ভবঘুরেকথা

সতীমা কে?

সরস্বতী আবার ‘সতীমা’ হল কি করে? সতী শব্দের অর্থ কি?

সরস্বতী একজন ব্যক্তি বা মানুষের নাম, আর সতীমা হচ্ছে উপাধি বিশিষ্ট নাম। কোন মানুষ যদি তার অতিমানবীয় গুণাবলী দ্বারা অসংখ্য পাপী, তাপী, অবহেলিত মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য আত্মনিবেদন করে বা তাঁর কর্মময় জীবন দুঃখী, তাপী, অবহেলিত মানুষের জন্য নিজের আত্মসুখ সমৃদ্ধির চিন্তা উপেক্ষা করে।

সম্পূর্ণরূপে নিজেকে মানবতার সেবায় উৎসর্গ করে এবং তার উদ্দেশ্য সাধনের পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন উক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন উপাধিতে অলংকৃত হয়ে মনের অজান্তেই অগণিত মানুষের হৃদয় আসনে স্থান করে নেয়, পৃথিবীতে এরূপ ঘটনা বিরল নয়।

এ পৃথিবীতে অতীতে যত মানব সন্তান ছিল তাদের সকলের মা ছিল এবং বর্তমানে যত মানব সন্তান আছে তাদের সকলের মা ছিল বা আছে, যুগে যুগে যে সব মহাত্মা, মহামানবগণ অবতার রূপে এজগতে এসেছেন এবং তাদেরকে যে সব মায়েরা গর্ভে ধারণ করেছে তারা কি সতী নয়?

যেমন- স্বামীজি, নেতাজী আরো অনেকে, ঐসব মহামানবগণের পিতা মাতার রাখা নাম ছিল, এরা কোনদিন সভা ডেকে সভামঞ্চে দাড়িয়ে নিজের উপাধি বিশিষ্ট নাম প্রচার করেননি। দুঃখী, পীড়িত, অবহেলিত মানব সকল ঐসব মহামানবের অতিমানবীয় গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে তাদের সু-কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ মনের অজান্তেই বিভন্ন উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ঐ সব মহাত্মা মহামানবগণ মানুষের মনের মনি কোঠায় দেবতার মত স্থান করে নেয়।

মহামানব মহামানবী হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না, ইহা সাধনার ফল, অর্থ সম্পদ, উচ্চশিক্ষা, বংশগৌরব এর মাপ কাঠি নয়, মনুষ্যত্ব ও আত্মত্যাগ-ই এর মাপকাঠি। তর্ক দ্বারা এর বিচার করা যায় না, ‘সতীমা’ ঐরূপ একজন উপাধি বিশিষ্ট, তাই গােবিন্দ ঘােষের কন্যা সরস্বতী-ই পরবর্তীকালে ‘সতীমা’ নামে খ্যাত হন। সরস্বতী’র প্রথম অক্ষর স’ এবং শেষ অক্ষর ‘তী’ = সতী (সতীমা) নাম।

কেহ কেহ বলেন যিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করেছেন, তিনি আবার সতী হন কি করে? এ জাতিয় প্রশ্ন মূর্খতার পরিচায়ক, যে নারী গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি তিনি মা হতে পারেন না কারণ মা শব্দের অর্থ-ই তাে সন্তানের জননী।

এ পৃথিবীতে অতীতে যত মানব সন্তান ছিল তাদের সকলের মা ছিল এবং বর্তমানে যত মানব সন্তান আছে তাদের সকলের মা ছিল বা আছে, যুগে যুগে যে সব মহাত্মা, মহামানবগণ অবতার রূপে এজগতে এসেছেন এবং তাদেরকে যে সব মায়েরা গর্ভে ধারণ করেছে তারা কি সতী নয়?

