ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত লস‍্ এঞ্জেলেস্-এ প্রদত্ত বক্তৃতা

বস্তুর স্বরূপ অবধারণ করিতে গিয়া আমরা যে-উপায়ই অবলম্বন করি না কেন, গভীর বিশ্লেষণের ফলে আমরা দেখিতে পাই, বস্তুর যে-স্বরূপ আমাদের নিকট প্রকাশিত হয়, তাহাকে আপাততঃ স্ববিরোধী ছাড়া আর কিছু বলা চলে না; তাহা যুক্তির অগম্য হইলেও সত্য। প্রাথমিক দৃষ্টিতে যে-কোন বস্তুই সসীম বলিয়া মনে হয়; কিন্তু উহাকে বিশ্লেষণ করিতে আরম্ভ করিলে—কি গুণের দিক দিয়া, কি সম্ভাবনার দিক দিয়া কি শক্তির দিক দিয়া, কি সম্বন্ধের দিক দিয়া উহার কোন অন্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

বিচারের দৃষ্টিতে উহা অসীম হইয়া দাঁড়ায়। একটি ফুলের কথাই ধরা হউক। ফুল তো ক্ষুদ্র, সসীম পদার্থ, কিন্তু কে বলিতে পারে, সে ফুলের সম্বন্ধে সবই জানে? সামান্য একটি ফুলের সম্বন্ধেও জ্ঞানের শেষ সীমায় পৌঁছানো কাহারও পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ফুলটি প্রথমে সসীম বলিয়া প্রতীত হইলেও বিচারের দৃষ্টিতে অসীমে পরিণত হইয়াছে। একটি ক্ষুদ্র বালুকণাকে বিশ্লেষণ করিলেও বুঝা যায়।

উহা আপাতদৃষ্টিতে সসীম হইলেও বস্তুত অসীম ; তথাপি বালুকণা আমরা সসীম পদার্থ বলিয়াই মনে করিয়া আসিতেছি, ফুলও তেমনি আমাদের কাছে সসীম পদার্থ বলিয়া বিবেচিত হয়।

আমাদের অন্তরের এবং বাহিরের সকল চিন্তা ও অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে এই একই কথা। আমরা প্রথমে সামান্য জিনিস মনে করিয়া যাহা কিছু চিন্তা করিতে আরম্ভ করি, অতি অল্পকাল-মধ্যেই তাহা আমাদের জ্ঞানের পরিধি অতিক্রম করিয়া অনন্তের গভীরে ডুবিয়া যায়। অনুভূত বস্তুর মধ্যে আমরা নিজেরাই প্রতম ও শ্রেষ্ঠ। অস্তিত্বের কথা ভাবিতে গেলেও ধাঁধায় পড়িতে হয়। আমাদের অস্তিত্ব আছে। আমরা সসীম জীব। আমরা জীবনধারণ করি এবং মরিয়া যাই।

আমাদের দিগন্ত সীমাদ্ধ। আমরা জানি—আমাদের সত্তা সসীম, আমাদের জীবনের পরিণতি মৃত্যু, আমাদের দিঙ্‌মণ্ডল স্বল্পপ্রসারী; আমরা চারিদিকে জগৎ-পরিবেষ্টিত হইয়া সঙ্কীর্ণ জীবন যাপন করিতেছি। বিশ্বপ্রকৃতি যে-কোন মুহূর্তে আমাদিগকে চূর্ণ করিয়া আমাদের সত্তার বিলোপ ঘটাইতে পারে। বিশাল বিশ্বের সম্মুখে আমাদের ক্ষুদ্র দেহগুলি কোনমতে টিকিয়া আছে, মুহূর্তমধ্যে ইহারা ভাঙিয়া পড়িতে পারে। আমরা জানি, কর্মক্ষেত্রে আমরা কত শক্তিহীন।

