ষড়রিপুর পরিচয় ও নিয়ন্ত্রণ-কৌশল
-রব নেওয়াজ আলগওহার
সংস্কৃত ‘ষট্’ ধাতু থেকে ষড় বা ছয়। ‘রিপু’ শব্দের অর্থ শত্রু। ষড়রিপু শব্দটি দিয়ে ছয়টি শত্রুকে বোঝানো হয়। এরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে অবস্থান করে। ইন্দ্রিয়দ্বার দিয়ে এরা মানবসত্তায় প্রবেশ করে। মানবিক গুণ বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
মানুষের নৈতিকতাকে কলুষিত করে। তাই অতীন্দ্রিয় সাধকগণ এদের চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণের কৌশল বাতলে দিয়েছেন। এরা যথাক্রমে-
১. কাম।
২. ক্রোধ।
৩. লোভ।
৪. মোহ।
৫. মদ।
৬. মাৎসর্য।
রিপুগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়-
১. কাম:
কামনা বা লিপ্সা যা যৌনবাসনা থেকে বিকশিত হয়। প্রত্যেক জীবের মাঝেই এটির অস্তিত্ব রয়েছে। এর অনিয়ন্ত্রিত প্রভাবে মানুষ যৌন অনাচারে লিপ্ত হয়। সমাজের আইন ভঙ্গ করে বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে। যেটি মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর অতিব্যবহার বা বিকৃত-ব্যবহারে মানুষ যৌনরোগে আক্রান্ত হয়। মানুষকে অমানুষে পরিণত করতে এর জুড়ি নেই।
২. ক্রোধ:
এটির প্রতিশব্দ হল রাগ। রাগ থেকে বাকবিতণ্ডা, ঝগড়া, মারামারি, যুদ্ধ প্রভৃতি সংঘটিত হয়ে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অশান্তির সৃষ্টি করে।
৩. লোভ:
অন্যের জিনিস বা সম্পদকে অন্যায়ভাবে নিজের অধিকারে নিয়ে আসার অভিসন্ধিকে লোভ বলা হয়। এর প্রভাবে চুরি, ডাকাতি, ভূমিদখল প্রভৃতি অন্যায় সংঘটিত হয়। এটিও মানবিকতার বিপর্যয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
৪. মোহ:
‘মোহ’ শব্দটি আসক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়। মাদকের নেশা থেকে শুরু করে সম্পদ, নারী প্রভৃতির প্রতি নেশার আসক্তিও মোহের আওতাভুক্ত। মনুষ্যত্বকে চুরমার করে দিতে এর ভূমিকাও কম নয়।
৫. মদ:
হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা মদ শব্দের সমার্থক। এগুলিও সমাজ, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে প্রসিদ্ধ।
৬. মাৎসর্য্য:
পরশ্রীকাতরতাকে মাৎসর্য্য শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। পরশ্রীকাতরতার সীমা যখন অতিক্রান্ত হয়, মানুষ তখন অন্যের সৌন্দর্য্য, সুবিধা, উন্নতিকে বিভিন্ন কৌশলে নষ্ট করে দিতে বাধ্য হয়।
উক্ত রিপুগুলোকে ধ্বংস বা নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। কারণ এগুলি সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিশে আছে। তবে বিখ্যাত সাধকদের দ্বারা তা সম্ভব হয়েছে। সাধারণের জন্য এগুলি ধ্বংস করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কিছু কৌশল রয়েছে।
অন্তত এদের লাগাম টেনে ধরতে পারলে একজন ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার কিছু উপায় নিম্নরূপ-
১. সালাত:
সালাত হলো ষড়রিপু বশে আনার সবচেয়ে ভালো উপায়। তবে তা হতে হবে কোরআন নির্দেশিত কায়েমি বা দায়েমি সালাত। এটিকে সার্বক্ষণিক সালাতও বলা হয়। সূফীসাধকগণ এই সালাতের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে থাকেন। সেজন্যে একজন কামেল মোর্শেদের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
২. সাওম:
সাওম বা রোজা রাখলে ষড়রিপুর পতন হয়। তবে মনে রাখতে হবে কেবল উপোস করলেই রোজা হয় না। আত্মসংযম বা সকল প্রকার পাপাচার থেকে বিরত থেকে আমিত্বকে বা নাফসকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াকে রোজা বা সাওম বলে।
৩. জিকির:
জিকির প্রধানত চার প্রকার। যথা: জিকিরে জাহির, জিকিরে বাতেন, জিকেরে ক্বালব ও জিকিরে সুলতানি। জিকিরে জাহির ও জিকিরে বাতেন নিজে নিজে করা সম্ভব। তবে জিকিরে ক্বালব অর্জনের জন্য মোর্শেদের সাহায্য নিতে হয়।
জিকিরে সুলতানি সাধারণের জন্য নয়। এটি অলিগণ করে থাকেন। ষড়রিপুর নিয়ন্ত্রণে জিকির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
৪. ধ্যান বা মোরাক্কাবা:
মোরাক্কাবা মোর্শেদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ, এটি অতীন্দ্রিয় ধ্যানবিশেষ। এর কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। মহানবী (স) প্রায় পনেরো বছর হেরাগুহায় মোরাক্কাবার পর নবুয়তপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
৬. যোগ:
এটিও ধ্যান বা মেডিটেশন। ক্রিয়াযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, বিভিন্ন প্রকারের যোগ রয়েছে। প্রাণায়াম বা দমসাধনা নামে পরিচিত এক ধরণের যোগ রয়েছে যা ষড়রিপু নিয়ন্ত্রণে আশাতীত ফল দিয়ে থাকে। ঋষি, যোগী এবং অন্যান্য সাধুগণ প্রাণায়াম বা দমসাধনা করে থাকেন। ষড়রিপুর দমন পূর্বক আত্মজ্ঞান লাভের এটি একটি উত্তম পন্থা।
(সমাপ্ত)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
পড়ুন লেখকের অন্যান্য লেখা-
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭
ষড়রিপুর পরিচয় ও নিয়ন্ত্রণ-কৌশল
মনের স্তরবিন্যাশ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন