ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

পূর্বে বলিয়াছি, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র চারি বর্ণ পর্যায়ক্রমে পৃথিবী ভোগ করে। প্রত্যেক বর্ণেরই রাজত্বকালে কতকগুলি লোকহিতকর এবং অপর কতকগুলি অহিতকর কার্যের অনুষ্ঠান হয়।

পৌরোহিত্যশক্তির ভিত্তি বুদ্ধিবলের উপর, বাহুবলের উপর নহে; এজন্য পুরোহিতদিগের প্রাধান্যের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাচর্চার আবির্ভাব! অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক জগতের বার্তা ও সহায়তার জন্য সর্বমানবপ্রাণ সদাই ব্যাকুল। সাধারণের সেথায় প্রবেশ অসম্ভব; জড়ব্যূহ ভেদ করিয়া ইন্দ্রিয়সংযমী অতীন্দ্রিয়দর্শী সত্ত্বগুণপ্রধান পুরুষেরাই সে রাজ্যে গতিবিধি রাখেন, সংবাদ আনেন এবং অন্যকে পথ প্রদর্শন করেন। ইঁহারাই পুরোহিত, মানবসমাজের প্রথম গুরু, নেতা ও পরিচালক।

দেববিৎ পুরোহিত দেববৎ পূজিত হয়েন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া আর তাঁহাকে অন্নের সংস্থান করিতে হয় না। সর্বভোগের অগ্রভাগ দেবপ্রাপ্য, দেবতাদের মুখাদি পুরোহিত-কুল। সমাজ তাঁহাকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যথেষ্ট সময় দেয়, কাজেই পুরোহিত চিন্তাশীল হয়েন এবং তজ্জন্যই পুরোহিত-প্রাধান্যে প্রথম বিদ্যার উন্মেষ। দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয়-সিংহের এবং ভয়কম্পিত প্রজা-অজাযূথের মধ্যে পুরোহিত দণ্ডায়মান।

সিংহের সর্বনাশেচ্ছা পুরোহিতহস্তধৃত অধ্যাত্মরূপ কশার তাড়নে নিয়মিত। ধনজনমদোন্মত্ত ভূপালবৃন্দের যথেচ্ছা-চাররূপ অগ্নিশিখা সকলকেই ভস্ম করিতে সক্ষম, কেবল ধনজনহীন দরিদ্র তপোবলসহায় পুরোহিতের বাণীরূপ জলে সে অগ্নি নির্বাপিত। পুরোহিতপ্রাধান্যে সভ্যতার প্রথম আবির্ভাব, পশুত্বের উপর দেবত্বের প্রথম বিজয়, জড়ের উপর চেতনের প্রথম অধিকার-বিস্তার, প্রকৃতির ক্রীতদাস জড়পিণ্ডবৎ মনুষ্যদেহের মধ্যে অস্ফুটভাবে যে অধীশ্বরত্ব লুক্কায়িত, তাহার প্রথম বিকাশ।

পুরোহিত জড়-চৈতন্যের প্রথম বিভাজক, ইহ-পরলোকের সংযোগ-সহায়, দেব-মনুষ্যের বার্তাবহ, রাজা-প্রজার মধ্যবর্তী সেতু। বহুকল্যাণের প্রথমাঙ্কুর তাঁহারই তপোবল, তাঁহারই বিদ্যানিষ্ঠায়, তাঁহারই ত্যাগমন্ত্রে, তাঁহারই প্রাণসিঞ্চনে সমুদ্ভূত; এজন্যই সর্বদেশে প্রথম পূজা তিনিই পাইয়াছিলেন, এজন্যই তাঁহাদের স্মৃতিও আমাদের পক্ষে পবিত্র।

দোষও আছে; প্রাণ-স্ফূর্তির সঙ্গে সঙ্গেই মৃতবীজ উপ্ত। অন্ধকার আলোর সঙ্গে সঙ্গে চলে। প্রবল দোষও আছে, যাহা কালে সংযত না হইলে সমাজের বিনাশসাধন করে। স্থূলের মধ্য দিয়া শক্তির বিকাশ সর্বজনীন প্রত্যক্ষ, অস্ত্রশস্ত্রের ছেদ-ভেদ, অগ্ন্যাদির দাহিকাদি শক্তি, স্থূল প্রকৃতির প্রবল সংঘর্ষ সকলেই দেখে, সকলেই বুঝে। ইহাতে কাহারও সন্দেহ হয় না, মনেও দ্বিধা থাকে না।

কিন্তু যেখানে শক্তির আধার ও বিকাশকেন্দ্র কেবল মানসিক, যেখানে বল কেবল শব্দবিশেষে, উচ্চারণবিশেষে, জপবিশেষে বা অন্যান্য মানসিক প্রয়োগবিশেষে, সেথায় আলোয় আঁধার মিশিয়া আছে; বিশ্বাসে সেথায় জোয়ার-ভাঁটা স্বাভাবিক, প্রত্যক্ষেও সেথায় কখনও কখনও সন্দেহ হয়।

