না এবং কোনওভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে দেবেন না। যখন তা আপনার চেতনায় অর্থহীন চিন্তা বা অনুভূতি চাপাতে চেষ্টা করবে তখনই সমূলে তাদের উপড়ে ফেলবেন, তাদের পরীক্ষা করবেন এবং ত্যাগ করবেন। অর্ধেক যুক্তি এবং অর্ধেক শিশুসুলভ বুদ্ধিহীনতার দোলায় নিজেকে দোদুল্যমান প্রাণীর মতো করে তুলবেন না।

আপনার শৈশব যারা নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন তাদের স্মৃতির প্রতি যদি অশ্রদ্ধা দেখাতে হয় তার জন্যে ভয় পাবেন না। তারা আপনার কাছে তখন কঠোর এবং জ্ঞানী মনে হয়েছিল। কারণ শৈশবে আপনি দুর্বল এবং বুদ্ধিহীন ছিলেন। এখন আপনি তা নন, তাই আপনার দায়িত্ব অভ্যাসের জোরে যে সম্মান এখনো দেখাচ্ছেন তা তাদের প্রাপ্য কিনা তা বিবেচনা করে দেখার জন্যে তাদের আপাত দৃশ্যশক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে পরীক্ষা করে দেখা।

ছোটদের ঐতিহ্য পরম্পরায় যে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে পৃথিবীর কোনও উপকার হয়েছে কিনা এই প্রশ্ন গুরুত্ব সহকারে নিজেকে করুন। ভেবে দেখুন একজন আচার-স্বীকৃত ধার্মিক ব্যক্তির মনন-সৃষ্টিতে কতটুকু বিশুদ্ধ কুসংস্কারের উপকরণ প্রয়োজন হয়েছে এবং আরো ভেবে দেখুন, অবিশ্বাস্য সব নিষেধবিধি দিয়ে কাল্পনিক নৈতিক বিপদসমূহ কীভাবে ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের যেসব বাস্তব বিপদের মুখে পড়ার ভয় আছে তাদের ব্যাপারে কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। কোন্ কোন্ ক্ষতিকর কাজের দিকে সাধারণ লোকের আকর্ষণ থাকে? আইনকে বাঁচিয়ে ব্যবসাতে প্রতারণা, অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রতি রূঢ় আচরণ, স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, প্রতিযোগীদের প্রতি বিদ্বেষ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হিংস্রতা– এইসবই হল সত্যিকারের অন্যায়, যা সম্মানীয় এবং সম্মানিত নাগরিকদের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায়।

যুক্তিবাদী মানুষ নিজের অবাঞ্ছিত কাজকে, অপরের অবাঞ্ছিত কাজকে যে দৃষ্টিতে দেখে, সেভাবেই দেখবে। যে কাজগুলি ঘটনার কারণে সৃষ্ট এবং তা যে অবাঞ্ছিত, তা ভালভাবে উপলব্ধি করে তাকে এড়াতে হবে, অথবা যেখানে তা সম্ভব তা যেসব ঘটনার কারণে ঘটতে পারে, তা এড়াতে হবে।

এইসব অন্যায়ের সাহায্য নিয়েই একজন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশে দুর্দশা বিস্তারিত করে এবং সভ্যতাকে ধ্বংস করার কাজে যতটুকু দেবার তা দিয়ে দেয়। তবুও, এই ধরনের মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু এসব কাজের জন্যে নিজেকে সমাজ পরিত্যক্ত অথবা স্বর্গীয় সুবিধা পাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত মনে করে না। এইসব কাজ তার দুঃস্বপ্নের মধ্যে আনত দৃষ্টিতে তিরষ্কার রত তার মায়ের মূর্তিটি তুলে ধরে না।

কেন তার অবচেতন নৈতিকতা যৌক্তিকতা থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন? কারণ শৈশবে সে যাদের হাতে মানুষ হয়েছে তারা যে নৈতিকতায় বিশ্বাসী ছিল তার মধ্যে কোনও যুক্তি নেই। কারণ এই নৈতিকতা সমাজের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্য কী সেই শিক্ষা থেকে জন্ম নেয়নি। কারণ এ হচ্ছে প্রাচীন যুক্তিহীন নিষেধবিধির ছোট ছোট খণ্ড দিয়ে তৈরী।

কারণ মরণাপন্ন রোমান সমাজকে যে আত্মিক ব্যাধি পীড়িত করেছিল এর মধ্যেই নিহিত ছিল এর উপাদান। আমাদের নামমাত্র যে নৈতিকতাবোধ তা যাজক এবং মানসিকভাবে দাস মনোবৃত্তির নারীদের তৈরী। সময় এসে গেছে বিশ্বের স্বাভাবিক জীবনে স্বাভাবিক ভূমিকা যাদের গ্রহণ করতে হবে তাদের এই যন্ত্রণাকর এবং বাতিল জিনিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শিক্ষা নেওয়ার।

