ভবঘুরেকথা
সাংখ্য-দর্শনের উৎস

সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি সপ্তম

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যখন প্রধানকে ছোটো করে পুরুষ, পরমাত্মা, দেব ও ঈশ্বরের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, যখন বলা হচ্ছে অদ্বিতীয় দেবতাই উর্ণনাভের ন্যায় আত্মস্বভাব প্রসূত প্রকৃতি দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদন করেছেন- তখন কি আমরা সে-কথাকে সাংখ্যের উপদেশ বলে গ্রহণ করবো, না, সাংখ্যের অচেতনকারণ-বাদকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে, চেতনকারণ-বাদকেই প্রতিষ্ঠা করবার আয়োজন বলে স্বীকার করতে বাধ্য হবো?

মনে রাখতে হবে, সাংখ্য-দর্শন মানে অব্যক্ত, মহৎ, প্রকৃতি, পুরুষ প্রভৃতি কয়েকটি দার্শনিক পরিভাষামাত্র নয়; তাই উপনিষদের মধ্যে ওই পরিভাষাগুলির পরিচয় পেলেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ খুঁজে পাওয়া গেলে বলা যায় না। তার বদলে, সাংখ্য একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক মতবাদ, যে-মতবাদটিকে খণ্ডন করবার জন্য বাদরায়ণ অতো রকমের আয়োজন করেছেন।

সে-মতবাদ অনুসারে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানই জগৎকারণ; পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন। এই কথাটি মনে রাখলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে যে, উপনিষদের মধ্যেই ওই সাংখ্যমতের বীজ খুঁজে পাওয়া সত্যিই যাচ্ছে না; তার বদলে সাংখ্যমত খণ্ডনেরই একটা প্রবল প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

অতএব, উপনিষদের এই সাক্ষ্যগুলি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সাংখ্যমত শুধুই যে উপনিষদ-বিরুদ্ধ তাই নয়, তুলনায় প্রাচীনতরও। উপনিষদ রচনার আগে থাকতেই এই মতটি নিশ্চয়ই এদেশে প্রচলিত ছিলো; তা না হলে উপনিষদকারেরা কী করে এই মতকে এ-ভাবে খণ্ডন করবার চেষ্টা করলেন?

কেননা, উপনিষদের চিন্তাধারা শুধুই ভাববাদী বা idealistic নয়, পুরুষপ্রধানও (পূঃ ১৫২)। অতএব, উপনিষদের চিন্তাধারার মধ্যে কালক্রমে সাংখ্য-মতের স্থান হওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই সঙ্কীর্ণ। এবং উপনিষদের মধ্যে সাংখ্য-মত স্বীকৃত হবার নিদর্শন হিসেবে অধ্যাপক গার্বে উপনিষদের যে-অংশগুলির উল্লেখ করছেন, সেগুলিকে স্পষ্টভাবে বিচার করলেও আমরা দেখতে পাই যে, আসলে সেখানে সাংখ্যমত গ্রহণ করবার পরিবর্তে সাংখ্যমত খণ্ডন করবার প্রচেষ্টাটাই প্রকট।

এদিক থেকে, শঙ্করাচার্য(৭৪০) যখন বলেন, উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সাংখ্যাদিমত খণ্ডনের একান্ত প্রয়োজন,- ‘বেদান্তবাক্যানি ব্যাচক্ষাণৈঃ সম্যগ্‌দর্শনপ্রতিপক্ষভূতানি সাংখ্যাদিদর্শনানি নিরাকরণীয়ানীতি’- তখন তিনি নিশ্চয়ই আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যারা বেদান্ত বা উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্যের বীজ অনুসন্ধান করেন তাঁদের তুলনায় সাংখ্য ও উপনিষদ উভয় মতবাদকেই অনেক সম্যকভাবে বোঝবার সহায়তা করেন।

অধ্যাপক রিচার্ড গার্বের কথায় ফিরে আসা যাক। তিনি যখন সিদ্ধান্ত করছেন যে, সাংখ্য আদিতে অ-বৈদিক মত ছিলো, তখন আমরা তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহজেই একমত হতে পারি। বেদান্ত-সূত্রকারের সাংখ্য-খণ্ডনই এর একমাত্র প্রমাণ নয়। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি পশুপালন-নির্ভর বৈদিক সমাজ পুরুষ-প্রধান ছিলো বলেই বৈদিক চিন্তাধারাতেও এই পুরুষপ্রাধান্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায়; অপরপক্ষে সাংখ্য-দর্শনের প্রধান বা

প্রকৃতি শুধুই অচেতনবস্তুবাচক বা material principle নয়, তাছাড়াও নারীবাচক বা female principle-ও। কিন্তু অধ্যাপক গার্বে সেইসঙ্গেই যখন বলেন, কালক্রমে এই সাংখ্য-দর্শনই উপনিষদাদির মধ্যে স্বীকৃত বা গৃহীত হয়েছিলো, তখন স্বভাবতই আমরা তার মন্তব্যটিকে মেনে নিতে অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করি।

কেননা, উপনিষদের চিন্তাধারা শুধুই ভাববাদী বা idealistic নয়, পুরুষপ্রধানও (পূঃ ১৫২)। অতএব, উপনিষদের চিন্তাধারার মধ্যে কালক্রমে সাংখ্য-মতের স্থান হওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই সঙ্কীর্ণ। এবং উপনিষদের মধ্যে সাংখ্য-মত স্বীকৃত হবার নিদর্শন হিসেবে অধ্যাপক গার্বে উপনিষদের যে-অংশগুলির উল্লেখ করছেন, সেগুলিকে স্পষ্টভাবে বিচার করলেও আমরা দেখতে পাই যে, আসলে সেখানে সাংখ্যমত গ্রহণ করবার পরিবর্তে সাংখ্যমত খণ্ডন করবার প্রচেষ্টাটাই প্রকট।

বেদান্ত ভাববাদী, সাংখ্য বস্তুবাদী- দুয়ের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ। উপরোক্ত উক্তির মধ্যে এই স্বীকৃতিটি অবশ্যই মূল্যবান। কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, আমরা দুয়ের মধ্যে উপনিষদের ভাববাদকেই প্রাচীনতর এবং সাংখ্যের বস্তুবাদকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া-মাত্র বলে স্বীকার করতে বাধ্য।

আমরা আরো বলতে চাই যে, অধ্যাপক গার্বের যুক্তি এখানে স্বপক্ষদোষদুষ্টও হয়েছে। কেননা, সাংখ্য যে আদিতে শুধু নিরীশ্বরবাদই নয়, বস্তুবাদও ছিলো- একথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। এবং একথা যদি ঠিক হয় তাহলে তাকে মানতে হবে যে, অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী উপনিষদের মধ্যেই কালক্রমে নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী সাংখ্য-দর্শনেরও স্থান হয়েছিলো।

আদিসাংখ্যকে যে বস্তুবাদী বলাই বাঞ্ছনীয়- একথা অধ্যাপক গার্বে কী ভাবে স্বীকার করছেন? বৌদ্ধদৰ্শনের আদিরূপটির সঙ্গে সাংখ্যের আদিরূপটির সাদৃশ্য দেখাবার উদ্দেশ্যে তিনি[৭৪১] বলছেন-

…it is a merit of Oldenberg to have emphatically pointed out the fact that primitive Buddhism does not yet know the often mentioned speculations on the nothingness of the world, but that, on the contrary, the idea of nothingness belongs to the later metaphysics of the Buddhists.

The world of objects is, therefore, considered to be real by Buddha as well as by Kapila (c.f. Sutra I, 79; VI, 52); and this world of objects comprehends also the psychic organs and states according to the systems of both.

As in Sankhya philosophy, even the highest internal processes, like thinking, volition, judging, etc., are mechanical functions of Matter, which are not to be ascribed to the Atman, but must be known to be anatman, so Buddha teaches, too, that… ‘sentiments, conceptions and cognition’ are anatta (= anatma).