আমার মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিল বলেই তাে আজ আমি সুন্দর এই পৃথিবীতে বিচরণ করছি, তাহলে কি বলবাে আমার মা অসতী? নিশ্চয়, ‘তা’ বলব না কারণ- মা শব্দ অতি পবিত্র।

‘সতী’ শব্দের অর্থ-

যে নারী পতির অনুগত- তিনিই সতী। যে নারী অতিশয় সৎ- তিনিই সতী। যিনি অতিশয় সহ্য, ধৈর্য্য ও সহনশীলতা গুণের অধিকারিণী তিনিই সতী। যিনি সত্যকে ধারণ করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ ও পরমসত্য জগৎকর্তার কৃপা লাভ করে পরম সত্যে লীন হয়েছেন তিনি-ই সতী।

যিনি জগতের সকল সন্তান নিজের সম্ভান মনে করে মাতৃস্লেহ, দিয়ে সন্তানের ত্রিতাপ জ্বালা (অধিদৈবিক, আদিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপ জ্বালা) প্রশমিত করতে পারেন তিনি-ই সতীমা।

বাস্তবিক-ই সতীমা সৎ, সত্য, নিষ্ঠা, সহনশীলতা, মাতৃস্নেহ, বাকসিদ্ধা ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন, তাই তিনি সতীমা। সতীমা যখন এই ধরাধামে ছিলেন তখন তাঁর মাতৃস্নেহ দিয়ে অগণিত দুঃখী তাপী মানুষকে সন্তান জ্ঞানে ভালবাসতেন, অগণিত মানব সন্তানগণও মাতৃ জ্ঞানে সতীমাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন।

সকল মানুষই যে এক-ই ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং সকল ধর্ম-ই সত্য, ধর্মের প্রকৃত এই নীতি-আদর্শকে উপেক্ষা করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপােষকতায় ভারতবর্ষে ইসলামধর্ম প্রচার শুরু হয়।

উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ, ধনী-গরীব, অস্পৃশ্য পতিত, সতীমার কাছে ছিল সবাই সমান, সতীমার অতীমানবীয় গুণাবলী ও ঐশ্বরিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে অগণিত মানুষ সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে, রােগে-শােকে মায়ের কাছে এসেছে এবং মায়ের আশীর্বাদে রােগে শােকে, আপদে-বিপদে মুক্তি পেয়েছে।

সতীমার তিরােধানের শতশত বৎসর পরে আজও এ জাতীয় মনস্কামনা পূরণের আশায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মহাতীর্থ নিত্যধাম ঘােষপাড়ায় সতীমায়ের সমাধিতে উপস্থিত হয়ে মনের দুঃখ-বেদনা, আশা-বাসনা, মায়ের চরণে নিবেদন করে।

সতীমার প্রতি, অগাধ ভক্তি বিশ্বাস থাকার ফলে আজও মানুষের মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছে এবং মায়ের জয়গানে চারিদিক মুখরিত হচ্ছে। কর্তাভজা ধর্মের অগণিত ভক্ত যে যেখানে যে অবস্থায় বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সতীমাকে স্মরণ করে মানসিক করে এবং মনােবাসনা পূর্ণ হলে বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সতীমায়ের জয়গান করে।

সতীমার সমকালীন সময়ে বাংলার সার্বিক অবস্থা-

বাংলা ১১৪১ সালে ‘সতীমা’র আবির্ভাব। তখনকার দিনে সনাতনধর্ম তথা বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল এক অন্ধকারময় যুগ। তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ইং ১২০৬ সাল (মােহাম্মদ ঘােরী) থেকে ১৭৫৭ সাল নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল মুসলমানদের শাসনাধীন।

সকল মানুষই যে এক-ই ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং সকল ধর্ম-ই সত্য, ধর্মের প্রকৃত এই নীতি-আদর্শকে উপেক্ষা করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপােষকতায় ভারতবর্ষে ইসলামধর্ম প্রচার শুরু হয়।

কারণ এগুলি ছিল তাদের আধিপত্যবাদ ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান পথ। শূদ্ররা ‘ঈশ্বরের পা’ থেকে জন্মেছে, আর ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের মুখ থেকে জন্মেছে, ব্রাহ্মণ জাতির শ্রেষ্ঠ, তাই ব্রাহ্মণরা বংশপরম্পরায় অন্যান্য সকল জাতির কাছে পুঁজনীয়, আর শূদ্ররা বংশপরম্পরায় ব্রাহ্মণসহ সকল জাতির সেবার যােগ্য, সেবা করাই এদের ধর্ম, এসব অগ্রহণ যােগ্য আধিপত্যবাদী শাস্ত্রগ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।

হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথার কারণে অবহেলতি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ভারতবর্ষে বিপুল পরিমাণে ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষ তার প্রমাণ। ইং ১২০০ সালের পূর্বে ভারতবর্ষে মুসলমান ছিল না। হিন্দুর সমাজ ব্যবস্থায় জাতিভেদ প্রথার কারণে ভারতবর্ষে আজ এত মুসলমান জনগােষ্ঠী।

ইং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পতনের পর থেকে শুরু হয় ভারতবর্ষে বৃটিশ খৃষ্টানদের শাসন কাল, যােগ হয় নৃতন মাত্রা। বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু, মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, মূর্খতা ও হিন্দু সমাজে জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা এ সব দুর্বলতার সুযােগ বুঝে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খৃষ্টান মিশনারীরা অর্থের লােভ দেখিয়ে।

বিদ্যাশিক্ষার সুযােগ করে দিয়ে, চাকুরীর লােভ দেখিয়ে এবং হিন্দুদের মূর্তিপূজা, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে থাকে। ভারতবর্ষে আজ বিপুল পরিমাণে খৃষ্টান জনগােষ্ঠী তার প্রমাণ।

ইং ১৭৫৭ সালের আগে ভারতবর্ষে কোন খৃষ্টান ছিল না। ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা মুসলমান ও খৃষ্টানদের হাতে চলে যাওয়ায় হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা সম্ভব হয়েছিল, এই ছিল তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা। তৎকালীন সময়ে হিন্দুর সামাজিক অবস্থা- খৃষ্টান মিশনারীরা যখন হিন্দু সমাজের জাতিভেদ, অশিক্ষিত, দারিদ্রতা ও বিভিন্ন প্রকার দুর্বলতার সুযােগ বুঝে এদের কে ধর্মান্তরিত করার কাজে ব্যস্ত।

তখনও স্বার্থান্বেষী অকাল কুষ্মাণ্ড ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের হিন্দু মূর্খরা আভিজাত্য ও বংশগৌরবে মাে হাছন্ন হয়ে, প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থের দোহাই দিয়ে (যা তাদের পূর্ব পুরুষদের দ্বারা রচিত) হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা, মূর্তিপূজা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা বজায় রাখার জন্য স্বচেষ্ট ছিলেন।

কারণ এগুলি ছিল তাদের আধিপত্যবাদ ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান পথ। শূদ্ররা ‘ঈশ্বরের পা’ থেকে জন্মেছে, আর ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের মুখ থেকে জন্মেছে, ব্রাহ্মণ জাতির শ্রেষ্ঠ, তাই ব্রাহ্মণরা বংশপরম্পরায় অন্যান্য সকল জাতির কাছে পুঁজনীয়, আর শূদ্ররা বংশপরম্পরায় ব্রাহ্মণসহ সকল জাতির সেবার যােগ্য, সেবা করাই এদের ধর্ম, এসব অগ্রহণ যােগ্য আধিপত্যবাদী শাস্ত্রগ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।

সমাজের বৃহৎ অংশকে বিদ্যাশিক্ষা, ধর্মীয় দীক্ষা-শিক্ষা এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বাইরে রেখে তাদেরকে নিগ্রহ করা হত। এমন কি অস্পৃশ্য নিচুজাতি ভেবে শূদ্রদের স্পর্শ করে ব্রাহ্মণরা ঘরে যেত না।

শূদ্র কারা?>>

……………..
‘সতীমা ও সত্যদর্শন’ বই থেকে সংগৃহীত

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা ধর্মের ইতিহাস
ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাব
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তদের বিশ্বাস
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষা গ্রহণ
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দশ আজ্ঞা
সতীমা কে?
শূদ্র কারা?
ঘোষপাড়ার ডালিম তলা ও হিমসাগরের মাহাত্ম্য
কর্তাভজার বাইশ ফকির
আউলচাঁদের তিরােধান
দুলালচাঁদ
সতীমায়ের উপদেশ বাণী
ঘোষপাড়ার রথযাত্রা উৎসব
সতীমার তিরােধান
কর্তাভজা ধর্মের মূলস্তম্ভ

ত্রিশ ধারা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!