ভবঘুরেকথা
গুপ্তসংঘ

-স্বামী বিবেকানন্দ

এইবার প্রতীকোপাসনা ও প্রতিমাপূজার বিষয় আলোচনা করিব। প্রতীক অর্থে যে- সকল বস্তু ব্রহ্মের পরিবর্তে উপাসনার যোগ্য। প্রতীকে ভগবদুপাসনার অর্থ কি? ভগবান্ রামানুজ বলিয়াছেনঃ ‘ব্রহ্ম নয়, এমন বস্তুতে ব্রহ্মবুদ্ধি করিয়া ব্রহ্মের অনুসন্ধানকে প্রতীকোপাসনা বলে।’৩৪ শঙ্কারাচার্য বলিয়াছেনঃ ‘মনকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করিবে-ইহা আধ্যাত্মিক, আকাশ ব্রহ্ম-ইহা আধিদৈবিক। মন আধ্যাত্মিক প্রতীক, এবং আকাশ বাহ্য প্রতীক-এই উভয়কেই ব্রহ্মস্বরূপে উপাসনা করিতে হইবে।

এইরূপ আদিত্যই ব্রহ্ম, ইহাই আদেশ…যিনি নামকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন-ইত্যাদি স্থলে প্রতীকোপাসনা সম্বন্ধে সংশয় হয়।’৩৫ প্রতীক শব্দের অর্থ-বাহিরের দিকে যাওয়া, আর প্রতীকোপাসন-অর্থে ব্রহ্মের পরিবর্তে এমন এক বস্তুর উপাসনা, যাহা একাংশে অথবা অনেকাংশে ব্রহ্মের খুব সন্নিহিত, কিন্তু ব্রহ্ম নয়। শ্রুতিতে বর্ণিত প্রতীকের ন্যায় পুরাণ-তন্ত্রেও বহু প্রতীকের বর্ণনা আছে। সমুদয় পিতৃ-উপাসনা ও দেবোপাসনা এই প্রতীকোপাসনার অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।

অর্থাৎ যেখানে প্রতীকের সহায়তায় সর্বব্যাপী ব্রহ্মের উপাসনা করা হয়, প্রতীককে প্রতীকমাত্র না দেখিয়া জগৎকারণরূপে চিন্তা করা হয়, সেখানে এইরূপ উপাসনা বিশেষ উপকারী। শুধু তাই নয়, প্রবর্তকদিগের পক্ষে উহা একেবারে অনিবার্যরূপে প্রয়োজনীয়। সুতরাং যখন কোন দেবতাকে অথবা অন্য প্রাণীকে ঐ দেবতা বা প্রাণী-রূপেই উপাসনা করা হয়, তখন এরূপ উপাসনাকে একটি আনুষ্ঠানিক কর্মমাত্র বলা যাইতে পারে।

এখন কথা এইঃ ঈশ্বরকে-কেবল ঈশ্বরকে উপাসনা করার নামই ভক্তি। দেব, পিতৃ অথবা অন্য কোন উপাসনা ভক্তি-শব্দবাচ্য হইতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন উপাসনা কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত; উহা উপাসককে কেবল কোন প্রকার স্বর্গভোগরূপ বিশেষ ফল প্রদান করে, কিন্তু উহাতে ভক্তির উদয় হয় না-উহা মুক্তিও দিতে পারে না। সুতরাং একটি কথা বিশেষরূপে মনে রাখা আবশ্যক। দার্শনিক দৃষ্টিতে পরব্রহ্ম হইতে জগৎকারণের উচ্চতম ধারণা আর হইতে পারে না।

প্রতীকোপাসক কিন্তু অনেক স্থলে এই প্রতীককে ব্রহ্মের আসনে বসাইয়া উহাকে আপন অন্তরাত্মা বা অন্তর্যামিরূপে চিন্তা করেন, এরূপ স্থলে সেই উপাসক সম্পৃর্ণ বিপথে চালিত হন, কারণ প্রকৃত প্রস্তাবে কোন প্রতীকই উপাসকের আত্মা হইতে পারে না। কিন্তু যেখানে ব্রহ্মই উপাস্য, আর প্রতীক কেবল উহার প্রতিনিধিস্বরূপ অথবা উহার উদ্দীপক কারণমাত্র।

অর্থাৎ যেখানে প্রতীকের সহায়তায় সর্বব্যাপী ব্রহ্মের উপাসনা করা হয়, প্রতীককে প্রতীকমাত্র না দেখিয়া জগৎকারণরূপে চিন্তা করা হয়, সেখানে এইরূপ উপাসনা বিশেষ উপকারী। শুধু তাই নয়, প্রবর্তকদিগের পক্ষে উহা একেবারে অনিবার্যরূপে প্রয়োজনীয়। সুতরাং যখন কোন দেবতাকে অথবা অন্য প্রাণীকে ঐ দেবতা বা প্রাণী-রূপেই উপাসনা করা হয়, তখন এরূপ উপাসনাকে একটি আনুষ্ঠানিক কর্মমাত্র বলা যাইতে পারে।

অতএব উহা হইতে মুক্তি বা ভক্তিলাভ হইতে পারে না। এই প্রকার প্রতিমাপূজাতে সাধক সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর ভিন্ন অন্য বস্তুতে আত্মসমর্পণ করে, সুতরাং মূর্তি বা কবর, মন্দির বা স্মৃতিস্তম্ভের এইরূপ ব্যবহারই প্রকৃত পুতুলপূজা। কিন্তু তাহা হইলেও উহা কোন পাপকর্ম বা অন্যায় নয়, উহা একটি অনুষ্ঠান-একটি কর্মমাত্র; উপাসকেরা অবশ্যই উহার ফল পাইয়া থাকেন।