কিন্তু যদি ব্যক্তিগত সুখকে বাড়ানো এবং মানুষকে একই মানে বাস করতে সক্ষম করার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহকে সফল করতে হয়, তাহলে দুই মানের মধ্যে দোলায়িত না হয়ে যুক্তির সাহায্যে যা পাওয়া যায় তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা এবং অনুভব করা প্রয়োজন। অধিকাংশ মানুষই শৈশবের সব কুসংস্কার হালকাভাবে ত্যাগ করে মনে করে তাদের আর কিছু করণীয় নেই।

তারা বুঝতেই পারে না যে, সেসব কুসংস্কার এখনো তাদের মনের গভীরে অজ্ঞাতবাস করে রয়েছে। যুক্তির পথে কোন বিশ্বাসে পৌঁছাতে হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত। যাতে তা থেকে কী ঘটতে পারে তা আগেই অনুধাবন করা যায়। নিজের মধ্যেই সন্ধান করা উচিত নতুন বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিকর কোনও পূর্ব বিশ্বাস এখনও বেঁচে আছে কিনা।

পাপের চেতনা প্রখর হলে এবং মাঝে মাঝে তা হবেই, তখন তাকে প্রত্যাদেশ বা মহৎ কিছুর জন্যে আহ্বান মনে না করে তাকে একটি রোগ এবং দুর্বলতা বলে মনে করা উচিত। এর ব্যতিক্রম হবে শুধু পাপের চেতনা যেখানে যুক্তিপূর্ণ নীতি দ্বারা নিন্দিত হয় সেখানে। মানুষ নৈতিকতাবর্জিত হোক এমন কোনও পরামর্শ আমি দিচ্ছি না, আমি শুধু বলছি তারা যেন কুসংস্কারজাত নৈতিকতা পরিহার করে। কারণ এটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।

কিন্তু কোনও মানুষ যদি তার নিজের যৌক্তিক বিধান ভঙ্গ করে তার পরেও পাপের চেতনা জীবনকে উন্নততর করার শ্রেষ্ঠ উপায় কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। পাপ-চেতনার মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা হীন। যাতে কোনও আত্মমর্যাদা নেই। আত্মমর্যাদার অভাব কখনো কারো মঙ্গল করেনি।

যুক্তিবাদী মানুষ নিজের অবাঞ্ছিত কাজকে, অপরের অবাঞ্ছিত কাজকে যে দৃষ্টিতে দেখে, সেভাবেই দেখবে। যে কাজগুলি ঘটনার কারণে সৃষ্ট এবং তা যে অবাঞ্ছিত, তা ভালভাবে উপলব্ধি করে তাকে এড়াতে হবে, অথবা যেখানে তা সম্ভব তা যেসব ঘটনার কারণে ঘটতে পারে, তা এড়াতে হবে।

অনেক মানুষের কাছে যৌক্তিকতা পছন্দনীয় নয়। যেখানে এই রকম অবস্থা, সেখানে যেসব কথা আমি বলছি তা অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হবে। অনেকের এমন ধারণা রয়েছে যে, যুক্তিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তার মনের গভীরতর সব আবেগকে হত্যা করে। আমার মনে হয় এই বিশ্বাস মানুষের জীবনে যুক্তি স্থান নিয়ে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে পাপের চেতনা উন্নত জীবনের সহায়ের কারণ না হয়ে ঠিক তার বিপরীতই হয়। মানুষকে তা অসুখী করে, নিজেকে হীন বলে ভাবতে শিক্ষা দেয়। অসুখী হওয়ার কারণে সে প্রায় হয়তো অন্যদের ওপর অতিরিক্ত দাবি জানাতে থাকে, যা তাদের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি করে। নিজেকে হীন মনে হওয়াতে তার চেয়ে উন্নত লোকদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। তার পক্ষে প্রশংসা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

কিন্তু ঈর্ষা করা সহজ হয়ে যায়। সে সবার কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। অন্যের প্রতি উন্মুক্ত ও উদার মনোভাব শুধু যে অন্যকেই আনন্দ দেয় তা নয়। যে এর অধিকারী তার জন্যেও পরম সুখের উৎস। এই ধরনের লোক সাধারণত সকলেই পছন্দ করে। কিন্তু পাপের চেতনা যার মনকে অধিকার করে থাকে তার পক্ষে এই ধারণা গড়ে তোলা খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভব।