যেথায় রোগ, শোক, ভয়, তাপ, ঈর্ষা, বৈরনির্যাতন-সমস্তই উপস্থিত বাহুবল ছাড়িয়া, স্থূল উপায় ছাড়িয়া ইষ্টসিদ্ধির জন্য কেবল স্তম্ভন, উচ্চাটন, বশীকরণ, মারণাদির আশ্রয় গ্রহণ করে, স্থূল-সূক্ষ্মের মধ্যবর্তী এই কুজ্ঝটিকাময় প্রহেলিকাময় জগতে যাঁহারা নিয়ত বাস করেন, তাঁহাদের মধ্যেও যেন একটা ঐ প্রকার ধূম্রময়ভাব আপনা আপনি প্রবিষ্ট হয়! সে মনের সম্মুখে সরল রেখা প্রায়ই পড়ে না, পড়িলেও মন তাহাকে বক্র করিয়া লয়।

ইহার পরিণাম অসরলতা-হৃদয়ের অতি সঙ্কীর্ণ, অতি অনুদার ভাব; আর সর্বাপেক্ষা মারাত্মক, নিদারুণ ঈর্ষাপ্রসূত অপরাসহিষ্ণুতা। যে বলে, আমার দেবতা বশ, রোগাদির উপর আধিপত্য, ভূতপ্রেতাদির উপর বিজয়, যাহার বিনিময়ে আমার পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ঐশ্বর্য, তাহা অন্যকে কেন দিব? আবার তাহা সম্পূর্ণ মানসিক। গোপন করিবার সুবিধা কত!

এ ঘটনাচক্রমধ্যে মানবপ্রকৃতির যাহা হইবার তাহাই হয়; সর্বদা আত্মগোপন অভ্যাস করিতে করিতে স্বার্থপরতা ও কপটতার আগমন ও তাহার বিষময় ফল। কালে গোপনেচ্ছার প্রতিক্রিয়াও আপনার উপর আসিয়া পড়ে। বিনাভ্যাসে বিনা বিতরণে প্রায় সর্ববিদ্যার নাশ; যাহা বাকী থাকে, তাহাও অলৌকিক দৈব উপায়ে প্রাপ্ত বলিয়া আর তাহাকে মার্জিত করিবারও (নূতন বিদ্যার কথা তো দূরে থাকুক) চেষ্টা বৃথা বলিয়া ধারণ হয়।

তাহার পর বিদ্যাহীন, পুরুষকারহীন, পূর্বপুরুষদের নামমাত্রধারী পুরোহিতকুল পৈতৃক অধিকার পৈতৃক সম্মান, পৈতৃক আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য ‘যেন তেন প্রকারণে’ চেষ্টা করেন; অন্যান্য জাতির সহিত কাজেই বিষম সংঘর্ষ।

প্রাকৃতিক নিয়মে জরাজীর্ণের স্থানে নব প্রাণোন্মেষের প্রতি-স্থাপনের১৯ স্বাভাবিক চেষ্টায় উহা সমুপস্থিত হয়। এ সংগ্রামে জয়বিজয়ের ফলাফল পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে।

উন্নতির সময় পুরোহিতের যে তপস্যা, যে সংযম, যে ত্যাগ সত্যের অনুসন্ধানে সম্যক্ প্রযুক্ত ছিল, অবনতির পূর্বকালে তাহাই আবার কেবলমাত্র ভোগ্যসংগ্রহে বা আধিপত্য-বিস্তারে সম্পূর্ণ ব্যয়িত। যে শক্তির আধারত্বে তাঁহার মান, তাঁহার পূজা, সেই শক্তিই এখন স্বর্গধাম হইতে নরকে সমানীত। উদ্দেশ্য-হারা খেই-হারা পৌরোহিত্যশক্তি ঊর্ণাকীটবৎ আপনার কোষে আপনিই বদ্ধ;

যে শৃঙ্খল অপরের পদের জন্য পুরুষানুক্রমে অতি যত্নের সহিত বিনির্মিত, তাহা নিজের গতিশক্তিকে শত বেষ্টনে প্রতিহত করিয়াছে; যে সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ বহিঃশুদ্ধির আচার-জাল সমাজকে বজ্রবন্ধনে রাখিবার জন্য চারিদিকে বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহারই তন্তুরাশিদ্বারা আপাদমস্তক-বিজড়িত পৌরোহিত্যশক্তির হতাশ হইয়া নিদ্রিত। আর উপায় নাই, এ জাল ছিঁড়িলে আর পুরোহিতের পৌরোহিত্য থাকে না।

