ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

মাদুরা অভিনন্দনের উত্তর

[মনমাদুরা হইতে মাদুরায় আসিয়া স্বামীজী রামনাদের রাজার সুন্দর বাঙ্গলায় অবস্থান করেন। অপরাহ্নে, মখমলের খাপে পুরিয়া স্বামীজীকে একটি অভিনন্দন-পত্র প্রদত্ত হয়-উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ]

আমার খুব ইচ্ছা যে, কয়েকদিন তোমাদের নিকট থাকিয়া সুযোগ্য সভাপতি মহাশয়ের আদেশমত আমার পাশ্চাত্যদেশের সমুদয় অভিজ্ঞতা ও বিগত চারবৎসরব্যাপী প্রচারকার্যের বিবরণ দিই। দুঃখের বিষয়, সন্ন্যাসিগণকেও দেহভার বহন করিতে হয়। গত তিন সপ্তাহ যাবৎ ক্রমাগত নানাস্থানে ভ্রমণ ও বক্তৃতা করিয়া এত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, আর সন্ধ্যাকালে দীর্ঘ বক্তৃতা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। তোমরা আমার প্রতি যে অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছ, সেজন্য তোমাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়াই আমাকে সন্তুষ্ট থাকিতে হাইবে; আর অন্যান্য বিষয় ভবিষ্যতের জন্য রাখিয়া দিতে হইবে। স্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত ভাল হইলে এবং আর একটু অবকাশ পাইলে আমাদের অন্যান্য বিষয় আলোচনা করিবার সুবিধা হইবে। আজ এই অল্প সময়ের মধ্যে সব কথা বলিবার সুযোগ হইবে না। একটি কথা বিশেষভাবে আমার মনে উদিত হইতেছে। আমি এখন মাদুরায় তোমাদের স্বদেশবাসী স্বনামখ্যাত উদারচেতা রামনাদরাজের অতিথি। তোমরা বোধ হয় অনেকেই জান না, উক্ত রাজাই আমার মাথায় চিকাগো-সভায় যাইবার ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং বরাবরই সর্বান্তঃকরণে ও সর্বশক্তি-দ্বারা আমার কার্য সমর্থন করিয়াছেন। সুতরাং অভিনন্দন-পত্রে আমাকে যে-সকল প্রশংসা করা হইয়াছে, তাহার অধিকাংশই দাক্ষিণাত্যবাসী এই মহাপুরুষের প্রাপ্য। কেবল আমার মনে হয়, তিনি রাজা না হইয়া সন্ন্যাসী হইলে আরও ভাল হইত; কারণ তিনি সন্ন্যাসেরই উপযুক্ত।

