ভবঘুরেকথা
মাওলা সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী

সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী স্মারক বক্তৃতা ২০১৯

অতএব (তাহাকে) আজাব দেওয়া হইবে না সেই সময়ে, তাহার আজাব হইল আহাদ এবং তখন (তাহাকে) বন্ধন করা হইবে না, তাহার বন্ধন হইল আহাদ। সুরা ফাজর : বাক্য # ২৫-২৬

ব্যাখ্যা : মৃত্যুর পর থেকে আরম্ভ করে পুনরায় জাহান্নামে পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত চিরন্তন নফসকে সম্পূর্ণ সজাগ রাখা হয় (দ্রষ্টব্য ৭৫:১৪)। এ সময়ের মধ্যে তার কোনও শাস্তি হয় না। কারণ সে তখন অশরীরী বা বিদেহী অবস্থায় রবের হেফাজতে থাকে। অতএব তখন ৈদহিক শাস্তির কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

পূর্বকৃত পাপের জন্য অনুতাপের যে অবস্থায় সে বাস করে সেটাই তার একমাত্র শাস্তি। মৃত্যুর পর পুনরায় সৃষ্টিতে আসার পর সে আহাদ থেকেই সেফাতপ্রাপ্ত হয়। তখনই কেবল আহাদের সেফাতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তি ও অশান্তির অবস্থায় সে বিজড়িত হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত ধারামতে, পুনরায় জন্ম না নেয়া পর্যন্ত কোনও শাস্তি নেই। তবে কি অপরাধী নফসের তথা পাপাত্মার অপকর্মের শাস্তি হবে না? শাস্তি অবশ্য ইহবে, তবে তা হবে এই পার্থিব জগতেই। পার্থিব জগতের সংসার-যাতনাই জাহান্নামের বোবা জ্বালা-যন্ত্রণা। পাপের কারণেই পুনর্জন্ম হয়ে থাকে এবং কোনও পাপই শাস্তি ব্যতিরেকে খণ্ডন হয় না। আলোচ্য বাক্য দুটি পুনর্জন্মেরই ইঙ্গিত বহন করছে।

তাহা নয় (যাহা ভাবিয়াছে), সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হইবে হুতামায়। তুমি কি জান হুতামা কি? ইহা প্রজ্জ্বলিত আগুন যাহা হৃদয় গ্রাস করে। সুরা হুমাজাহ : বাক্য # ৪-৭

ব্যাখ্যা : হুতামার আগুনের জ্বালা-যন্ত্রণার স্থান কোনও কল্পিত স্থান জাহান্নাম নয়; হুতামা বাস্তব জ্বালা-যন্ত্রণার স্থান এবং তা এই নশ্বর পৃথিবীতেই। অপরাধী চিরন্তন-নফসকে পরবর্তী জীবনে এমন কর্মবৃত্তে আবদ্ধ করে দেয়া হবে যাতে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে তাকে জীবনকাল অতিবাহিত হবে-এটাই হুতামা। আমরা প্রায় সবাই কমবেশি হুতামা দোজখের আগুনেই জ্বলছি।

অপরাধী হলে তবেই জাহান্নামের শাস্তির প্রশ্ন। এখন যুক্তির আলোকে হুতামা নরকের শাস্তি যদি পার্থিব জগতেই হয়; তবে এ শাস্তিভোগের জন্য অপরাধী চিরন্তন নফসের পুনর্জন্ম প্রাপ্ত না হয়ে এ শাস্তিভোগ করার অবকাশ কোথায়?

উপরোক্ত কারিমাগুলোর ব্যাখ্যায় আমাদের কাছে জন্মান্তরবাদ বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এবার আমরা রসুলুল্লাহর (স) আহলে বায়েতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম হোসাইনের (আ) আরাফার একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ উদ্ধৃত করছি। পাকপাঞ্জাতনের একজন হিসেবে এ মহাপুরুষের বাণী শিরোধার্য। নিশ্চয় তাঁর বক্তব্যের উদ্ধৃতি আমাদের কোরান অনুধাবনে আরও অধিক সহায়ক হবে।

