ভবঘুরেকথা
তথাগত গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধ ভগবান

স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন : প্রথম কিস্তি

-ভগিনী নিবেদিতা

স্বামীজীর জীবনে বুদ্ধের প্রতি ভক্তিই ছিল সর্বপ্রধান বিচারমূলক অনুরাগ। সম্ভবতঃ ভারতের এই মহাপুরুষের জীবনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্যই তাহাকে ঐ বিষয়ে আনন্দ প্রদান করিত। তিনি বলিতেন, “ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদ সম্পর্কেই আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানি, কারণ সৌভাগ্যক্রমে তাহাদের শত্রু মিত্র দুই-ই ছিল।”

তাহার আদর্শ পুরুষের (বুদ্ধের) চরিত্রে যে পূর্ণ বিচারবোধের পরিচয় পাওয়া যায় বার বার তিনি সে-প্রসঙ্গ উল্লেখ করিতেন। তাহার নিকট বুদ্ধ কেবল আর্যগণের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নহেন, পরন্তু জগতে যত লোক জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সম্পূর্ণ স্থির-মস্তিষ্ক ছিলেন।

তিনি কেমন পূজা গ্রহণে অস্বীকার করেন? কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে যে তাহাকে পূজা করা হইয়াছিল, সে বিষয়ে স্বামীজী কোন উচ্চবাচ্য করেন নাই। তিনি বলিতেন, “বুদ্ধ ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, এক উচ্চ অবস্থা বিশেষ। এস, সকলেই ঐ অবস্থা লাভ কর। এই নাও তার চাবি!”

আজগুবী ব্যাপার সম্পর্কে সাধারণের যে ঔৎসুক্য, বুদ্ধ তাহার প্রতি এত বীতস্পৃহ ছিলেন যে, জনতার সমক্ষে একটা লম্বা খুঁটির উপর হইতে কেবল শব্দের দ্বারা মণিমুক্তাখচিত একটি বাটি নামাইয়া আনার জন্য এক যুবককে সঙ্ঘ হইতে নির্মমভাবে বাহির করিয়া দেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ধর্মের সহিত বুজরুকির কোন সম্পর্ক নাই।

এই আনন্দময় পুরুষের কি অসাধারণ স্বাধীনতাবোধ ও নিরভিমানতা ছিল! বারনারী অশ্বপালীর নিমন্ত্রণে তিনি যোগ দেন। মৃত্যু ঘটিতে পারে জানিয়াও তিনি এক অন্ত্যজের গৃহে ভিক্ষাগ্রহণ করেন, কারণ তাঁহার ইচ্ছা ছিল,দীন-হীন ব্যক্তিগণের সহিত সংযোগস্থাপনই যেন তাহার জীবনের শেষকার্য হয়।

স্বয়ং হিন্দু সন্ন্যাসী হইলেও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক বোধ হইয়াছিল যে, বুদ্ধের ন্যায় দৃঢ়চেতা ব্যক্তির পরিণয় সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মতো ধারণা” থাকিবে, এবং তিনি স্বয়ং দেখিয়া পাত্রী নির্বাচন করার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব অবলম্বন করিবেন।

অতঃপর যাহার গৃহে ভিক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাকে মহাপরিনির্বাণলাভে সহায়তার জন্য সৌজন্যপূর্ণ বার্তা পাঠান। কি প্রশান্ত! কি পুরুষোচিত আচরণ! সত্যই তিনি ছিলেন পুরুষর্ষভ এবং অশেষ গুণাকর।

আবার তাহার মধ্যে যেমন বিচারশক্তির পূর্ণতা ঘটিয়াছিল, তেমনি তিনি ছিলেন আশ্চর্য দয়ার আধার। রাজগৃহে ছাগগুলির জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। একবার এক ব্যাঘ্রীর ক্ষুধা পরিতৃপ্তির জন্য নিজ শরীর দান করিতে চাহিয়াছিলেন।

পঁচশতবার পরার্থে জীবন বিসর্জনের ফলেই ধীরে ধীরে সেই অপার পবিত্র করুণার উদ্ভব হয়, এবং উহাই তাহাকে বুদ্ধত্বে উপনীত করে।

জনৈক যুবক সম্বন্ধে তিনি যে গল্পটি বলেন, তাহা হইতে বহুযুগের ব্যবধানেও আমরা তাহার রসজ্ঞানের কিঞ্চিৎ আভাস পাই। যাহাকে জীবনে দেখে নাই, এবং যাহার নাম পর্যন্ত শোনে নাই, এইরূপ এক নায়িকার প্রতি ঐ যুবক গদগদভাবে নিজের প্রেম ব্যক্ত করিতেছে-

