ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

ভক্তি

[৯ নভেম্বর, ১৮৯৭, সন্ধ্যা ৬।। ঘটিকায় গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের তাঁবুতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে স্বামীজীর বক্তৃতা হয়। ইহাই লাহোরে স্বামীজীর দ্বিতীয় বক্তৃতা। লালা বালমুকুন্দ সভাপতি ছিলেন। লাহোর হইতে প্রকাশিত ‘ট্রিবিউন’-পত্রে বক্তৃতার সারাংশ প্রকাশিত হয়।]

উপনিষদসমূহের গম্ভীরনাদী প্রবাহের মধ্যে একটি শব্দ দূরাগত প্রতিধ্বনির ন্যায় আমাদের নিকট উপস্থিত হয়। যদিও উহা ত্রমশঃ বৃদ্ধি পাইয়াছে, তথাপি সমগ্র বেদান্ত-সাহিত্যে উহা স্পষ্ট হইলেও তত প্রবল নহে। উপনিষদগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য মনে হয়-যেন আমাদের সম্মুখে ভূমার ভাব ও চিত্র উপস্থিত করা। তথাপি এই অদ্ভুত ভাবগাম্ভীর্যের পশ্চাতে মধ্যে মধ্যে আমরা কবিত্বেরও আভাস পাই; যথা- ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্ নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোয়ঽয়মগ্নিঃ।৫৪ সেখানে সূর্য প্রকাশ পায় না, চন্দ্রতারকাও নহে, এই-সব বিদ্যুৎও সেখানে প্রকাশ পায় না, অগ্নির তো কথাই নাই।

এই অপূর্ব পঙ্‌ক্তিদ্বয়ের হৃদয়স্পর্শী কবিত্ব শুনিতে শুনিতে আমরা যেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ হইতে, এমন কি মনোরাজ্য হইতে দূরে অতি দূরে নীত হই-এমন এক জগতে নীত হই, যাহা কোন কালে বুঝিবার উপায় নাই; অথচ তাহা সর্বদা আমাদের নিকটেই রহিয়াছে। এই মহান্ ভাবের পিছনেও ছায়ার ন্যায় অনুগামী আর একটি মহান্ ভাব আছে, যাহা মানবজাতির অধিকতর গ্রহণযোগ্য, লোকের প্রাত্যহিক জীবনে অনুসরণের অধিকতর উপযোগী, যাহা মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগে প্রবেশ করান যাইতে পারে। এই ভক্তিবীজ ক্রমশঃ পুষ্ট হইয়াছে এবং পরবর্তী কালে পূর্ণভাবে ও সুস্পষ্ট ভাষায় প্রচারিত হইয়াছে-আমরা পুরাণকে লক্ষ্য করিয়া এ-কথা বলিতেছি।

পুরাণেই ভক্তির চরম আদর্শ দেখিতে পাওয়া যায়। ভক্তিবীজ পূর্বাবধি বর্তমান; সংহিতাতেও উহার পরিচয়, উপনিষদে কিঞ্চিৎ অধিক বিকাশ, কিন্তু পুরাণে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। সুতরাং ভক্তি কী বুঝিতে হইলে আমাদের এই পুরাণগুলি বুঝা আবশ্যক। পুরাণের প্রামাণিকত্ব লইয়া ইদানীং বহু বাদানুবাদ হইয়া গিয়াছে। এখান হইতে ওখান হইতে অনেক অংশ লইয়া সমালোচনা হইয়াছে, যেগুলির ঠিক অর্থ পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখান হইয়াছে, ঐ অংশগুলি আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে টিকিতে পারে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই বাদানুবাদ ছাড়িয়া দিয়া, পৌরাণিক উক্তিগুলির বৈজ্ঞানিক ভৌগোলিক ও জ্যোতিষিক সত্যাসত্য প্রভৃতি ছাড়িয়া দিয়া একটি জিনিষ আমরা নিশ্চিতরূপে দেখিতে পাই; প্রায় সকল পুরাণেই আগা হইতে গোড়া পর্যন্ত তন্ন তন্ন করিয়া আলোচনা করিলে সর্বত্র এই ভক্তিবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। সাধু-মহাত্মা ও রাজর্ষিগণের চরিত্র-বর্ণনমুখে উহার পুনঃপুনঃ উল্লেখ ও আলোচনা করা হইয়াছে এবং দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। সৌন্দর্যের মহান্ আদর্শের-ভক্তির আদর্শের দৃষ্টান্তসমূহ বিবৃতি করাই যেন পুরাণগুলির প্রধান কাজ বলিয়া মনে হয়।