এটা হচ্ছে সুস্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসের ফল। এটা সব মননের সংহতি দাবি করে, যা দিয়ে আমি চেতনার সবগুলি স্তরকে বোঝাতে চাই– চেতন, অবচেতন, অচেতন, সব, যারা একত্রে সম্মিলিতভাবে ক্রিয়া করবে। সব সময় নিজেদের মধ্যে বিরোধিতায় মেতে থাকবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমন্বয় সুচিন্তিত শিক্ষার দ্বারা সম্ভব হয়। কিন্তু শিক্ষা যেখানে জ্ঞানশূন্য, সেখানে এই কাজ খুব কঠিন।

এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন মনোবিশ্লেষকরা। কিন্তু আমার বিশ্বাস প্রায় সব ক্ষেত্রেই রোগীরাই এই কাজ করতে পারে, অবস্থা চরম পর্যায়ে জেনেই বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। একথা বলা উচিত নয়; “আমার এসব মনস্তাত্ত্বিক শ্রম দেওয়ার মতো সময় নেই। আমি ব্যস্ত মানুষ। আমার সময় কাজের মধ্যে ঠাসা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে কাজ করার জন্যে আমি আমার অচেতন মনের ওপর ভার দিলাম।”

ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে যে পরিমাণ আনন্দ ও কর্মদক্ষতা নষ্ট করে এমন অন্য কিছু করে না। যে সময় ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন বিভক্ত অংশকে সমন্বয় করার কাজে খাটে, সেটাই হল কার্যকরভাবে সময়-ব্যয়। আমি বলছি না কেউ প্রতিদিন নিয়মি একঘণ্টা সময় আত্মসমীক্ষার জন্যে তুলে রাখুক। আমার মতে এটি শ্রেষ্ঠ উপায় নয় কারণ এতে আত্মসমীক্ষার জন্যে তুলে রাখুক।

আমার মতে এটি শ্রেষ্ঠ উপায় নয় কারণ এতে আত্মমগ্নতা বাড়ায় এবং এটাও আরোগ্যযোগ্য ব্যাধির একটা অংশ। সুসমন্বিত ব্যক্তিত্ব সবসময় বহির্মুখী। আমি যা বলতে চাই, তা হল, মানুষ তার মনকে স্থির করবে দৃঢ়তার সাথে, যা সে যৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করে তা নিয়ে। এর বিপরীত অযৌক্তিক বিশ্বাসকে প্রশ্নাতীত চলে যেতে অনুমতি দেবে না অথবা তার ওপর কোনওরূপ প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না, যদি তা ক্ষণকালের জন্যেও হয়।

এটা হচ্ছে যুক্তির সাথে নিজের মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্ন। যেসব মুহূর্তে প্রলুব্ধ হতে হয় শিশুর মতো হতে। কিন্তু যুক্তির যদি প্রবল জোর থাকে তাহলে সময় খুব কম লাগে। সুতরাং এই কালক্ষেপণকে অগ্রাহ্য করা উচিত।

অনেক মানুষের কাছে যৌক্তিকতা পছন্দনীয় নয়। যেখানে এই রকম অবস্থা, সেখানে যেসব কথা আমি বলছি তা অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হবে। অনেকের এমন ধারণা রয়েছে যে, যুক্তিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তার মনের গভীরতর সব আবেগকে হত্যা করে। আমার মনে হয় এই বিশ্বাস মানুষের জীবনে যুক্তি স্থান নিয়ে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছে।

বেদনা থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পাওয়া তার কাছে একমাত্র প্রমত্ততার ভিতর দিয়ে, সম্ভব বলেই মনে করে, এটা মনের গভীর স্তরে অবস্থিত একটি রোগের লক্ষণ। যে ক্ষেত্রে এই রোগ নেই সেখানে মেধার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা থেকে সবচেয়ে আনন্দ লাভ করা যেতে পারে। যে মুহূর্তে মন সবচেয়ে ক্রিয়াশীল থাকে, বিস্মরণ কম হয় তখনই গভীর আনন্দের স্পর্শ পাওয়া যায়।

আবেগ সৃষ্টি করা যুক্তির কাজ নয়। যদিও মানুষের মঙ্গলের পথে বাধা সৃষ্টিকারী আবেগকে খুঁজে বের করা এবং প্রতিহত করা তার কাজের একটা অংশ। যৌক্তিক মনস্তত্ত্বের কাজের অংশ হল সন্দেহাতীতভাবে ঘৃণা এবং ঈর্ষাকে বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করা। এটা একটা ভুল ধারণা যে এইসব আবেগকে কমিয়ে আনার সাথে সাথে যুক্তি নিন্দা করে না এমন সব আবেগের শক্তিও কমিয়ে দেওয়া হয়।