সাংখ্য-মতে যদি চিন্তা, ইচ্ছা, বিচার প্রভৃতি মানসব্যাপারগুলিও অচেতনবস্তু বা matter-এরই যান্ত্রিক বিকাশমাত্র হয়,- যদি এগুলিও আত্মজনিত না হয়ে অনাত্মজনিতই হয়,- তাহলে বৌদ্ধ দর্শনের আদিরূপটির সঙ্গে তার সাদৃশ্য থাকুক আর নাই থাকুক, অন্তত উপনিষদের চিন্তার মধ্যে তার স্থান কষ্টকল্পিত হতে বাধ্য।

কেননা, উপনিষদ মূলতই ভাববাদী এবং এই ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের সংঘর্ষই দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক দ্বন্দ্ব[৭৪২]। এবং অধ্যাপক গার্বেও স্বীকার করেছেন যে, উপনিষদের চিন্তার সঙ্গে সাংখ্যের যে-বিরোধ, তা আসলে ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদেরই মূল বিরোধ। অধ্যাপক গার্বে[৭৪২] বলছেন,

“আমার মতে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে, উপনিষদের ব্রহ্মন্‌-আত্মন্‌মূলক যে ভাববাদী মতবাদ,- যে-মতবাদ বেদ থেকেই শুরু এবং উত্তরকালে যা বেদান্ত দর্শনের কেন্দ্র হয়েছে- সেই মতবাদটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতবাদের তুলনায় প্রাচীনতর। এই ভাববাদ সংহত-রূপে এবং সোৎসাহে প্রচারিত হতে শুরু হবার পর এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সাংখ্য-দর্শনের উদ্ভব হয়েছিলো”।

বেদান্ত ভাববাদী, সাংখ্য বস্তুবাদী- দুয়ের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ। উপরোক্ত উক্তির মধ্যে এই স্বীকৃতিটি অবশ্যই মূল্যবান। কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, আমরা দুয়ের মধ্যে উপনিষদের ভাববাদকেই প্রাচীনতর এবং সাংখ্যের বস্তুবাদকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া-মাত্র বলে স্বীকার করতে বাধ্য।

এই বস্তুবাদের দিক থেকে এখানে নতুন সমস্যাও ওঠে। বৈদান্তিক বা উপনিষদের চিন্তাধারা যতো চূড়ান্ত ভাববাদীই হোক না কেন, তারও একটা অতীত ছিলো এবং সেই অতীতটিকে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই লোকায়তর মতোই একরকম প্রাকৃত বস্তুবাদী ধ্যানধারণার ধ্বংসস্তুপের উপর বৈদান্তিক ভাববাদের আবির্ভাব ঘটেছে, যদিও সেই প্রাকৃত বস্তুবাদের সঙ্গে লোকায়তিক বস্তুবাদের মূল প্রভেদ হলো এ-বস্তুবাদ পুরুষ-প্রধান চেতনার অঙ্গ, তন্ত্র ও সাংখ্যের মতো নারীপ্রাধান্যের পরিচায়ক নয়।

বরং, আমাদের পক্ষে নিছক ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে যেটুকু সংগ্রহ করা সম্ভবপর, তার সাক্ষ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, আমরা আগেই দেখেছি, উপনিষদ-সাহিত্যের মধ্যে- এবং বিশেষ করে ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে- সাংখ্যমতের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রচেষ্টাটা স্পষ্ট; অপরপক্ষে সাংখ্যের কোনো গ্রন্থেই আমরা উপনিষদের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অভিযানের লক্ষণ দেখতে পাই না।

অবশ্যই, এ-কথা ঠিক যে, ষষ্টিতন্ত্র প্রভৃতি সাংখ্যের আদি গ্রন্থগুলি বিলুপ্ত হয়েছে এবং সাংখ্য-সূত্র ও এমন কি সাংখ্যকারিকাও অনেক পরের রচনা বলেই এগুলির মধ্যে সাংখ্যের আদিরূপটির পরিচয় নেই। সাংখ্যের আদিগ্রন্থ উদ্ধার করা সম্ভব হলে তার মধ্যে বৈদান্তিক ভাববাদের বিরুদ্ধে সচেতন অভিযানের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেতো কিনা সে-কথা কল্পনা করেও কোনো লাভ নেই।