প্রতিনয়তই আমাদের ইচ্ছা প্রতিহত হইতেছে। কত শত ইচ্ছা আমরা পূর্ণ করিতে চাই, কিন্তু কয়টি ইচ্ছা আমরা পূর্ণ করিতে পারি? আমাদের বাসনা অনন্ত । আমরা সব কিছুই কামনা করিতে পারি। অন্য বাসনা তো তুচ্ছ, সুদূর নীলাকাশের লুব্ধক নক্ষত্রে যাইব, এইরূপ বাসনাও আমরা পোষণ করিতে পারি। কিন্তু কয়কটি বাসনা আমরা পূর্ণ করিতে পারি? আমাদের দেহ অপটু, বহিঃপ্রকৃতি ইচ্ছার প্রতিকূল, আমরা দুর্বল।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আমাদের আর একটি দিক আছে। ক্ষুদ্র ফুলটি কিংবা সূক্ষ্ম বলকণাটি যেমন একাধারে সসীম ও অসীমের দ্যোতক, আমাদের স্বরূপও সেইরূপ। আমরা সমু্দ্রের তরঙ্গের মতো। একদিক দিয়া দেখিতে গেলে তরঙ্গটি সমুদ্র ভিন্ন আর কিছু নয়, আবার অন্য দিক দিয়া বিচার করিলে তরঙ্গ এবং সমুদ্রের পার্থক্য স্পষ্ট। তরঙ্গের এমন কোন অংশ নাই, যাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলা যায় না যে, ইহা সমুদ্রই।

‘সমুদ্র’ নামটি শুধু তরঙ্গ সম্বন্ধে নয় , সমুদ্রের সকল অংশ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, তথাপি সমুদ্র তরঙ্গ হইতে পৃথক্। সত্তারূপ বিরাট সমুদ্রের মধ্যে আমরা এক-একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গের মতো; কিন্তু আমরা যখন আমাদের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করিতে যাই, তখন আমরা বুঝিতে পারি, আমাদের সত্তাকে ধরা সম্ভব নয়, কারণ আমরা অসীম হইয়া পড়িয়াছি।

আমরা যেন স্বপ্নে বিচরণ করিতেছি। যতক্ষণ মন স্বপ্নাবস্থায় থাকে, ততক্ষণ কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না, কিন্তু যখনই স্বপ্নের বিষয়কে বাস্তব বলিয়া আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করা হয়, তখনই উহা অদৃশ্য হয়। কেন?—স্বপ্ন মিথ্যা বলিয়া নয়, স্বপ্নের স্বরূপ আমাদের যুক্তি বিচার ও বুদ্ধির অগোচর বলিয়া। জীবনে অনুভূত প্রত্যেকটি বস্তু এত বিরাট যে, তাহার তুলনায় আমাদের বুদ্ধি অতি তুচ্ছ। বুদ্ধি চায় নিজের উদ্ভাবিত কতকগুলি নিয়মের মধ্যে বস্তুকে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে।

কিন্তু বস্তু কখনও বুদ্ধির নিগড়ে আবদ্ধ হইতে স্বীকৃত হয় না। বস্তুকে নিয়মের জালে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধির এই প্রচেষ্টা মানবাত্মার ক্ষেত্রে আরও সহস্রগুণ ব্যর্থ বলিয়া প্রতীত হয়। বস্তুতঃ বিশ্বের সকল পদার্থের মধ্যে ‘আমরা নিজেরাই’ সর্বাধিক রহস্যময়।

এই তো বিরাট বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি সম্মুখে রহিয়াছে’; আমরা চোখের সাক্ষ্যে বিশ্বাস করিয়া প্রকৃতির বিচিত্র রূপের অস্তিত্ব স্বীকার করি। এইভাবে ক্ষুদ্র কান, নাক, জিভ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিপুল বিশ্বের পরিচয় লাভ করি

সব কিছুই বিস্ময়কর! মানুষের চোখের দিকে তাকাও! কত সহজে ইহা নষ্ট হইয়া যাইতে পারে। অথচ তোমার চোখ দেখিতেছে বলিয়াই প্রকাণ্ড সূর্যের অস্তিত্ব। সেই রহস্যের কথা ভাবো! ক্ষুদ্র অসহায় চোখ-দুটি! একটা তীব্র আলোক কিংবা একটা কাঁটা চোখ-দুটিকে নষ্ট করিয়া দিতে পারে। তবু সবচেয়ে শক্তিশালী ধ্বংসকারী যন্ত্র, প্রলয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহাবিস্ময়কর চন্দ্র সূর্য তারকা পৃথিবী প্রভৃতির অস্তিত্ব এই দুইটি ক্ষুদ্র চোখের উপর নির্ভর করে!

