ভবঘুরেকথা
সতী মাতা রামশরণ কর্তভজা

সতীমায়ের উপদেশ বাণী

অগ্রদ্বীপের মেলার ভিন্ন ভিন্ন সন্ন্যাসীর ভিন্ন ভিন্ন দিকনির্দেশনায় বিভ্রান্ত না হয়ে ‘অমনি সেই গুণমনি আপনি করলেন স্মরণ অর্থাৎ সর্বগুণে গুণান্বিত সতীমাকে বললেন মা অগ্রদ্বীপের সন্ন্যাসীরা ঈশ্বর উপাসনা তত্ত্ব বিষয়ে যা বলেছে ওই পথ-ই কি সর্বোত্তম?

পুত্র দুলালচাঁদের মুখে সকল কথা শুনে সতীমা বললেন সন্ন্যাসীরা যা বলেছে তা সম্পূর্ণ ঠিক বলেনি আবার বে-ঠিকও বলেনি, এ কথা শুনে দুলালচাঁদ বললেন একই বিষয় কিন্তু ঠিকও নয় আবার বে-ঠিকও নয় এ কেমন কথা আমাকে বুঝিয়ে বল মা।

সাধনার স্তরভেদ-

সতীমা বললেন- স্থূল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধি, এই চার অবস্থা। এই চার অবস্থার মধ্যে মন যে অবস্থায় অবস্থান করে, তার জ্ঞান বুদ্ধি ও ধারণ শক্তি তদ্রূপ হয়। স্থূল- মানব শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে যেকোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন না করা পর্যন্ত তার যে জ্ঞান থাকে তার নাম স্থূল অবস্থা। সাধনা দ্বারা মানুষ ক্রমে ক্রমে সিদ্ধ অবস্থায় পৌঁছাতে পারে।

যেমন সামাজিক জীবনে একটি মানব শিশু জন্মগ্রহণ করার পর যতদিন তার জীবন ও জীবিকার বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান না থাকে ততদিন পর্যন্ত মনের যে অবস্থা তার নাম স্থূলজ্ঞান বা স্থূল অবস্থা।

তারপর মনে যখন জীবন ও জীবিকার বিষয়ে কিছু একটা করতে হবে এ রূপ সাধারণ জ্ঞানের উদয় হয় এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য কর্মক্ষেত্রানুসন্ধান করতে থাকে তখন মন যে অবস্থা প্রাপ্ত হয় তার নাম প্রবর্ত্ত।

তারপর ভবিষ্যত পরিকল্পনা মত জীবন জীবিকার জন্য কর্ম ক্ষেত্রে, দৃঢ় সংকল্প ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে কর্মের সফলতার জন্য যখন আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে তখন মন যে অবস্থা প্রাপ্ত হয় তার নাম সাধক।

শ্রমজীবি পেশাজীবি, চাকুরীজীবি সমাজ সেবা যে কর্ম-ই হােক না কেন সেই কর্মে পরীক্ষিত ভাবে সে যদি সফল হয় এবং সামাজিক ভাবে অথবা রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি পেয়ে তার কর্মগুণ মানুষের মাঝে প্রসংশিত হয় তখন মনের যে অবস্থা তার নাম সিদ্ধি।

তেমনি ঈশ্বরের উপাসনা ও আধ্যাত্মিক জগতেও একজন মানুষ যতদিন মনে করে মানুষের জীবন শুধু মাত্র সুখ-দুঃখ, ভােগ বিলাস ও জন্ম-মৃত্যুর মাঝেই সীমাবদ্ধ ততদিন মনের যে অবস্থা থাকে তার নাম স্থূলজ্ঞান বা স্থূল অবস্থা। আর যখন আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? শেষে কোথায় যাব?

