ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

[স্বামীজী কলিকাতায় থাকাকালে অধিকাংশ সময়ই তদানীন্তন আলমবাজারের মঠে বাস করিতেন। এই সময় কলিকাতাবসী কয়েকজন যুবক, যাঁহারা পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিলেন, স্বামীজীর নিকট ব্রহ্মচর্য বা সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হন। স্বামীজী ইঁহাদিগকে ধ্যান-ধারণা এবং গীতা বেদান্ত প্রভৃতি শিক্ষা দিয়া ভবিষ্যৎ কর্মের উপযুক্ত করিতে লাগিলেন। একদিন গীতাব্যাখ্যাকালে তিনি যে কথাগুলি বলিয়াছিলেন, তাহার সারাংশ জনৈক ব্রহ্মচারী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়; তাহাই এখানে ‘গীতাতত্ত্ব’ নামে সঙ্কলিত হইল।]

গীতাগ্রন্থখানি মহাভারতের অংশবিশেষ। এই গীতা বুঝিতে চেষ্টা করিবার পূর্বে কয়েকটি বিষয় জানা আবশ্যক। প্রথম-গীতাটি মহাভারতের ভিতর প্রক্ষিপ্ত অথবা মহাভারতেরই অংশবিশেষ, অর্থাৎ উহা বেদব্যাস-প্রণীত কিনা? দ্বিতীয়-কৃষ্ণ নামে কেহ ছিলেন কিনা? তৃতীয়-যে যুদ্ধের কথা গীতায় বর্ণিত হইয়াছে, তাহা যথার্থ ঘটিয়াছিল কিনা? চতুর্থ-অর্জুনাদি যথার্থ ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা? প্রথমতঃ সন্দেহ হইবার কারণগুলি কি, দেখা যাক।

প্রথম প্রশ্ন-

বেদব্যাস নামে পরিচিত অনেকে ছিলেন, তন্মধ্যে বাদরায়ণ ব্যাস বা দ্বৈপায়ন ব্যাস-কে ইহার প্রণেতা? ব্যাস একটি উপাধিমাত্র। যিনি কোন পুরাণাদি শাস্ত্র রচনা করিয়াছেন, তিনিই ‘ব্যাস’ নামে পরিচিত। যেমন বিক্রমাদিত্য-এই নামটিও একটি সাধারণ নাম। শঙ্করাচার্য ভাষ্য রচনা করিবার পূর্বে গীতা-গ্রন্থখানি সর্বসাধারণে ততদূর পরিচিত ছিল না। তাঁহার পরেই গীতা সর্বসাধারণের মধ্যে বিশেষরূপে পরিচিত হয়। অনেকে বলেন, গীতার বোধায়ন-ভাষ্য পূর্বে প্রচলিত ছিল।

এ-কথা প্রমাণিত হইলে গীতার প্রাচীনত্ব ও ব্যাসকর্তৃত্ব কতকটা সিদ্ধ হয় বটে, কিন্তু বেদান্তদর্শনের যে বোধায়ন-ভাষ্য ছিল বলিয়া শুনা যায়, যদবলম্বনে রামানুজ ‘শ্রীভাষ্য’ প্রস্তুত করিয়াছেন-বলিয়াছেন, শঙ্করের ভাষ্যের মধ্যে উদ্ধৃত যে ভাষ্যের অংশবিশেষ উক্ত বোধায়ন-কৃত বলিয়া অনেকে অনুমান করেন, যাহার কথা লইয়া দয়ানন্দ স্বামী প্রায় নাড়াচাড়া করিতেন, তাহা আমি সমুদয় ভারতবর্ষ খুঁজিয়াও এ পর্যন্ত দেখিতে পাই নাই।