পূর্বেই বলিয়াছি, এই আদর্শ সাধারণ মানবের ধারণার পক্ষে অধিকতর উপযোগী। এমন লোক অতি অল্পই আছেন, যাঁহারা বেদান্তালোকের পূর্ণচ্ছটার মহিমা বুঝিতে ও উহার আদর করিতে পারেন-উহার তত্ত্বগুলি জীবনে পরিণত করা তো দূরের কথা। কারণ প্রকৃত বেদান্তীর প্রথম কার্য ‘অভীঃ’ বা নির্ভীক হওয়া। যদি কেহ বেদান্তী হইবার স্পর্ধা রাখে, তাহাকে হৃদয় হইতে ভয় একেবারে নির্বাসিত করিতে হইবে। আর আমরা জানি, ইহা কত কঠিন। যাঁহারা সংসারের সমুদয় সংস্রব ত্যাগ করিয়াছেন এবং যাঁহাদের এমন বন্ধন খুব কমই আছে, যাহা তাঁহাদিগকে দুর্বল কাপুরুষ করিয়া ফেলিতে পারে, তাঁহারাও অন্তরে অন্তরে অনুভব করেন, সময়ে সময়ে তাঁহারা কত দুর্বল, কত কোমল, কত নিস্তেজ। যাহাদের চারিদিকে বন্ধন, যাহারা অন্তরে বাহিরে শত সহস্র বিষয়ের দাস হইয়া রহিয়াছে, জীবনের প্রতি মুহূর্তেই দাসত্ব যাহাদিগকে ক্রমশঃ নীচের দিকে টানিতেছে, তাহারা আরও বেশী দুর্বল। এরূপ ব্যক্তিদের নিকট পুরাণসমূহ ভক্তির অতি মনোহারিণী বার্তা বহন করিয়া আনে।

তাহাদেরই জন্য ভক্তির এই কোমল ও কবিত্বময় ভাব প্রচারিত, তাহাদেরই জন্য ধ্রুব প্রহ্লাদ ও শত সহস্র সাধুগণের এই-সকল অদ্ভুত ও বিস্ময়কর কাহিনী বিবৃত; এবং এই দৃষ্টান্তগুলির উদ্দেশ্য-লোকে যাহাতে এই ভক্তিকে নিজ নিজ জীবনে বিকাশ করিতে পারে, তাহার পথ প্রদর্শন করা। আপনারা পুরাণগুলির বৈজ্ঞানিক সত্যতায় বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, আপনাদের মধ্যে এমন একজনও নাই, যাঁহার জীবনে প্রহ্লাদ ধ্রুব বা ঐ-সকল প্রসিদ্ধ পৌরাণিক মহাত্মাগণের উপাখ্যানের প্রভাব কিছুমাত্র লক্ষিত হয় না।


যাঁহারা সমুদয় মানবীয় দুর্বলতার অতীত হইয়া প্রকৃত পরমহংসোচিত নির্ভীকতা লাভ করিয়াছেন, যাঁহারা মায়ার বন্ধন, এমন কি স্বাভাবিক অভাবগুলি পর্যন্ত অতিক্রম করিয়াছেন, শুধু সেই বিজয়মহিমায় মণ্ডিত দেবমানবদেরই পুরাণের প্রয়োজন নাই।

