ভবঘুরেকথা

প্রেম

-লুৎফর রহমান

খ্রিষ্টান ধর্ম আজ এত সমুজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রভাবের ফলে। আল্লাহর মঙ্গলবাণী হযরত মোহাম্মদ (স) বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে প্রচার করেছিলেন, তারপর ইঞ্জিল কেতাবের দীপ্তি ইউরোপবাসীর চোখে সমুজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়েছে।

আতুর, কয়েদি, পাগল, দাস, কুষ্ঠরোগীকে ইউরোপ কুকুরের মতো, বন্য পশুর মতো ঘৃণা করতো। পিসা (টে) শহরে জীবন্ত মানুষের শরীরে এনাটমি শিখবার জন্যে ডাক্তারেরা স্কালপোল (ছুরি) ব্যবহার করতো। মানুষের উপরে এই অত্যাচারের কাহিনী পড়ে আমরা ভীত হই। আত্মা ব্যাকুল হয়ে উঠে।

মানব জাতির জন্যে আর্শীবাদ হয়েই ইসলাম যথাসময়ে পৃথিবীতে এসে ছিল। ছোট নাই, বড় নাই, ধনী নাই, দরিদ্র নাই, পীড়িত, লাঞ্ছিত, দাস গোলাম, রোগী সবই ভাই’!

ইসলামে দান খেয়ালী বিষয় নহে; তা আল্লাহর অপরিহার্য আদেশ। জলেম ও জুলুম’কে ইসলাম আল্লাহর অভিশাপ দেয়- আন্তরিক ঘৃণা করে। মজলুম’কে সমস্ত ত্রাণ দিয়ে রক্ষা কর- এই তাঁর বাণী।

অনেককাল আগে একবার আমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। গাড়ির মধ্যে একজন দুর্বলকায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক এসে প্রবেশ করলো। গাড়িতে জায়গা ছিল অনেক। কয়েকজন কাবুলি উপাসনার ভান করে তাদের দীর্ঘ দেহ এবং উপাসনার আসন দিয়ে সমস্ত জায়গা জুড়ে রাখলো।

ইসলাম তস্করের হাত কাটতে, ব্যভিচারীকে পাথর মারতে বলেছে; কিন্তু সে ক্ষমার কথাও বলেছে। মুসলমান সাধু চোরকে রিক্ত হস্তে ফিরতে দেখে ব্যথিতচিত্তে আপন একমাত্র সম্বল কম্বলটি চোরের যাওয়ার পথে রেখে গিয়েছেন। সাধু ফকিরদের জীবন কাহিনী কত সুন্দর, জগতে কোথাও তার তুলনা নাই।

ইসলামে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম- অপর জাতির প্রতি প্রেম নিন্মলিখিত সত্য ঘটনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রেমে আপন-পর নাই, জাতি-বিচার নাই। মিশরে এক। সময়ে একটি মসজিদ ভস্মীভূত হয়। কতকগুলি লোক সন্দেহ করল খ্রিস্টানদের এ কাজ। তারা সন্দেহ করে খ্রিস্টানদের ঘর জ্বালিয়ে দিল।

খলিফা কিন্তু অপরাধীদের নিজের জাত বলে ক্ষমা করলেন না। বিচারক কতকগুলি কাগজে মৃত্যুদণ্ড, কতকগুলিতে বেত্রাঘাতের দণ্ড লিখে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন- “যার যেখানা ইচ্ছা তুলে নাও।” কোনো কাগজে কী শাস্তি লেখা আছে, তা তাদের জানতে দেওয়া হল না।

খলিফার কঠিন শাস্তি অপরাধী মুসলমানদের গ্রহণ করতে হলো। খলিফার কঠিন শাস্তি লেখা আছে, তা তাদের জানতে দেওয়া হল না। খলিফার কঠিন শাস্তি অপরাধী মুসলমানদের গ্রহণ করতে হল। ইহাই ইসলামের কঠিন আদর্শ, ইহাই প্রেমের আদর্শ।

সেই অপরাধী জনসংঘের মাঝে দুই ব্যক্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। তাদের একজনের ভাগ্যে ঘটেছিল মৃত্যুদণ্ড, অপরের বেত্রাঘাত। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি বললেন- ”আমার মরণের ভয় নাই, কিন্তু আমার নিঃসহায়া মা আছেন, তারই জন্য দুঃখ হচ্ছে। কে তাঁর সেবা করবে?”