শুনিতে পাওয়া যায়, রামানুজও অপর লোকের হস্তে একটি কীটদষ্ট পুঁথি দেখিয়া তাহা হইতে তাঁহার ভাষ্য রচনা করেন। বেদান্তের বোধায়ন-ভাষ্যই যখন এতদূর অনিশ্চয়ের অন্ধকারে, তখন গীতাসম্বন্ধে তৎকৃত ভাষ্যের উপর কোন প্রমাণ স্থাপন করিবার চেষ্টা বৃথা প্রয়াসমাত্র। অনেকে এইরূপ অনুমান করেন যে, গীতাখানি শঙ্করাচার্য-প্রণীত। তাঁহাদের মতে-তিনি উহা প্রণয়ন করিয়া মহাভারতের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন-

কৃষ্ণসম্বন্ধে সন্দেহ এইঃ ছান্দোগ্য উপনিষদে এক স্থলে পাওয়া যায়, দেবকীপুত্র কৃষ্ণ ঘোরনামা কোন ঋষির নিকট উপদেশ গ্রহণ করেন। মহাভারতের কৃষ্ণ দ্বারকার রাজা, আর বিষ্ণুপুরাণে গোপীদের সহিত বিহারকারী কৃষ্ণের কথা বর্ণিত আছে। আবার ভাগবতে কৃষ্ণের রাসলীলা বিস্তারিতরূপে বর্ণিত আছে। অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে ‘মদনোৎসব’ নামে এক উৎসব প্রচলিত ছিল। সেইটিকেই লোকে দোলরূপে পরিণত করিয়া কৃষ্ণের ঘাড়ে চাপাইয়াছে।

রাসলীলাদিও যে ঐরূপে চাপানো হয় নাই, কে বলিতে পারে? পূর্বকালে আমাদের দেশে ঐতিহাসিক সত্যানুসন্ধান করিবার প্রবৃত্তি অতি সামান্যই ছিল। সুতরাং যাঁহার যাহা ইচ্ছা, তিনি তাহাই বলিয়া গিয়াছেন। আর পূর্বকালে লোকের নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা খুব অল্পই ছিল। এরূপ অনেক হইয়াছে, যেখানে একজন কোন গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়া গুরু অথবা অপর কাহারও নামে চালাইয়া দিয়া গেলেন। এইরূপ স্থলে সত্যানুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিকের বড় বিপদ।

পূর্বকালে ভূগোলের জ্ঞানও কিছুমাত্র ছিল না-অনেকে কল্পনাবলে ইক্ষুসমুদ্র, ক্ষীরসমুদ্র দধিসমুদ্রাদি রচনা করিয়াছেন। পুরাণে দেখা যায়, কেহ অযুত বর্ষ, কেহ লক্ষ বর্ষ জীবনধারণ করিতেছেন; কিন্তু আবার বেদে পাই, ‘শতায়ুর্বৈ পুরুষঃ’। আমরা এখানে কাহাকে অনুসরণ করিব? সুতরাং কৃষ্ণ সম্বন্ধে সঠিক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত করা একরূপ অসম্ভব। লোকের একটা স্বভাবই এই যে, কোন মহাপুরুষের প্রকৃত চরিত্রের চতুর্দিকে তাহারা নানাবিধ অস্বাভাবিক কল্পনা করে।

কৃষ্ণ সম্বন্ধে এই বোধ হয় যে, তিনি একজন রাজা ছিলেন। ইহা খুব সম্ভব এই জন্য যে, প্রাচীন কালে আমাদের দেশে রাজারাই ব্রহ্মজ্ঞান-প্রচারে উদ্যোগী ছিলেন। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা আবশ্যক-গীতাকার যিনিই হউন, গীতার মধ্যে যে শিক্ষা, সমুদয় মহাভারতের মধ্যেও সেই শিক্ষা দেখিতে পাই। তাহাতে বোধ হয়, সেই সময় কোন মহাপুরুষ নূতনভাবে সমাজে এই ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার করিয়াছিলেন।

