ভবঘুরেকথা
টুনটুন ফকির

-ফিরোজ এহতেশাম

টুনটুন: বাউলদের কোনো রাজনীতি নাই। বাউলদেরকে নিয়ে রাজনীতি করছে। বাউল না খেয়ে মরে যাচ্ছে, ওদিকে যে ক্ষমতার চেয়ারে বসতেছে সে কিন্তু ঠিকই মাল নিজের পকেটে ভরছে। আজকাল সরকার তো কোনো নেতাকে থানায় যেতে বা কথা বলতে দিচ্ছে না।

সরকার বলছে, তোমরা বাড়ি থাক, তোমাদের ভাগ পৌঁছে যাবে। তুমি সুপারিশও করতে এস না। এরকমই, আল্লাহর কাজে সুপারিশও হয় না-

‘খাটবে না লালন ভেঁড়ে
তোর টাকশালে চাতুরি,
মনেরই নেংট এটে
কর রে ফকিরি।।’

মনের কোনো রূপ নাই, সেক্সের কোনো রূপ নাই।

ফিরোজ: বিমূর্ত? মূর্ত না আরকি?

টুনটুন: হুঁ, রূপ নাই। আবার রূপ আছে। বস্তু যখন তখন তার রূপ আছেই। তো এরকম বস্তুবিহীন কথা কখনও লালন ফকির বলে নাই। নতুন করে বাংলা বলতে হবে, লালন ফকির এরকম কোনো বাংলা মানতে যায় নি।

ফিরোজ: আপনি কখনও গান লেখেন নি?

টুনটুন: আমি গান লিখতে গিয়ে দেখেছি, কিছু লিখতে গেলে লালন সাঁইয়ের কথাই চলে আসে। আমার প্রভুর কথাই চলে আসে, আর কারও কথা আসে না।

অতএব, তখন থেকে জানি যে খালি গাইতে হবে, আমার জন্য লেখা না। তখন থেকেই আমি গাওয়ার চেষ্টা করি এবং নিজেই সুর করি। লালন সাঁইয়ের সুর এ পর্যন্ত যা করেছি তা সব আমার নিজের করা সুর।

ফিরোজ: আপনি করছেন?

টুনটুন: আমার সব নিজের করা সুর।

ফিরোজ: মানে যেসব গানের সুর করা হয় নাই, এরকম গানগুলার সুর আপনি করছেন?

টুনটুন: এরকম কোনো গান আমি… অনেক সুর আছে, আমি আমার মতো করেছি।

ফিরোজ: ও, লালন সাঁইয়ের যেসব প্রচলিত সুর আছে, সেসব না করে আপনি নিজের মতো করে করছেন?

টুনটুন: না, প্রচলিত বলতে গেলে যেমন, ফরিদা পারভিন ১২ খানা গান নিয়ে, আজ পর্যন্ত ওই ১২ খানা গান নিয়েই ঘুরছে। আমার তা না। আমার ২৫০টা গান রেকর্ডিং হয়ে গেছে লালন সাঁইয়ের।

ফিরোজ: ২৫০টা গান!

টুনটুন: হ্যাঁ, এখনও আড়াই শ’, তিন শ’ গান আছে এরকম এইটা রেকর্ডিং করব সামনে। মানে সিডির মার্কেট নাই, গানে আর কেউ ইনভেস্ট করছে না। চ্যানেল আই সামনেই, দিন কয়েক পরেই, ঈদের পরের থেকেই আমার কাজ শুরু করবে। আমি এককভাবে এখানে অনুষ্ঠান করব।

ফিরোজ: আপনার কাছে ফকিরির মানে কী?

টুনটুন: ফকিরি হচ্ছে ত্যাগ। ফকিরি হচ্ছে নিজেকে খোদা মেনে, গুরু যা বলে দিবে সেটা। গুরু কী বলবে? ও কথাই বলবে। তাই নিজেকে খোদা ভাবতে হবে। নিজেকে খোদা মনে করতে পেরে খোদাকে ভজতে হবে। কিন্তু তুমি যদি, না… তুমি খাও, পড়, শোও, গোসল কর, অনেক কিছু কর।

খোদা খায়ও না, পড়েও না, শোয়ও না, এক সেকেন্ড তন্দ্রা নাই। ও তোমার দায় আছে তাই ওকে দায়েমি করে ফেল। আদমের দায়েই তিনি আমার কাছে থাকার একমাত্র বাহানা।

ফিরোজ: সহজ মানুষ কী?