পাশের ব্যক্তি তার হাতে নিজের শাস্তি পত্রখানি দিয়ে বললে- ”আমার মা নেই, আমার মরণে কারো ক্ষতি হবে না।” যার মরণের কথা ছিল, সে মুক্তি পেল, যার বাচবার কথা ছিল আনন্দে মৃত্যুবরণ করলো। এই লোকটির সংবাদ জগৎ রাখে নাই। কিন্তু তার জীবনে মহা আদর্শ মনুষ্যকে শিক্ষা দিয়েছে- প্রেম কাকে বলে।

অনেককাল আগে একবার আমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। গাড়ির মধ্যে একজন দুর্বলকায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক এসে প্রবেশ করলো। গাড়িতে জায়গা ছিল অনেক। কয়েকজন কাবুলি উপাসনার ভান করে তাদের দীর্ঘ দেহ এবং উপাসনার আসন দিয়ে সমস্ত জায়গা জুড়ে রাখলো।

শীতকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের মাতা একখানি বস্ত্র গায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন। তা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন- ”মা, আমি তো আপনাকে তুলা দিয়ে নরম লেপ তৈরি করে দিয়েছি, এই শীতে আপনি এই সামান্য বস্ত্রে রাত্রি কাটাবেন?”

আমি বিধর্মীকে দয়াপরবশ হয়ে একটু স্থান দিতে সবাইকে অনুরোধ করলাম। গাড়ির সবাই রেগে উঠলো। শেষকালে আমি অতি কষ্টে কোনোরকমে সেই ক্লান্ত অতিথিটিকে একটু স্থান দিলাম। আমার এই অন্যায় (?) ব্যবহারে কাবুলি ভাইরা এবং অন্যান্য সবাই চটে গেল।

শেষরাত্রে দ্ৰিাকাতর হয়ে যেই একটু শোবার জন্য একটু কাৎ হয়েছি, অমনি কতকগুলি হাত আমার কান নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করলো। কান যে মলে দেয় নাই, এটাই সৌভাগ্যের বিষয়। ইসলামের প্রতি আত্মার প্রেম লোকগুলি এভাবেই সার্থক করলো। বস্তুত এ ইসলামের কাজ নয়। ইসলামের প্রেমে জাতি বিচার নাই। সর্বত্রই সে ন্যায়নিষ্ঠ এবং মহাজন।

এমার্সন বলেছেন- “কোমল, পেলব ব্যাঙের ছাতাগুলি মৃদু আঘাতে কঠিন মাটির ছাপড়া ভেঙ্গে দেয়। কার কাজ কেমন শান্ত অথচ অব্যর্থ। প্রেম ও দয়া মান-চিত্তকে জয় করে। মনুষ্য হৃদয়কে আসন পাতবার, আকর্ষণ করবার, দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। হৃদয়হীন শাসনের ফল দ্রুত; কিন্তু ক্ষণস্থায়ী, প্রেমের শাসনই, চিরস্থায়ী।”

জন উলমান (John Woolman) বলেছেন- ”মানুষের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছে না। ব্যথা, পিতৃহীনের করুণ নয়ন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না! কত শত নয়ন পতিত হয়েছে, কত মুখ শোকদুঃখভারে বিবর্ণ হয়েছে, আমরা তা দেখি নাই। আমাদের হাসি, উল্লাস, উৎসব, গান থামে নাই। মানব-দুঃখ আমাদের জাগায় নাই। মানুষের পাপে আমাদের শরীর শিউরে ওঠে নাই।”