আধুনিক কালে পুরাণগুলির প্রভাব শুধু স্বীকার করিলেই চলিবে না, পুরাণের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ পরবর্তী যুগের অবনত বৌদ্ধধর্ম আমাদিগকে যে-ধর্মের অভিমুখে লইয়া যাইতেছিল, পুরাণগুলি আমাদিগকে তদপেক্ষা প্রশস্ততর ও উন্নততর এবং সর্বসাধারণের উপযোগী ধর্ম শিক্ষা দিয়াছে। ভক্তির সহজ ও সুখসাধ্য ভাব লিখিত ও আলোচিত হইয়াছে বটে, কিন্তু শুধু তাহাতেই হইবে না, এই ভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অবলম্বন করিতে হইবে, কারণ আমরা পরে দেখিব-এই ভক্তির ভাবটি ক্রমে প্রস্ফুটিত হইয়া অবশেষে প্রেমে পরিণত হয়। যতদিন ব্যক্তিগত ও বিষয়গত প্রীতি বলিয়া কিছু থাকিবে, ততদিন কেহ পুরাণের উপদেশাবলী অতিক্রম করিয়া যাইতে পারিবে না। যতদিন সাহায্যের জন্য কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর করারূপ মানবীয় দুর্বলতা বর্তমান থাকিবে, ততদিন এই-সকল পুরাণ কোন না কোন আকারে থাকিবেই থাকিবে। আপনারা ঐগুলির নাম পরিবর্তন করিতে পারেন, আপনারা এতকাল যাবৎ প্রচলিত পুরাণগুলির নিন্দা করিতে পারেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার আপনাদিগকে বাধ্য হইয়া আর একখানি নূতন পুরাণ প্রণয়ন করিতে হইবে। ধরুন, আমাদের মধ্যে কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব হইল-তিনি এই-সকল প্রাচীন পুরাণ অস্বীকার করিলেন; তাঁহার দেহত্যাগের পর বিশ বৎসর যাইতে না যাইতে দেখিবেন, তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহারই জীবন অবলম্বন করিয়া একখানি পুরাণ রচনা করিয়া ফেলিবে। পুরাণ ছাড়িবার জো নাই, প্রাচীন পুরাণ ও আধুনিক পুরাণ-এইটুকুমাত্র পার্থক্য। মানুষের প্রকৃতিই ইহা চাহিয়া থাকে। যাঁহারা সমুদয় মানবীয় দুর্বলতার অতীত হইয়া প্রকৃত পরমহংসোচিত নির্ভীকতা লাভ করিয়াছেন, যাঁহারা মায়ার বন্ধন, এমন কি স্বাভাবিক অভাবগুলি পর্যন্ত অতিক্রম করিয়াছেন, শুধু সেই বিজয়মহিমায় মণ্ডিত দেবমানবদেরই পুরাণের প্রয়োজন নাই।

ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরকে উপাসনা না করিলে সাধারণ মানুষের চলে না। যদি সে প্রকৃতির মধ্যে বিরাজিত ঈশ্বরের পূজা না করে, তবে তাহাকে স্ত্রী-পুত্র, পিতা-বন্ধু, আচার্য বা অন্য কোন ব্যক্তিকে ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত করিয়া পূজা করিতেই হইবে। পুরুষ অপেক্ষা নারীগণের আবার ইহা অধিক আবশ্যক। আলোকের স্পন্দন সর্বত্রই থাকিতে পারে, অন্ধকার স্থানেও থাকিতে পারে; বিড়াল ও অন্যান্য জন্তু যে অন্ধকারেও দেখিতে পায়, এই ঘটনা হইতেই ইহা অনুমিত হয়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতে হইলে আমরা যে স্তরে রহিয়াছি, আলোককে তদুপযোগী স্তরের স্পন্দনবিশিষ্ট হইতে হইবে। সুতরাং আমরা এক নির্গুণ নিরাকার সত্তা প্রভৃতি সম্বন্ধে কথা বলিতে পারি বটে, কিন্তু যতদিন আমরা সাধারণ মর্ত্যজীব, ততদিন আমাদিগকে কেবল মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর দর্শন করিতে হইবে। অতএব ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ও উপাসনা স্বভাবতই মানুষ-ভাবাপন্ন। সত্য-সত্যই এই শরীর ভগবানের শ্রেষ্ঠ মন্দির। সেইজন্যই দেখিতে পাই, যুগযুগান্তর ধরিয়া লোকে মানুষের উপাসনা করিয়া আসিতেছে, আর যদিও ঐ সঙ্গে স্বভাবতঃ যে-সকল বাড়াবাড়ি হইয়া থাকে, ঐসব বাড়াবাড়ির কতকগুলি আমরা নিন্দা বা সমালোচনা করিতে পারি, তথাপি আমরা সঙ্গে সঙ্গে দেখিতে পাই, তত্ত্বটির মর্মদেশ অটুট রহিয়াছে; এই-সব বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও, এই-সকল চরমে উঠা সত্ত্বেও এই প্রচারিত মতবাদে সারবস্তু আছে, উহার অন্তরতম অংশ খাঁটি ও সুদৃঢ়-উহার একটা মেরুদণ্ড আছে।

না বুঝিয়া কোন পুরাতন উপকথা বা অবিজ্ঞাতিক দুর্বোধ্য শব্দরাশি আপনাদিগকে গলাধঃকরণ করিতে বলিতেছি না, কতকগুলি পুরাণের ভিতর দুর্ভাগ্যবশতঃ যে-সকল বামাচারী ব্যাখ্যা প্রবেশ করিয়াছে, সেগুলির প্রত্যেকটিতে বিশ্বাস করিতে বলিতেছি না; কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, এগুলির ভিতর একটি সারবস্তু আছে, এগুলির লোপ না পাইবার একটি কারণ আছে। ভক্তির উপদেশ দেওয়া, ধর্মকে দৈনন্দিন জীবনে রূপায়িত করা, দার্শনিক উচ্চস্তরে বিচরণশীল ধর্মকে সাধারণ মানবের দৈনন্দিন জীবনে কাজে পরিণত করাই পুরাণগুলির স্থায়িত্বের কারণ।

মানুষ এখন যেরূপ অবস্থায় আছে, ঈশ্বরেচ্ছায় সেরূপ না হইলে বড় ভাল হইত। কিন্তু বাস্তব ঘটনার প্রতিবাদ করা বৃথা। চৈতন্য, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি সম্বন্ধে যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন, এখনও সে জড়ভাবাপন্ন। সেই জড়ভাবাপন্ন মানবকে হাতে ধরিয়া ধীরে ধীরে তুলিতে হইবে, যতদিন না সে চৈতন্যময়, সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন হয়। আজকালকার দিনে শতকরা নিরানব্বই জন লোকের পক্ষে আধ্যাত্মিকতা বুঝা কঠিন, এ বিষয়ে কিছু বলা আরও কঠিন। যে প্রেরণা-শক্তি আমাদিগকে কার্যক্ষেত্রে আগাইয়া দিতেছে এবং যে-সব ফল আমরা লাভ করিতে চাহিতেছি, সে-সবই জড়।

