ভবঘুরেকথা
ফকির আব্দুল খালেক

ফকির আব্দুল খালেক

-ইমরান উজ-জামান

আহা! চাক চাক তেলতেলে রান্না করা মাংস, সঙ্গে আলু। দেখলেই খিদে কয়েকগুন বেড়ে যায়। তার উপর যদি হয় খালি পেট! চাঁদকেও রুটি মনে হয়। সেই গতকাল থেকে ভাত খাওয়া হয়নি। মেলাস্থল পরে ঘুরে দেখা যাবে এখন ক্ষুধায় প্রাণ যায় যায়। মেলার জন্য বসা অস্থায়ী দোকানের ছেলেটি এক এক করে বলে যায়।

চাক চাক তেলতেলে মাংসটা দেখিয়ে বলে, এটা শুকরের মাংস, এটা কচ্ছপ, এটা কুই আর এটা ফার্মের মুরগির মাংশ। থামিয়ে দিয়ে বললাম, থাক বাবা আর বলতে হবে না। খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেছে। কোথায় আসলাম, এতো দেখি না খেয়ে মরতে হবে। আশপাশে বাঙালি লোকবসতি আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।

অবশেষে পাহারের নীচে শেষ মাথায় এক ঘর বাঙালি পাওয়া গেল। ধান ক্ষেতের পাশ ঘেঁষে বসতি। ঘরের ঘরনী চুলায় ভাত চরাবেন কেবল। জাহিদ ভাই খালা বলে সম্বোধন করে আলাপ জুড়ে দিলেন। খালা কি রান্না হচ্ছে আজ আপনার ঘরে? ডাল, ভাত আর মুরগির মাংস। খালা আমরা আপনার এখানে খেতে চাই।

ঘরনি একটু থেমে কি যেন চিন্তা করলেন। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন, আপনারা কই থেকে আইছেন? ধরনের নানা প্রশ্ন শেষে বললেন, এই দুই তরকারীতে কি আপনাদের হবে। মনে হচ্ছে এমন কথা অহরহই তাকে শুনতে হয়, তিনি অভ্যস্থ। খালা আমরা তো মুরগির মাংস খাই না। ডালের সঙ্গে একটা শাক-পাতা হলে আমাদের হয়ে যাবে। ১০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমরা গারো পাহাড়ে রওনা হলাম।

অবলোকন আর বিনোদিত হওয়ার মতো পরিবেশনা দেখে বের হওয়া গেল সমতলের জনপদের খোঁজে। তখন সন্ধ্যা, রাস্তার পাশে এক বাড়িতে গাছের গোড়ায় বাতি জ্বলতে দেখে থেমে গেলাম। ভেসে আসছিল বাউল চাঁন মিয়ার গান। তার উত্তরঙ্গের আকাশে-বাতাসে কাপন তোলে। গিয়ে ধরলাম বাউলকে। চাঁন মিয়া বাউলের শিষ্য আব্দুল খালেক বয়াতির গলায় রাতে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে গান শুনতে অসাধারণ লাগছিল।

পাহাড় বেয়ে উঠে পড়লাম এক বাড়িতে। বাড়ির আঙ্গিনায় লম্বা করে চিরে, রোদে শুকাতে দেয়া কুইচ্চার শুটকি। মাটির ঘর, আছে ঢেকি। মাটির ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খাঁচায় ঝুলিয়ে রাখা শালিক পাখি। বাড়ির চারদিক শুনশান নিরবতা। সবাই কাজে গেছে, ধান তোলার মৌশুম। সবাই ফসল ঘরে তুলতে ব্যাস্ত, দিনরাত কাজ।

দুই পা ফেলে ঢু মারলাম নালিতাবাড়ী সীমান্তে। শেরপুরের নালিতাবাড়ি এত সুন্দর জানা ছিলো না। ওই পারে মেঘালয় এ পারে নালিতাবাড়ী। মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ড। নো ম্যন্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। কি অদ্ভুত না এই জায়গাটা কোন মালিক নাই।

এই জমিতে যাই ঘটুক কোন দেশের আইনে এর বিচার হবে না। কারণ এটা কোনো দেশের জায়গা নয়। ক্ষিদায় পেট জ্বলছে। জলদি খালার বাড়ি যেতে হবে।