যখনই পৃথিবীর অংশবিশেষে কোন কিছুর আবশ্যক হয়, তখনই তাহা এক অংশ হইতে অপরাংশে গিয়া সেখানে নূতন জীবন প্রদান করে। কি প্রাকৃতিক, কি আধ্যাত্মিক-উভয় ক্ষেত্রেই ইহা সত্য। যদি জগতের কোন অংশে ধর্মের অভাব হয় এবং অপর কোথাও সেই ধর্ম থাকে, তবে আমরা জ্ঞাতসারে চেষ্টা করি বা না করি, যেখানে সেই ধর্মের অভাব সেখানে ধর্মস্রোত আপনা-আপনি প্রবাহিত হইয়া উভয় স্থানের সামঞ্জস্য বিধান করিবে। মানবজাতির ইতিহাসে দেখিতে পাই-একবার নয়, দুইবার নয়, বার বার এই প্রাচীন ভারতকে যেন বিধাতার নিয়মে পৃথিবীকে ধর্মশিক্ষা দিতে হইয়াছে। দেখিতে পাই-যখনই কোন জাতির দিগ্বিজয় বা বাণিজ্যে প্রাধান্য উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ একসূত্রে গ্রথিত হইয়াছে এবং যখনই এক জাতির অপর জাতিকে কিছু দিবার সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে, তখনই প্রত্যেক জাতি অপর জাতিকে রাজনীতিক, সামাজিক বা আধ্যাত্মিক যাহার যাহা আছে, তাহাই দিয়াছে। ভারত সমগ্র পৃথিবীকে ধর্ম ও দর্শন শিখাইয়াছে। পারস্য-সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের অনেক পূর্বেই ভারত পৃথিবীকে আপন আধ্যাত্মিক সম্পদ দান করিয়াছে। পারস্য-সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়কালে আর একবার এই ঘটনা ঘটে। গ্রীকদিগের অভ্যুদয়কালে তৃতীয়বার। আবার ইংরেজের প্রাধান্যকালে এই চতুর্থবার সে বিধাতৃ-নির্দিষ্ট ব্রতপালনে নিযুক্ত হইতেছে। যেমন আমরা ইচ্ছা করি বা না-করি, পাশ্চাত্যদিগের সংঘবদ্ধ কার্যপ্রণালী ও বাহ্যসভ্যতার ভাব আমাদের দেশে প্রবেশ করিয়া সমগ্র দেশকে ছাইয়া ফেলিবার উপক্রম করিতেছে, সেইরূপ ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন পাশ্চাত্যদেশকে প্লাবিত করিবার উপক্রম করিতেছে। কেহই ইহার গতিরোধে সমর্থ নহে। আমরাও পাশ্চাত্য জড়বাদপ্রধান সভ্যতার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করিতে অসমর্থ। সম্ভবতঃ কিছু কিছু বাহ্যসভ্যতা আমাদের পক্ষে কল্যাণকর, পাশ্চাত্যদেশের পক্ষে আবার সম্ভবতঃ একটু আধ্যাত্মিকতা আবশ্যক। তাহা হইলে উভয়ের সামঞ্জস্য রক্ষিত হইবে; আমাদিগকে যে পাশ্চাত্যদেশ হইতে সব-কিছু শিখিতে হইবে বা পাশ্চাত্যকে আমাদের নিকট সব-কিছু শিখিতে হইবে, তাহা নহে। সমগ্র পৃথিবী যুগযুগান্তর ধরিয়া যে আদর্শ-অবস্থা কল্পনা করিয়া আসিতেছে, যাহাতে শীঘ্র তাহা রূপায়িত হয়, যাহাতে সকল জাতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়, তদুদ্দেশ্যে প্রত্যেকেরই যতটুকু সাধ্য ততটুকু ভবিষ্যৎ বংশধরদিগকে দেওয়া উচিত। এই আদর্শ-জগতের আবির্ভাব কখনও হইবে কিনা, তাহা জানি না; এই সামাজিক সম্পূর্ণতা কখনও আসিবে কিনা, এই সম্বন্ধে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে; কিন্তু জগতের এই আদর্শ অবস্থা কখনও আসুক বা না আসুক, এই অবস্থা আনিবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে চেষ্টা করিতে হইবে। মনে করিতে হইবে, কালই জগতের এই অবস্থা আসিবে, আর কেবল আমার কাজের উপরই ইহা নির্ভর করিতেছে। আমাদের প্রত্যেককেই বিশ্বাস করিতে হইবে যে, অপর সকলে নিজ নিজ কাজ শেষ করিয়া বসিয়া আছে-কেবল একমাত্র আমারই কাজ করার বাকী আছে; আমি যদি নিজের কাজ সম্পন্ন করি; তবেই সমাজ ও সংসারের সম্পূর্ণতা সাধিত হইবে। আমাদের নিজেদের এই দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হইবে।


তাহাও যদি সম্ভব হয়, তথাপি তোমাদের পক্ষে ইওরোপীয়-ভাবাপন্ন হইয়া যাওয়া অসম্ভব। ইওরোপীয়গণের পক্ষে যদি কয়েক শতাব্দীর শিক্ষাসংস্কার পরিত্যাগ করা অসম্ভব বোধ হয়, তবে তোমাদের পক্ষে শত শত শতাব্দীর সংস্কার পরিত্যাগ করা কিরূপে সম্ভব হইবে? তাহা কখনই হইতে পারে না।