যাঁহারা এ কঠোর বন্ধনের মধ্যে স্বাভাবিক উন্নতির বাসনা অত্যন্ত প্রতিহত দেখিয়া এ জাল ছিঁড়িয়া অন্যান্য জাতির বৃত্তি-অবলম্বনে ধন-সঞ্চয়ে নিযুক্ত, সমাজ তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের পৌরোহিত্য-অধিকার কাড়িয়া লইতেছেন। শিখাহীন টেড়িকাটা, অর্ধ-ইওরোপীয় বেশভূষা-আচারাদি-সুমণ্ডিত ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যে সমাজ বিশ্বাসী নহেন।

আবার-ভারতবর্ষে যেথায় এই নবাগত ইওরোপীয় রাজ্য, শিক্ষা এবং ধনাগমের উপায় বিস্তৃত হইতেছে, সেথায়ই পুরুষানুক্রমাগত পৌরোহিত্য-ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়া দলে দলে ব্রাহ্মণযুবকবৃন্দ অন্যান্য জাতির বৃত্তি অবলম্বন করিয়া ধনবান্‌ হইতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই পুরোহিত-পূর্বপুরুষদের আচার-ব্যবহার একেবারে রসাতলে যাইতেছে।

গুর্জরদেশের ব্রাহ্মণজাতির মধ্যে প্রত্যেক অবান্তর সম্প্রদায়েই দুইটি করিয়া ভাগ আছে-একটি পুরোহিত-ব্যবসায়ী, অপরটি অপর কোন বৃত্তি দ্বারা জীবিকা করে। এই পুরোহিত-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ই উক্ত প্রদেশে ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত এবং অপর সম্প্রদায় একই ব্রাহ্মণকুলপ্রসূত হইলেও পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা তাঁহাদের সহিত যৌন-সম্বন্ধে আবদ্ধ হন না। যথা ‘নাগর ব্রাহ্মণ’ বলিলে উক্ত ব্রাহ্মণজাতির মধ্যে যাঁহারা ভিক্ষাবৃত্ত পুরোহিত, তাঁহাদিগকেই কেবল বুঝাইবে।

‘নাগর’ বলিলে উক্ত জাতির যাঁহারা রাজকর্মচারী বা বৈশ্যবৃত্ত, তাঁহাদিগকে বুঝায়। কিন্তু এক্ষণে দেখা যাইতেছে যে, উক্ত প্রদেশসমূহেও এ বিভাগ আর বড় চলে না। নাগর ব্রাহ্মণের পুত্রেরাও ইংরেজী পড়িয়া রাজকর্মচারী হইতেছে, অথবা বাণিজ্যাদি ব্যাপার অবলম্বন করিতেছে। টোলের অধ্যাপকেরা সকল কষ্ট সহ্য করিয়া আপনাপন পুত্রদিগকে ইংরেজী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করাইতেছেন এবং বৈদ্য-কায়স্থাদির বৃত্তি অবলম্বন করাইতেছেন।

যদি এই প্রকার স্রোত চলে, তাহা হইলে বর্তমান পুরোহিত-জাতি আর কতদিন এদেশে থাকিবেন, বিবেচ্য বিষয় সন্দেহ নাই। যাঁহারা সম্প্রদায়বিশেষ বা ব্যক্তিবিশেষের উপর ব্রাহ্মণজাতির অধিকার-বিচ্যুতি-চেষ্টারূপ দোষারোপ করেন, তাঁহাদের জানা উচিত যে, ব্রাহ্মণজাতি প্রাকৃতিক অবশ্যম্ভাবী নিয়মের অধীন হইয়া আপনার সমাধিমন্দির আপনিই নির্মাণ করিতেছেন। ইহাই কল্যাণপ্রদ, প্রত্যেক অভিজাত জাতির স্বহস্তে নিজের চিতা নির্মাণ করাই প্রধান কর্তব্য।

শক্তিসঞ্চয় যে প্রকার আবশ্যক, তাহার বিকিরণও সেইরূপ বা তদপেক্ষা অধিক আবশ্যক। হৃৎপিণ্ডে রুধিরসঞ্চয় অত্যাবশ্যক, তাহার শরীরময় সঞ্চালন না হইলেই মৃত্যু। কুলবিশেষে বা জাতিবিশেষে সমাজের কল্যাণের জন্য বিদ্যা বা শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া এককালের জন্য অতি আবশ্যক, কিন্তু সেই কেন্দ্রীভূত শক্তি কেবল সর্বতঃ সঞ্চারের জন্য পুঞ্জীকৃত। যদি তাহা না হইতে পায়, সে সমাজ-শরীর নিশ্চয়ই ক্ষিপ্র মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!