অবলোকন আর বিনোদিত হওয়ার মতো পরিবেশনা দেখে বের হওয়া গেল সমতলের জনপদের খোঁজে। তখন সন্ধ্যা, রাস্তার পাশে এক বাড়িতে গাছের গোড়ায় বাতি জ্বলতে দেখে থেমে গেলাম। ভেসে আসছিল বাউল চাঁন মিয়ার গান। তার উত্তরঙ্গের আকাশে-বাতাসে কাপন তোলে। গিয়ে ধরলাম বাউলকে। চাঁন মিয়া বাউলের শিষ্য আব্দুল খালেক বয়াতির গলায় রাতে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে গান শুনতে অসাধারণ লাগছিল।

আমি ফকির হইয়া যাব গো
সন্ন্যাসী সাঝিব,
আমি কেটে দিব মায়া বেরি
পূত্র কন্যা সুন্দর নারী।
হুর নারীরা থাক সামনে
দেখব না নয়ন মেলে।

জানালেন এই গানের কথা ও সূর করেছেন তার গুরু চাঁন মিয়া বয়াতি।

আব্দুল খালেকের শিষ্য সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, ৪৫৪ জন। শেরপুরের নিজ বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার বসে আসর। আরেকটা গান ধরলেন আব্দুল খালেক-

তোমার মনে এতই ছিল লীলা
গো মওলা,
তোমার মনে এতই ছিল লীলা।।

তোমার যাহা মনে ধরে
তাই তুমি করো আমারে,
খেলো শুধু মধু মাখা খেলা,

গো মওলা।
তোমার মনে এতই ছিল লীলা।

গান শেষ হলে স্ত্রী পান শরবত নিয়ে দাওয়ায় রাখলেন। শাড়ির কোনার এক পাশ মুখে কামড়ে ধরে দাড়িয়ে আছেন। সালাম দিতে, লজ্জা আরো বেশি পেলেন মনে হলো। খালেক বাউল জানালেন তার স্ত্রীর নাম রূপজান। বিয়ের আগে তিনি বিভাগী ছিলেন। বিয়ে করার পর বুঝতে পারলেন দুই কুল এক সঙ্গে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

কাজেই সংসার কুল নিয়েই থাকলেন। তবে গান তেমন একটা না করলেও শিষ্যদের সঙ্গে সঙ্গত করেন অনেক সময়। সংসার ধর্ম বেছে নিয়ে ভুল করেছেন কিনা জানতে চাইলে বাউল বলেন, বৌ শুনলে রক্ষা নাই। তবে সত্যি কথা বলতে কি, আমার এই কুল রক্ষা করার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।

আমার জীবনে দরকার ছিল বৈরাগ্য। আমাবশ্যা আর পূর্ণিমায় গুরুর ডাক শুনতে পাই, গুরু ডেকে বলে ‘খালেকরে এইটা তুই কি করলি? – আমি শরমিন্দা হই, আর কেঁদে বুক ভাসাই।

তুই মোরে বানাইলেরে
পীড়িতের দেওয়ানা রে
কালিয়া সোনা।।

বন্ধুরে-
আমি জানি আমার দুঃখ
অন্য কেউ জানে না।
শুনিলে উজানে যাইত
গঙ্গা আর যমুনা।
রে কালিয়া সোনা।

বন্ধুগো –
আইতে যাইতে আলাপ করো
অন্য কেউ দেখে না তোরে
অন্য কেউ দেখে না।
কত ফান্দো পাতলাম আমি
এক ফান্দে তুই পড়লে নারে
পড়লে না।।

সত্যি চোখের পানিতে বুক ভেসে গেলো খালেত বাউলের। তার স্ত্রী রূপজান হাতে ধরে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমরা বুকের কষ্ট চোখে বের করে দিয়ে ব্যাথিত মনে উঠান ছেড়ে রাস্তায় বের হলাম। বাড়ির শেষ পার্শ্বের জাম গাছের গোড়ায় তখনো মোমবাতির আগুন জ্বলছিল।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
সাধক কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
কাওয়ালির জনক আমির খসরু
মহান সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়
সাধক কমলাকান্ত
বাঙালির প্রাণনাথ বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খাঁ
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ৪৭তম মহাপ্রয়াণ দিবস
মীর্জা গালিব
ফকির আব্দুল খালেক
অচেনা যোগী কাজী নজরুল
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!