তোমার চোখই বিশ্বের অস্তিত্বের সাক্ষী। চোখ বলে, ‘এই তো বিরাট বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি সম্মুখে রহিয়াছে’; আমরা চোখের সাক্ষ্যে বিশ্বাস করিয়া প্রকৃতির বিচিত্র রূপের অস্তিত্ব স্বীকার করি। এইভাবে ক্ষুদ্র কান, নাক, জিভ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিপুল বিশ্বের পরিচয় লাভ করি।

কিন্তু বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে কে ক্ষুদ্র, কে মহৎ, কে দুর্বল, কে সবল, কে উচ্চ, কে নীচ—তাহা নিশ্চয় করিয়া বলার উপায় নাই, কারণ এই বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের পরস্পর-নির্ভরশীলতা এমন অদ্ভুত যে, ক্ষুদ্রতম পরমাণুটির সত্তাও সমগ্র জগতের অস্তিত্বের পক্ষে অত্যাবশ্যক। কেহই ছোট নয়, কেহই বড় নয়। সব কিছুই এক অসীম পরম সত্যের সহিত বিজড়িত, সব কিছুই অনন্ত সমুদ্রে ভাসমান, সব কিছুই তত্ত্বতঃ অসীম।

স্থূল বৃক্ষাদি ও সূক্ষ্ম বালুকাদি যাহা দেখা যায়, সুখ-দুঃখাদি যাহা অনুভব করা যায়—সব কিছুই বস্তুতঃ অসীম। প্রত্যেকটি জীব, প্রত্যেকটি চিন্তা, প্রত্যেকটি পরিচ্ছন্ন সত্তাই স্বরূপতঃ অসীম। আমাদের সত্তার রহস্য এই যে, আমরা অসীম হইয়াও সসীম এবং সসীম হইয়াও অসীম।

ইহা সত্য হইতে পারে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় অসীমের এই উপলব্ধি আমাদের প্রায় অজ্ঞাত। আমরা আমাদের অসীমত্ব ভুলিয়া গিয়াছি, তাহা নয়, কারণ নিজের প্রকৃত স্বরূপ কেহই ভুলিতে পারে না। কেহ কি কখনও নিজের ধ্বংস কল্পনা করিতে পারে? কে ভাবিতে পারে, সে মরিয়া যাইবে?—কেহই এইরূপ চিন্তা করিতে পারে না। অসীমের সহিত আমাদের সম্বন্ধ-বোধ অজ্ঞাতসারেও আমাদের মধ্যে কাজ করিতে থাকে। একদিক দিয়া দেখিতে গেলে ইহা আমাদের স্বরূপ-বিস্মৃতি এবং ইহাই আমাদের সকল দুঃখের মূল।

দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে দেখা যায় যে, আমরা সামান্য কারণেই ব্যথিত হই, ক্ষুদ্র সত্তার দাসত্ব স্বীকার করি। আমরা মনে করি, আমরা সসীম—ক্ষুদ্র জীব। এই ধারণা হইতেই আমাদের দুঃখের উৎপত্তি। তথাপি আমরা যে অসীম, এই ধারণা পোষণ করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

আমরা যখন দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হই, আমরা যখন তুচ্ছ বিষয়ে বিচলিত হই, তখন আমাদের এই বিশ্বাস জাগ্রত করা উচিত যে, আমরা অসীম। বস্তুতঃ আমরা অসীমই। জ্ঞাতসারে হউক কিংবা অজ্ঞাতসারে হউক, আমরা তো অসীম অনন্তের সন্ধানেই ছুটিতেছি; আমরা সর্বদা এমন কিছু খুঁজিতেছি, যাহা মুক্ত।