মানব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? এ বিষয়ে জানা শুনার জন্য মন উদগ্রীব হয় তখন মনের যে ভক্তভাব তার নাম প্রবর্ত্ত। তারপর ভক্তমনা মানুষ যখন নিজেকে চিনতে পারে এবং মানব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দূঢ় সংকল্প, অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে কঠোর সাধনা করতে থাকে তখন ভক্ত মনের যে অবস্থা তার নাম সাধক।

আর সাধক যখন সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে বিশ্বস্রষ্টা ও বৈচিত্রময় এজগৎ সম্মন্ধে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং ঈশ্বর প্রেমের প্রেমিক হয়ে সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করে, তখন সাধকের মনের যে অবস্থা তার নাম সিদ্ধি।

তবে একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারে না এবং তাতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যায় না, তাই তুমি তােমার স্ব-ধর্ম পালন কর, একমাত্র স্ব-ধর্ম পালনের মাধ্যমে জীবনের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানাে সম্ভব। স্ব-ধর্ম অর্জিত না হলে জপ-তপ-সাধন-ভজন পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞান গড়িমা সবই নিষ্ফল।

স্থল অবস্থার জ্ঞান ও সিদ্ধি অবস্থার জ্ঞান এক নয়, একজন অজ্ঞ ব্যক্তি সে স্ব-চক্ষে দেখে সূর্য প্রতিদিন ভােরে পূর্বদিক থেকে উঠে সন্ধ্যায় পশ্চিম দিকে ডুবে যায় এ কথা তার কাছে যেমন সত্য, একজন বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তি জানে সূর্য কখনও ডুবে যায় না, পৃথিবীর কোন না কোন স্থানে দৃশ্যমান থাকে এ কথাও তেমনি সত্য।

পাত্র অনুসারে উভয়ের কথায় সত্য পার্থক্য শুধু জ্ঞানের, জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি না পেলে বৈচিত্রময় এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্মন্ধে কিছুই জানা যায় না। তাই সতীমা বললেন এজগৎ যেমন বৈচিত্রময় তেমনি ঈশ্বরের মহিমাও বৈচিত্রময়, ঈশ্বর ও জগৎ সম্মন্ধে যে যতটুকু শুনেছে, যে যতটুকু জেনেছে, যে যতটুকু বুঝেছে, সে তাই তাে বলবে। ঈশ্বরের মহিমা যেমন অনন্ত তার উপাসনা পথও অনন্ত, তাই যার উপাসনাতত্ব তার কাছে ঠিক, তাই বলে সকলের উপাসনাতত্ত্ব একই হবে একথা ঠিক নয়।

এ জন্য-ই বলেছি অগ্রদ্বীপের সাধু-সন্ন্যাসীরা যা বলেছে তা ঠিকও বলেনি আবার বে-ঠিকও বলেনি। তবে সিদ্ধি অবস্থায়ও মনে আমিত্ব বোধ বা অহংকার থাকে আর সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হলেই আত্মসুখ ইচ্ছা ত্যাগ করা যায় না কারণ সিদ্ধি অবস্থায় সাধারণ মানুষ কর্তৃক শ্রদ্ধেয়, পূঁজনীয় ও প্রসংশিত হওয়ায়।

আমি সাধারণ মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ট, মনে এই আমিত্ব বা অহংকার জন্মে, আর রিপু-ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হয়ে সংসারী মানুষ যেমন সব সময় শারীরিক, মানষিক ও বৈষয়িক বিষয়ে নিজে সুখী হতে চায়, তেমনি সংসার ত্যাগি সন্ন্যাসীরা ইহজগতের সুখ ত্যাগ করলেও পরজগতে সুখী হব এই কামনা নিয়ে সাধন-ভজন করতে করতে দিন অতিবাহিত করে।

তাই ভােগী-ই হােক আর ত্যাগী-ই হােক, কামনা-বাসনা মূলক সাধন-ভজন দার্শনিকের দৃষ্টিতে উভয়েই আত্মসুখী, এই উভয় প্রকার আত্মসুখত্যাগ-ই কর্তাভজা ধর্মের মূল আদর্শ। সাধক তার সাধনালদ্ধ জ্ঞান দ্বারা নিজেকে চিনতে পারে এবং ক্রমেক্রমে আমিত্ব লয় প্রাপ্ত হয়ে সাধকের যখন আমিত্ববোধ থাকেনা তখন মন যে অবস্থা প্রাপ্ত হয় তার নাম নিবৃত্তি বা সহজ অবস্থা, সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হলে সহজ দেশে বসতি, সহজ দেশের অপর নাম সকল প্রকার কামনা-বাসনার অতীত নিত্যধাম।