যাহা হউক দেখা যাইতেছে-ভারতে ধর্মের এক প্রবল পুনরুত্থান হইয়াছে। ইহাতে খুব আনন্দের কারণ আছে বটে, আবার বিপদেরও আশঙ্কা আছে। কারণ ধর্মের পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক গোঁড়ামিও আসিয়া থাকে। কখনও কখনও লোকে এত বাড়াবাড়ি করিয়া থাকে যে, অনেক সময় যাঁহাদের চেষ্টায় এই পুনরভ্যুত্থান সাধিত হয়, কিছুদূর অগ্রসর হইলে তাঁহারাও উহা নিয়ন্ত্রিত করিতে পারেন না। অতএব পূর্ব হইতেই সাবধান হওয়া ভাল। আমাদের মধ্যপথ অবলম্বন করিতে হইবে। এক দিকে কুসংস্কারপূর্ণ প্রাচীন সমাজ, অপর দিকে জড়বাদ-ইওরোপীয় ভাব, নাস্তিকতা, তথাকথিত সংস্কার, যাহা পাশ্চাত্য জগতের উন্নতির মূল ভিত্তিতে পর্যন্ত প্রবিষ্ট। এই দুই-ভাব হইতেই সাবধান থাকিতে হইবে প্রথমতঃ আমরা কখনও পাশ্চাত্য জাতি হইতে পারিব না, সুতরাং উহাদের অনুকরণ বৃথা। মনে কর তোমরা পাশ্চাত্য জাতির হুবহু অনুকরণ করিতে সমর্থ হইলে, কিন্তু যে মুহূর্তে সমর্থ হইবে, সেই মুহূর্তেই তোমাদের মৃত্যু ঘটিবে-তোমাদের জাতীয় জীবনের অস্তিত্ব আর থাকিবে না; ইহা অসম্ভব। কালের প্রারম্ভ হইতে মানবজাতির ইতিহাসের লক্ষ লক্ষ বর্ষ ধরিয়া একটি নদী হিমালয় হইতে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে; তুমি কি উহাকে উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চাও? তাহাও যদি সম্ভব হয়, তথাপি তোমাদের পক্ষে ইওরোপীয়-ভাবাপন্ন হইয়া যাওয়া অসম্ভব। ইওরোপীয়গণের পক্ষে যদি কয়েক শতাব্দীর শিক্ষাসংস্কার পরিত্যাগ করা অসম্ভব বোধ হয়, তবে তোমাদের পক্ষে শত শত শতাব্দীর সংস্কার পরিত্যাগ করা কিরূপে সম্ভব হইবে? তাহা কখনই হইতে পারে না।

দ্বিতীয়তঃ আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে, আমরা সচরাচর যেগুলিকে আমাদের ধর্মবিশ্বাস বলি, সেগুলি আমাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র গ্রাম্যদেবতা-সম্বন্ধীয় এবং কতকগুলি ক্ষুদ্র কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচারমাত্র। এইরূপ দেশাচার অসংখ্য এবং পরস্পরবিরোধী। ইহাদের মধ্যে কোন্‌টি মানিব, আর কোন‌্‌টি মানিব না? উদাহরণস্বরূপ দেখ, দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ অপর ব্রাহ্মণকে এক টুকরা মাংস খাইতে দেখিলে ভয়ে দুই শত হাত পিছাইয়া যাইবে; আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ কিন্তু মহাপ্রসাদের অতিশয় ভক্ত, পূজার জন্য তিনি শত শত ছাগবলি দিতেছেন। তুমি তোমার দেশাচারের দোহাই দিবে, তিনি তাঁহার দেশাচারের দোহাই দিবেন। ভারতের বিভিন্ন দেশে নানাবিধ দেশাচার আছে, কিন্তু প্রত্যেক দেশাচারই স্থানবিশেষে আবদ্ধ; কেবল অজ্ঞ ব্যক্তিরাই তাহাদের নিজ নিজ পল্লীতে প্রচলিত আচারকে ধর্মের সার বলিয়া মনে করে, ইহাই তাহাদের মহাভুল।

ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি মুশকিল আছে। আমাদের শাস্ত্রে দুই প্রকার সত্য উপদিষ্ট হইয়াছে। এক প্রকার সত্য মানুষের নিত্যস্বরূপ-বিষয়ক-ঈশ্বর, জীবাত্মা ও প্রকৃতির পরস্পর সম্বন্ধ-বিষয়ক; আর একপ্রকার সত্য কোন বিশেষ দেশ-কাল-অবস্থার উপর নির্ভর করে। প্রথম প্রকার সত্য প্রধানতঃ আমাদের শাস্ত্র বেদে রহিয়াছে; দ্বিতীয় প্রকার সত্য স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতিতে রহিয়াছে। আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে, চিরকালের জন্য বেদই আমাদের চরম লক্ষ্য ও চরম প্রমাণ! আর যদি কোন পুরাণ বেদের বিরোধী হয়, তবে পুরাণের সেই অংশ নির্মমভাবে ত্যাগ করিতে হইবে। আমরা স্মৃতিতে কি দেখিতে পাই? দেখিতে পাই, বিভিন্ন স্মৃতির উপদেশ বিভিন্ন প্রকার। এক স্মৃতি বলিতেছেন-ইহাই দেশাচার, এই যুগে ইহারই অনুসরণ করিতে হইবে। অপর স্মৃতি আবার ঐ যুগের জন্যই অন্যপ্রকার আচার সমর্থন করিতেছেন। কোন স্মৃতি আবার সত্য-ত্রেতা প্রভৃতি যুগভেদে বিভিন্ন আচার সমর্থন করিয়াছেন। এখন দেখ, তোমাদের শাস্ত্রের এই মতটি কি উদার ও মহান্‌। সনাতন সত্যসমূহ মানবপ্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া যতদিন মানুষ আছে, ততদিন ঐগুলির পরিবর্তন হইবে না-অনন্তকাল ধরিয়া সর্বদেশে সর্ব অবস্থায় ঐগুলি ধর্ম। স্মৃতি অপর দিকে বিশেষ বিশেষ স্থানে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় অনুষ্ঠেয় কর্তব্যসমূহের কথাই অধিক বলিয়া থাকেন, সুতরাং কালে সেগুলির পরিবর্তন হয়। এইটি সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে-কোন সামান্য সামাজিক প্রথা বদলাইতেছে বলিয়া তোমাদের ধর্ম গেল, মনে করিও না। মনে রাখিও, চিরকালই এই-সকল প্রথা ও আচারের পরিবর্তন হইতেছে। এই ভারতেই এমন সময় ছিল, যখন গোমাংস ভোজন না করিলে কোন ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব থাকিত না। বেদপাঠ করিলে দেখিতে পাইবে, কোন বড় সন্ন্যাসী বা রাজা বা অন্য কোন বড়লোক আসিলে ছাগ ও গোহত্যা করিয়া তাঁহাদিগকে ভোজন করানোর প্রথা ছিল। ক্রমশঃ সকলে বুঝিল-আমাদের জাতি প্রধানতঃ কৃষিজীবী, সুতরাং ভাল ভাল ষাঁড়গুলি হত্যা করিলে সমগ্র জাতি বিনষ্ট হইবে। এই কারণেই গোহত্যা-প্রথা রহিত করা হইল-গোহত্যা মহাপাতক বলিয়া পরিগণিত হইল। প্রাচীনশাস্ত্র-পাঠে আমরা দেখিতে পাই, তখন হয়তো এমন সব আচার প্রচলিত ছিল, যেগুলিকে এখন আমরা বীভৎস বলিয়া মনে করি। ক্রমশঃ সেগুলির পরিবর্তে অন্য সব বিধি প্রবর্তন করিতে হইয়াছে। ঐগুলি আবার পরিবর্তিত হইবে, তখন নূতন নূতন স্মৃতির অভ্যুদয় হইবে। এইটিই বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বেদ চিরকাল একরূপ থাকিবে, কিন্তু কোন স্মৃতির প্রাধান্য যুগ-পরিবর্তনেই শেষ হইয়া যাইবে। সময়স্রোত যতই চলিবে, ততই পূর্ব পূর্ব স্মৃতির প্রামাণ্য লোপ পাইবে, আর মহাপুরুষগণ আবির্ভূত হইয়া সমাজকে পূর্বাপেক্ষা ভাল পথে পরিচালিত করিবেন; সেই যুগের পক্ষে যাহা অত্যাবশ্যক, যাহা ব্যতীত সমাজ বাঁচিতেই পারে না-তাঁহারা আসিয়া সেই সকল কর্তব্য ও পথ সমাজকে দেখাইয়া দিবেন।