জগতে কোনদিন এমন জাতি ছিল না, যাহাদের ধর্ম ছিল না বা যাহারা কোন না কোন প্রকার ঈশ্বর অথবা দেবতার পূজা করিত না। ঈশ্বর আছেন কিনা, দেবতারা আছেন কিনা, এই-সকল প্রশ্নের প্রয়োজন নাই। আসল প্রশ্ন, মানুষের মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ করিলে কোন্ তথ্য আবিষ্কৃত হয়? সারা জগতের লোক একজন ঈশ্বরের খোঁজ করে কেন? মানুষের কত বাধা, কত বন্ধন! নিয়মের ভয়াবহ নিষ্পেষণ তাহাকে কোন দিকে নড়িতে দেয় না।

সে যাহা কিছু করিতে চায়, তাহাতেই নিয়মের বাধা। সর্বত্রই নিয়ম। কিন্তু এত বাধা এবং নিষ্পেষণ সত্ত্বেও মানুষের আত্মা তাহার স্বাধীনতা বিস্মৃত হয় না, সে খোঁজে মুক্তি। জগতে যত ধর্মমত আছে, তাহাদের সকলেরই লক্ষ্য এক—সকল ধর্মই খোঁজে মুক্তি। মানুষ জানুক আর নাই জানুক, স্পষ্ট ভাষায় বুঝাইয়া বলিতে পারুক আর নাই পারুক, মুক্তির ধারণা, স্বাধীনতার ভাব তাহার স্বভাবগত।

মানুষের মধ্যে যাহারা অতি সাধারণ, যাহারা নিতান্ত অজ্ঞ, তাহারাও এমন কিছু খোঁজে, যাহা প্রকৃতির নিয়মের উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে। কেউ দানবের খোঁজ করে, কেউ ভূতের খোঁজ করে, কেউ বা দেবদেবীর খোঁজ করে। এই দানব, ভূত বা দেবতার নিকট প্রকৃতি সর্বশক্তিময়ী নয়, তাহার দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নিয়ম তুচ্ছ, কারণ সে প্রকৃতিকে দমন করিতে পারে।

মানুষের হৃদয়ের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা : আহা, যদি এমন কাহাকেও পাওয়া যাইত, যিনি নিয়মের নিগড় ভাঙিয়া দিতে পারেন! আমরা তো সর্বদা তাঁহারই খোঁজ করিতেছি, যিনি নিয়ম লঙ্ঘন করিতে পারেন। একটি ধাবমান ইঞ্জিন রেলপথে অগ্রসর হইতেছে, আর উহার আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র কীট সরিয়া যাইতেছে।

তখনই আমরা বলি : ইঞ্জিনটি যত প্রকাণ্ডই হউক, উহা জড় পদার্থ, উহা একটি যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়; উহা যতই শক্তিশালী হউক না কেন, উহা কে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়; মানুষ যে দিকে চালাইতে চায়, সেই দিকেই উহাকে চলিতে হয়; উহা কখনও নিয়মকে অতিক্রম করিতে পারে না। কিন্তু কীটটি ক্ষুদ্র হইলেও নিয়ম লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করে, নিজেকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করে।

নিয়মকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করিতে পারুক বা নাই পারুক, নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া সে তাহার স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছে। ইহাই তাহার মধ্যে ভবিষ্যৎ অসীমত্ব বা ঐশী সত্তার লক্ষণ।

সত্য আবিষ্কৃত হইল—সে বুঝিল, পরমেশ্বর নিজেরই অনুরূপ করিয়া মানুষকে গড়িয়াছেন, ইহাই শুধু সত্য নয়, মানুষ নিজের মতো করিয়া পরমেশ্বরকে গড়িয়াছে, ইহাও সত্য।

নিয়মের বিরুদ্ধে স্বাধীন ইচ্ছার এই আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মার এই মুক্তিপ্রবণতা সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক ধর্মেই ঈশ্বর বা কোন দেবতার আকারে ইহা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু ইহা সর্বৈব বাহিরের—যাহারা দেবতাকে কেবল বাহিরেই দেখে, তাহাদের জন্য। মানুষ প্রথমে নিজেকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে করিয়াছিল; তাহার ভয় হইয়াছিল, সে হয়তো কোনদিনই মুক্ত হইতে পারিবে না।