এই কষ্টকর অবস্থাকে তিনি মানবের ঈশ্বর সম্পর্কে নানা উক্তির সহিত তুলনা করেন। একমাত্র তিনিই ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে স্বর্গ-নরকাদি কল্পনা হইতে মুক্ত করিতে সমর্থ হন। অথচ উহা দ্বারা তাহার শক্তি এবং মানবহৃদয়ে তাহার প্রাণস্পর্শী আবেদন কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। উহার কারণ তাহার নিজের মহান ব্যক্তিত্বপূর্ণ ক্ষমতা এবং সমসাময়িক ব্যক্তিগণের উপর উহার অসীম প্রভাব।

এক সন্ধ্যায় স্বামীজী, বুদ্ধের সহধর্মিণী যশোধরার নিকট বুদ্ধের জীবনকাহিনী যেরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল, তাহার একটি কাল্পনিক চিত্র আমাদের কয়েকজনের নিকট বর্ণনা করেন। ইতিহাসের শুষ্ক অস্থি ঐরূপ পরিপূর্ণ জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ ঘটনার ন্যায় বর্ণিত হইতে আমি ইতিপূর্বে কখনও শুনি নাই।

স্বয়ং হিন্দু সন্ন্যাসী হইলেও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক বোধ হইয়াছিল যে, বুদ্ধের ন্যায় দৃঢ়চেতা ব্যক্তির পরিণয় সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মতো ধারণা” থাকিবে, এবং তিনি স্বয়ং দেখিয়া পাত্রী নির্বাচন করার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব অবলম্বন করিবেন।

সপ্তাহব্যাপী উৎসব ও বাগদানের প্রত্যেকটি ঘটনা স্বামীজী বিশদভাবে ও দরদের সহিত বর্ণনা করিলেন। অতঃপর উভয়ের সুদীর্ঘ দাম্পত্যজীবন এবং অবশেষে সেই বিখ্যাত বিদায়রজনীর চিত্র বর্ণিত হইল। দেবগণ গাহিলেন,”জাগো, হে প্রবুদ্ধ! ওঠ এবং জগৎকে সাহায্য কর।”

তারপর যশোধরাকে দেখিয়া এবং স্বামীর নিকট থাকিবার জন্য তাহার আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করিয়া প্রধান শিষ্য ভগবানকে বলিলেন, “ভগবান, স্ত্রীলোকেরাও কি সঙ্গে প্রবেশ করিতে পারেন? আমরা কি এঁকেও গৈরিক বস্ত্র প্রদান করব?”

রাজপুত্রের মনের মধ্যে সংগ্রাম চলিতে লাগিল,বার বার তিনি নিদ্রিত পত্নীর শয্যাপার্শ্বে প্রত্যাগত হইলেন। “কি সেই সমস্যা- যা তাকে বিচলিত করিয়াছিল! তিনি যে তার পত্নীকেই জগতের কল্যাণের জন্য বলি দিতে উদ্যত হয়েছেন! তার জন্যই এই সংগ্রাম। নিজের কথা তিনি একেবারেই ভাবছিলেন না।”

অতঃপর তাহার জয়লাভ এবং তাহারই অনিবার্য ফলস্বরূপ বিদায় গ্রহণ, এবং অতি সন্তর্পণে রাজপুত্রীর চরণচুম্বন–এত সন্তর্পণে যে, তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল না। স্বামীজী বলিলেন, “তোমরা কি কখনো বীরদের হৃদয়ের কথা চিন্তা করনি? তাহার হৃদয় মহৎ, অতি মহৎ। সে মহত্ত্বের তুলনা নেই, আবার তাননীর মতোই কোমল!”