রোগীর কী যাতনা, তার দুঃখের দুঃসহ জ্বালা, সুস্থ মানুষ অনুভব করতে পারে না। দুঃখীর দুঃখ যিনি যতটুকু অনুভব করেন, তিনি তত বড় মানুষ। হাসি-খেলার দিনমান শেষ। হয়, কিন্তু যাতনাদগ্ধ নর-নারীর আর্তনাদ দিনের প্রতি মুহূর্তে কঠিন প্রতিধ্বনি জানাচ্ছে কে তা চিন্তা করে? কে ব্যথিতের বেদনার কথা ভেবে জীবনের সুখকে বিষাদ-মলিন করে। তুলবে? যে মুখ মানব-দুঃখে উদাসীন, সে মুখ পশুর, সে মুখ মানুষের যোগ্য নয়।

শীতকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের মাতা একখানি বস্ত্র গায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন। তা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন- ”মা, আমি তো আপনাকে তুলা দিয়ে নরম লেপ তৈরি করে দিয়েছি, এই শীতে আপনি এই সামান্য বস্ত্রে রাত্রি কাটাবেন?”

মনুষ্য যতই অপরাধ ও মূঢ় হোক না কেন, তাকে আঘাত করে মানুষের মনে যখন। আনন্দ হয়, তখন বুঝতে হবে, শয়তান আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। সে আঘাত মানুষের নয়। মনুষ্যকে শাস্তি দাও- আঘাত কর কর্তব্যের খাতিরে- পশুর আনন্দ নয়।

মা বললেন- “বাবা, এই গ্রামের অনেক হতভাগিনী আছে, যাদের গায়ে দেবার বস্ত্র নেই, তাদের কথা চিন্তা করে আমি গায়ে গরম কাপড় দিতে পারছি না।” কী সুন্দর মহানুভবতা, কী স্বর্গীয় সহৃদয়তা- দরিদ্রের প্রতি তার আশ্চর্য প্রেম।

সুইডেনের রাজকুমারী ইউজীন পীড়িতের কথা চিন্তা করে তার সাধের রত্ন অলঙ্কারগুলি কণ্টক বলে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি সেইগুলিকে বিক্রি করে দুঃখীদের জন্যে এক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। একদা হাসপাতাল পরিদর্শনকালে জনৈক রোগী তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,

“মা, আপনার এই হাসপাতালে আশ্রয় না পেলে আমি রাস্তায় প্রাণত্যাগ করতাম”। এই বলে লোকটি নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। রাজকুমারী তা দেখে বললেন, “এই অশ্রুধারাই আমার শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার, আজ আমি মুক্তার হার ধারণ করলাম।”

আমরা কি সত্যই উন্নতির পথে চলেছি? – তা হলে দেখতে হবে, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হচ্ছে কিনা। সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সভ্যতা, সকল ধার্মিকতার প্রাণ-প্রেম। প্রেম ব্যতীত জাতির সাধনা ব্যর্থ। প্রেম মনুষ্যত্বকে ত্যাগী করে, তাকে দুঃখ বরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে, মানুষের এবং জাতির জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রেম কখনও মানুষকে অবিবেচক, নিষ্ঠুর, আত্মসর্বস্ব, অবিনয়ী, পরস্বার্থহারী, দাম্ভিক করে না।

দেখতে হবে, আমরা দেশের মানুষকে ভালোবাসি কিনা। দেশের মানুষের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছি কিনা? তা হলে বুঝবো জাতির সত্যই উন্নতি শুরু হয়েছে।

আমরা কি প্রতিবেশীকে আঘাত করি?- আমরা কি কারও দাবি নষ্ট করি?- জাতির দুঃখে কি আমাদের কোনো সহানুভূতি নাই?- পরস্পরে কি আমরা মিথ্যা ব্যবহার করি? তা হলে বুঝবো কিছুই হয় নাই।

মনুষ্য যতই অপরাধ ও মূঢ় হোক না কেন, তাকে আঘাত করে মানুষের মনে যখন। আনন্দ হয়, তখন বুঝতে হবে, শয়তান আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। সে আঘাত মানুষের নয়। মনুষ্যকে শাস্তি দাও- আঘাত কর কর্তব্যের খাতিরে- পশুর আনন্দ নয়।

(চলবে…)

<<পরিবার ।। সেবা>>

………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!