ভবঘুরেকথা
নিরাহারা মায়ের সন্ধানে

নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে

রাইট সাহেব ফোর্ড গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞাসা করল, ‘গুরুদেব, আজ সকালে কোথায় যাওয়া হবে?’ বলে, রাস্তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমার দিকে স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। কারণ দিনের পর দিন তাকে যে রকমভাবে বেরিয়ে পড়তে হত, তাতে বেচারা জানতেই পারত না যে আগামীকাল তাকে বাংলাদেশের কোন অংশ আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করতে হবে।

সোৎসাহে উত্তর দিলাম, ‘ঈশ্বরের যদি কৃপা হয়, তাহলে আজ আমরা বেরোচ্ছি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখতে-এক সাধ্বী মহিলা, যিনি মাত্র বায়ু সেবন করেই বেঁচে থাকেন।’

রাইট সাহেব সমান আগ্রহে হেসে বলল, ‘থেরেসা ন্যোয়ম্যানের পর এ যে আর এক আশ্চর্য ব্যাপার!’ আর উৎসাহের চোটে গাড়ির গতিও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দিল। তার ভ্রমণ ডায়েরীর মধ্যে এটাও হবে এক অত্যাশ্চর্য বিবরণ, যা কোন সাধারণ পর্যটকের পক্ষে সহজলভ্য নয়! রাঁচী বিদ্যালয় সবেমাত্র আমরা পিছনে ছেড়ে এসেছি; সূর্যোদ্বয়ের আগেই আমরা সব জেগে উঠেছি।

দলের মধ্যে আমার সেক্রেটারি আর আমি ছাড়া আরও তিন বাঙালি বন্ধু ছিলেন। ভোরের বাতাস শরীরে একটা অপূর্ব পুলকশিহরণ এনে দিচ্ছিল। আমাদের গাড়ির চালককে তখন অতি সন্তর্পণে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল।

ভোরবেলায় কৃষকেরা সব বেরিয়েছে জোয়াল কাঁধে ধীরে চলা উচ্চককুদ বলদটানা দুচাকার গাড়ি নিয়ে- তাদের রাজ্যে ভক্ ভক্ করে মোটর গাড়ির অনধিকার প্রবেশ তারা সহজে বরদাস্ত করবে কেন?

রাইট সাহেব বলল, ‘গুরুদেব, এঁর সম্বন্ধে আরও কিছু বলুন, শুনতে বড্ড ইচ্ছে করছে।’

আমি শুরু করলাম, ‘এঁর নাম হচ্ছে গিরিবালা।’  বহুবছর আগে, স্থিতিলাল নন্দী নামে জনৈক পণ্ডিত ভদ্রলোকের কাছ থেকে এর বিষয় আমি প্রথম শুনি। তিনি আমার ভাই বিষ্ণুকে পড়াতে আমাদের গড়পারের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। স্থিতিবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি গিরিবালাকে বেশ ভাল করেই জানি; তিনি এমন একটা বিশেষ যোগপ্রক্রিয়া অভ্যাস করেন, যাতে করে আহার বিনাই জীবনধারণ করতে পারেন।’

ইছাপুরের কাছে নবাবগঞ্জে তাঁর বাড়ি, তিনি আমাদের নিকট প্রতিবেশিনী ছিলেন। তাঁর উপর ভালোভাবে লক্ষ্য রেখে অনেকদিন ধরে দেখলাম, কিন্তু তাঁর পানভোজনের প্রমাণ একটা দিনের জন্যেও বার করতে পারলাম না। আমার আগ্রহ তখন এতদূর বেড়ে উঠল যে শেষপর্যন্ত আমি বর্ধমানের মহারাজার কাছে গিয়ে তাঁকে ব্যাপারটার একটা তদন্ত করবার জন্যে অনুরোধ করলাম।

ব্যাপারটা শুনে তো অবাক হয়ে মহারাজা গিরিবালাকে তাঁর প্রাসাদে আমন্ত্রণ করলেন। গিরিবালা মহারাজার পরীক্ষায় সম্মত হয়ে তাঁর প্রাসাদের একটা অংশে মাস দুই অতিবাহিত করেন। সেই অংশটা চাবি দেওয়াই থাকত। পরে তিনি একবার রাজপ্রাসাদে এসে দিনকুড়ি, আর তৃতীয়বার এসে দিনপনেরো থেকে যান।

মহারাজা নিজে আমাকে বলেছেন যে, এই তিনটে খুব কঠিন পরীক্ষায় নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাস্তবিকই তিনি নিরম্বু উপবাস করে থাকেন-কিছুই খান না।’

স্থিতিবাবুর এই গল্পটি পঁচিশ বছরেরও উপর আমার মনের মধ্যে রয়েছে। আমেরিকায় বসে কখনও কখনও ভাবতাম- এই অপূর্ব যোগীনির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবার পূর্বে কালস্রোত তাঁকে গ্রাস করে ফেলবে না তো? এখন অবশ্য তিনি বেশ বৃদ্ধাই হবেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন কিনা, আর যদিই বা থাকেন, তাহলে কোথায় থাকেন তাও আমি জানি না।

যাইহোক, আর ঘণ্টাখানেক বাদেই পুরুলিয়ায় গিয়ে পৌঁছব; সেখানে তাঁর ভাইয়ের বাড়ি আছে। সাড়ে দশটার সময় আমাদের ছোট দলটি পুরুলিয়ায় শ্রীযুক্ত লম্বোদর দে মহাশয়ের বাড়িতে উপস্থিত হলো; পুরুলিয়ার তিনি একজন উকিল। কথাবার্তা শুরু হল।

আমাদের প্রশ্নের উত্তরে লম্বোদরবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার ভগিনী এখনো বর্তমান। কখনও সখনও তিনি এখানে এসে আমার কাছে কিছুদিন থাকেন। কিন্তু এখন তিনি বিউরে আমাদের দেশের বাড়িতেই আছেন।’ তারপর লম্বোদরবাবু ফোর্ড গাড়িটার দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন-

‘স্বামীজী, আমার তো মনে হয় না যে, কোন মোটরগাড়ি এ পর্যন্ত বিউর অবধি গিয়ে ঢুকতে পেরেছে। তারচেয়ে বরং গরুর গাড়ির ঝাঁকানির হাতে নিজেদের সমর্পণ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ!’