দীর্ঘ সাতবৎসর পরে রাজপুত্র- তখন তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত কপিলাবস্তুতে প্রত্যাবর্তন করিলেন। যেদিন তিনি তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া যান, সেইদিন হইতে যশোধরাও তাহার নারীজনোচিত উপায়ে স্বামীর ধর্মজীবনের অনুবর্তনকারিণী।

তাহার পরিধানে কষায় বসন, আহার কেবল ফলমূল, অনাবৃত স্থানে ভূমিশয্যায় শয়ন। বুদ্ধ প্রবেশ করিলেন, যশোধরা প্রকৃত সহধর্মিণীর ন্যায় তাহার বস্ত্রের প্রান্তভাগ স্পর্শ করিলেন। ভগবানও তাহাকে এবং তাহার পুত্রকে সত্য উপদেশ দিলেন।

উপদেশ প্রদানের পর তিনি উদ্যানে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে যশোধরার চমক ভাঙিল। তিনি পুত্রের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “শীঘ্র যাও, তোমার পিতার নিকট গিয়ে পিতৃধন চেয়ে নাও।”

শিশু যখন প্রশ্ন করিল, “মা, এদের মধ্যে আমার পিতা কে?” যশোধরা গর্বের সহিত উত্তরে কেবল এইটুকু বলিলেন, “যিনি সিংহের ন্যায় রাজপথ দিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই তোমার পিতা!”

শাক্যবংশের ভাবী উত্তরাধিকারী কুমার তখন পিতার নিকট গিয়া বলিল, “পিতা, আমাকে আমার পিতৃধন দিন!”

বালক তিনবার বুদ্ধের নিকট ঐরূপ ভিক্ষা করিলে বুদ্ধ আনন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘ওকে দাও! তখন বালককে গৈরিক বস্ত্র প্রদান করা হইল।

তারপর যশোধরাকে দেখিয়া এবং স্বামীর নিকট থাকিবার জন্য তাহার আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করিয়া প্রধান শিষ্য ভগবানকে বলিলেন, “ভগবান, স্ত্রীলোকেরাও কি সঙ্গে প্রবেশ করিতে পারেন? আমরা কি এঁকেও গৈরিক বস্ত্র প্রদান করব?”

তাহাদের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তিই পালিভাষা বুঝিতে সাহায্য করে, কারণ পালিভাষা সংস্কৃত হইতেই উদ্ভূত। ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের রচনাবলী এবং ‘লাইট অব এশিয়া’র অধ্যয়ন স্বামীজীর জীবনের স্বল্পকাল স্থায়ী ঘটনামাত্র হয় নাই। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট শিষ্যরূপে অবস্থানকালে তাহার এই প্রধান শিষ্যের সূক্ষ্মভাবপ্রবণ চিত্তে এইরূপে যে বীজ উপ্ত হয়, তাহা সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষালাভের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পভারে বিকশিত হইয়া উঠে।

বুদ্ধ উত্তর করিলেন, “জ্ঞানে কি কখনো লিঙ্গভেদ থাকতে পারে? আমি কি কখনো বলেছি যে, স্ত্রীলোকের সঙেঘ প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু আনন্দ, এ প্রশ্ন তোমারই উপযুক্ত।”

এইরূপে যশোধরাও শিষ্যারূপে গৃহীত হইলেন। অতঃপর সেই দীর্ঘ সাত বৎসরের অবরুদ্ধ প্রেম ও করুণা জাতক কাহিনীগুলিতে প্রবাহিত হইল! কারণ, ঐগুলি সবই যশোধরার জন্য! পঁচ শতবার উভয়েই অহংভাবনা বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। এখন তাহারা উভয়ে একত্রে চরম পূর্ণত্বলাভ করিবেন।

“হাঁ, হাঁ, এইরূপই হয়েছিল! যশোধরা এবং সীতার পক্ষে তাদের প্রেমপরীক্ষার জন্য একশ বছর যথেষ্ট সময় নয়।”

ক্ষণকাল নীরবতার পর আখ্যায়িকা সমাপ্ত করিতে গিয়া স্বামীজী আপন মনে বলিলেন, “না, না, এস, আমরা সকলেই স্বীকার করি যে, আমাদের মধ্যে এখনো কামক্রোধাদি বর্তমান! এস, আমরা প্রত্যেকেই বলি, ‘এখনো আমি আদর্শ অবস্থায় উপনীত হইনি।’ কেউ যেন অপর কোন ব্যক্তিকে ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে সাহস না করে!”