হার্বাট স্পেন্সারের ভাষায় বলি-আমরা কেবল স্বল্পতম বাধার পথে কাজ করিতে পারি। পুরাণকারগণের এই সহজ কাণ্ডজ্ঞান ছিল বলিয়াই তাঁহারা লোককে এই স্বল্পতম বাধার পথে কাজ করিবার প্রণালী দেখাইয়া গিয়াছেন। এইভাবে উপদেশ দেওয়াতে পুরাণগুলি লোকের কল্যাণসাধনে যেরূপ কৃতকার্য হইয়াছে, তাহা বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব; ভক্তির আদর্শ অবশ্য আধ্যাত্মিক-উহার লক্ষ্য চৈতন্য, কিন্তু পথ জড়ের ভিতর দিয়া, এবং জড়ের সাহায্য অবলম্বন করা ব্যতীত গত্যন্তর নাই। অতএব জড়জগতের যাহা-কিছু এই আধ্যাত্মিকতা লাভ করিতে সাহায্য করে, সে-সবই লইতে হইবে এবং সেগুলিকে এমনভাবে আমাদের কাজে লাগাইতে হইবে, যাহাতে জড়ভাবাপন্ন মানুষ ক্রমে উন্নত হইয়া আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন হইতে পারে। গোড়া হইতেই শাস্ত্র জাতিবর্ণধর্মনির্বিশেষে স্ত্রীপুরুষ সকলকেই বেদপাঠে অধিকার প্রদান করিয়াছে। যদি জড়বস্তু দ্বারা মন্দির নির্মাণ করিয়া মানুষ ভগবানকে বেশী ভালবাসিতে পারে, সে তো খুব ভাল কথা; যদি ভগবানের প্রতিমা গঠন করিয়া সে এই প্রেমের আদর্শে উপনীত হইবার সাহায্য লাভ করে, ভগবান্ তাহার ইচ্ছা পূর্ণ করুন!-সে যদি চায়, তাহাকে বিশটি প্রতিমা পূজা করিতে দাও। যে-কোন বিষয় হউক, যদি ঐগুলি তাহাকে ধর্মের সেই চরম লক্ষ্যবস্তু লাভ করিতে সাহায়তা করে, এবং যদি তাহা নীতিবিরুদ্ধ না হয়, তবে অবাধে সে ঐগুলি অবলম্বন করুক। ‘নীতিবিরুদ্ধ না হয়’-এ কথা বলিবার উদ্দেশ্য এই যে, নীতিবিরুদ্ধ বিষয় আমাদের ধর্মপথে সহায় না হইয়া বরং বহুল বিঘ্নই সৃষ্টি করিয়া থাকে।

ভারতে ঈশ্বরোপাসনায় প্রতিমা-ব্যবহারের যাঁহারা বিরোধিতা করেন, কবীর তাঁহাদের অন্যতম; ভারতে এমন অনেক বড় বড় দার্শনিক ও ধর্মসংস্থাপকের অভ্যুদয় হইয়াছে, যাঁহারা বিশ্বাস করিতেন না-ভগবান্‌ সগুণ বা ব্যক্তিভাবাপন্ন, এবং অকুতোভয়ে সর্বসাধারণের সমক্ষে সেই মত প্রচার করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু তাঁহারাও প্রতিমাপূজায় দোষারোপ করেন নাই। বড়জোর বলা যায়, তাঁহারা উহাকে খুব উচ্চাঙ্গের উপাসনা বলিয়া স্বীকার করেন নাই। কোন পুরাণেই প্রতিমাপূজাকে উচ্চাঙ্গের উপাসনা বলা হয় নাই। যে-সব য়াহুদী বিশ্বাস করিতেন, জিহোবা একটি পেটিকায় অবস্থান করেন, তাঁহারাও মূর্তিপূজক ছিলেন। শুধু অপরে মন্দ বলে বলিয়া মূর্তিপূজায় দোষারোপ করা উচিত নহে। বরং প্রতিমা বা অপর কোন জড়বস্তু যদি মানুষকে ধর্মলাভে সাহায্য করে, তবে স্বচ্ছন্দে উহা ব্যবহার করা যাইতে পারে। আর আমাদের এমন কোন ধর্মগ্রন্থ নাই, যাহাতে এ-কথা অতি পরিষ্কারভাবে বলা হয় নাই যে, জড়ের সাহায্যে অনুষ্ঠিত মূর্তিপূজা অতি নিম্নস্তরের উপাসনা।