‘নাঃ এমনটি হয় না বটে। আমেরিকায় থাকতে আম না পেয়ে কত দুঃখই যে হতো। আম ছাড়া হিন্দুর স্বর্গ কল্পনাই করা যায় না!’

ডিট্রয়েটের গৌরব আমাদের ফোর্ড গাড়িটির প্রতিদলের সকলেই সমস্বরে আনুগত্য জানাল। আমি উকিল মহাশয়কে বললাম, ‘ফোর্ড গাড়িটি আমেরিকা থেকে এসেছে। এ বেচারাকে যদি গ্রামবাংলার সঙ্গে পরিচয় ঘটতে দেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়, তা হলে সেটা তার প্রতি নিতান্তই অবিচার করা আর বড় লজ্জার বিষয় হবে!’

কি আর করেন, অবশেষে লম্বোদরবাবু একটু হেসে বললেন, ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ আপনাদের সহায় হোন!’ তারপর সৌজন্য সহকারে বললেন, ‘যদি একবার সেখানে পৌঁছতে পারেন, তা হলে গিরিবালা যে আপনাদের দেখে খুব খুশিই হবেন সেকথা আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি। বয়স তাঁর প্রায় সত্তর হয়ে এল; কিন্তু স্বাস্থ্য তাঁর এখনও খুব চমৎকারই আছে।’

মনের দর্পণ হচ্ছে মানুষের দুটি চোখ; সোজাসুজি তাঁর সেই মনের গবাক্ষ, চোখদুটির উপর দৃষ্টি স্থাপন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মশায়! আচ্ছা দয়া করে আমায় বলুন তো, তিনি যে একদম কিছুই খান না, এটা কি খাঁটি সত্যি?’

‘খাঁটি সত্যি মশায়।’ দৃষ্টি তাঁর সরল ও অকপট। তারপর তিনি বললেন, ‘পঞ্চাশ বছরেরও উপর আমি তো তাঁকে কখন একগ্রাসও খেতে দেখিনি। আজ যদি পৃথিবী হঠাৎ প্রলয়ে ধ্বংসও হয়ে যায়, তাহলে আমি যত না আশ্চর্য হব, তারচেয়ে বেশি আশ্চর্য হব আমার ভগিনীকে আহার করতে দেখলে!’

এ দুটো মহাজাগতিক ঘটনা ঘটার অসম্ভব্যতার বিষয় স্মরণ করে আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। লম্বোদরবাবু বলতে লাগলেন, ‘গিরিবালা তাঁর যোগসাধনে কখনও এমন নির্জনতা খোঁজেননি যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। সারা জীবনটাই তাঁর সংসার আর আত্মীয়পরিজনের সহচর্যেই কেটেছে। তাঁর এইরকম অদ্ভুত অবস্থা এখন তাদের কাছে সব সয়ে গেছে।

তাদের মধ্যে এমন একজন কেউ নেই যে, গিরিবালা দেবীকে খাদ্যগ্রহণ করতে দেখলে একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে যাবে! স্বভাবতঃই ভগিনী একটু গম্ভীর, চাপা স্বভাবের মহিলা- হিন্দু বিধবারা যেমন হয়; কিন্তু পুরুলিয়া আর বিউরে আমাদের ছোট পরিবারের সকলেই জানে যে, বলতে গেলে প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ‘অসাধারণ’ স্ত্রীলোক।

ভগিনীর প্রতি ভ্রাতার আগাধ বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবেই প্রতিয়মান হল। আমরা সকলেই তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বিউরের দিকে যাত্রা করলাম। রাস্তার ধারে এক খাবারের দোকানের কাছে দাঁড়ানো গেল, কিছু খেয়ে নেবার জন্যে। লুচি আর তরকারি; সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় ভবঘুরে ছোঁড়াদের বেশ ভিড় লেগে গেল।

রাইট সাহেব বিনা কাঁটাচামচেতে হিন্দুদের মত হাতের আঙুল দিয়ে লুচি ছিঁড়ে খাচ্ছে দেখে তো তাজ্জব বনে গেল; যাক, আমাদের সবাইকার তখন ক্ষিধেও পেয়েছিল বেশ, বিকেলে জুটবে কি জুটবে না ভেবে সকাল সকাল সব সেরে নেওয়া গেল; কেন না এরপর আবার অনেক ঘোরাঘুরি আছে।

গাড়ি দৌঁড়াল বর্ধমান জেলার ভেতর দিয়ে পূর্বদিকে। চারধারে রোদেপোড়া ধানের ক্ষেত, রাস্তার দুধারে ছায়াঘন গাছপালার সারি; প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছাতার মত গাছের ডাল হতে সব ময়না, গলায় ডোরাকাটা বুলবুলের গান ভেসে আসছে। লোহার হালবাধান চাকার গ্রাম্য গরুগাড়ির রিনিঝিনি, রিনি মঞ্জু মঞ্জু শব্দের সঙ্গে মনে মনে তুলনা করতে লাগলাম।

শহরের অভিজাত পিচবাঁধান রাস্তায় মোটর টায়ারের সর-র-র শব্দ। গাড়ি উদ্দামগতিতে ছুটে চলেছে। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, ‘ডিক, থাম, থাম! দেখ দেখ, আমগাছটা যেন ফলে ভেঙে পড়ছে। এ সাদর নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করলে বৃক্ষরাজের প্রতি নিতান্ত অসম্মান প্রদর্শন করা হবে, কি বল ?’ আমার হঠাৎ অনুরোধে ফোর্ড গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল।

