ভবঘুরেকথা
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব

শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তিন

তোমাদের মধ্যে আমাকেই দেখিতেছি

কুমিল্লা জেলান্তর্গত বাঘাউড়া-নিবাসী অপর এক পত্রলেখকের পত্রোত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি লিখিলেন,-

আমার স্নেহ সর্ত্তহীন, স্বার্থহীন, অফুরন্ত ও অতলস্পর্শ। তোমরা যে যত পবিত্র হইবে, তাহার দৃষ্টি তত স্বচ্ছ হইবে এবং সে তত পরিষ্কার ভাবে এই প্রেমকে উপলব্ধি করিতে পারিবে। মানুষ আমার নিকটে উপলক্ষ্য, তাহাকে আশ্রয় করিয়া আমার প্রেম কোটি ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত কোটি জীবকুলকে স্পর্শ করিতে চাহিতেছে।

তোমাকে যখন আলিঙ্গন করি, তখন তোমার দুইটী কচি করপুটই আমার বক্ষ স্পর্শ করে না, আমি সেখানে তখন কোটি কোটি জগতের লক্ষ কোটি জীবের প্রেমবিহ্বল করপুটের আবেশ-চঞ্চল আবেগ -বিভোর হস্তাঙ্গুলীগুলির মেদুর স্পর্শ অনুভব করি।

একটী মাত্র মানুষের ভিতর দিয়াই আমি অনন্ত বিশ্বের সকলের স্পর্শ পাই। এই বিদ্যাই আমি আকৈশোর শিখিয়াছি। ভালবাসাই আমার ধর্ম্ম, প্রেমই আমার উপজীব্য, সকলকে আপনার আপন, জীবনের জীবন বলিয়া উপলব্ধি করাই আমার সাধনা, এই সাধনাকে সফল করিবার জন্য সর্ব্বপ্রকার সুখলালসা ও আরাম- প্রিয়তাকে জীবন হইতে একেবারে নির্ব্বাসিত করিয়া দেওয়াই আমার তপস্যা।

এই তপস্যায় আমি একনিষ্ঠ, এই সাধনায় আমি একলক্ষ্য, এই উপজীব্যেই আমি একাগ্র, এই ধর্ম্মেই আমি আত্মসমাহিত। এই জন্যই আমার উচ্ছ্বাস বন্যার ধারায় বহে না, দুগ্ধের মত ইহা শুভ্র কিন্তু ক্ষীরের মত ইহা প্রগাঢ় ও তরঙ্গহীন সুস্থির। তোমাদের মধ্যে আমি আমাকেই দেখিতেছি, ব্রহ্মাণ্ডে অপর কিছুই আমার দর্শনীয় নাই।

অখণ্ড-সংহিতা ষোড়শ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৯০)

নাম চঞ্চলতা-হারক

মনে চঞ্চলতা আসিলে মঙ্গলময় নামে অধিকতর দৃঢ়তা সহকারে লাগিয়া থাকিবে। নামের মত দুঃখ-নাশক, বিঘ্নহারক, ভীতি-বারক কাম-জারক, প্রেমদায়ক এবং চিত্তের স্থৈর্য্য-বিধায়ক আর কোনও বস্তু নাই। মন যত অধিক চঞ্চল হইবে, নামে তত দৃঢ় ভাবে লাগিয়া থাকিবে।

অখণ্ড-সংহিতা ত্রয়োদশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২০৮ – ২০৯)

অখণ্ডের আদর্শ

শ্রীযুক্ত অমর জিজ্ঞাসিলেন,-আচ্ছা বাবামণি, আমরা ত অখণ্ড। আমাদের আদর্শটা কি?

শ্রীযুক্ত আবদুল আজিজ বলিলেন,-ঠিক এই প্রশ্নটাই আমিও কর্ ব ব’লে ভাবছিলাম। হিন্দুর ছেলে, মুসলমানের ছেলে, কত জনের কত রকমের ছেলে আমরা সব বাবামণির শিষ্যত্ব গ্রহণ ক’রেছি, দীক্ষা নিয়ে তাঁকে গুরু ব’লে স্বীকার ক’রেছি কিন্তু আমাদের আদর্শটা কি ঠিক ঠিক জানি নি।

শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,- মনুষ্যত্বই অখণ্ডের আদর্শ। অখণ্ড হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়, খ্রীষ্টানও নয়, বৌদ্ধও নয়,-অখণ্ড হচ্ছে মানুষ। যে মানুষ অপর মানুষকে ঘৃণা করে না, যে মানুষ অপর মানুষকে পর ভাবে না, যে মানুষ ধর্ম্মীয় সাম্প্রদায়িকতার যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দেয় না,