‘দুলালচাঁদ’ সতীমাকে বললেন জগতে বিভিন্ন প্রকার সাধন-ভজন ও উপাসনা তত্ত্বের মধ্যে কোন পথ সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি কোন পথ অবলম্বন করলে সেই সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে সহজ মানুষের দর্শন পাব!। সতীমা বললেন- আদর্শ ও উদ্দেশ্য ঠিক রেখে সাধন ভজন করলে সকল পথ-ই শ্রেষ্ঠ।

তবে একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারে না এবং তাতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যায় না, তাই তুমি তােমার স্ব-ধর্ম পালন কর, একমাত্র স্ব-ধর্ম পালনের মাধ্যমে জীবনের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানাে সম্ভব। স্ব-ধর্ম অর্জিত না হলে জপ-তপ-সাধন-ভজন পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞান গড়িমা সবই নিষ্ফল।

সতীমা দুলালচাঁদকে বললেন জাতিভেদের এ অমানবিক সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ ও ধর্মের যে অবক্ষয় হচ্ছে এর প্রতিকারের জন্য তােমাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, এ জন্য তােমাকে ঠাকুর আউলচাঁদের আদর্শ বুকে ধারণ করে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।

মানুষের স্ব-ধর্ম মনুষ্যত্ব, মনুষ্যত্ব অর্জন হলেই জপ-তপ-সাধন-ভজন, ধর্ম-কর্ম মােক্ষ, লয়, নির্বাণ সব কিছু-ই তার করায়ত্ব হয়। সকল প্রকার ভেদ জ্ঞানের উর্ধে থেকে নিস্কাম ভাবে মানুষকে ভালবাসার নাম মনুষ্যত্ব, তুমি সেই স্ব-ধর্ম পালনের জন্য সর্বাত্মক ভাবে আত্মনিবেদন কর তারপর তােমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় মতাদর্শের নীতি-আদর্শ, বিধি-নিষেধ, আচার-আচরণ বিশেষভাবে অবগত হও।

জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় মতাদর্শ যদি স্ব-ধর্ম পালন তথা মনুষ্যত্ব অর্জন ও পারমার্থিক মুক্তি পথের অনুকুল হয় তাহলে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় মতাদর্শকে স্ব-ধর্ম হিসেবে গ্রহণ কর। তারপর জন্মসূত্রে প্রাপ্ত স্ব-ধর্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে তার নীতি-আদর্শ-উদ্দেশ্য নিজের জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য গুরুর নির্দেশিত পথে দৃঢ়সংকল্পিত ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তােমার অভীষ্ঠ লক্ষে পৌঁছানাের জন্য সচেষ্ট হও নিশ্চয় তুমি সফল হবে এত কোন সন্দেহ নেই।

দুলালচাঁদ বললেন জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আমার স্ব-ধর্মের আদর্শ কি? সতীমা বললেন ঠাকুর আউলচাঁদের নির্দেশিত পথ-ই তােমর স্ব-ধর্ম, যার আদর্শ-

একেশ্বরবাদ, শুরুবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সহজভাব (আমিত্ব বর্জন)।

সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে নিজের মুক্তি সাধন তােমর স্ব-ধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য নয়, তুমি যদি সন্ন্যসী হও তাহলে তােমার স্ব-ধর্মের আদর্শ উপেক্ষিত হবে, তাই তােমার স্ব-ধর্ম পালনের জন্য তােমাকে সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী হতে হবে, আধ্যাত্মিক সাধন ব্যতিত পুঁথিগত বিদ্যা শুধু লােক ঠকানাের পূঁজি মাত্র।

তােমাকে আধ্যাত্মিক সাধন দ্বারা একটি বৃহৎ বটবৃক্ষে পরিণত হতে হবে, যার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে অবহেলিত, নির্যাতিত, দীন-দুঃখী মানুষেরা পাবে মানষিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ বা আলাের সন্ধান। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোন মানুষের ধর্মে-কর্মে অধিকার নেই, ব্রাহ্মণদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী শূদ্রদের ধর্ম-কর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হবে, একেই বলে ব্রাহ্মণ্যবাদ।

ব্রাহ্মণরা তাদের আধিপাত্যবাদ ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা পাকাপােক্ত করার জন্য সু-কৌশলে হিন্দু সমাজে কিছু কু-সংস্কারের বীজ রােপন করেছে (মরণাশৌচ, জননাশৌচ, একজন ব্যক্তির মৃত্যুতে একপাদ দোষ, দুইপাদ, তিনপাদ, চারপাদ দোষ, শনিগ্রহ চক্র দোষ ইত্যাদি) তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যাতে ব্রাহ্মণদেরই শরণাপন্ন হতে হয়, এজন্য তারা বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘পুরোহিত দর্পন’।