পাঁচজনে গাড়ি থেকে নেমে পরে ছোট ছেলেদের মত ছুটলাম সেই আমতলায়; রাশি রাশি পাকা আম চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। আমি একটা সুপ্রসিদ্ধ কবিতার অনুকৃতি করে বললাম,-

“বহু সুরসাল রসাল ফলেছে চোখের অন্তরালে,
হারাতে তাদের মধুর স্বাদ পাথুরে জমির পরে”

শৈলেশ মজুমদার নামে আমার একটি ছাত্র একগাল হেসে বলল, ‘আমেরিকায় আর এমনটি হতে হয় না, কি বলেন স্বামীজি?’ অত্যন্ত পরিতৃপ্তি সহকারে আম্ররস আস্বাদন ও তজ্জনিত সন্তোষ লাভের আনন্দরসে পরিপ্লুত হয়ে অকপটে স্বীকার করতে হল যে, ‘নাঃ এমনটি হয় না বটে। আমেরিকায় থাকতে আম না পেয়ে কত দুঃখই যে হতো। আম ছাড়া হিন্দুর স্বর্গ কল্পনাই করা যায় না!’

খুব উঁচু ডালে একটা বেশ বড়ো আর পাকা আম ঝুলছিল; একটা ইটের ঘায়ে সেটাকে পেরে ফেললাম। দেখা গেল রোদে সেটা গরম হয়ে রয়েছে। তারপর সেই অমৃত ফল আস্বাদনের মাঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডিক, আমাদের সব ক্যামেরাগুলোই কি গাড়িতে রেখে এসেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ গুরুদেব, ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টে!’

‘দেখ, যদি গিরিবালা সত্যিকারের একজন খুব উঁচুদরের সাধিকা হন, তা হলে আমেরিকায় গিয়ে তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছু লিখব। এমন অপূর্ব শক্তির আধার এই হিন্দু যোগিনী যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে ইহজগৎ পরিত্যাগ করে যাবেন সে হতে পারে না- এই আমগুলোর যা দশা হচ্ছিল তার মতো আর কি! কি বল?’

আরও আধঘণ্টা কাটল, তখনও আমরা ছায়াসুনিবিড় স্নিগ্ধ শান্তির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

রাইট সাহেব বললেন, ‘গুরুদেব, গিরিবালা দেবীর বাড়ি আমাদের সূর্যাস্তের আগেই পৌঁছন দরকার, যাতে করে ফটো নেবার জন্যে যথেষ্ট আলো পাওয়া যেতে পারে।’ তারপর একটু হেসে বলল, ‘মুশকিল হচ্ছে, আমেরিকানরা আবার একটু সন্দিগ্ধ প্রকৃতির কিনা, তাই এঁর সম্বন্ধে কিছু বিশ্বাস করতে হলে ফটো না হলে তো চলবে না!’

তার কথা যথার্থ বটে, তর্ক করা চলে না; কাজেই লোভ সম্বরণ করে গাড়িতে অনুঃপ্রবেশ করা গেল।

যেতে যেতে সখেদে দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে বললাম, ‘ডিক, তোমার কথা ঠিক! আমেরিকার বাস্তুতন্ত্রতার বেদীতে আজ আমের স্বর্গকে আমি বলি দিলাম। যাক, ফটোগ্রাফ কিন্তু আমাদের নিতেই হবে!’

রাস্তা ক্রমশই ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসতে লাগল। গরুর গাড়ির চাকার দাগ, শক্ত মাটির ঢেলা-যেন বার্ধক্যের জরাজীর্ণ অবস্থা! আমাদের চারজনের দল মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটাকে পিছন দিক দিয়ে ঠেলে এগিয়ে দিতে লাগল যাতে করে রাইট সাহেব ফোর্ড গাড়িটাকে আরও একটু সহজে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

শৈলেশকে স্বীকার করতে হল, ‘লম্বোদরবাবু ঠিকই বলেছিলেন; এখন দেখছি যে গাড়ি আমাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে না, আমরাই গাড়িকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি!’

মা, পঁচিশ বছরেরও উপর আমি সাগ্রহে আপনার দর্শন কামনা করে আসছি। আপনার এ পূণ্যজীবনের কথা স্থিতিলাল নন্দীবাবুর কাছ থেকেই শুনেছিলাম।

আমরা এগোতে লাগলাম পুরনো গরুর গাড়ির চাকার দাগ ধরে; একধারে মেয়েরা তাদের কুঁড়েঘরের দরজা থেকে বিস্ময় বিস্ফাোরিত চোখে চেয়ে আছে, আর একধারে পুরুষেরা পাশেপাশে আর পিছনপিছন আসতে লাগল, ছোড়াগুলো সব লাফাতে লাফাতে এসে শোভাযাত্রাটির কলেবর বৃদ্ধিসাধনে তৎপর হল-সে এক অপরূপ দৃশ্য!

আমাদের গাড়িটিই বোধহয় এ রাস্তায় প্রথম মোটর যান! গরুর গাড়ির একাধিপত্য যেখানে, সেখানে এ এক অদ্ভুত ব্যাপার বই কি! কি যে চাঞ্চল্য তখন সৃষ্টি করেছিলাম আমরা। একজন আমেরিকান এক গর্জনশীল মোটর গাড়িতে কিছু লোক নিয়ে তাদের গ্রাম্যদূর্গের একেবারে দুয়ারের গোড়ায় এসে হাজির। এতদিনের পুরানো আবরু এইবার বুঝি গেল!