এইরূপে আমাদিগকে এই উভয় বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করিতে হইবে; আমি আশা করি, আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেরই একদিকে যেমন উদার ভাব-হৃদয়ের প্রসারতা আসিবে, অপর দিকে তেমন দৃঢ় নিষ্ঠা ও বিশ্বাস থাকিবে; তাহা হইলে তোমরা আমার কথার মর্ম বুঝিবে-বুঝিবে আমার উদ্দেশ্য সকলকেই আপনার করিয়া লওয়া, কাহাকেও বর্জন করা নয়। আমি চাই গোঁড়ার নিষ্ঠাটুকু ও তাহার সহিত জড়বাদীর উদার ভাব। হৃদয় সমুদ্রবৎ গভীর অথচ আকাশবৎ প্রশস্ত হওয়া চাই। আমাদিগকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নতিশীল জাতির মত উন্নত হইতে হইবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবহমান কালের সঞ্চিত সংস্কারসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবান্ হইতে হইবে; আর হিন্দুই কেবল প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন প্রথাগুলিকে সম্মান করিতে জানে। সহজ কথা বলি-সর্ব ব্যাপারই আমাদিগকে মুখ্য ও গৌণ বিষয়ের বিভিন্নতা কোথায়, তাহা শিখিতে হইবে। মুখ্য তত্ত্বগুলি সর্বকালের জন্য, আর গৌণ বিষয়গুলি কোন বিশেষ সময়ের উপযোগী মাত্র। যদি যথাসময়ে সেইগুলির পরিবর্তে অন্য প্রথা প্রবর্তিত না হয়, তবে সেগুলির দ্বারা নিশ্চয় অনিষ্ট ঘটিয়া থাকে। আমার এ কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, তোমাদিগকে প্রাচীন আচারপদ্ধতিসমূহের নিন্দা করিতে হইবে। কখনই নহে, অতিশয় কুৎসিত আচারগুলিরও নিন্দা করিও না। নিন্দা কিছুরই করিও না; এখন যে প্রথাগুলিকে সাক্ষাৎসম্বন্ধে অনিষ্টকর বলিয়া বোধ হইতেছে, সেইগুলিই অতীত কালে প্রত্যক্ষভাবে জীবনপ্রদ ছিল। এখন যদি সেইগুলি উঠাইয়া দিতে হয়, তবে উঠাইয়া দিবার সময়ও সেইগুলির নিন্দা করিও না; বরং ঐগুলির দ্বারা আমাদের জাতীয় জীবনরক্ষারূপ যে মহৎ কার্য সাধিত হইয়াছে, সেজন্য ঐগুলির প্রশংসা কর-ঐগুলির প্রতি কৃতজ্ঞ হও।


আর কাহাকেও নিন্দা বা অভিসম্পাত করিতে হইবে না, অথবা কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে না। এখানে আজ যাঁহারা উপস্থিত আছেন, তাঁহাদের প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের মুক্তির জন্য ঋষিত্ব লাভ করিতে শ্রীভগবান্‌ সাহায্য করুন।

আর আমাদিগকে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে, কোন সেনাপতি বা রাজা কোনকালে আমাদের সমাজের নেতা ছিলেন না, ঋষিগণই চিরকাল আমাদের সমাজের নেতা। ঋষি কাহারা? তিনিই ঋষি, যিনি ধর্মকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, যাঁহার নিকট ধর্ম কেবল পুঁথিগত বিদ্যা, বাগবিতণ্ডা বা তর্কযুক্তি নহে-সাক্ষাৎ উপলব্ধি অতীন্দ্রিয় সত্যের সাক্ষাৎকার। উপনিষদ্ বলিয়াছেন, এরূপ ব্যক্তি সাধারণ মানবতুল্য নহেন, তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা। তিনি ঋষিত্ব। আর এই ঋষিত্বলাভ কোন দেশ কাল জাতি বা সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে না। বাৎস্যায়ন ঋষি বলিয়াছেন-‘সত্যের সাক্ষাৎকার করিতে হইবে’; আর আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, তোমাকে আমাকে-আমাদের সকলকেই ঋষি হইতে হইবে, অগাধ আত্মবিশ্বাস-সম্পন্ন হইতে হইবে; আমরাই সমগ্র জগতে শক্তিসঞ্চার করিব। কারণ সব শক্তি আমাদের ভিতরে রহিয়াছে। আমাদিগকে ধর্ম প্রত্যক্ষ করিতে হইবে-উপলব্ধি করিতে হইবে; তবেই ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের সকল সন্দেহ দূরীভূত হইবে; তখনই ঋষিত্বের উজ্জ্বল জ্যোতিতে পূর্ণ হইয়া আমরা প্রত্যেকেই মহাপুরুষত্ব লাভ করিব। তখনই আমাদের মুখ হইতে যে বাণী নির্গত হইবে, তাহা অব্যর্থ অমোঘ ও শক্তিসম্পন্ন হইবে; তখনই আমাদের সম্মুখ হইতে যাহা কিছু মন্দ, তাহা আপনিই পলায়ন করিবে, আর কাহাকেও নিন্দা বা অভিসম্পাত করিতে হইবে না, অথবা কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে না। এখানে আজ যাঁহারা উপস্থিত আছেন, তাঁহাদের প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের মুক্তির জন্য ঋষিত্ব লাভ করিতে শ্রীভগবান্‌ সাহায্য করুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!