সমগ্র ভারতে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর জোর করিয়া প্রতিমাপূজা চাপাইবার যে চেষ্টা হইয়াছিল, তাহার দোষ দেখাইবার উপযুক্ত ভাষা আমি খুঁজিয়া পাই না। কাহার কি উপাসনা করা উচিত এবং কোন্ বস্তু অবলম্বন করিয়া উপাসনা করা উচিত, এ বিষয়ে হুকুম করিবার জন্য অন্যের কি মাথাব্যথা পড়িয়াছিল? সে কি করিয়া জানিবে, কিসের সাহায্যে আর একজনের উন্নতি হইবে-প্রতিমাপূজা দ্বারা, না অগ্নিপূজা দ্বারা, না এমন কি একটা স্তম্ভের উপাসনা দ্বারা? আমাদের নিজ নিজ গুরু এবং গুরুশিষ্যের সম্বন্ধ দ্বারাই এ-সকল বিষয় নির্দিষ্ট ও পরিচালিত হইবে। ভক্তিগ্রন্থে ইষ্টসম্বন্ধে যে-নিয়ম আছে, তাহা হইতেই ইহার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রত্যেক লোককেই তাহার বিশেষ উপাসনা-পদ্ধতি, ভগবানের দিকে অগ্রসর হইবার বিশেষ পথ অবলম্বন করিতে হইবে। আর সেই নির্বাচিত পথই তাহার ‘ইষ্ট’। অন্য উপাসনাগুলিকে সহানুভূতির চক্ষে দেখিতে হইবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজ উপাসনাপদ্ধতি-অনুসারে সাধন করিতে হইবে-যতদিন না সাধক গন্তব্য স্থলে উপনীত হন, যতদিন না তিনি সেই কেন্দ্রস্থলে উপনীত হন, যেখানে আর জড়ের সাহায্য প্রয়োজন নাই।


গুরুর কার্য যেন ব্যবসায়ে পরিণত না হয়। ইহা নিবারণ করিতেই হইবে, ইহা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। নিজেকে গুরু বলিয়া পরিচয় দিবার সময় কুলগুরুপ্রথা যে-অবস্থা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা সমর্থন করা কাহারও উচিত নহে।

এই প্রসঙ্গে ভারতের অনেক স্থানে প্রচলিত কুলগুরুপ্রথা সম্বন্ধে সাবধান করিয়া দিবার জন্য দু-চারিটি কথা বলা আবশ্যক-ঐ প্রথা এক প্রকার বংশপরম্পরাগত গুরুগিরিমাত্র। শাস্ত্রে আমরা পড়িয়া থাকি, যিনি বেদের সারমর্ম বুঝেন, যিনি নিষ্পাপ, যিনি অর্থলোভে বা অপর কোন উদ্দেশ্যে লোককে শিক্ষা দেন না, যাঁহার কৃপা অহৈতুকী, বসন্ত ঋতু যেমন বৃক্ষলতাদির নিকট কিছু প্রার্থনা করে না, কিন্তু যেমন বসন্তাগমে বৃক্ষলতাদি সতেজ হইয়া উঠে, উহাদের নূতন ফলপত্র-মূকুলাদির উদ্গম হয়, সেইরূপ যাঁহার স্বভাবই লোকের কল্যাণসাধন করা, যিনি উহার পরিবর্তে কিছুই চাহেন না, যাঁহার সারাজীবনই অপরের কল্যাণের জন্য, এইরূপ লোকই গুরূপদবাচ্য, অন্যে নহে।৫৫ অসদ‍্গুরুর নিকট তো জ্ঞানলাভের সম্ভাবনাই নাই, বরং তাঁহার শিক্ষায় একটি বিপদের আশঙ্কা আছে। কারণ গুরু কেবল শিক্ষক বা উপদেষ্টামাত্র নহেন, শিক্ষকতা তাঁহার কর্তব্যের অতি সামান্য অংশমাত্র। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, গুরু শিষ্যে শক্তিসঞ্চার করেন। সাধারণ জড়জগতের একটি দৃষ্টান্ত ধরুন-যদি কোন ব্যক্তি ভাল বীজের টিকা না লয়, তাহার শরীরে দূষিত অনিষ্টকর বীজ প্রবেশের ভয় আছে। সেইরূপ অসদ‍্গুরুর শিক্ষায় কিছু মন্দ শিখিবার আশঙ্কা আছে। সুতরাং ভারতবর্ষ হইতে এই কুলগুরুর ভাবটি উঠিয়া যাওয়া একান্ত প্রয়োজন হইয়াছে। গুরুর কার্য যেন ব্যবসায়ে পরিণত না হয়। ইহা নিবারণ করিতেই হইবে, ইহা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। নিজেকে গুরু বলিয়া পরিচয় দিবার সময় কুলগুরুপ্রথা যে-অবস্থা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা সমর্থন করা কাহারও উচিত নহে।