গাড়ি গিয়ে থামল একটা সরু গলির মুখে, সেখান থেকে গিরিবালা দেবীর বাপের বাড়ি একশত ফুট হবে। রাস্তার সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই করে শ্রান্তক্লান্ত হয়ে অবশেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে আমাদের মন তখন বিজয়গর্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। চারিদিকে মাটির কুঁড়েঘরের মাঝে একটা বড় দোতলা পাকাবাড়ি। তখন মেরামত চলছে, কারণ তখনও বাড়িটার চারিদিকে বাঁশের ভারা বাঁধা।

অন্তরের চাপা উল্লাসে আর অধীর আগ্রহে খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর বাড়িতে, ভগবান যাকে ক্ষুধার ক্লেশ থেকে মুক্তি দিয়ে অপার করুণা প্রদর্শন করেছেন। গ্রামবাসীরা ছেলে বুড়ো ন্যাংটা, কাপড়পরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে। মেয়েরা একটু দূরে দূরে রয়েছে বটে কিন্তু তাদেরও কৌতূহলের সীমা নেই- ছেলেবুড়ো সবাই এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে অসঙ্কোচে আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগল।

তারপরেই দ্বারপথে দেখা গেল একটি ক্ষুদ্রমূর্তি- গিরিবালা দেবী স্বয়ং, তসরের কাপড় পরা। ঘোমটার তলা থেকে সলজ্জ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে এগিয়ে এলেন। ঘোমটার ছায়াতলে চোখ দুটি হতে এক অপূর্ব জ্যোতিঃ বিকীর্ণ হচ্ছে। স্নিগ্ধ, শান্ত, সৌম্যমূর্তি- পার্থিব আকর্ষনমুক্ত ঈশ্বরোপলব্ধিজাত এক মহিমময় প্রশান্তিতে মুখখানি উদ্ভাসিত।

ধীর শান্তপদে তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর নীরব সম্মতি পেয়ে আমরা তাঁর ‘স্থির’ আর ‘চলচ্চিত্র’ তুলে নিলাম। আমাদের ক্যামেরা ঠিক করে নেওয়া, আলোর ব্যবস্থা করা আর ঠিক হয়ে বসা প্রভৃতি ব্যাপারের হাঙ্গামা তিনি সহ্য করে সলজ্জভাবে অপেক্ষা করে বসে রইলেন।

অবশেষে তাঁর অনেকগুলো ফটো গ্রহণ করা গেল- ভবিষ্যতে সাক্ষী রাখবার জন্যে যে তিনিই পৃথিবীতে একমাত্র নারী যিনি গত পঞ্চাশ বৎসরেরও উপর নিরম্বু উপবাস করে আছেন (থেরেসা ন্যোয়ম্যান অবশ্য ১৯২৩ সাল থেকে উপবাস করে আছেন)।

গিরিবালা দেবী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন- মুখে তাঁর অপূর্ব মাতৃভাব, দেহ সম্পূর্ণরূপে বস্ত্রাবৃত; ছোট্ট দুটি পা, আর মুখটি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না; দৃষ্টি অবনত। মুখে অপূর্ব সারল্যের ভাব ও প্রশান্তির ছাপ, নাসিকাটি সুডৌল, শিশুদের মত ওষ্ঠাধার, উজ্জ্বল দুটি চোখ আর মুখে অপরূপ হাসি!

গিরিবালা দেবী সম্বন্ধে রাইট সাহেবের যা ধারণা, আমারও তাই। তাঁর স্নিগ্ধজল আবগুণ্ঠনের মতই একটা আধ্যাত্মিক ভাব তাঁকে ঘিরে রয়েছে। প্রণাম করলেন আমাকে- গৃহস্থ যেমন সাধুসন্ন্যাসী দেখে করে। তাঁর সরল মধুর ভাব আর নীরব স্নিগ্ধ হাসি, মধুমাখা অভ্যর্থনা বাণীর চেয়েও বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত সম্ভাষণ জানাল।

ধুলোমাখা পথের কষ্টকর ভ্রমণের সব ব্যথা একনিমেষে দূর হয়ে গেল। গিরিবালা দেবী বারান্দায় গিয়ে ভূমিতে পা মুড়ে উপবেশন করলেন; বার্ধক্যের চিহ্ন দেখা গেলেও তিনি ক্ষীণদেহ ছিলেন না। বর্ণ ছিল তাঁর গৌর, পরিষ্কার আর স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল। আমি তাঁকে বললাম, মা, পঁচিশ বছরেরও উপর আমি সাগ্রহে আপনার দর্শন কামনা করে আসছি। আপনার এ পূণ্যজীবনের কথা স্থিতিলাল নন্দীবাবুর কাছ থেকেই শুনেছিলাম।

তিনি মাথা নেড়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, তিনি নবাবগঞ্জে আমাদের বাড়ির পাশেই থাকতেন।’

এই সময়ের মধ্যে আমি সমুদ্রযাত্রা করে বিদেশে গেছি, কিন্তু একদিন এসে আপনার দর্শনলাভ করতে হবে- পূর্বেকার এ আকাঙ্খার কথা আমি কখনও ভুলিনি। মানুষের অন্তরে ভগবানের অনন্ত করুণাধারার কথা সংসার বহুদিন ভুলে গেছে। আপনি নীরবে নিভৃতে ভগবানের যে মহিমা এখানে প্রদর্শন করছেন, তার কথা সারা পৃথিবীতে প্রচার হওয়া উচিত।

মিনিটখানেক এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, মুখের হাসিতে গভীর আগ্রহ। তারপর বিনম্রস্বরে বললেন, ‘বাবাই সব জানেন।’

তিনি যে কোন অপরাধ নিলেন না- তাতে আমি খুব খুশিই হলাম। প্রচার হবার কথায় যোগী বা যোগিনীরা যে কে কি রকম ব্যবহার করবেন, তা কেউ বলতে পারে না। সাধারণতঃ তাঁরা এসব পরিহার করে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা নীরবেই করে যেতে পছন্দ করেন।

জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের উপকারের জন্য তাঁদের জীবনলীলা প্রকাশ্য উপযুক্ত সময় উপস্থিত হলেই তাঁরা অন্তরের মধ্যে সাড়া পান। আমি বলতে লাগলাম, ‘মা, তা হলে দয়া করে আমায় ক্ষমা করবেন যদি বেশি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে আপনাকে বিরক্ত করি। যেটা খুশি হয় সেটাই উত্তর দেবেন, না হলে দেবেন না- আপনি চুপ করে থাকলেও আমি তা সব বুঝে নিতে পারব।’

প্রসন্ন মধুর ভঙ্গিতে হস্তদুটি প্রসারিত করে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়, খুশি হয়েই উত্তর দেব আমি, তবে বাবা আমার মত আকিঞ্চন ব্যক্তি যতটা ভাল করে উত্তর দিতে পারে সেই অবধি- তার বেশি আর কি পারব ?’

অন্তরের সঙ্গে প্রতিবাদ করে বললাম, ‘না,  না মা, অকিঞ্চন কি বলছেন! আপনি কত উচ্চ, কত মহান।’

‘কিন্তু নিশ্চয়ই আপনি কিছু খান বইকি!’ একটু প্রতিবাদের সুরেই বললাম। চট করে বুঝে নিয়ে একটু হেসে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই!’

‘কি যে বলেন বাবা, দীনাতিদীনা আমি, সকলের অনুগতা দাসী’, তারপর তিনি অপূর্ব সারল্যের সঙ্গে বললেন, ‘তবে, লোককে রেঁধে খাওয়াতে আমি বড্ড ভালবাসি।’ ভাবলাম এ তো ভারি অদ্ভুত শখ- বিশেষতঃ এই নিরহারা সাধিকার পক্ষে!

‘আচ্ছা মা, আপনি নিজে মুখে বলুন তো- আপনি কি সত্যিই অনাহারে থাকেন?’

‘হ্যাঁ  বাবা, সত্যি।’ মিনিটখানেক চুপ করে বসে রইলেন; তাঁর পরের কথাতে বোঝা গেল যে মনে মনে তিনি হিসেব কষছিলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘বারো বছর চার মাস বয়স থেকে আজকে এই আটষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত, ছাপ্পান্ন বছরের উপর আমি কি খাবার, কি জল- কিছুই খাইনি।’

‘খেতে কখনও লোভ হয় না ?’

‘খাবার ইচ্ছে হলে আমায় খেতে হত বইকি বাবা।’

সরল হলেও এই মহিমাদীপ্ত উত্তরদানে তিনি এক স্বতঃসিদ্ধ সত্য প্রকাশ করলেন, যা দিনে অন্ততঃ তিনবার করে ভোজনক্রিয়ায় রত পৃথিবীবাসীর কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত।

‘কিন্তু নিশ্চয়ই আপনি কিছু খান বইকি!’ একটু প্রতিবাদের সুরেই বললাম। চট করে বুঝে নিয়ে একটু হেসে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই!’

‘সূর্যের আলো আর বাতাসের সূক্ষ্মতর শক্তি আর যে ব্যোমশক্তি সুষূম্নাশীর্ষকের মধ্য দিয়ে আপনার শরীরে শক্ত সঞ্চার করে, তা থেকেই আপনি পুষ্টিগ্রহণ করেন, তাই না?’

‘বাবাই তো সব জানেন।’ বলে আবার তিনি নীরব হয়ে পড়লেন, তাঁর ভাব শান্তস্নিগ্ধ ও অপ্রগলভ।

‘মা, আপনার ছেলেবেলাকার কথা সব বলুন। ভারতের সবাইকার কাছে এটা একটা আগ্রহের বিষয়- এমনকি সমুদ্রপারে আমাদের যে সব ভাইবোনেরা আছে, তাদের কাছেও।’

গিরিবালা দেবী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য পরিহার করে আলাপ আলোচনায় মগ্ন হয়ে মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আচ্ছা তবে বলি। আমার জন্ম এই জঙ্গলের দেশেই। আমার ছেলেবেলাকার কাহিনীতে বিশেষত্ব কিছুই নেই, কেবল একটামাত্র কথা ছাড়া- তা হ’ল, আমার ক্ষিধে ছিল রাক্ষুসে। ন’বছর বয়সেই আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়।

মা আমাকে সাবধান করে বলতেন, ‘বাছা, ক্ষিধে চাপতে চেষ্টা করো। শ্বশুর ঘরে গিয়ে যখন অজানা লোকেদের মাঝখানে তোমায় বাস করতে হবে, তখন সারাদিন তোমার খাই খাই করা দেখে তারা সব কি ভাববে বল দেখি? তিনি যে বিপদের সম্ভাবনা আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন অবশেষে তাই-ই ঘটল। নবাবগঞ্জে যখন শ্বশুরঘর করতে গেলাম, তখন আমার বয়স মাত্র বারো বছর।

আমার সর্বদা খাই খাই স্বভাব দেখে শ্বাশুড়ী ঠাকুরুণ দিনরাত অনবরত গঞ্জনা করতে লাগলেন। যাই হোক তাঁর বকুনি হয়েছিল শাপে বর! তা আমার মধ্যে সুপ্ত আধ্যাত্মিক বৃত্তিকে ক্রমশঃ জাগিয়ে তুলল। একদিন তিনি যে উপহাস আর বকুনি দিলেন, তা ভয়ঙ্কর নির্মম, হৃদয়হীন। অন্তরের অন্তঃস্থলে দারুন মর্মবেদনা পেয়ে আমি বলে ফেললাম-

‘আমি আপনার কাছে শীঘ্রই প্রমাণ করে দেব যে, যতদিন আমি বাঁচব,  ততদিন আমি আর কোন খাবারই ছোঁব না।’

শ্বাশুড়ীঠাকরুণ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘বটে? ওমা তাই নাকি গো? যখন তুমি একবার খাওয়ার ওপর আবার না খেয়ে থাকতে পার না, তখন একেবারে না খেয়ে থাকতে পারবে কি করে গো, এ্যাঁ?’