সতীমা দুলালচাঁদকে বললেন জাতিভেদের এ অমানবিক সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ ও ধর্মের যে অবক্ষয় হচ্ছে এর প্রতিকারের জন্য তােমাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, এ জন্য তােমাকে ঠাকুর আউলচাঁদের আদর্শ বুকে ধারণ করে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।

দুলালচাঁদ তার স্ব-রচিত ‘ভাবেরগীত’-এর পদ বিভিন্ন ‘মহতী বৈঠক’ অনুষ্ঠানে কীর্তন করতেন এবং তার ভাবার্থ অতি সুন্দর ভাবে ভক্তদের বোঝাতেন, এই ভাবে তার ঐকান্তিক চেষ্টায় অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই কর্তাভজা ধর্মের আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আর সবাইকে বুঝাতে হবে আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ছােটজাত, বড়জাত নয়, সবাই আমরা মানুষ এক জগৎ মাতার সন্তান, আর অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িতদের বােঝাতে হবে তােমরা শুধু ব্রাহ্মণদের ব্যবসার পুঁজি নও, তােমরাও মানুষ তােমাদেরও মন আছে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক আছে, তোমরা কর্তাভজা ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হও।

আর ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে তােমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারমার্থিক মুক্তির পথে অগ্রসর হও। কর্তাভজা ধর্মে জাতি ধর্ম-বর্ণ-গােত্র নির্বিশেষে সকলেরই যার যার ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার আছে, ধর্ম-কর্ম করার জন্য তােমাদের আর বংশগত বর্ণবাদী ব্রাহ্মণদের দ্বারস্থ হতে হবে না।

সতীমা দুলালচাঁদকে বললেন তােমাকে সকল শাস্ত্র মন্থন করে প্রাচীন শাস্ত্রের সকল কু-সংস্কার ঝেড়ে ফেলে ধর্মের সারবস্তু গ্রহণ করে সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ, পারমার্থিক মুক্তি পথের দিশারী স্বরুপ এক মহাগ্রন্থ রচনা করতে হবে এবং ঠাকুর আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা ধর্মের আদর্শ সকল স্তরের মানুষের মাঝে প্রচার করতে হবে।

যে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সব একাকার হবে, নিম্নবর্ণের মানুষেরা পাবে ধর্ম-কর্মে অধিকার আর কর্তাভজা সত্যধর্ম হবে স্ব-মহিমায় উজ্জল। দুলালচাঁদ যখন অগ্রন্বীপের মেলায় গিয়েছিলেন তখন ঠাকুরমনি নামে এক মহা জ্ঞানতপস্বীর সাথে সাক্ষাৎ হয়, ঠাকুরমণির উপদেশ মত দুলালচাঁদ নিজ মায়ের (সতীমা) নিকট থেকে ‘সত্যনামে’ দীক্ষা গ্রহণ করেন।

দুলালচাঁদ মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনা ও ধর্মীয় নিগুঢ়তত্ব বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন, মায়ের অনুরোধ ক্রমে মাত্র ১৬ বছর বয়সে দুলালচাঁদ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই ‘ভাবেরগীত’ নামে মহাগ্রন্থ রচনা শুরু করেন।

দুলালচাঁদ তার স্ব-রচিত ‘ভাবেরগীত’-এর পদ বিভিন্ন ‘মহতী বৈঠক’ অনুষ্ঠানে কীর্তন করতেন এবং তার ভাবার্থ অতি সুন্দর ভাবে ভক্তদের বোঝাতেন, এই ভাবে তার ঐকান্তিক চেষ্টায় অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই কর্তাভজা ধর্মের আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

তারা খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য ডুবােপাড়ার (ঘােষপাড়ার) অদূরে একটি খৃষ্টান মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু কর্তাভজা ধর্মের প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রী না হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই সেই স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে দুলালচাঁদের সাথে সাক্ষাৎ ও ধর্ম বিষয়ে আলাপ আলােচনার জন্য মাঝে মাঝে উক্ত সাহেবরা নিত্যধাম ঘােষপাড়ায় আসতেন, দুলালচাঁদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও উদার মনােভাবে মুগ্ধ হয়ে উক্ত বিশপ, পাদ্রীরা দুলালচাঁদের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন।