আহার সম্বন্ধে আজকাল যে কঠোর নিয়মের উপর ঝোঁক দেওয়া হয়, সেটির অধিকাংশ বাহ্য ব্যাপার এবং যে উদ্দেশ্যে ঐ-সকল নিয়ম প্রথম বিধিবদ্ধ হইয়াছিল, সে উদ্দেশ্য এখন লোপ পাইয়াছে। কে খাদ্য স্পর্শ করিতে পাইবে, এই বিষয়ে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। ইহার এক অতি গভীর দার্শনিক অর্থ আছে, কিন্তু সাধারণ লোকের প্রাত্যহিক জীবনে এই সাবধানতা রক্ষা করা কঠিন বা অসম্ভব। যে-ভাবটি পালন করা কেবল ধর্মের জন্য উৎসর্গীকৃতপ্রাণ সাধকের পক্ষেই সম্ভব, তাহা সাধারণের জন্য নির্দেশ করা ভুল হইয়াছে। কেন না, জনসাধারণের অধিকাংশই জড়সুখের আস্বাদে অতৃপ্ত; এবং তৃপ্তির পূর্বেই জোর করিয়া তাহাদের উপর ধর্ম চাপাইয়া দিবার সঙ্কল্প করা বৃথা।

ভক্তের জন্য বিহিত উপাসনাপদ্ধতিগুলির মধ্যে মানুষের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ। বাস্তবিক যদি কোনরূপ পূজা করিতে হয়, তাহা হইলে অবস্থানুযায়ী একটি, ছয়টি বা দ্বাদশটি দরিদ্রকে প্রত্যহ নিজ গৃহে আনিয়া নারায়ণজ্ঞানে সেবা করিলে ভাল হয়। অনেক দেশে দানের প্রথা দেখিয়া আসিয়াছি, কিন্তু উহাতে তেমন সুফল না হওয়ার কারণ এই যে, উহা যথাযথ ভাবের সহিত অনুষ্ঠিত হয় না। ‘এই নিয়ে যা’-এ-ভাবে দান বা দয়াধর্মের অনুষ্ঠান করা যায় না, পরন্তু উহা হৃদয়ের অহঙ্কারের পরিচায়ক; দানের উদ্দেশ্য-জগৎ যেন জানিতে না পারে যে, দাতা দয়াধর্ম করিতেছে। হিন্দুদের অবশ্য জানা উচিত যে, স্মৃতির মতে-দাতা গ্রহীতা অপেক্ষা নিকৃষ্ট; গ্রহীতা সেই সময় স্বয়ং নারায়ণ, সুতরাং আমার মতে এইরূপ নূতন ধরনের পূজাপদ্ধতি প্রবর্তিত করিলে ভাল হয়-কতিপয় দরিদ্র অন্ধ বা ক্ষুধার্ত নারায়ণকে প্রত্যহ প্রতিগৃহে আনয়ন করিয়া প্রতিমার যেরূপ পূজা হয়, অশন-বসন দ্বারা তাহাদের সেইরূপ পূজা করা। পরদিবস আবার কতকগুলি লোককে লইয়া আসিয়া ঐরূপে পূজা করা। আমি কোন উপাসনাপ্রণালীর দোষ দিতেছি না, কিন্তু আমার বলিবার অভিপ্রায় এই যে, এইভাবে নারায়ণপূজাই শ্রেষ্ঠ পূজা এবং ভারতের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী।