টুনটুন: সহজ মানুষ এই যে, বিবেক।

ফিরোজ: বিবেক?

টুনটুন: সহজ মানুষের কোনো রূপ নাই। সহজ মানুষ খারাপ কাজ কখনও… বিবেক কি কখনও খারাপ কাজ নেয়?

ফিরোজ: না।

টুনটুন: তাহলে ওটা কে? তোমার মধ্যে আছে লুকিয়ে। তুমি একটা খারাপ কাজ করতে গেলে, না, বিবেক তোমায় বাধা দিবে। ওটা কে?

ফিরোজ: ওইটাই সহজ মানুষ?

টুনটুন: ওইটাই সহজ মানুষ।

ফিরোজ: লালন হিন্দু নাকি মুসলমান- এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করাটাকে কি বোকামি বা হাস্যকর না? এটাকে আপনি কী চোখে দেখেন? যেখানে লালন নিজেই ছিলেন এসব ধর্মের ঊর্ধ্বে? তাঁর অসংখ্য গানে এসবের প্রমাণ আছে। তাঁর গানই তো তাঁর জীবনদর্শন।

টুনটুন: বোকামি। লালন কয় জাত হাতে পেলে পোড়াতাম আগুন দিয়ে। কেন, কোন দুঃখে বলে গেল? রে বেটা, একই ঘাটে আসা-যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া… জন্মদ্বারও একইরকম। ওই জন্মদ্বারই হচ্ছে প্রভু। ওখানেই প্রভু বিরাজ করে। জন্মদ্বারটা নট এ মা, নট এ বাপ, ওটা প্রভু।

ফিরোজ: প্রভু। মানে যোনি যেটা, স্ত্রী যোনি?

টুনটুন: যোনি। অযোনি সহজ সংস্কার… একটা মেয়ের কাছে তুমি থাকলে পাঁচ বছর, যদি তোমার গিন্নি হয় তো তোমাক একসময় ত্যালাবে- কী ব্যাপার তুমি কী করছ, হেনতেন… আর যদি তোমার ওর সঙ্গে ওই সম্পর্ক না থাকে, তুমি যদি তাকে ভালোবাস পাঁচ বছর, তারপরও দেখে তোমায় কোনোদিন বলবে না যে, তুমি এই কাজ করো।

কেননা, তুমি যদি, না, তোমার মনের ইঙ্গিত পেয়েই ও তোমাক ভালোবাসতে শিখবে। এখন তুমি যদি ইঙ্গিত না দাও তাহলে তো কোনোদিন তোমাকে বলবে না। কোনোদিন বলবে না। অতএব, যাতে, কেন বলবে না যে, মেয়েরা কঠিন জিনিস। বুক ফাটে, মুখ ফুটে না।

অল্পতে গলে যায়। কিন্তু ওর সঙ্গে ওইরকম করে তুমি সুখ পাবা না। কোনো মেয়েদের সাথে জীবনে কোনোদিন খারাপ ভাষা ব্যবহার কোরো না। খালি মেয়েদের পক্ষে না, তোমার সিনিয়ার, এমনকি তোমার জুনিয়ারদের সাথে বেশি করে ভালো কথা ভালো করি বলতে হবে। যাতে ওরা তোমাকে ধারণ করতে পারে।

ফিরোজ: লালন তো ছিলেন প্রচলিত সব ধর্মের ঊর্ধ্বে?

টুনটুন: ধর্মের ঊর্ধ্বে মানে হিন্দু ভাষায় হচ্ছে সনাতন আর ইসলামী ভাষায় হচ্ছে সুফী। সুফী আর সনাতনে পাশাপাশি। একই কার্যক্রম।

ফিরোজ: লালনের মতবাদ তো হিন্দুদের বৈষ্ণববাদ, মুসলমানদের সুফীবাদ আর বৌদ্ধদের সহজিয়া মতবাদের মিশ্রণে গঠিত হইছে।

টুনটুন: না, না, কোনো বাদই না, এসব অনেক পরে আইছে। ইসলাম সর্বপ্রথম। সৃষ্টি থেকেই ইসলাম। এই ইসলামকে বুঝতে না পারার দরুন বহু লাইন দিয়ে এখানে ওখানে চলে গেছে।

ফিরোজ: কিন্তু ইতিহাস তো বলে যে ইসলাম হচ্ছে সর্বশেষ ধর্ম?