এ মন্তব্যের আর কোন জবাব চলে না। কিন্তু তবুও মনে জেগে উঠল এক লৌহকঠিন দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। একটু নিরালা জায়গায় গিয়ে ঈশ্বরের কাছে অনবরত প্রার্থনা করতে লাগলাম, ‘ভগবান, দয়া করে আমায় এমন গুরু পাঠিয়ে দাও যিনি তোমারই আলোয় বেঁচে থাকতে আমায় শিখিয়ে দিতে পারবেন- খাওয়াতে নয়!’ মনে একটা স্বর্গীয় আনন্দ আমাকে ছেয়ে দিল!

কি একটা অপরূপ আনন্দের ঘোরে নবাবগঞ্জের গঙ্গার ঘাটের দিকে চললাম। রাস্তায় দেখা হল আমার শ্বশুরবাড়ির পুরুতঠাকুরের সঙ্গে। তাঁর উপর ভরসা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঠাকুর মশাই, দয়া করে বলুন না, না খেয়ে কি করে বেঁচে থাকা যায়?’

জীবনে কখনও অসুস্থ হইনি, বা রোগভোগও কোনদিন করিনি। হঠাৎ করে কোথাও আঘাত লেগে গেলে সেখানে কেবলমাত্র ঈষৎ বেদনাই অনুভব করি। মলমূত্র ত্যাগের কোন প্রয়োজন হয় না। হৃৎপিণ্ডের গতি আর শ্বাসপ্রশ্বাস সংযত করতে পারি। স্বপ্নে প্রায়ই আমার গুরুদেব আর অন্যান্য মহাপুরুষদের দর্শনলাভ হয়।

ঠাকুর মশাই তো প্রশ্ন শুনে অবাক। মুখে তাঁর কোন উত্তর যোগাল না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। অবশেষে যেন একটু আশ্বাস দেওয়ার জন্যে বললেন, ‘বাছা, আজ সন্ধ্যার সময় মন্দিরে এসো, তোমার জন্যে একটা বিশেষ বৈদিক প্রক্রিয়া করব।’ এইরকম অস্পষ্টগোছের উত্তরে আমি তৃপ্তিলাভ করতে পারলাম না; আবার ঘাটের দিকে এগোতে লাগলাম।

সকালবেলা সূর্যের আলো গঙ্গার জলে ছড়িয়ে পড়েছে। গঙ্গাস্নান সেরে পবিত্র হলাম, যেন আমার তখন পূণ্য দীক্ষা হবে। ঘাট ছেড়ে ভিজে কাপড়ে যখন উঠে আসছি, তখন সেইদিনের আলোর মাঝখানে আমার গুরুদেব আমার সামনে স্বশরীরে আবির্ভূত হলেন!

স্নেহকোমল স্বরে তিনি বললেন, ‘মা লক্ষ্মী, আমিই তোমার গুরু, ভগবান আমায় এখানে পাঠিয়েছেন তোমার ব্যাকুল প্রার্থনা পূরণ করবার জন্যে। এরকম অদ্ভুত প্রার্থনায় তিনিও গভীরভাবে বিচলিত হয়ে উঠেছেন। আজ হতে তুমি সূক্ষ্মশক্তির বলে জীবনধারণ করবে। তোমার শরীরের অনুপরমাণু সেই অনন্ত শক্তির সাহায্যেই পুষ্ট হবে।’

গিরিবালা দেবী নীরব হলেন। রাইট সাহেবের কাছ থেকে আমি প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে কতকগুলো কথা তার বুঝবার জন্যে ইংরেজিতে লিখে দিলাম। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। তাঁর শান্তস্বর এত মৃদু যে তা প্রায় শ্রুতিগোচর হয় না। ঘাট তখন নির্জন, কিন্তু আমার গুরুদেব আমাদের চারধারে এমন একটা আলোর বলয় সৃষ্টি করলেন যাতে হঠাৎ কেউ স্নান করতে এসে পড়ে আমাদের বিরক্ত না করে।

তিনি তখন আমায় এমন একটি ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করলেন যাতে করে মনুষ্য জীবনে প্রয়োজনীয় কোন জড় খাদ্যের উপরই শরীরকে নির্ভর করতে না হয়। প্রণালীটির ভেতর প্রধানতঃ একটি মন্ত্রের ব্যবহার আর শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম আছে, যা সাধারণ কোনো লোকেরপক্ষে প্রয়োগ করা অত্যন্ত কঠিন। এতে কোন ওষুধবিষুখও নেই, আর কোন ভোজবাজিও নেই, ‘ক্রিয়া ছাড়া এতে আর কিছুই নেই!’