আর উহা একটি ‘বিদ্যা’ বলিয়া উপাসক ঐ বিশেষ বিদ্যার ফল লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু যখন কোন দেবতা বা অন্য কেহ ব্রহ্মরূপে দৃষ্ট ও উপাসিত হন, তখন উহা সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বরের উপাসনার সহিত তুল্য হইয়া পড়ে। ইহা হইতেই বুঝা যায়, অনেক স্থলে শ্রুতি, স্মৃতি-সর্বত্রই কোন দেবতা, মহাপুরুষ বা অন্য কোন অলৌকিক পুরুষের ব্যক্তিগত প্রকৃতি ভুলিয়া গিয়া তাঁহাদিগকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করা হয় কেন। ব্যাখ্যাস্বরূপে অদ্বৈতবাদী বলেন, ‘নামরূপ বাদ দিলে সকল বস্তুই কি ব্রহ্ম নয়?’

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বলেন, ‘সেই প্রভুই কি সকলের অন্তরাত্মা নন?’ শঙ্কর তাঁহার ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলিয়াছেন, ‘আদিত্যাদির উপাসনার ফল ব্রহ্মই দেন, কারণ তিনিই সকলের অধ্যক্ষ। যেমন প্রতিমাদিতে বিষ্ণু-আদি দৃষ্টি আরোপ করিতে হয়, তেমনি প্রতীকেও ব্রহ্মদৃষ্টি আরোপ করিতে হয়, সুতরাং এখানে প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই উপাসনা করা হইতেছে বুঝিতে হইবে।’৩৬

প্রতীক সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলা হইল, প্রতিমা সম্বন্ধেও সেই-সকল কথা খাটিবে, অর্থাৎ যদি প্রতিমা কোন দেবতা বা সাধুসন্তের সূচক হয়, তাহা হইলে সেইরূপ উপাসনাকে ভক্তি বলা যাইবে না, সুতরাং উহা হইতে মুক্তিলাভ হইবে না। কিন্তু উহা সেই এক ঈশ্বরের সূচক হইলে উহার উপাসনায় ভক্তি ও মুক্তি-উভয়ই লাভ হয়।

জগতের প্রধান প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে বেদান্ত, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রীষ্টধর্মের কোন কোন সম্প্রদায় সাধকদের সহায়তার জন্য অবাধে পূর্বোক্তভাবে প্রতিমার সদ্ব্যবহার করিয়া থাকেন; কেবল মুসলমান ও প্রোটেস্ট্যাণ্ট ধর্ম এই সহায়তা অস্বীকার করেন। তাহা হইলেও মুসলমানেরা তাঁহাদের সাধুসন্ত ও শহীদগণের কবর অনেকটা প্রতীক বা প্রতিমারূপেই ব্যবহার করিয়া থাকেন।

প্রোটেস্ট্যাণ্টরা ধর্মে বাহ্য সহায়তার আবশ্যকতা উড়াইয়া দিতে গিয়া ক্রমশঃ আধ্যাত্মিক ভাব হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িতেছেন, আর আজকাল খাঁটি প্রোটেস্ট্যাণ্টের সহিত অগস্ট কম্‌তের চেলা বা নীতিমাত্র-প্রচারক ও অজ্ঞেয়বাদীদের কোন প্রভেদ নাই। আবার খ্রীষ্ট বা ইসলাম ধর্মে প্রতিমাপূজার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকুতে কেবল প্রতীক বা প্রতিমাই উপাসিত হয়, ব্রহ্মদৃষ্টিসৌকর্যার্থে নয়। সুতরাং উহা বড়জোর কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত মাত্র।

অতএব উহা হইতে মুক্তি বা ভক্তিলাভ হইতে পারে না। এই প্রকার প্রতিমাপূজাতে সাধক সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর ভিন্ন অন্য বস্তুতে আত্মসমর্পণ করে, সুতরাং মূর্তি বা কবর, মন্দির বা স্মৃতিস্তম্ভের এইরূপ ব্যবহারই প্রকৃত পুতুলপূজা। কিন্তু তাহা হইলেও উহা কোন পাপকর্ম বা অন্যায় নয়, উহা একটি অনুষ্ঠান-একটি কর্মমাত্র; উপাসকেরা অবশ্যই উহার ফল পাইয়া থাকেন।

…………………………………..  
৩৪ অব্রহ্মণি ব্রহ্মদৃষ্ট্যাঽনুসন্ধানম্। রামানুজ ভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র, ৪।১।৫    
৩৫
মনো ব্রহ্মেত্যুপাসীতেত্যধ্যাত্মম্। অথাধিদৈবতমাকাশো ব্রহ্মেতি। তথা আদিত্যো ব্রহ্মেত্যাদেশঃ। স যো নামব্রহ্মেত্যুপাস্তে ইত্যেবমাদিষু প্রতীকোপাসনেষু সংশয়ঃ।–শাঙ্করভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র, ৪।১।৪। সংশয়ের উত্তর পরবর্তী সূত্রের ভাষ্যে প্রদত্ত হইয়াছে।   
৩৬
ফলন্ত…আদিত্যাদ্যুপাসনেঽপি ব্রহ্মৈব দাস্যতি সর্বাধ্যক্ষত্বাৎ।…ঈদৃশং চাত্র ব্রহ্মণ উপাস্যত্বং যৎ প্রতীকেষু তদ্‌দৃষ্ট্যধ্যারোপণং প্রতিমাদিষু ইব বিষ্ণ্বাদীনাম্।–শঙ্করভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র ৪।১।৫

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!