ঠাকুর দুলালচাঁদ অতি সুন্দর ভাবে ধর্মের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তত্ত্ব নিখুঁত ভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে এমন ভাবে বােঝাতেন যে যারা কর্তাভজা ধর্মের বিরােধিতা করতেন তারাও অনেকেই পরবর্তী কালে কর্তাভজা ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

কর্তাভজা ধর্মের নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শুধু নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নয়, উদার মনােভাবাপন্ন শিক্ষিত উচ্চবর্ণ হিন্দুসহ ব্রাহ্মণগণও কর্তাভজা ধর্ম গ্রহণ করেছিল, আর সতীমার ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করে, অন্ধদৃষ্টি পেয়ে, দূরারােগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকেই কর্তাভজা সত্যধর্ম গ্রহণ করেছিল।

ভূ-কৈলাসের রাজা জয় নারায়ণ ঘােষাল (তৎকালীণ সময়ে কলকাতার আঞ্চলিক রাজা)। এক সময় কঠিন দূরারােগ্য ব্যাধিতে শয্যা শায়িত ছিলেন, সেই সময়ের যথা সম্ভব উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেও রােগ হতে মুক্তি লাভ করতে পারছিলেন না, এমতাবস্থায় রাজা জয় নারায়ন ঘােষাল নিত্যধাম ঘােষপাড়ায় সতীমায়ের শরণাপন্ন হয়, সতীমায়ের অলৌকিক মহিমায় অলৌকিক ভাবে রাজা রােগ হতে মুক্তি পেয়ে সুস্থ জীবন-যাপন করতে সমর্থ হন।

তখন থেকে রাজ পরিবারের সকলেই কর্তাভজা সত্যধর্ম গ্রহণ করে এবং সত্যধর্মের নিদর্শন স্বরূপ রাজ পরিবারের সকলেই নামের আগে ‘সত্য’ শব্দটি ব্যবহার শুরু করেন, রাজ পরিবারের সেই ধারা আজও অব্যহত আছে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের শাসন ক্ষমতা ব্রিটিশ খৃষ্টানদের হাতে চলে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় অর্থ ও চাকুরীর লােভে দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা খৃষ্টান হয়ে যেতে থাকে।

এমতাবস্থায় দুলালচাঁদ জাত-পাত-বর্ণ-বৈষম্যহীন কর্তাভজা ধর্ম প্রচার করায় নিন্মবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং অনেক ধর্মান্তরিত মানুষ কর্তাভজা ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তৎকালীন সময়ে ইংল্যাণ্ডের রাণী কর্তৃক মনােনীত।

সুদূর লন্ডন থেকে আগত খৃষ্টান ধর্ম প্রচারক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ডাফ সাহেব, উইলিয়াম সাহেব, জনকেরী সাহেব প্রমুখ বিশপ পাদ্রীরা বাংলায় খৃষ্টান ধর্ম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন, তারা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলায় খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের প্রধান বাঁধা কর্তাভজা ধর্ম বা সতীমা ও দুলালচাঁদ।

তারা খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য ডুবােপাড়ার (ঘােষপাড়ার) অদূরে একটি খৃষ্টান মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু কর্তাভজা ধর্মের প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রী না হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই সেই স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে দুলালচাঁদের সাথে সাক্ষাৎ ও ধর্ম বিষয়ে আলাপ আলােচনার জন্য মাঝে মাঝে উক্ত সাহেবরা নিত্যধাম ঘােষপাড়ায় আসতেন, দুলালচাঁদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও উদার মনােভাবে মুগ্ধ হয়ে উক্ত বিশপ, পাদ্রীরা দুলালচাঁদের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন।

এই মহাপুরুষের সমাধি আজও নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়ায় অক্ষত অবস্থায় আছে এবং অগণিত ভক্তগণ আজও সমাধিতে শ্রদ্ধাভক্তি নিবেদন করছে। ‘ঈশ্বর এক অদ্বিতীয়’, ‘জগৎ ব্রহ্মময়’ মানুষের মাঝেই ঈশ্বর দর্শন এই মূলমন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করা এবং সকল মানুষ-ই আমার নমস্য এই ভাবে আমিত্ব বর্জন করে এক ঈশ্বরের ভজনা করাকেই বলে কর্তাভজা।