আরও দেখা যায়, প্রাচীন কালে এক-একটি সম্প্রদায় উঠিয়াছে-তাহার মধ্যে এক-একখানি শাস্ত্র প্রচারিত হইয়াছে। কিছুদিন পরে সম্প্রদায় ও শাস্ত্র উভয়ই লোপ পাইয়াছে, অথবা সম্প্রদায়টি লোপ পাইয়াছে, শাস্ত্রখানি রহিয়া গিয়াছে। সুতরাং অনুমান হয়, গীতা সম্ভবতঃ এমন এক সম্প্রদায়ের শাস্ত্র, যাহা এক্ষণে লোপ পাইয়াছে, কিন্তু যাহার মধ্যে খুব উচ্চ ভাবসকল নিবিষ্ট ছিল।

তৃতীয় প্রশ্ন-

কুরুপাঞ্চাল-যুদ্ধের বিশেষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না, তবে কুরুপাঞ্চাল নামে যুদ্ধ যে সংঘটিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। আর এক কথা-যুদ্ধের সময় এত জ্ঞান, ভক্তি ও যোগের কথা আসিল কোথা হইতে? আর সেই সময় কি কোন সাঙ্কেতিকলিপি-কুশল ব্যক্তি (Short-hand Writer) উপস্থিত ছিলেন, যিনি সে-সমস্ত টুকিয়া লইয়াছিলেন? কেহ কেহ বলেন, এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ রূপকমাত্র। ইহার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য-সদসৎপ্রবৃত্তির সংগ্রাম। এ অর্থও অসঙ্গত না হইতে পারে।

চতুর্থ প্রশ্ন-

অর্জুন প্রভৃতির ঐতিহাসিকতা-সম্বন্ধে সন্দেহ এই যে-‘শতপথব্রাহ্মণ’ অতি প্রাচীন গ্রন্থ, উহাতে সমস্ত অশ্বমেধযজ্ঞকারিগণের নামের উল্লেখ আছে। কিন্তু সে স্থলে অর্জুনাদির নামগন্ধও নাই, অথচ পরীক্ষিৎ জন্মেজয়ের নাম উল্লিখিত আছে। এ দিকে মহাভারতাদিতে বর্ণনা-যুধিষ্ঠির অর্জুনাদি অশ্বমেধযজ্ঞ করিয়াছিলেন।

সত্য বিশ্বাস করা। কুসংস্কার মানুষকে এতদূর আবদ্ধ করিয়া রাখে যে, যীশুখ্রীষ্ট মহম্মদ প্রভৃতি মহাপুরুষগণও অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করিতেন। তোমাদিগকে সত্যের উপর লক্ষ্য রাখিতে হইবে, কুসংস্কার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিতে হইবে।

এখানে একটি কথা বিশেষরূপে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এই-সকল ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধানের সহিত আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্থাৎ ধর্মসাধনা-শিক্ষার কোন সংস্রব নাই। ঐগুলি যদি আজই সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হয়, তাহা হইলেও আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। তবে এত ঐতিহাসিক গবেষণার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন আছে; আমাদিগকে সত্য জানিতে হইবে, কুসংস্কারে আবদ্ধ থাকিলে চলিবে না। এদেশে এ-সম্বন্ধে সামান্য ধারণা আছে।

অনেক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এই যে, কোন একটি ভাল বিষয় প্রচার করিতে হইলে একটি মিথ্যা বলিলে যদি সেই প্রচারের সাহায্য হয়, তাহাতে কিছুমাত্র দোষ নাই, অর্থাৎ The end justifies the means; এই কারণে অনেক তন্ত্রে ‘পার্বতীং প্রতি মহাদেব উবাচ’ দেখা যায়। কিন্তু আমাদের উচিত সত্যকে ধারণা করা, সত্য বিশ্বাস করা। কুসংস্কার মানুষকে এতদূর আবদ্ধ করিয়া রাখে যে, যীশুখ্রীষ্ট মহম্মদ প্রভৃতি মহাপুরুষগণও অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করিতেন। তোমাদিগকে সত্যের উপর লক্ষ্য রাখিতে হইবে, কুসংস্কার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিতে হইবে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!