হয়তো যেতো; কিন্তু তার থেকেই প্রমাণিত হতো না যে, উপনিষদের ভাববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সাংখ্য-দর্শনের সূত্রপাত হয়েছিলো। কেননা, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সাদৃশ্যের দিক থেকে এবং সাংখ্যকে তন্ত্রেরই দার্শনিক সংস্করণ হিসাবে চেনবার দিক থেকে, আমরা যে-কথা বোঝবার চেষ্টা করছি তা হলো সাংখ্য আগে না উপনিষদ আগে,- এই তর্কই অনেকাংশে ভ্রান্তিপ্রসূত।

আসলে বেদান্ত ও সাংখ্য- দুটি চিন্তাধারা বৈদিক ও অবৈদিক হটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচায়ক। এবং বৈদিক ও অবৈদিক এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্যকে আধুনিক বিদ্বানের অনেক সময় নিছক জাতিগত পার্থক্যের দিক থেকে বোঝবার চেষ্টা করে ভুল করেছেন; কেননা, এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে যে-পার্থক্য, তার সঙ্গে জাতিগত পার্থক্যের সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক, অন্তত নিছক জাতিগত পার্থক্য হিসেবে তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা যায় না।

আমরা ইতিপূর্বেই দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, তান্ত্রিক ও বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যে যে-মৌলিক পার্থক্য তার ব্যাখ্যা উৎপাদন-পদ্ধতির পার্থক্যের দিক থেকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর- পশুপালন-প্রধান জীবন বলেই বৈদিক সমাজ পুরুষ-প্রধান এবং বৈদিক সমাজের প্রতিফলন হিসেবে বৈদিক চিন্তাধারাও পুরুষ-প্রধান।

অপরপক্ষে কৃষি-নির্ভর মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিফলন হিসেবে, তান্ত্রিক চিন্তাধারা শক্তিপ্রধান বা মাতৃপ্রধান। তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সাদৃশ্য যদি সত্যিই মৌলিক হয় তাহলে বৈদান্তিক চিন্তাধারার সঙ্গে সাংখ্য-মতের বিরোধটিকেও এই দিক থেকেই বোঝবার অবকাশ থাকে নাকি?

অবশ্যই এখানে আর একটি প্রশ্ন উঠবে। সাংখ্যের প্রকৃতি বলতে শুধুমাত্র female principle নয়; material principle-ও। তাই নারীপ্রধান্য ও পুরুষ-প্রাধান্যমূলক প্রভেদ ছাড়াও সাংখ্য ও বেদান্তের মধ্যে বস্তুবাদ-বনাম-ভাববাদের দিক থেকে যে-তফাত- তার ব্যাখ্যা উপরোক্ত উক্তির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই বস্তুবাদের দিক থেকে এখানে নতুন সমস্যাও ওঠে। বৈদান্তিক বা উপনিষদের চিন্তাধারা যতো চূড়ান্ত ভাববাদীই হোক না কেন, তারও একটা অতীত ছিলো এবং সেই অতীতটিকে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই লোকায়তর মতোই একরকম প্রাকৃত বস্তুবাদী ধ্যানধারণার ধ্বংসস্তুপের উপর বৈদান্তিক ভাববাদের আবির্ভাব ঘটেছে, যদিও সেই প্রাকৃত বস্তুবাদের সঙ্গে লোকায়তিক বস্তুবাদের মূল প্রভেদ হলো এ-বস্তুবাদ পুরুষ-প্রধান চেতনার অঙ্গ, তন্ত্র ও সাংখ্যের মতো নারীপ্রাধান্যের পরিচায়ক নয়।

আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, এই সাদৃশ্যের মূল কারণ হলো উভয়েই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের- এবং অতএব প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার- পরিচায়ক- বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে তুলেছিলেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে তাদের ধ্যানধারণায় আবির্ভাব হয়েছিলো অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের।