জন্মান্তরবাদ সম্বন্ধে হয়রত ইমাম হোসাইন আলাইহে সসালাতু আসসালামের বাণী*৫

হে আল্লাহ, আমি তোমারই দিকে ঝুঁকিতেছি এবং তোমার রবুবিয়াতের সাক্ষ্য দিতেছি। তোমার কারণেই স্থির বিশ্রাম। তোমা-দ্বারাই যে আমরা রব।*৬ এবং তোমার দিকেই আমার প্রত্যাবর্তন। উল্লেখযোগ্য একটি বস্তু হওয়ার পূর্বেই তোমার নেয়ামতের দ্বারা আমার প্রারম্ভ হইয়াছে। এবং তুমি আমাকে মাটি হইতে সৃষ্টি করিয়াছ।

তারপর আমাকে নিরাপত্তার সহিত (পিতাগণের) ঔরসসমূহে পৃথক পৃথকভাবে স্থান দিয়াছ অসীমকাল এবং বছরের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার জন্য।*৭ যুগ যুগের এক একটি প্রাচীনের মধ্যে আমি একজন ভ্রমণকারী, পিতার এক একটি ঔরস হইতে এক একটি মাতৃগর্ভের দিকে অনাদিকাল হইতে বাস করিয়া আসিয়াছি।*৮

অতীতের বিগত জমানাগুলিতে আমার সহিত অনুগ্রহ এবং আমার জন্য ভালবাসার কারণে এবং আমার প্রতি তোমার সাহায্যের কারণে আমাকে খারেজ কর নাই কুফরীর ইমামগণের (অর্থাৎ চালকগণের) রাজত্বের মধ্যে যাহারা তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়াছে এবং তোমার রসুলগণকে অস্বীকার করিয়াছে।*৯

বরং তুমি আমাকে বাহির করিয়া আনিয়াছ তাঁহাদের জন্য যাহারা হেদায়েত দানে আমার অগ্রবর্তী। উহার জন্য (অর্থাৎ হেদায়েত দানের সেই দায়িত্ব পালনের জন্য) আমাকে সহজ করিয়াছ এবং উহাতে আমাকে (কর্তব্যে) উন্নীত করিয়াছ। এবং উহার পূর্ব হইতেই আমার সহিত তুমি কারগরিপূর্ণ জামালী দয়া বিগলিত।*১০

আমাকে সৃষ্টি করা আরম্ভ করিয়াছ বেগবান বীর্য হইতে এবং অবস্থান দিয়াছ তিনটি অন্ধকারের মাঝে: মাংস, রক্ত এবং চর্ম (অর্থাৎ দেহের মধ্যে)। আমার (দেহ) সৃষ্টিতে আমাকে সাক্ষী কর নাই এবং আমার (দৈহিক প্রবৃদ্ধির) বিষয়ভার আমার উপরে ন্যস্ত কর নাই।*১১ তারপর তুমি আমাকে বাহির করিয়াছ তাঁহাদের (ফেলে

যাওয়া কর্তব্য পালনের) জন্য যাঁহারা আমার অগ্রবর্তী হইয়া (ইমাম হাসান, ইমামআলী ও রসুলাল্লাহ) দুনিয়ার দিকে পরিপূর্ণ, নিখুঁত হেদায়েত দিয়াছিলেন। এবং আমাকে রেজেক দিয়াছ অসীম খাদ্য হইতে সহজপাচ্য এক একটি দুগ্ধ। এবং স্নেহশীলা মাতৃগণের নিরাপত্তা দান করিয়াছ।

এবং আমাকে উদ্ধার করিয়াছ অসীম জিনদের সীমা হইতে (অর্থাৎ মনের অসীম জিনভাব হইতে আমাকে মুক্ত করিয়াছ)। এবং বৃদ্ধি ও লোকসান হইতে আমাকে দিয়াছ প্রশান্তি।*১২

কোরানের বাক্যসমূহের পর্যালোচনা এবং মাওলা হোসাইনের (আ) বক্তৃতা থেকে আমরা এই মর্মে উপনীত হতে পারি যে, জন্মান্তর বা রূপান্তর কোনও অমূলক ধারণা নয়। এটি সৃষ্টিরহস্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। একে মে․খিক স্বীকৃতি দেয়া

*৫ সুফি সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতী প্রণীত অখ- ‘কোরানদর্শন’এর পরিশিষ্ট থেকে গৃহীত।