যে মানুষ মানুষের সাথে মানুষের মিলনের সূত্র অবিষ্কারেই নিয়ত নিরত, যে মানুষ অতীতের মহত্ত্বকে অস্বীকার না ক’রেও অতীতের ভ্রমত্রুটীকে সংশোধনের সৎসাহস রাখে, যে মানুষ সম্প্রদায়ের মৌলিক একত্বে বিশ্বাস করে, যে মানুষ সর্ব্বজীবকে জানে ভাই,

সর্ব্বমানবকে জানে আপন, সর্ব্বদেশকে জানে স্বদেশ, সর্ব্বভাষাকে জানে ইষ্টনামেরই বহিঃপ্রকাশ, সকল সংঘকে জানে নিজের প্রতিষ্ঠান,সকল মত ও পথকে জানে নিজের মত ও পথের অন্তর্ভুক্ত সত্য,-সে হচ্ছে অখণ্ড।

খণ্ড নাহি করা যায় যারে,
মারিয়াও মারিতে না পারে,

মৃত্যুমাঝে অমৃত-ভৃঙ্গার
অবিরাম পূর্ণ রহে যার,
ভিন্নতা ও ছিন্নতার ক্লেদ
যাহার না ঘটায় বিচ্ছেদ,

সর্ব্বমত সর্ব্বপথ যার
চিরন্তন সত্য আপনার,
কেহ যার নহে কভু পর,
সর্ব্বধর্ম্মে সমান আদর,

হিন্দু নহে, নহে সে খ্রীষ্টান,
নহে বৌদ্ধ, নহে মুসলমান,
সর্ব্বজনে যার সমপ্রীতি,
অখণ্ড তাহার পরিচিতি।

অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২৪৬ – ২৪৮)

স্বর্গ অনিত্য বস্তু

অপরাহ্ণে শ্রীশ্রীবাবামণি পূর্ব্বধৈর হইতে আকুবপুর আসিয়াছেন। সন্ধ্যার পরে ‘স্বর্গ’ সম্বন্ধে কথা উঠিল।

শ্রীশ্রীবাবামণি হাসিতে হাসিতে বলিলেন,-স্বর্গে অনেক ভাল জিনিষ আছে রে! অপ্সরারা আছে চিরযৌবনা, পারিজাত আছে চিরসুগন্ধি,নৃত্য আছে, গীত আছে, নেশা করার জন্য মদ-ভাংএর চেয়ে সহস্রগুণ মোলায়েম সুধা আছে,-এত সত্ত্বেও কি স্বর্গ তোদের চিত্তকে আকৃষ্ট না ক’রে পারে?

জিহ্বা, উপস্থ, চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি তাদের ভোগ্য বিষয় প্রচুর পাবে, স্বচ্ছন্দে পাবে, অতি দীর্ঘকাল ধ’রে পাবে, স্বর্গের প্রতি লব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপের এইটীই না কারণ? কিন্তু হায়রে হায়, সেইখান থেকে আবার পতনও আছে। তোরা ত’ সামান্য মানব, সাত বছরে একবার হরি-নাম জপ্ লে হরি-ঠাকুর কৃতার্থ হবেন,

কিন্তু যাঁরা হাজার হাজার বছর ধ’রে তপস্যা ক’রে ইন্দ্রত্ব পেলেন, সেই ভদ্রলোকেরা পর্যন্ত্য এক একজন অসুরদের গুঁতোর চোটে বারংবার স্বর্গভ্রষ্ট হচ্ছেন। তার কারণ কি জানিস্? স্বর্গ অনিত্য বস্তু। ইন্দ্রিয়-সুখ লালসার উপরে এর অস্তিত্ব।

নিত্য স্বর্গ চাই

শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-প্রার্থনা যদি কত্তে হয়, তবে নিত্য-স্বর্গে যাবার প্রার্থনা কর্ বি। যেখানে মদ্য, নারী, নৃত্য, গীত, পুষ্প, শয্যা, খাদ্য আর পানীয়ই লোভনীয় নয়,-চাইবি সেই স্বর্গ। যেই স্বর্গে গেলে আর ” ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্ত‍্যলোকং বিশন্তি” হয় না, যেখান থেকে পতন হয় না, যেখান থেকে কস্মিন্ কালে কারো দ্বারা বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা নেই।

সেই স্বর্গ, ভগবদ্দর্শনজাত পরম সুখের স্বর্গ। চক্ষু, কর্ণ, রসনা ও কামেন্দ্রিয়ের স্বর্গ নয়, চক্ষুরও যে চক্ষু, কর্ণেরও যে কর্ণ, রসনারও যে রসনা, কামেরও যে কাম, তার পরিতৃপ্তির স্বর্গ।