আবেগময় ভালবাসায়, বাৎসল্যে, জনহিতকর কাজে, শিল্প অথবা বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠায় এমন কিছু নেই যা যুক্তি কমাতে চাইবে। যুক্তিবাদী মানুষ যখন এইসব আবেগ অনুভব করবে, সে খুশী হবে যে সে এইসব অনুভব করে, যার শক্তি কমানোর কোনও কারণও নেই, কারণ এইসব আবেগ সুন্দর জীবনেরই অঙ্গ, যে জীবন সুখ বয়ে আনে নিজের জন্যে এবং অন্যের জন্যেও।

এইসব আবেগের মধ্যে কোন অযৌক্তিকতা নেই এবং অনেক যুক্তিহীন মানুষ শুধুমাত্র গতানুগতিক আবেগগুলি অনুভব করে। কোনও মানুষের ভয় পাওয়ার কারণ নেই যে, সে যদি নিজেকে যুক্তিবাদী করে তোলে তাহলে জীবন আনন্দহীন হয়ে যাবে। বরং যৌক্তিকতা মূলত অভ্যন্তর সমন্বয়ভাবে চিন্তা করতে পারে। সে নিজের শক্তি স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারে।

পক্ষান্তরে যে মানুষ অভ্যন্তর দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত সে তা পারে না। নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকার মতো স্বাদহীন আর কিছু নেই। যেমন নেই শক্তি ও মনোযোগ বাইরে ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো আনন্দময় আর কিছু। আমাদের ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতা খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং পাপের চেতনা সম্পর্কে ধারণা এই অজ্ঞানতাজাত আত্মকেন্দ্রিকতারই একটা অংশ।

ভুল নৈতিকতার মাধ্যমে সৃষ্ট অবস্থার ভিতর দিয়ে যে মানুষ কখনো পার হয়ে যায়নি, তার কাছে যুক্তি অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু যে একবার অন্তত পাপের চেতনায় রোগগ্রস্ত হয়েছে তাকে সারিয়ে তুলতে যুক্তি প্রয়োজনীয়। মনে হয় মানসিক বিকাশের জন্যে এই রোগের প্রয়োজন রয়েছে।

আমার মনে হয় যে মানুষ যুক্তির সাহায্যে এই অবস্থা পার হয়ে গেছে সে একটা উচ্চতর স্তরে উঠে গেছে এবং যে মানুষের এই রোগ এবং তার নিরাময় সম্বন্ধে কোনওটারই অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়নি সে ততটা উচ্চস্থানে উঠতে পারে নি। আমাদের সময়ে যৌক্তিকতার প্রতি ঘৃণা খুবই বিস্তৃত। যার কারণ মূলত এই যে, যুক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অত্যন্ত অগভীর।

যে মানুষ নিজেকে নিজের বিরোধী করে তোলে সে উদ্দীপক এবং চিত্তহরণকারী জিনিসের প্রতি মোহ অনুভব করে। সে জোরালো উত্তেজনা পছন্দ করে কিন্তু তার কোনও উপযুক্ত কারণ নেই। সে এইসব করে নিজেকে বহির্মুখী করার জন্যে এবং চিন্তা করার বেদনাময় দায় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে। যে কোনও ধরণের উত্তেজনা তার কাছে একরকমের প্রমত্ততা এবং সে আসল সুখ কী তা কল্পনা করতে পারে না বলে।

বেদনা থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পাওয়া তার কাছে একমাত্র প্রমত্ততার ভিতর দিয়ে, সম্ভব বলেই মনে করে, এটা মনের গভীর স্তরে অবস্থিত একটি রোগের লক্ষণ। যে ক্ষেত্রে এই রোগ নেই সেখানে মেধার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা থেকে সবচেয়ে আনন্দ লাভ করা যেতে পারে। যে মুহূর্তে মন সবচেয়ে ক্রিয়াশীল থাকে, বিস্মরণ কম হয় তখনই গভীর আনন্দের স্পর্শ পাওয়া যায়।

যে আনন্দের জন্য প্রমত্ততা প্রয়োজন হয়, তা সে যে ধরণেরই হোক, সে আনন্দ কৃত্রিম এবং অতৃপ্তিকর। সত্যিকার তৃপ্তিদায়ক আনন্দের সাথে থাকে মানসিক শক্তির পূর্ণ সক্রিয়তা এবং যে পৃথিবীতে আমরা জীবন কাটাই তার সম্পর্কে পূর্ণতম জ্ঞান।

সুখলাভ কি তবু সম্ভব?>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
সুখের সন্ধানে- বার্ট্রান্ড রাসেল।
অনুবাদক- আতা-ই-রাব্বি।

……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!