*৬ আপন রবের সঙ্গে পরিচয় ব্যতীত রবের কার্যকলাপের সাক্ষ্য দেয়া যায় না। হযরত হোসাইন (আ) রবের সহিত প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত বলিয়াই তিনি এইরূপ সাক্ষ্য দিতে পারিতেছেন। লা মোকামে না পৌঁছা পর্যন্ত মানুষ মনের স্থিরবিশ্রাম অর্জন করিতে পারে না। তিনি প্রার্থনারূপে বলিতেছেন, তোমার দয়ার কারণেই স্থিরবিশ্রামপ্রাপ্ত হইয়াছি এবং তোমাদ্বারাই আমার রব সংগঠিত ও সমৃদ্ধ হইয়াছে। অর্থাৎ নূরে মোহাম্মদী হযরত হোসাইনের (আ) মনে স্থিতিমান হইয়াছেন।

*৭ মুক্তিলাভের পূর্ব পর্যন্ত বারংবার জন-জন্ম¥ান্তরে আসিবার বিষয়টি রবের দিকে প্রত্যাবর্তনের বিধানের কারণেই হইয়া থাকে। মানুষের প্রারম্ভমাটি হইতে সৃষ্ট হইয়া উল্লেখযোগ্য একটি বস্তু হওয়ার পূর্ব হইতেই আল্লাহর নেয়ামতের দৃষ্টির মধ্যে থাকিয়া ক্রমোন্নতির দিকে চলিয়া আসিতেছে।

*৮ তিনি বলিতেছেন, প্রাচীনকাল হইতে জীবরূপে আমি পিতার ঔরস হইতে মাতৃগর্ভের দিকে জীব হইতে জীবে ভ্রমণরত ছিলাম।

*৯ তারপর বর্তমানে তিনি যে সত্যাশ্রয়ী একজন ইমামরূপে আছেন তাহা তাঁহার অতীত জীবনগুলির উপর আল্লাহর অনুগ্রহ দানের ফলশ্রুতি মাত্র। তাই তিনি বর্তমানকালে আল্লাহর রহমত হইতে বহিষ্কৃত হইয়া সেই সকল কাফের নেতাদের সমর্থক হন নাই যাহারা নবীগণের নীতিকে অস্বীকার করিয়া আপন রবের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়াছে। তিনি কাফেরদের রাজত্বে বাস করিয়াও কুফরীর আওতাভুক্ত হন নাই।

*১০ পক্ষান্তরে আল্লাহ তাঁহাকে বানাইয়াছেন উচ্চতম পরিষদের সদস্য এবং সেই পর্যায়ের হেদায়েত দানের দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা দানের জন্য তাঁহাকে সহজ করিয়া দিয়াছেন। আমরা দলের সদস্য হওয়ার পূর্ববর্তী কয়েকটি জীবন হইল জান্নাতের জীবন। জান্নাতের জীবনগুলিতে আল্লাহ জান্নাতবাসীদের প্রতি জামালী দয়া বিগলিত হইয়া থাকেন। সেই কারণেই তাঁহারা জান্নাত হইতে উন্নীত হইয়া লা মোকামে পৌঁছিয়া আমরা দলের সদস্য হইয়া থাকেন।

*১১ দেহের মধ্যে নফস সৃষ্টি করিবার বিষয়টি আল্লাতালা মানুষকে সাক্ষী করিয়া করেন না এবং মাতৃগর্ভ হইতে আরম্ভ করিয়া দেহের প্রবৃদ্ধিকরণ বিষয়টি শিশুর উপর ন্যস্ত করা হয় না।

*১২ এইরূপে জঞ্জালময় জীবন হইতে বাহির করিয়া হজরত হোসাইন (আ)কে চরম উন্নতির পর্যায়ভুক্ত করিয়া দুনিয়ার দিকে নিখুঁত হেদায়েত দান করিবার ভার দেওয়া হইয়াছে। ইহা হইল তাঁহার অগ্রবর্তী তিনজনের ফেলে যাওয়া কর্তব্য পালন করা। উচ্চতম এই অবস্থা প্রাপ্তির পূর্ববর্তী জীবনগুলির উল্লেখ করিয়া তিনি বলিতেছেন, কত দোলনায় তিনি হেফাজতপ্রাপ্ত হইয়াছেন, কত মাতৃদুগ্ধ তিনি পান করিয়াছেন, কত স্নেহশীলা মাতা ও স্বজনগণের স্নেহে তিনি নিরাপত্তার সহিত প্রতিপালিত হইয়াছেন।

(চলবে…)

……………………………………
স্বারক বক্তা : সালেহ আহমেদ শিশির
সভাপতি : অধ্যাপক ড আনিসুজ্জামান
২৫ নভেম্বর ২০১৯
আর সি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়াম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!