যৌবনের প্রারম্ভে আমাদের গুরুদেব যখন দক্ষিণেশ্বর যাতায়াত করিতেন, সেই সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতি জগতের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিল। ব্রিটিশ সরকারের আদেশে এই সময়ে বুদ্ধগয়ার বৃহৎ মন্দিরের পুনরুদ্ধার[১] কার্য চলিতেছিল, এবং বাঙালী পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র উক্ত কার্যে যোগদান করায় সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে গভীর আগ্রহ দেখা যায়।

অধিকন্তু ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে সার এডউইন আর্ণন্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ গ্রন্থখানি প্রকাশিত হওয়ায় ইংরেজীভাষী দেশগুলিতে অল্পশিক্ষিত সাধারণ লোকের কল্পনাও বিশেষভাবে উদ্দীপিত হয়। ঐ গ্রন্থের অধিকাংশ স্থল অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিতের’ প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ বলিয়া কথিত।

কিন্তু স্বামীজী কখনও অপরের মুখে কিছু শুনিয়া তৃপ্ত হইতেন না, এবং এই বিষয়েও তিনি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন নাই; অবশেষে ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি গুরুভ্রাতাদের সহিত একত্র কেবল ‘ললিত বিস্তর’ নহে, বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রজ্ঞাপারমিতার’[২] মূল সংগ্রহ করিয়া অধ্যয়ন করেন।[৩]

তাহাদের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তিই পালিভাষা বুঝিতে সাহায্য করে, কারণ পালিভাষা সংস্কৃত হইতেই উদ্ভূত। ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের রচনাবলী এবং ‘লাইট অব এশিয়া’র অধ্যয়ন স্বামীজীর জীবনের স্বল্পকাল স্থায়ী ঘটনামাত্র হয় নাই। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট শিষ্যরূপে অবস্থানকালে তাহার এই প্রধান শিষ্যের সূক্ষ্মভাবপ্রবণ চিত্তে এইরূপে যে বীজ উপ্ত হয়, তাহা সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষালাভের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পভারে বিকশিত হইয়া উঠে।

একদিন বুদ্ধের দেহত্যাগের দৃশ্য বর্ণনা করিতে করিতে চকিতের ন্যায় তাহার মনে এই চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিল। তিনি বলিতে লাগিলেন- কিরূপে এক বৃক্ষতলে তাহার জন্য কম্বল বিছানো হইয়াছিল, এবং সেই আনন্দময় পুরুষ “সিংহের ন্যায় দক্ষিণ পার্শ্বে শয়ন করিয়া” মৃত্যু-প্রতীক্ষায় রত, এমন সময়ে সহসা এক ব্যক্তি তাহার নিকট দৌড়িয়া আসিল উপদেশ গ্রহণের জন্য।

কারণ, ঐ সময়ে তাহার প্রথম কার্য হইল অবিলম্বে বুদ্ধগয়া গমন, এবং সেই মহাবৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া আপনমনে চিন্তায় মগ্ন হইয়া যাওয়া, “এ কি সত্যই সম্ভব, তিনি যে বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন, আমিও সেই বায়ুতে শ্বাস গ্রহণ করছি?- যে ভূমির উপর তিনি বিচরণ করেছিলেন, আমিও তার উপরেই বিচরণ করছি?”

তাহার জীবনের শেষভাগে- তাহার উনচল্লিশ বৎসরের জন্মদিনের প্রাতঃকালে তিনি অনুরূপভাবে বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হন। কাশী দর্শনান্তে এই যাত্রার শেষ হয়, এবং ইহাই তাহার জীবনের শেষ ভ্রমণ। তাহার ভারত পর্যটনের বৎসরগুলিতে কোন সময়ে তিনি বুদ্ধের ভস্মাবশেষ অস্থি স্পর্শ করিবার অনুমতি লাভ করেন- সম্ভবতঃ যে স্থানে ঐসকল অস্থি প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তাহারই সন্নিকটে।

ঐ সময় তিনি যে প্রবল ভক্তি ও নিঃসংশয়তার ভাবে বিশেষ অভিভূত হইয়াছিলেন, পরবর্তী কালে ঐ ঘটনার উল্লেখ করিতে গেলে তাহার কিছুটা প্রকাশ সর্বদাই দেখা যাইত। অবতারগণকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করা সম্বন্ধে একবার তাহাকে কেহ প্রশ্ন করিলে তিনি যে উত্তর দেন, তাহা খুবই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, ‘সত্য বলতে কি মহাশয়া, ন্যাজারেথবাসী ঈশার সময়ে আমি যদি জুডিয়ায় বাস করতাম, তাহলে চোখের জল দিয়ে নয়, হৃদয়ের শোণিতে আমি তার পা-দুখানি ধুয়ে দিতাম।”