এইজন্য সে প্রকৃতির বাহিরে এমন একজনের খোঁজ করিতেছিল, যিনি স্বভাবতঃ মুক্ত। তারপর তাহার মনে হইল, বাহিরে এইরূপ অসংখ্য মুক্ত সত্তা বা দেবতা আছেন। ক্রমে মানুষ সকল দেবতাকে এক দেবাদিদেব পরমেশ্বরে মিলিত করিল। কিন্তু তাহাতেও মানুষ তৃপ্ত হইতে পারে নাই। যে যখন চরম সত্যের দিকে আরও অগ্রসর হইল, তখন সে বুঝিতে পারিল যে, সে নিজে যাহাই হউক না কেন, যিনি সকল দেবতার দেবতা।

যিনি সকল প্রভুর প্রভু, তাঁহার সহিত তাহার নিজের কোন সম্বন্ধ আছে। সে বদ্ধ, হীনমতি এবং দুর্বল হইলেও পরমেশ্বরের সহিত সম্পর্কযুক্ত। এইভাবে মানুষের দৃষ্টি খুলিল, চিন্তার উন্মেষ হইল এবং জ্ঞানের প্রসার হইল। মানুষ ক্রমশঃ সেই পরমেশ্বরের নিকটবর্তী হইতে লাগিল।

অবশেষে সে বুঝিল, এক সর্বশক্তিমান্ মুক্ত আত্মাকে খুঁজিতে গিয়া তাহার মানসপটে পরমেশ্বর ও নানা দেবতার যে দৃশ্য প্রতিভাত হইয়াছে, সেই দৃশ্য তাহার নিজেরই সম্বন্ধে নিজভাবের প্রতিচ্ছবি মাত্র। সত্য আবিষ্কৃত হইল—সে বুঝিল, পরমেশ্বর নিজেরই অনুরূপ করিয়া মানুষকে গড়িয়াছেন, ইহাই শুধু সত্য নয়, মানুষ নিজের মতো করিয়া পরমেশ্বরকে গড়িয়াছে, ইহাও সত্য।

এরূপেই মানুষ স্বরূপতঃ মুক্ত—এই বোধ জাগ্রত হইল। সেই পরমেশ্বর সদা অন্তরে বিরাজমান, আমাদের নিকটতম। এতকাল আমরা তাঁহাকে বাহিরে খুঁজিয়াছিলাম, অবশেষে বুঝিলাম—তিনি আমাদের অন্তরের অন্তরে।

গল্পে আছে, এক ব্যক্তি তাহার নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দকে গৃহের দরজায় ধাক্কা বলিয়া ভুল করিয়াছিল। প্রথমে একবার দরজা খুলিয়া সে দেখিল, বাহিরে কেহ নাই। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া সে আবার সেই দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনিয়া বিস্মিত হইল। এবারও দরজা খুলিয়া বাহিরে কাহাকেও দেখিতে পাইল না। অবশেষে সে বুঝিতে পারিল যে, উহা তাহার নিজেরই হৃৎস্পন্দনের শব্দ। মানুষের অবস্থা এই গল্পের লোকটির মতো।

এক অনন্ত মুক্ত সত্তার সন্ধানে বাহির হইয়া মানুষ যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছিল, তখন তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, এতদিন সে বহির্জগতে যাঁহাকে অনন্ত মুক্ত সত্তা বলিয়া কল্পনা করিয়াছে, তিনি তাহার স্বরূপেরই বহিঃপ্রকাশ—সকল আত্মার আত্মা। এই সত্যস্বরূপ সে নিজেই।

এইরূপেই মানুষ একদিন বুঝিতে পারে, তাহার সত্তার মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বৈতভাব বিদ্যমান। সে একাধারে অসীম ও সসীম। যিনি অসীম, তিনিও তাহারই আত্মা। অসীম অনন্ত পরব্রহ্ম যেন বুদ্ধির জালে পড়িয়া সসীম জীবকুলের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছেন। কিন্তু ইহাতে ব্রহ্মের স্বরূপে কোন বিকার উপস্থিত হয় নাই। তিনি অবিকৃতই রহিয়াছেন।