টুনটুন: সর্বশেষ ধর্ম এবং সর্বপ্রথম ধর্ম। প্রথম এবং ওটাই সর্বশেষ। আমি লালন সাঁইকে মুসলমান বলব না, লালন সাঁইকে হিন্দু বলব না, লালন সাঁই হচ্ছেন একজন স্বনামধন্য মানুষ। যার আছে মানবতা। তিনি মানবতার কথাই বলেছেন। যে, সত্যের অনুসন্ধানী যারা, তারা যদি ওটাকে আল্লাহ না মানে তাহলে সত্য খোঁজা হবে?

ফিরোজ: না, খোঁজা হবে না।

টুনটুন: লালন সাঁইকে মুসলমান বা হিন্দু বলে আমি ছোট করতে চাই না। লালন হচ্ছে আমার মহামানব। মানবতার শ্রেষ্ঠ মানবের উদাহরণ, দৃষ্টান্ত।

ফিরোজ: লালনকে নিয়ে যে দুটি উৎসব হয় কুষ্টিয়ায় সেগুলা নিয়ে একটু বলেন-

টুনটুন: ১লা কার্তিক হচ্ছে লালনের ওফাত দিবস।

ফিরোজ: মানে উনি মারা গেছেন। ও, মারা গেছেন তো বলা যাবে না?

টুনটুন: না, উনি মরবে কেন?

কোন নবী হলেন ওফাত
কোন নবী বান্দার হায়াত,
লেহাজ করে জানলে
নেহাত যাবে রে সংশয়।

নবী না চিনলে সে কি খোদার ভেদ পায়। লালন সাঁই হচ্ছেন সেই জন।

ফিরোজ: ও আচ্ছা-আচ্ছা, উনারই রূপ আরেকটা নাকি?

টুনটুন: উনিই।

ফিরোজ: উনিই?

টুনটুন: উনিই লালন সাঁই। শেষ নবী আর আসবেন না, তাই বলে কি বার্তা আসবে না?

ফিরোজ: বার্তা তো আসবে।

টুনটুন: লালন সাঁই বাংলা ভাষায় বলে দিয়ে গেল যে, এই ধর্ম, এটা এই।

ফিরোজ: ও আচ্ছা। বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। আচ্ছা, বাউলরা যে সন্তান নেয় না, এটার কারণ কী? যুক্তিটা কী?

টুনটুন: এরা জন্মনিয়ন্ত্রণকারী।

ফিরোজ: কেন?

টুনটুন: সৃষ্টি করলে তো… ওই ব্যক্তি সৃষ্টি করে না বলতে গেলে কি, সবাই করে ফেলে আর করে না। তো, করে ফেলে আর করে না মানে? যখন গুরুর আদেশ হয় তখন থেকে ওটা করে না। যেহেতু ওই জায়গাটা নামাজের জায়গা, পবিত্র।

গুপ্ত অঙ্গের হেফাজত করতে হবে। গুপ্ত অঙ্গের হেফাজত মানে? অধপদই ঊর্ধ্বপদ। মানে জন্মদ্বারই ওইটা। অধপদই ঊর্ধ্বপদ। অতএব ধর্ম করতে হলে নিজকে আগে জানতে হবে। নিজেকে জানাটাই ধর্ম। জানতে পারলে জন্মদ্বারটাও জানা যাবে। জন্মদ্বারটাকে না জানলে পরে খোদা চেনা যাবে না।

ফিরোজ: কেন নেয় না সন্তান?

টুনটুন: কেন মানে সাধনার বিঘ্ন ঘটবে। হয়ত মানুষ হবে না। হয়ত জানোয়ার সৃষ্টি হবে।

ফিরোজ: সৃষ্টি কি করতে চায় না এই কারণে?

টুনটুন: নফসের বন্দেগি করতে হবে, নফস। তোমার নফসের ইচ্ছা করলে হবে, নাইলে হবে না।

ফিরোজ: অটল পুরুষের কথা যে আপনারা বলেন…

টুনটুন: অটল পুরুষ। যে ব্যক্তি সাধনার শীর্ষে পৌঁছে যাবে। যার আর কাম, ধাম, এই পৃথিবীর গন্ধ যার কাছে আর থাকে না, সে-ই হলো অটল পুরুষ।

ফিরোজ: জ্যান্তে মরা…

টুনটুন: হ্যাঁ, সে জ্যান্তে মরে গেছে।

ফিরোজ: জ্যান্তে মরে গেছে।

টুনটুন: প্রাণ থাকতে সে মরে গেছে একেবারে। আর ওর মরার ভয় নাই।

ফিরোজ: এতক্ষণ তো প্রশ্ন করলাম, আপনার কি মনে হয় এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমি করি নাই যা আপনি বলতে চান?