তিনি কোন ধর্মাবলম্বী ঠিক না জানিয়া, একজন ভ্রমবশতঃ তাহাকে বৌদ্ধ বলায় তিনি বলিয়া উঠেন, “বৌদ্ধ! আমি বুদ্ধের দাসানুদাসের দাস!” বুদ্ধের প্রতি তাহার ভক্তি এরূপ প্রগাঢ় ছিল যে, বৌদ্ধমতে বিশ্বাসী হওয়াও যেন তাহার নিকট এক উচ্চ অবস্থায় উপনীত হওয়া বোধ হইত- যেন তিনি উহাও দাবি করিতে পারেন না।

বুদ্ধের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রামাণ্যই কেবল তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে নাই। আর একটি প্রধান কারণ এই যে, তাহার প্রত্যক্ষদৃষ্ট গুরুদেবের জীবনের সহিত আড়াই হাজার বৎসর পূর্বেকার এই সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাসের বহু পরিমাণে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। ভগবান বুদ্ধের জীবনে তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে; শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে তিনি দেখিয়াছিলেন ভগবান বুদ্ধকে।

একদিন বুদ্ধের দেহত্যাগের দৃশ্য বর্ণনা করিতে করিতে চকিতের ন্যায় তাহার মনে এই চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিল। তিনি বলিতে লাগিলেন- কিরূপে এক বৃক্ষতলে তাহার জন্য কম্বল বিছানো হইয়াছিল, এবং সেই আনন্দময় পুরুষ “সিংহের ন্যায় দক্ষিণ পার্শ্বে শয়ন করিয়া” মৃত্যু-প্রতীক্ষায় রত, এমন সময়ে সহসা এক ব্যক্তি তাহার নিকট দৌড়িয়া আসিল উপদেশ গ্রহণের জন্য।

একদিন তিনি বুদ্ধের উপদেশ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিলেন, “রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান- এই হলো পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চতত্ত্ব যা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, এবং পরস্পরের সঙ্গে সংমিশ্রিত। এরই নাম ‘মায়া। কোন একটি বিশেষ তরঙ্গ সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না, কারণ যা ছিল, এখন আর তা নেই।

শিষ্যগণ তাহাদের প্রভুর মৃত্যুশয্যার নিকট যেরূপে হউক শান্তিরক্ষা করিবার জন্য ঐ ব্যক্তির সেই সময়ে আগমন অনুচিত ভাবিয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিতেছিলেন, কিন্তু ভগবান দূর হইতে তাহাদের কথাবার্তা শুনিতে পাইয়া বলিলেন, “না, না! ফিরিয়ে দিও না! তথাগত[৪] সর্বদাই প্রস্তুত।”

তিনি কনুয়ের উপর ভর দিয়া একটু উঠিয়া তাহাকে উপদেশ দিলেন। চারবার এইরূপ ঘটিল; তখনই কেবল বুদ্ধ ভাবিলেন, এখন আমি নিশ্চিন্তচিত্তে মরতে পারি। তাহার পূর্বে নহে। স্বামীজী বলিতে লাগিলেন, “কিন্তু প্রথমে তিনি ক্রন্দন করার জন্য আনন্দকে তিরস্কার করেন।

বললেন, বুদ্ধ কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়, উহা এক উচ্চ অবস্থাবিশেষ এবং যে কেহ ঐ অবস্থা লাভ করতে পারে আর শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে তিনি কারও পূজা করতে নিষেধ করেন।”

অমর কাহিনী ক্রমে সমাপ্ত হইল। কিন্তু বর্ণনাকালে স্বামীজী যখন “কনুয়ের উপর ভর দিয়ে একটু উঠে তাকে উপদেশ দিলেন” এইখানে আসিয়া একটু চুপ করিলেন, এবং কথার পিঠে বলিলেন, “দেখ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনে এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি?”

– তখন শ্রোতার নিকট ঐ অংশটি সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হইয়াছিল। আমার মনে সেই ব্যক্তির কথা উদিত হইল, সেই আচার্যশ্রেষ্ঠের নিকট শিক্ষালাভ যাহার ভাগ্যে ছিল। একশত মাইল দূর হইতে তিনি আসিতেছিলেন, এবং যখন তিনি কাশীপুরে উপনীত হইলেন, তখন পরমহংসদেবের অন্তিমকাল উপস্থিত।

এক্ষেত্রেও শিষ্যগণ তাহার আগমনে বাধা দিতেন, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ আপনা হইতে বলিলেন, “ওকে আসতে দাও, আমি ওকে উপদেশ দেব।”