বৈদিক ঐতিহ্য অতি দীর্ঘ; সংহিতা থেকে শুরু করে উপনিষদ পর্যস্ত সহস্রাধিক বছর ধরে রচিত হয়েছে তার সাহিত্যিক নিদর্শন। এবং এই সহস্রাধিক বছরের সাহিত্যিক নিদর্শন হুবহু একই ধ্যানধারণার পরিচায়ক নয়; এ-সাহিত্যের প্রাচীনতর অংশে ভাববাদের পরিচয় নেই এবং সেদিক থেকে পুরুষপ্রধান চিন্তার পরিচায়ক হলেও লোকায়তর মতোই তা অফুট বস্তুবাদই।

সেই অস্ফূট ও আদিম বস্তুবাদের ধ্বংসস্তুপের উপরই কালক্রমে উপনিষদের ভাববাদের আবির্ভাব হয়েছে। অতএব এদিক থেকে বলা যায়, উত্তরকালে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের যে-বস্তুবাদী চিন্তাকে অমন ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছিলেন, সেই বস্তুবাদই তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে- বৈদিক ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে- সত্যের মর্যাদা পেয়েছিলো।

কামাচার অর্থে বামাচার প্রসঙ্গেও আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ১০৩- ১১২) এই বৈশিষ্ট্যটিই লক্ষ্য করেছি। আমরা দেখেছি, এই কামাচার বা বামাচার মানবোন্নতির প্রাচীন পর্যায়ের জাদুবিশ্বাসেরই পরিচায়ক; তার মূল কথা হলো প্রাকৃতিক উৎপাদনকে মানবীয় প্রজননের অনুকরণেই আয়ত্তে আনবার কল্পনা।

বৈদিক ঐতিহে সেই জাদুবিশ্বাসের স্মারক থেকেই প্রমাণিত হয় এ-ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতার মানবোন্নতির সেই প্রাচীন পর্যায়েই জীবন-যাপন করতেন, যদিও তাদের অর্থনীতি মূলতই বা প্রধানতই পশুপালন-নির্ভর ছিলো বলেই, এ-জাদুবিশ্বাস শুধুই পুরুষপ্রধান নয়, লোকায়তিক বামাচারের তুলনায় অনেকাংশেই গৌণ।

কারণ, ওই লোকায়তিক সংস্কৃতি মূলতই কৃষিনির্ভর, এবং কৃষিকাজের তুলনায় পশুপালনের ক্ষেত্রে জাদুবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কম (পৃ. ৩৪২- ৩৪৭)।

তাহলে, কালক্রমে লোকায়তর সঙ্গে বৈদান্তিক ধ্যানধারণার যতো প্রভেদই দেখা যাক না কেন, এই বৈদিক ঐতিহ্যেরও যেটা প্রাচীনতম পর্যায় তার সঙ্গে লোকায়তিক চিন্তার সাদৃশ্য দেখা যায়।

আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, এই সাদৃশ্যের মূল কারণ হলো উভয়েই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের- এবং অতএব প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার- পরিচায়ক- বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে তুলেছিলেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে তাদের ধ্যানধারণায় আবির্ভাব হয়েছিলো অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের।

কিন্তু সে-ভাববাদের নিচে, প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি বহন করে একটা অস্ফুট বস্তুবাদের ইতিহাস চাপা পড়ে আছে, এবং প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণার স্মৃতি হিসেবেই তার সঙ্গে লোকায়তিক চিন্তাধারার ওই সাদৃশ্য। বৈদিক সাহিত্যে ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি হিসেবেই গণ ও ব্রাত্যের কীরকম গৌরবময় অতীতের পরিচয় পাওয়া যায় তার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বেই করেছি (পৃ: ২২৯- ২৩২)।

ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ও তার প্রাক্ অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার আলোচনায় পরে প্রত্যাবর্তন করা যাবে। তার আগে লোকায়ত, সাংখ্য ও তন্ত্রের কথাটা আরো ভালো করে দেখা যাক।

