ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

[১৮৯৪, ১৫ ফেব্রুআরী আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরের ইউনিটারিয়ান চার্চে প্রদত্ত ভাষণের সারাংশ]

ভগবানকে আমরা মানি, যথার্থই তাঁকে চাই বলে নয়-নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁকে দরকার বলে। প্রেম হচ্ছে এমন কিছু, যা সম্পূর্ণ স্বার্থহীন; এ প্রেম যাঁকে অর্পিত হয়, শুধু তাঁরই মহিমা ও স্তুতি ছাড়া তাতে অন্য কোন চিন্তার স্থান নেই। প্রেমের স্বভাব হচ্ছে প্রণতি আর পূজা, প্রতিদানে প্রেম কিছু চায় না। শুধু ভালবাসাই হল বিশুদ্ধ প্রেমের একমাত্র আবেদন।

একজন হিন্দু-সাধিকা২৬ সম্পর্কে এ-রকম শোনা যায়-বিবাহের পর তিনি তাঁর পতি রাজাকে বলেছিলেন, ‘ইতিপূর্বেই আমি বিবাহিতা।’ রাজা জিজ্ঞাসা করেন, ‘কার সঙ্গে?’ সাধিকা উত্তর দেন, ‘ভগবানের সঙ্গে।’ দীন-দরিদ্রের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তিনি তাদের শিখিয়েছিলেন ঈশ্বরকে গভীরভাবে ভালবাসতে। তাঁর হৃদয়ের ব্যাকুলতা কত গভীর ছিল তা তাঁর প্রার্থনাগীতিগুলির একটি হতে জানা যায়ঃ ‘আমি ধন মান কিছুই চাই না-এমন কি মুক্তিও চাই না; প্রভু, তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে শত শত নরক-যাতনাও দিতে পার-তথাপি শুধু তোমাতেই আমার অনুরাগ দাও।’

আমাদের প্রাচীন ভাষা এই সাধিকার মধুর ভজনাবলীতে পূর্ণ। তাঁর মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এল, তখন এক নদীর তীরে গিয়ে তিনি সমাধিতে নিমগ্ন হলেন। এক মর্মস্পর্শী সঙ্গীতে তিনি ব্যক্ত করে যান যে, তাঁর প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলনের জন্যই তিনি যাত্রা করেছেন।

পুরুষেরা ধর্মের দার্শনিক বিচারে সমর্থ। নারী স্বভাবতঃ ভক্তিপ্রবণ; সে ভগবানকে ভালবাসে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, বুদ্ধি দিয়ে নয়। সলোমনের প্রার্থনা-সঙ্গীতগুলি বাইবেলের চমৎকার অংশগুলির অন্যতম। এগুলির ভাবও অনেকটা ঐ হিন্দু-সাধিকার ভজনগীতের মত অনুরাগে পূর্ণ। তথাপি শুনেছি, এই অতুলনীয় সঙ্গীতগুলি খ্রীষ্টানরা নাকি বাইবেল থেকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। এর একটা কৈফিয়তও আমি শুনেছি-সলোমন নাকি কোন যুবতীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং যুবতীর কাছ থেকে তাঁর রাজোচিত প্রেমের প্রতিদান চেয়েছিলেন।

যুবতী অন্য কোন যুবককে ভালবাসত, সলোমনের সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখতে চাইত না। এ কৈফিয়তটি কারও কারও কাছে হয়তো ভালই লাগবে, কারণ এ-সব ভজনগীতের অন্তর্নিহিত ভাব-অলৌকিক ভগবৎ-প্রেম-তারা বুঝতে অক্ষম। ভারতের ভগবদ্‌ভক্তি অন্যান্য দেশের ভগবদ্‌ভক্তি থেকে কিছু স্বতন্ত্র, কারণ যে-দেশের তাপমান-যন্ত্র শূন্যের নীচে ৪০ ডিগ্রী সূচিত করে, সে দেশের লোকের প্রকৃতিও কিছু ভিন্ন ধরনের হয়।

যে-জলবায়ুতে বাইবেল রচিত হয়েছিল বলে শোনা যায়, সেখানকার লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা-যারা ঈশ্বরোপাসনার চেয়ে সঙ্গীতগুলিতেও ব্যক্ত হৃদয়াবেগ দিয়ে সর্বসিদ্ধিপ্রদ অর্থের পূজা করতেই অধিকতর অভ্যস্ত-সেই-সব আবেগশূন্য পাশ্চাত্য জাতিগুলি থেকে পৃথক্ ছিল। ‘এতে আমার কি লাভ?’-এটাই যেন ভগবদ্‌ভক্তির ভিত্তি। প্রার্থনাদিতে তারা শুধু স্বার্থপূর্ণ বিষয়গুলিই কামনা করে।

লোকে গির্জায় যায় গড্ডলিকা-প্রবাহের মত; তারা ভগবানকে স্বেচ্ছায় বরণ করে না, তারণ তাঁর সঙ্গে তো তাদের প্রয়োজন বা স্বার্থের সম্বন্ধমাত্র। অধিকাংশ লোকই একরকম প্রচ্ছন্ন নাস্তিক, অথচ নিজেদের খুব ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকে।

খ্রীষ্টানরা সর্বদা চান, ভগবান্ তাঁদের কিছু না কিছু দিন। সর্বশক্তিমান্‌ ঈশ্বরের সিংহাসন-সমীপে তাঁরা ভিক্ষুকরূপে উপস্থিত হন। গল্পে আছে-এক ভিক্ষুক কোন সম্রাটের কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী হয়েছিল। ভিক্ষুক যখন অপেক্ষা করছিল, সম্রাটের তখন প্রার্থনার সময়। সম্রাট্ প্রার্থনা করছিলেনঃ ‘হে জগদীশ্বর, আমাকে তুমি আরও ঐশ্বর্য দাও, আরও শক্তি দাও, আরও বড় সাম্রাজ্য দাও।’ ভিক্ষুক এই শুনে চলে যাচ্ছিল। সম্রাট্ পিছনে ফিরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘চলে যাচ্ছ কেন?’ উত্তর হল, ‘ভিক্ষুকের কাছে আমি ভিক্ষা চাই না।’

যে তীব্র আধ্যাত্মিক উন্মাদনা মহম্মদের হৃদয় আলোড়িত করেছিল, অনেকের পক্ষেই তা বোঝা কঠিন। তিনি ধুলোয় গড়াগড়ি দিতেন এবং বিরহ-যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। যে-সব লোকোত্তর পুরুষ এরূপ তীব্র হৃদয়াবেগ অনুভব করেছেন, লোকে তাঁদের বায়ুরোগগ্রস্ত বলেছে। অহং-শূন্যতাই ঈশ্বরানুরাগের প্রধান লক্ষণ; ধর্ম আজকাল মানুষের এক-রকম শখ বা বিলাসমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লোকে গির্জায় যায় গড্ডলিকা-প্রবাহের মত; তারা ভগবানকে স্বেচ্ছায় বরণ করে না, তারণ তাঁর সঙ্গে তো তাদের প্রয়োজন বা স্বার্থের সম্বন্ধমাত্র। অধিকাংশ লোকই একরকম প্রচ্ছন্ন নাস্তিক, অথচ নিজেদের খুব ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!