বৌদ্ধমতবাদের ঐতিহাসিক ও দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে স্বামীজী সর্বদা মনে মনে গভীরভাবে আলোচনা করিতেন। হঠাৎ ঐ প্রসঙ্গের উল্লেখ এবং আকস্মিক উক্তিসকল দ্বারা বোঝা যাইত যে, তাহার মনে ঐ সম্পর্কে চিন্তা সর্বদা বিদ্যমান।

একদিন তিনি বুদ্ধের উপদেশ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিলেন, “রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান- এই হলো পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চতত্ত্ব যা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, এবং পরস্পরের সঙ্গে সংমিশ্রিত। এরই নাম ‘মায়া। কোন একটি বিশেষ তরঙ্গ সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না, কারণ যা ছিল, এখন আর তা নেই।

(চলবে..,)

স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন : দ্বিতীয় কিস্তি>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………
১. উক্ত বৃহৎ মন্দিরের চারিদিকে খননকার্য ১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে ব্ৰহ্মদেশীয় সকার কর্তৃক প্রথম আরম্ভ হয়। ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সবকাব উহাব ভার গ্রহণ করেন, এবং ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে উহা শেষ।
২. যাহা বুদ্ধিবৃত্তির পারে অতীন্দ্রীয় রাজ্যে লইয়া যায়।
৩. এই দুইখানি পুস্তক তখন ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের দক্ষ সম্পাদকতায় এশিয়াটিক সোসাইটি ইতে প্রকাশিত হইতেছিল। সাধারণ পাঠকের সুবিধার জন্য গ্রন্থের মূল পালির পরিবর্তে সংস্কৃত অক্ষরে ছিল’- স্বামী সারদানন্দ
৪. তথাগত শব্দের আক্ষরিক অর্থ- যিনি লব্ধসত্য, অর্থাৎ তত্ত্ব সাক্ষাৎকার করিয়াছেন। স্বামীজী বুঝাইয়া বলিলেন, “এই শব্দ অনেকটা তোমাদের ত্রাণকর্তা(Messiah) শব্দের মতো।”
৫. শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দের ১৬ আগস্ট শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণগোপাল ঘোষের কাশীপুরস্থ উদ্যানবাটীতে মহাসমাধিলাভ করেন।
৬. বিনয় পিটক–প্রথমভাগ দ্রষ্টব্য।
৭. স্বামীজী এখানে সূত্তনিপাতের অন্তর্গত ধনিয়া সূত্তের Rhys Davids-কৃত পদ্যের অনুবাদের ভাবার্থ তাহার স্মৃতি হইতে আবৃত্তি করিতেছিলেন; Rhys Davids-এর আমেরিকার বক্তৃতাগুলি দ্রষ্টব্য।
৮. ‘উপালি পৃচ্ছা’ নামক গল্পটি প্রধান বৌদ্ধগ্রন্থে যে আকারে প্রকাশিত হয়, অধুনা তাহা লুপ্ত। কিন্তু ঐরূপ একটি রচনার অস্তিত্ব ‘বিনয় পিটক’ প্রভৃতি অন্যান্য বৌদ্ধগ্রন্থে উহার উল্লেখ দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায়।
৯. যদি আমরা ভাবি যে আমাদের দুষ্কৃতিসমূহের ফলভোগ আমাদের পরিবর্তে অপরে করিবে, তাহা হইলে আমাদের সৎকর্ম করিবার প্রবৃত্তি আরও দৃঢ় হয়! অপরের সম্পত্তি বা সন্তান-সন্ততি রক্ষার জন্য আমাদের যে দায়িত্ববোধ, তাহাও এই জাতীয়।

…………………..
অশেষ কৃতজ্ঞতা
স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি – ভগিনী নিবেদিতা। অনুবাদক-স্বামী মাধবানন্দ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরও পড়ুন-
বুদ্ধদেব
ভগবান্ বুদ্ধ
বুদ্ধদেব প্রসঙ্গ
ব্রহ্মবিহার
বুদ্ধের জীবন থেকে
স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন : প্রথম কিস্তি
স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন : দ্বিতীয় কিস্তি

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : এক
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : দুই
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : তিন
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : চার

……………….
আরও পড়ুন-
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি এক
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি দুই
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি তিন
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি চার

…………………
আরও পড়ুন-
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : এক
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : দুই
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে
ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী
হিন্দুধর্ম
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!