(সমাপ্ত)

<<সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি ষষ্ঠ ।। সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি প্রথম>>

……………………….
আরও পড়ুন-
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি প্রথম
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি দ্বিতীয়
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি তৃতীয়
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি চতুর্থ
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি পঞ্চম
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি ষষ্ঠ
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি সপ্তম

………………….
লোকায়ত দর্শন (২ম খণ্ড- বস্তুবাদ)- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………..
৬৯৪. সাংখ্যকারিকা ২১, গৌড়পাদভাষ্য।
৬৯৫. বিশ্বকোষ ৭:৫০৭।
৬৯৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী- বৌদ্ধধর্ম ৩৭ ৷
৬৯৭. H. Zimmer PI 282–সাংখ্যকারিকাকে লেখক আরো পরে (পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি ) রচিত বলে বিবেচনা করেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও (বৌদ্ধধর্ম ৩৮) একই মত পোষণ করেন।
৬৯৮. সাংখ্যকারিকা ৭০।
৬৯৯. ঐ ৭১।
৭০০. শঙ্করাচার্য- ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.৪.৯।
৭০১. S. N. Dasgupta HIP 1:213.
৭০২. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade HIP 2:412.
৭০৩. Ibid. 2:413f.
৭০৪. H. H. Wilson SK 160.
৭০৫. P. B. Chakravarti ODSST দ্রষ্টব্য I
৭০৬. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- রচনাবলী (সাহিত্য-সংসদ ) ২:২২২।
৭০৭. মণীন্দ্রমোহন বস্তু- সহজিয়া সাহিত্য ৫২ ৷
৭০৮. উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য- ভারতদর্শনসার ১৪৯-৫০।
৭০৯. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:428.
৭১০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.২.৭। নিয়োস্থত তৰ্জমা কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১৪০।
৭১১. ERE 11:191.
৭১২. P. R. T. Gurdon K xix-xx.
৭১৩. G. Thomson SAGS 153.
৭১৪. K. Marx. & F. Engels C 210.
৭১৫. ERE 6:706.
৭১৬. R. Garbe SPB Preface ix.
৭১৭. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী- বৌদ্ধধর্ম ৩৭।
৭১৮. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:415.
৭১৯. S.N. Dasgupta op. cit. 1:213.
৭২০. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:418f.
৭২১. Ibid. 2:420f.
৭২২. Ibid. 2:426f.
৭২৩. E. H. Johnston Es.
৭২৪. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:416.
৭২৫. ব্রহ্মসূত্রভাষ ২. ১, ১২। তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:৪৭।
৭২৬. ঐ ২, ১, ১। তৰ্জমা- কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২৮।
৭২৭. ঐ। কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১০।
৭২৮. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xx-xxi.
৭২৯. H. Zimmer PI 281.
৭৩০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১. ৪.১। তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ১:৪৯৭।
৭৩১. P. B. Chakravarti ODSST 4.
৭৩২. Ibid.
৭৩৩. তর্জমা- কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২:১২৩-৪।
৭৩৪. তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১২৮।
৭৩৫. কালীবর বেদান্তবাগীশ- সাংখ্য-দর্শনম্ ২২১-২।
৭৩৬. R. Garbe SPB Preface দ্রষ্টব্য।
৭৩৭. S. N. Dasguta op. cit. 1:213.
৭৩৮. R. Hume TPU.
৭৩৯. বরং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি (পৃ. ৫৩৬ ), গীতা-বর্ণিত অসুরমতের সঙ্গেই সাংখ্যের আদিরূপের সংযোগ অনুমান করা যায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মতটিই যদি আদি-অকৃত্রিম সাংখ্য হতো তাহলে অবশ্যই বাদরায়ণ সাংখ্য-খণ্ডনের জন্য অতো আয়োজন করতেন না।
৭৪০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২. ১. ২.।
৭৪১. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xii.
৭৪২. F. Engels LF 19.
৭৪৩. R. Garbe op. cit. Preface xix.

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!