যিনি আমাদের আত্মার আত্মা, তাঁহাকে নিত্য মুক্ত আনন্দময় ও নির্বিকার পরব্রহ্ম বলিয়া জানাই প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানই আমাদের সুদৃঢ় ভিত্তি, আমাদের আশ্রয়স্থল। ইহার মধ্যেই মৃত্যুর চির অবসান, দুঃখের চির নিবৃত্তি এবং অমৃতত্বের আবির্ভাব। যিনি বহুর মধ্যে এক, যিনি পরিনামশীল জগতের মধ্যে এক অপরিনামী সত্তা -তাহাকে যিনি নিজের আত্মা-রূপে উপলব্ধি করেন, শুধু তিনিই শাশ্বত শান্তির অধিকারী, অপর কেহ নয়।

মানুষ যখন দুঃখ-দুর্দশার অন্ধকারে পড়ে, তখন এই আত্মা স্বীয় জ্যোতির প্রভাবে তাহাকে জাগ্রত করে; মানুষ জাগিয়াই বুঝিতে পারে, যাহা সত্য-সত্যই তাহার নিজস্ব, তাহা সে কখনও হারাইতে পারে না। না, যাহা আমাদের নিজস্ব, তাহা আমরা হারাইতে পারি না। কে তাহার স্বরূপ হারাইতে পারে? যদি আমি ভাল হই, তাহা হইলে আমার সত্তাই প্রথম স্বীকৃত হয়, তারপর সেই সত্তাই ভাল গুণে রঞ্জিত হয়।

যদি আমি মন্দ হই, তাহা হইলেও আমার সত্তাই প্রথম স্বীকৃত হয়, তারপর সেই সত্তাই দোষ দ্বারা রঞ্জিত হয়। আদিতে, মধ্যে এবং অন্তে—সর্বত্রই এক অদ্বিতীয় সত্তা বা ‘সৎ’ বিদ্যমান। সৎ-এর ধ্বংস নাই।

অতএব সকলেরই আশা আছে। কেহই বিনষ্ট হইতে পারে না; কেহই চিরকাল হীন থাকিতে পারে না। জীবন একটা ক্রীড়াক্ষেত্র ছাড়া কিছু নয়, ক্রীড়া যতই স্থূল হউক না কেন। আমরা যতই দুঃখ-ক্লেশ ও আঘাত পাই না কেন, তাহাতে আত্মার কোন অনিষ্ট হয় না, আত্মা অচল ও সনাতন। আমরা সেই নিত্য আত্মা।

বৈদান্তিক বলেন, ‘আমার ভয় নাই, সংশয় নাই, মৃত্যু নাই; আমার পিতা নাই, মাতা নাই; আমার কখনও জন্ম হয় নাই। আমার শত্রুই বা কে? আমিই যে সব কিছু। আমি সচ্চিদানন্দ, আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম। কাম, ক্রোধ, লোভ, মাৎসর্য, কুচিন্তা প্রভৃতি আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না, কারণ আমি সচ্চিদান্দ, আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম।’

এই ভাবনাই সকল ব্যাধির মহৌষধ, ইহাই মৃত্যুহর অমৃত। আমরা এই জগতে আছি; আমাদের স্বরূপ সেই জগৎকে মানিয়া লইতে চায় না, উহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আমাদিগকে বার বার বলিতে দাওঃ আমি সেই, আমি সেই। আমার ভয় নাই সংশয় নাই, মৃত্যু নাই। আমি স্ত্রী নই পুরুষ নই; আমার সম্প্রদায় নাই, বর্ণও নাই। আমার কি মত থাকিতে পারে?

এমন কোন্ সম্প্রদায় আছে, আমি যাহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারি? কোন্ সম্প্রদায় আমাকে ধরিয়া রাখিতে পারে? আমি তো সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিদ্যমান! দেহ যতই প্রতিকূল আচরণ করুক, মন যতই বিদ্রোহী হউক, যখনই চারিদিক হইতে গভীরতম অন্ধকার, তীব্র বেদনাময় উৎপীড়ন এবং অকূল নৈরাশ্য আসিয়া ঘিরিবে, তখনই এই মন্ত্র উচ্চারণ করিবে, ‘আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম’—একবার নয়, দুইবার নয়, তিনবার নয়, বার বার।