প্রেমিকের হৃদয়ই স্বর্গ

শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-মর্ত্ত‍্যের সুখও যেমন অনিত্য, স্বর্গের সুখও তেমন অনিত্য, নিত্যসুখ একমাত্র ভগবদ্দর্শনে! তাঁকে লাভ ক’রেই নিত্যা শান্তি, নিত্যা তৃপ্তি, নিত্যানন্দ। তাঁকে এক কণা ভালবাসলে যে সুখ, কোটি-কল্পকাল স্বর্গবাসের সুখও তার তুলনায় নগণ্যাদপি নগণ্য।

তোমরা তাঁকে ভালবাস, তাঁর প্রেমিক হও। প্রেমিকের হৃদয়ই প্রকৃত স্বর্গ, প্রেমিকের হাসিমুখই প্রকৃত দেবজ্যোতি, প্রেমিকের নয়নাশ্রুই প্রকৃত সুরধুনী-প্রবাহ, প্রেমিকের অকৃত্রিম-ভাব-বিগলিত তনুর পুলক-চপল রোমাবলিই নয়নোদ্যানের পারিজাতপাদপ।

স্বর্গ আত্মপ্রসাদের স্তর মাত্র

শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-এই ভৌম-পৃথিবীর ন্যায় একটা ভৌম স্বর্গ তোমরা খুঁজে বেড়িও না। সেরূপ কোনও স্বর্গ নেই। স্বর্গ তোমার আত্মপ্রসাদের একটী স্তর মাত্র। সুখলোভী সকাম আত্মপ্রসাদই অনিত্য স্বর্গ। ভগবন্মুখী নিষ্কাম আত্মপ্রসাদই নিত্য স্বর্গ।

অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২৭৫ – ২৭৬)

নামের বলে ভগবৎ-প্রেম-সঞ্চার

অপর একজনের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-ভগবৎ-প্রেম বর্দ্ধনের প্রধান উপায় হচ্ছে, অবিরাম অবিশ্রাম ভগবন্নাম স্মরণ ; নামের স্মরণ-মননের দ্বারা ভগবৎ-প্রেমের দিব্য উৎস খুলে যায়। নামে রত হওয়া আর প্রেমে মত্ত হওয়া এক কথা ব’লে জান্ বে। নামের মহিমা অপরাজেয়, নামের শক্তি অমোঘ।

নাম কত্তে কত্তে প্রেমের উদয় হবেই হবে। একদিনে না হয়, দু’ দিনে না হয়, নাম ছেড়ে দিও না। শত কোটি শতাব্দী জুড়ে তুমি নাম ক’রে যাবে, প্রেমফল লাভ না হওয়া পর্য্যন্ত কিছুতেই নাম ছাড়্ বে না, এই নিদারুণ পণ নিয়ে নাম কত্তে থাক্ বে।

তোমার নাম-সেবন লোক দেখাবার জন্য নয়, পরন্তু প্রাণ মজাবার জন্যে,-এই কথা অনুক্ষণ স্মরণ রাখ্ বে।

শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-

ভগবৎ-প্রেম-সঞ্চারের অপর উপায়, ভগবৎ-প্রেমিক মহাপুরুষদের দিব্য চরিত্র প্রশংসমান চিত্তে পুনঃ পুনঃ আলোচনা। নানা সম্প্রদায়ের মধ্যবর্ত্তিতায় নানা মহাপুরুষের নানা ভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সেই সকল বিভেদ-বৈচিত্র্য নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

খ্রীষ্টান ভক্তও ভক্ত, মুস্ লিম ভক্তও ভক্ত, বৈষ্ণব ভক্তও ভক্ত। ভক্ত-চরিত্র মাত্রেই তোমার আদরণীয়, কে খ্রীষ্টান, কে মুস্ লিম, কে বৈষ্ণব, সেটা তোমার কাছে বড় কথা নয়। সাম্প্রদায়িক দেওয়ালের ঊর্দ্ধ্বেও মাথা তুলে তাঁদের যে ভক্তিনতকন্ধর প্রেমময় মূর্ত্তি আত্মপ্রকাশ করেছে, শ্রদ্ধার সহিত, বিনয়ের সহিত সেই মূর্ত্তির দিব্যপ্রভা দর্শন ক’রে, ‘তাঁদের ভগবৎ-প্রেম আমারও অন্তরে পরিস্ফূর্ত্ত হউক’,-অনিবার এই প্রার্থনা কর।

অখণ্ড-সংহিতা ত্রয়োদশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ১৯৪ – ১৯৫)

শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চার>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………….
আরও পড়ুন-
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এক
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তিন
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চার
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পাঁচ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ছয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সাত
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আট
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : নয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দশ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এগারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : বারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চোদ্দ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পনেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ষোল
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সতেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আঠারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : উনিশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!