উপসংহারে আমি ভক্তিকে একটি ত্রিকোণের সহিত তুলনা করিতেছি। ইহার প্রথম কোণ-প্রকৃত ভক্তি বা প্রেম কিছুই চাহে না। প্রেমে ভয় নাই-ইহাই উহার দ্বিতীয় কোণ। পুরস্কার বা প্রতিদানের উদ্দেশ্যে ভালবাসা ভিক্ষুকের ধর্ম, ব্যবসায়ীর ধর্ম, প্রকৃত ধর্মের সহিত উহার অতি অল্পই সম্বন্ধ। কেহ যেন ভিক্ষুক না হন, কারণ ভিক্ষুকতা নাস্তিকতার চিহ্ন। যে ব্যক্তি গঙ্গাতীরে বাস করিয়া পানীয় জলের জন্য কূপ খনন করে, সে মূর্খ নয়তো কি? তেমনি জড়বস্তুর জন্য ভগবানের নিকট যে প্রার্থনা করে, সেও মূর্খ। ভক্তকে সর্বদাই এই কথা বলিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবেঃ প্রভো, আমি তোমার নিকট কিছুই চাহি না, কিন্তু যদি তোমার কিছু প্রয়োজন থাকে, আমি দিতে প্রস্তুত। প্রেমে ভয় থাকে না। আপনারা কি দেখেন নাই যে, ক্ষীণকায় অবলা নারী পথ দিয়া যাইতে যাইতে কুকুরের চীৎকারে নিকটতম গৃহে পলাইয়া আশ্রয় লয়? পরদিন সে পথ চলিতেছে-সঙ্গে তাহার শিশুপুত্র। হঠাৎ একটা সিংহ শিশুটিকে আক্রমণ করিল-তখন কি তাহাকে পূর্বদিনের মত পলাইতে দেখিবেন? কখনই না। সে তাহার সন্তানটিকে রক্ষা করিবার জন্য সিংহের মুখে যাইতেও প্রস্তুত।


জড়রাজ্যে মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি শক্তিরূপে তিনিই প্রকাশিত। তিনি সকল স্থানেই রহিয়াছেন, প্রতি পরমাণুতে রহিয়াছেন, সকল স্থানেই তাঁহার প্রকাশ। তিনিই সেই অনন্ত প্রেম, যাহা জগতের একমাত্র প্রেরণা-শক্তি এবং সর্বত্র প্রত্যক্ষ স্বয়ং ভগবান্।

তৃতীয় বা সর্বশেষ কোণ এই যে, প্রেমই প্রেমের লক্ষ্য। ভক্ত অবশেষে এইভাবে উপনীত হন যে, শুধু প্রেমই ঈশ্বর, অন্য কিছু নয়। ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে মানুষ আর কোথায় যাইবে? সকল দৃশ্য বস্তুর মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট। তিনিই সেই শক্তি, যাহা চন্দ্র-সূর্য-তারকারাশি পরিচালিত করিতেছে এবং নরনারী ও ইতর প্রাণিগণের মধ্যে, সকল বস্তুতে সর্বত্রই প্রকাশ পাইতেছে; জড়রাজ্যে মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি শক্তিরূপে তিনিই প্রকাশিত। তিনি সকল স্থানেই রহিয়াছেন, প্রতি পরমাণুতে রহিয়াছেন, সকল স্থানেই তাঁহার প্রকাশ। তিনিই সেই অনন্ত প্রেম, যাহা জগতের একমাত্র প্রেরণা-শক্তি এবং সর্বত্র প্রত্যক্ষ স্বয়ং ভগবান্।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!