বার বার আমি মৃত্যুর কবলে পড়িয়াছি। কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়াছে, কতবার পায়ে নিদারুণ ক্ষত দেখা দিয়াছে, হাঁটিতে অক্ষম হইয়া ক্লান্তদেহে বৃক্ষতলে পড়িয়া রহিয়াছি, মনে হইয়াছে এইখানেই জীবনলীলা শেষ হইবে। কথা বলিতে পারি নাই, চিন্তাশক্তি তখন লুপ্তপ্রায়।

কিন্তু অবশেষে ঐ মন্ত্র মনে জাগিয়া উঠিয়াছে : আমার ভয় নাই, মৃত্যু নাই; আমার ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই। আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম। বিশ্বপ্রকৃতির সাধ্য নাই যে, আমাকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি আমার দাস। হে পরমাত্মন্, হে পরমেশ্বর, তোমার শক্তি বিস্তার কর। তোমার হৃতরাজ্য পুনরধিকার কর। উঠ, চলো, থামিও না। এই মন্ত্র ভাবিতে ভাবিতে আমি নবজীবন লাভ করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছি এবং আজ এখানে সশরীরে বর্তমান আছি।

সুতরাং যখনই অন্ধকার আসিবে, তখনই নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিও, দেখিবে—সকল বিরুদ্ধ শক্তি বিলীন হইয়া যাইবে। বিরুদ্ধ শক্তিগুলি তো স্বপ্ন মাত্র। জীবন-পথের বাধাবিঘ্নগুলি পর্বতপ্রমাণ, দুর্লঙ্ঘ্য ও বিষাদময় বলিয়া মনে হইলেও এগুলি মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। ভয় করিও না, দেখিবে উহারা দূরে চলিয়া গিয়াছে। নিষ্পেষণ কর, দেখিবে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে; পদদলিত কর, দেখিবে মরিয়া গিয়াছে।

ভীত হইও না। বার বার বিফল হইয়াছ বলিয়া নিরাশ হইও না। কাল নিরবধি, অগ্রসর হইতে থাকো, বার বার তোমার শক্তি প্রকাশ করিতে থাকো, আলোক আসিবেই। জগতে প্রত্যেকের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হইতে পারি, কিন্তু তাহাতে কি ফল হইবে? কে তোমাকে সাহায্য করিবে? মৃত্যুর হাত কে এড়াইতে পারিয়াছে? কে তোমাকে মৃত্যু হইতে উদ্ধার করিবে? তোমার উদ্ধারসাধন তোমাকেই করিতে হইবে:।

তোমাকে সাহায্য করার সাধ্য অপর কাহারও নাই। তুমি নিজেই তোমার পরম শত্রু, আবার তুমিই তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আত্মাকে জানো; উঠ, জাগো; ভীত হইও না। দুঃখ ও দুর্বলতার মধ্যে আত্মাকে প্রকাশ কর,—প্রথমে ইহা যতই ক্ষীণ ও অনুভবের অতীত বলিয়া মনে হউক না কেন। তোমার এমন সাহস হইবে যে, তুমি সিংহগর্জনে বলিয়া উঠিবে : আমিই আত্মা , আমিই ব্রহ্ম। আমি পুরুষ নই, স্ত্রীও নই; দেবতা নই, দৈত্যও নই, কোন প্রাণী বা বৃক্ষাদিও নই।

আমি ধনী নই, দরিদ্রও নই, পণ্ডিত নই, মূর্খও নই। আমার স্বরূপের তুললায় এই-সকল উপাধি অতি তুচ্ছ। আমি পরমাত্মা, আমি ব্রহ্ম। ঐ যে দেদীপ্যমান চন্দ্র-সূর্য গ্রহনক্ষত্র-নিচয় দেখিতেছে, উহারা আমার প্রভায় উদ্ভাসিত হইয়াই আলোক বিস্তার করিতেছে। অগ্নির যে রূপ, তাহা আমিই; বিশ্বের যে শক্তি, তাহাও আমি, কারণ আমিই পরমাত্মা, আমিই ব্রহ্ম।