আমি ধীরে ধীরে বললাম, ‘আচ্ছা মা, আপনিই যে একলা না খেয়ে বেঁচে আছেন, এটার মানে কি?’ জ্ঞানালোকদীপ্ত আননে স্নিগ্ধ মধুর স্বরে তিনি বলতে লাগলেন, ‘মানুষ যে আত্মা তা প্রমাণ করবার জন্যে। আধ্যাত্মিক উন্নতির বলে মানুষ যে শুধু অন্নেই নয়- ঈশ্বরের জ্যোতিঃতে বেঁচে থাকতে ক্রমশঃ শিক্ষা করতে পারে, তা প্রদর্শন করবার জন্যে।’

আমেরিকান সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের কেরামতি তারা আমাকে তাদের অজ্ঞাতসারেই শিখিয়েছিলেন; তা দিয়ে আমি গিরিবালা দেবীকে বহুবিষয়ে প্রশ্ন করলাম এই ভেবে যে, তাতে জগতের উপকার হবে। একটু একটু করে তিনি এইসব সংবাদ দিলেন, ‘ছেলেপুলে আমার কখনও হয় নি; বহুবছর আগে বিধবা হই। ঘুমাই খুবই কম, কারণ জাগা আর ঘুমানো- ও দুটোই আমার কাছে সমান।

দিনে ঘরসংসারের কাজকর্ম সব করি, রাত্রে একটু জপতপ, ধ্যানধারণায় বসি। ঋতুপরিবর্তন অবশ্য সামান্যই বোধ করি। জীবনে কখনও অসুস্থ হইনি, বা রোগভোগও কোনদিন করিনি। হঠাৎ করে কোথাও আঘাত লেগে গেলে সেখানে কেবলমাত্র ঈষৎ বেদনাই অনুভব করি। মলমূত্র ত্যাগের কোন প্রয়োজন হয় না। হৃৎপিণ্ডের গতি আর শ্বাসপ্রশ্বাস সংযত করতে পারি। স্বপ্নে প্রায়ই আমার গুরুদেব আর অন্যান্য মহাপুরুষদের দর্শনলাভ হয়।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা মা, অন্য কাউকে না খেয়ে বেঁচে থাকবার উপায়টা শিখিয়ে দেন না কেন?’

হায়! হায়! পৃথিবীর কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের মুক্তির উচ্চাশা আমার তখন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল! তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, তা হয় না, গুরুদেব এর রহস্য প্রকাশ করা বিশেষভাবেই নিষেধ করেছেন। তাঁর ইচ্ছে নয় যে ভগবানের সৃষ্টিনাটকে কোনো প্রতিবন্ধক উপস্থিত হয়। বহুলোককে আমি যদি না খেয়ে বেঁচে থাকবার উপায় শিখিয়ে দিই, তাহলে চাষীরা তো আগে আমায় তেড়ে মারতে আসবে।

এমন সুরসাল ফলমূল সব মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। দুঃখ, অনাহার আর ব্যাধি- এসব তো কর্মেরই পরিণতি বলে বোধহয়; এরাই শেষপর্যন্ত জীবনের সত্যিকারের অর্থ খোঁজবার জন্যে আমাদের পরিচালিত করে।’

আমি ধীরে ধীরে বললাম, ‘আচ্ছা মা, আপনিই যে একলা না খেয়ে বেঁচে আছেন, এটার মানে কি?’ জ্ঞানালোকদীপ্ত আননে স্নিগ্ধ মধুর স্বরে তিনি বলতে লাগলেন, ‘মানুষ যে আত্মা তা প্রমাণ করবার জন্যে। আধ্যাত্মিক উন্নতির বলে মানুষ যে শুধু অন্নেই নয়- ঈশ্বরের জ্যোতিঃতে বেঁচে থাকতে ক্রমশঃ শিক্ষা করতে পারে, তা প্রদর্শন করবার জন্যে।’

গিরিবালা দেবী চক্ষু উন্মীলন করতেই আমি বললাম, ‘মা, আপনার একটা কিছু স্মৃতিচিহ্ন আমায় দিন- অন্ততঃ আপনার শাড়ির একটু ফালি!’

তারপর গিরিবালা দেবী গভীরধ্যানের মধ্যে ডুবে গেলেন। দৃষ্টি অন্তমুখী। চোখের গভীরে শান্তভাব ক্রমশঃ ভাবলেশবিহীন হয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল-শ্বাসবিহীন আনন্দময় সমাধির পূর্বাভাস। কিছুক্ষণের জন্য তিনি ভেসে চললেন সেই আনন্দস্রোতে, যা তাঁকে তাঁর অন্তরেই পরমানন্দের স্বর্গরাজ্য পৌঁছে দেয়।

রাত্রির অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল। গ্রামের অনেকলোক অন্ধকারে চুপচাপ বসে। একটা ছোট কেরোসিনের আলো তাদের মাথার উপর ছড়িয়ে পড়েছে। রাত্রির কালো কোমল চন্দ্রাতপতলে দূরের কুটিরের লণ্ঠনের আলো আর জোনাকির চলমান ঝিকিমিকি একটা ভৌতিক নকশা রচনা করেছে।

বিদায়কাল ঘনিয়ে এল; মনটা বিচ্ছেদবেদনায় ভারী হয়ে উঠল, সামনের সুদীর্ঘপথ- একঘেয়ে, মন্থর, কষ্টকর যাত্রা! গিরিবালা দেবী চক্ষু উন্মীলন করতেই আমি বললাম, ‘মা, আপনার একটা কিছু স্মৃতিচিহ্ন আমায় দিন- অন্ততঃ আপনার শাড়ির একটু ফালি!’

তিনি অবিলম্বে বেনারসী কাপড় হাতে করে নিয়ে এসে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়ে আমায় প্রণাম করলেন। আমি ভক্তিভরে তখন বলে উঠলাম, ‘মা, আমাকে আবার প্রণাম করা কেন- বরং আমায় আপনার পূণ্য পাদস্পর্শ করে প্রণাম করতে দিন!’