টুনটুন: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলতে গেলে ধর্মটা খুব গুপ্ত জিনিস। ধর্মটা গুপ্ত জিনিস বলতে কী করম গুপ্ত জিনিস?

ফিরোজ: কী করম?

টুনটুন: বলে যে, পাঁচ ওয়াক্ত আমি তো পড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত তো সব কিছুই মনে থাকে। মসজিদে যাতে ঈমান মেনে যাই, সব কিছু মনে থাকে।

আল্লাহ বলেছে এমন জায়গায় গিয়ে নামাজ আদায় করো যেখানে আর পৃথিবীর কিছুই খেয়াল থাকে না। তো সেটা কোথায়? নারী আর পুরুষ এক জায়গায় হলে আর কিছু খেয়াল থাকে না পৃথিবীর।

ফিরোজ: ওটাই কি দায়েমী নামাজ?

টুনটুন: ওটাই দায়েমী নামাজের জায়গা। এখন তুমি যদি কায়েমী হয়ে যাও, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা- তাহলে তো হবে না। ওটা নামাজ পড়ার জায়গা।

ফিরোজ: এছাড়া আর কোনো কিছু বলতে চান নিজে থেকে?

টুনটুন: না, আর নিজে থেকে কী বলব-

ফিরোজ: লালনের সাধন পদ্ধতি নিয়ে কি কিছু বলা যাবে?

টুনটুন: সাধন পদ্ধতি বলতে গেলে যারা সোম্যরসের উপাসনা করে, যারা সেই কার্য করে তারা খাওয়া-দাওয়া, যেমন, মাছ-মাংস খায় না, পিঁয়াজ-রসুন খায় না, তারা সেবা করে আলো চালের ভাত…

ফিরোজ: সবজি খায়।

টুনটুন: সবজি, শাক-সবজি, আম, দুধ- এসব।

ফিরোজ: কেন খায় না? বীজ (বীর্য) উৎপন্ন হবে সেই কারণে?

টুনটুন: না, ওটা নোংরা হবে, সুরসের হবে না। মাংস খেলে কুরস হবে। মাছ হলে কুরস হবে। ডিম খেলে কুরস হবে।

ফিরোজ: কুরসের বৈশিষ্ট্য কী?

টুনটুন: কুরস বলতে গেলে, তুমি যদি সবজি বা ফল খাও, কুরসটা হবে না। মাছ-মাংসতে কুরস হয়।

ফিরোজ: মানে বীর্য যেইটা ওইটা কি…

টুনটুন: বীর্য তৈরী হয় না।

ফিরোজ: বীর্য তৈরী না হওয়ার জন্যই তো এসব খায় না?

টুনটুন: বীর্য তৈরী হয় না। এটা মৈথুনে তৈরী হয়। মৈথুনদারিতে সৃষ্টি হয়। কিন্তু এমনও সাধু আছে যে মৈথুনদারি থাকবে কিন্তু ওইটা সৃষ্টি করবে না।

ফিরোজ: ও, মানে ঊর্ধ্বরেতা যেটা? যার শুক্র বা বীর্য ঊর্ধ্বগামী? পড়বে না বা স্খলিত হবে না?

টুনটুন: না। অষ্ট পাস করে বসে আছে।

ফিরোজ: নারীর?

টুনটুন: নারীরটা হবে।

ফিরোজ: নারীর তৃপ্তি হবে কিন্তু পুরুষের বীর্য স্খলিত হবে না?

টুনটুন: না।

ফিরোজ: অটল। উনিই তো অটল?

টুনটুন: হ্যাঁ, উনিই অটল।

(সমাপ্ত)

………..
আরো পড়ুন:
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: এক

যে পেল সেই রূপের সন্ধান: দুই
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: তিন
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: চার

…………
সাক্ষাৎকারটি ফিরোজ এহতেশামের ‘সাধুকথা: ১৩ বাউল-ফকিরের সাথে কথাবার্তা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রিত

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!