যে মনে করে, ‘আমি ক্ষুদ্র’, সে ভ্রান্ত, কারণ আমিই তো একমাত্র সত্তা, আমিই সব কিছু। আমি বলি, ‘সূর্য আছে’, তাই সূর্য আছে; আমি বলি, ‘পৃথিবী আছে’, তাই পৃথিবী আছে। আমার উপর নির্ভর না করিয়া উহাদের কেহই থাকিতে পারে না, কারণ আমি সচ্চিদান্দ, আমি ব্রহ্ম, আমি চিরসুখী, চিরপবিত্র, চিরসুন্দর। বাহিরের ঐ সূর্য যেমন মানুষের দৃষ্টিশক্তির কারণ হইয়াও কাহারও চোখের দোষে দূষিত হয় না, তেমনি জগতের ভাল-মন্দ আমার স্বরূপকে স্পর্শ করে না।

আমি সকল ইন্দ্রিয় এবং সকল বিষয়ের ভিতর দিয়া কাজ করিতেছি, কিন্তু কোন ইন্দ্রিয় বা কোন বস্তুর দোষ আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না। আমি কোন নিয়ম বা কর্মের অধীন নই। আমি কর্মাধ্যক্ষ। আমি চিরদিন ছিলাম, চিরদিন আছি।

যতদিন না তোমার অন্তর হইতে নিজের ক্ষুদ্রতা দুর্বলতা দুঃখ এবং অমঙ্গলের ভয়াবহ স্বপ্ন চিরতরে তিরোহিত হয়, ততদিন জাগরণে ও স্বপ্নে ইহা চিন্তা কর এবং তখনই পরম সত্য তোমার নিকট আর ক্ষণকালও আত্মগোপন করিয়া থাকিবে না।

আমাদেরই জনৈক কবি বলিয়াছেন—আমার প্রকৃত সুখ জাগতিক পদার্থে নাই; পতি-পত্নী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি কোন কিছু আমাকে আনন্দ দিতে পারে নাই। আমি অনন্ত নীলাকাশের মতো। কত বিচিত্র মেঘ আকাশের বুকে খেলা করিয়া মুহূর্তমধ্যে দূরে চলিয়া যায়। আবার সেই একই নীলাকাশ। সুখ-দুঃখ শুভাশুভ আত্মাকে আবৃত করিয়া আমাকে মুহূর্তের জন্য অভিভূত করিতে পারে; কিন্তু ইহারা স্থায়ী নয়, অল্পক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য হইয়া যায়।

আমি সকল অবস্থাতেই আছি। আমি নিত্য, আমি অপরিণামী, আমি চির-ভাস্বর। দুঃখ আসে আসুক, আমি জানি উহা সসীম; অতএব উহার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। অশুভ আসে আসুক, আমি জানি উহাও বিনষ্ট হইবে; কেবল উহাও সসীম, ক্ষণস্থায়ী। একমাত্র আমিই অসীম, আমাকে কোন কিছুই স্পর্শ করিতে পারে না। আমি চিরন্তন, অসীম, অব্যয় পরমাত্মা।

এস, আমরা এই জ্ঞানামৃত পান করি; ইহাই আমাদিগকে অমৃতত্বে পৌঁছাইয়া দিবে। ইহাই অক্ষয় ব্রহ্মলাভের পথ। মা ভৈঃ। আমরা পাপী, আমরা সসীম, আমারা মৃত্যুর অধীন—একথা বিশ্বাস করিও না। ইহা সত্য নয়।

‘আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করিবে, মনন করিবে, নিদিধ্যাসন করিবে।’ হাত যখন কাজ করিবে, মন যেন তখন জপ করিতে থাকে, ‘আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম।’

যতদিন না এই সত্য তোমার অস্থি-মাংসের সহিত মিশিয়া যায়, যতদিন না তোমার অন্তর হইতে নিজের ক্ষুদ্রতা দুর্বলতা দুঃখ এবং অমঙ্গলের ভয়াবহ স্বপ্ন চিরতরে তিরোহিত হয়, ততদিন জাগরণে ও স্বপ্নে ইহা চিন্তা কর এবং তখনই পরম সত্য তোমার নিকট আর ক্ষণকালও আত্মগোপন করিয়া থাকিবে না।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!