শক্তিবহ কম্পোমান পাঠ। সংস্কৃত ‘মন্ত্র’ শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে ‘মননের মাধ্যমে।’ এর অর্থ: ‘আদর্শ অশ্রুত ধ্বনি, যা সৃষ্টির একটি রূপের প্রতিভূ। যখন তা অক্ষরে উচ্চারিত হয়, তখন তা বিশ্বজনীন শব্দ হয়ে ওঠে। শব্দের অনন্ত শক্তির উদ্ভব হয় ‘ওম্’ থেকে, যা হলো ‘বাক্য’ বা মহাজাগতিক চালকযন্ত্রের ( Cosmic Motor ) সৃজনশীল গুঞ্জন।

গিরিবালার লব্ধ নিরাহার অবস্থা হচ্ছে একপ্রকার যোগশক্তি, যা পতঞ্জলীর ‘যোগসূত্রের’ বিভূতিপাদে ৩১নং শ্লোকে উল্লেখিত হয়েছে। তিনি এমন একটি শ্বাসের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন যা মেরুদণ্ডস্থিত সূক্ষ্মশক্তির কেন্দ্রে পঞ্চম চক্র বিশুদ্ধাকে প্রভাবিত করে। কণ্ঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত এই বিশুদ্ধ চক্র, পঞ্চভূত, আকাশ অথবা ইথারকে নিয়ন্ত্রিত করে।

এই ইথার অথবা জড়কোষসমূহের আনুপরমাণুদের মধ্যবর্তী শুন্যস্থান ব্যেপে রয়েছে। এই চক্রে মনঃসংযোগ করলে সাধক ইথারের শক্তিবলে প্রাণ ধারণ করতে সমর্থ হন।

কয়লা অথবা খনিজ তেলের মধ্যে আমরা যে শক্তি পাই তা হচ্ছে সেই সৌরশক্তি, লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে উদ্ভিদ জীবনে ক্লোরোফিল যা ফাঁদ পেতে ধরে রেখেছিল। ক্লোরোফিল – এর মাধ্যমেই আমরা সূর্যদেবের কৃপায় বেঁচে  আছি।

১৯৩৩ সালের ১৭ই মে তারিখে মেমফিস শহরে ক্লেভল্যান্ডের ডা. জর্জ ডব্লুউ ক্রাইল এক চিকিৎসক সম্মেলনে নিম্নলিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন, ‘আমরা যা আহার করি তা বিকিরণ; আমাদের খাদ্য হচ্ছে কিছু পরমাণু শক্তি। এই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় বিকিরণ, যা তন্ত্রিকজাল বা শরীরস্ত বিদ্যুৎবর্তনীতে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত করে, তা সূর্যকিরণই খাদ্যের মধ্যে সঞ্চিত করে।’

ডা. ক্রাইল বলেন, ‘অনুপরমাণুরা সব যেন সৌরমণ্ডল। কুঞ্চিত স্প্রিং এর মত সৌরদীপ্তিপূর্ণ অনুপরমাণুরাই শক্তির বাহক। এইসব অসংখ্য অনুপরমাণুপূর্ণ শক্তিই খাদ্যরূপে গ্রহণ করা হয়।

এইসব উত্তেজনা বাহক অতি ক্ষুদ্রাকার অনুপরমাণু একবার মানব শরীরের প্রোটপ্লাজমে প্রবেশ করেই শরীরের তাপ বিকিরণকারী নতুন রাসায়ণিকশক্তি ও নতুন তড়িৎপ্রবাহ উৎপন্ন করে। ডা. ক্রাইল বলেছেন, ‘তোমার শরীর এইরকম অনুপরমাণুতে সংগঠিত। তারাই চক্ষুকর্ণের মত তোমার পেশী, মস্তিষ্ক, এবং ইন্দ্রিয়গ্রাম।’

বিজ্ঞানীরা হয়ত একদিন আবিষ্কার করবেন- মানুষ সরাসরি সৌরশক্তির উপর নির্ভর করে কিরূপে বেঁচে থাকতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমসে উইলিয়াম এল লরেন্স লিখছেন-

‘ক্লোরোফিল হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে জাত একমাত্র পদার্থ যা সূর্যকিরণ ধরা ফাঁদের মত কাজ করবার এক প্রকার শক্তি ধারণ করে। তারা সূর্যকিরণের শক্তি ‘ধরে’ উদ্ভিদ মধ্যে তা সঞ্চয় করে রাখে। এদের ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভবপর হ’ত না। আমাদের বাঁচবার জন্যে যে শক্তির দরকার, তা আমরা পাই সৌরশক্তি হতে- আর তা সঞ্চিত থাকে আমাদের উদ্ভিজ খাদ্যে অথবা উদ্ভিদভোজী প্রাণীদের মাংসের মধ্যে।

কয়লা অথবা খনিজ তেলের মধ্যে আমরা যে শক্তি পাই তা হচ্ছে সেই সৌরশক্তি, লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে উদ্ভিদ জীবনে ক্লোরোফিল যা ফাঁদ পেতে ধরে রেখেছিল। ক্লোরোফিল – এর মাধ্যমেই আমরা সূর্যদেবের কৃপায় বেঁচে  আছি।’

…………………………..
সূত্র:
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi)
**শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।

**মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। -শ্রী শ্রীপরমহংস যোগানন্দ

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরো পড়ুন:
মা সারদা দেবী
প্রজ্ঞাপারমিতা শ্রীশ্রীমা সারদা
বহুরূপিনী বিশ্বজননী সারদামণি
মা মনোমোহিনী
শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সপ্তসাধিকা
মাতৃময়ী তিনরূপ
মা আনন্দময়ী
আনন্দময়ী মায়ের কথা
ভারত উপাসিকা নিবেদিতা
রাসমণি
নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে
পূণ্যশীলা মাতা কাশীমণি দেবীর সাক্ষাৎকার
আনন্দময়ী মা
মা মারিয়াম :: পর্ব-১
মা মারিয়াম :: পর্ব-২
মা মারিয়াম :: পর্ব-৩
মা মারিয়াম :: পর্ব-৪
মীরার কথা
অলৌকিক চরিত্র মাদার তেরেসা
মা আনন্দময়ীর কথা
বৈষ্ণব সাধিকা যশোদা মাঈ
আম্মার সঙ্গলাভ
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!