বাংলায় খৃষ্টানধর্ম প্রচারের অবস্থা অবগত করানাের জন্য ডাফ সাহেবরা ইংল্যাণ্ডের রানীর কাছে মাঝে মাঝে প্রতিবেদন পাঠাতেন, ডাফ সাহেবরা উক্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে দুলালচাঁদকে বাংলার আধ্যাত্মিক জ্ঞানভাণ্ডার, উদার মনােভাবাপন্ন মহান ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে রানীর কাছে বেশ কিছু প্রতিবেদন পাঠান।

সেই সূত্র ধরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দুলালচাঁদ তথা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল, এর নিদর্শন স্বরূপ ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার শিকাগােতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্মসভায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণ লাভের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্য্য বহন করে।

এই বিশ্বধর্ম সভায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দুলালচাঁদ ওরফে রামদুলাল কাউন্সিল এডভাইজার বা উপদেষ্টা মণ্ডলীর সম্মানিত সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ লাভ করেছিলেন, স্মরণীয় যে ঠাকুর দুলালচাঁদ তার (৬০ বছর) পূর্বেই দেহত্যাগ করেছিলেন তাই তার পক্ষে উক্ত ধর্মসভায় যােগদান করা সম্ভব হয়নি।

ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভু কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় ‘মহতী বৈঠক’ অনুষ্ঠানকে দুলালচাঁদ পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন এবং কর্তাভজা ধর্মের আদর্শ মানুষের মাঝে প্রচার করার পথ সুগম করেন। দুলালচাঁদ যে অসাধারণ মেধাশক্তি ও আধাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন মহান ব্যক্তি ছিলেন তা তার ছন্দময় রচনা শৈলী বৃহৎ ‘’ভাবেরগীত’ গ্রন্থটি অনুধাবন করলে সহজেই বুঝা যায়।

ঠাকুর আউলচাঁদ কর্তাভজা সত্যধর্মের বীজ রােপন করেছিলেন, সতীমা তাতে ভক্তি বারি সিঞ্চন করে বৃহৎ বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন আর দুলালচাঁদ সেই বৃক্ষে ফলে-ফুলে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। কর্তাভজা সত্যধর্মের প্রাণপুরুষ, আধ্যাত্মিক সাধনার অগ্রদূত, অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের প্রাণের ঠাকুর, সতীমার সুযােগ্য পুত্র দুলালচাঁদ ওরফে রামদুলাল (লালশশী) বাংলা ১২৩৯ সালের চৈত্র মাসে চতুদ্দর্শী তিথিতে ৫৭ বছর বয়সে ইহলীলা সম্বরণ করেন।

এই মহাপুরুষের সমাধি আজও নিত্যধাম কল্যাণী ঘােষপাড়ায় অক্ষত অবস্থায় আছে এবং অগণিত ভক্তগণ আজও সমাধিতে শ্রদ্ধাভক্তি নিবেদন করছে। ‘ঈশ্বর এক অদ্বিতীয়’, ‘জগৎ ব্রহ্মময়’ মানুষের মাঝেই ঈশ্বর দর্শন এই মূলমন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করা এবং সকল মানুষ-ই আমার নমস্য এই ভাবে আমিত্ব বর্জন করে এক ঈশ্বরের ভজনা করাকেই বলে কর্তাভজা।

ঘোষপাড়ার রথযাত্রা উৎসব>>

……………..
‘সতীমা ও সত্যদর্শন’ বই থেকে সংগৃহীত

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা ধর্মের ইতিহাস
ঠাকুর আউলচাঁদের আবির্ভাব
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তদের বিশ্বাস
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষা গ্রহণ
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দশ আজ্ঞা
সতীমা কে?
শূদ্র কারা?
ঘোষপাড়ার ডালিম তলা ও হিমসাগরের মাহাত্ম্য
কর্তাভজার বাইশ ফকির
আউলচাঁদের তিরােধান
দুলালচাঁদ
সতীমায়ের উপদেশ বাণী
ঘোষপাড়ার রথযাত্রা উৎসব
সতীমার তিরােধান
কর্তাভজা ধর্মের মূলস্তম্ভ

ত্রিশ ধারা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!