ভবঘুরেকথা
ব্রাহ্মসামাজ

ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য

ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ রক্ষার জন্য ব্রাহ্মদিগের কোন্ কোন্ বিষয়ে সতর্ক হওয়া আবশ্যক, সে সম্বন্ধে বিগত অধ্যায়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা গিয়াছে। এখন ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক্।

কোনও স্থানে কয়েকজন ব্রাহ্ম বাস করিলেই তাঁহারা একত্র হইয়া অন্তত: সপ্তাহে একদিন ঈশ্বরের সমবেত উপাসনা করিবেন।

সেই উপাসনায় নিয়মিতরূপে ও যথা সময়ে উপস্থিত হওয়া প্রত্যেক ব্রাহ্ম আপন কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করিবেন। ব্রাহ্ম আপন পরিবারস্থ আত্মীয়গণকে ও বন্ধুদিগকে সাগ্রহে সেই উপাসনায় ডাকিয়া লইয়া যাইবেন। উপাসনার স্থলে সকলে শ্রদ্ধার সহিত বসিবেন ও মন দিয়া সমুদয় উপাসনা শ্রবণ করিবেন। উপাসনার শেষে ব্রাহ্মগণ সুযোগ অনুসারে পরস্পরের সহিত ও আচার্য্যে সহিত কুশল প্রশ্নাদি করিলে ভাল হয়।

সমবেত উপাসনার যে সকল অংশ অথবা যে যে সঙ্গীতাদি সমস্বরে উচ্চারণ বা সমস্বরে গান করিবার কথা, তাহার জন্য ব্রাহ্মগণ উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ করিবেন। যাহাতে মন্দিরের উপাসনা সুন্দর ও গম্ভীরভাবে সম্পন্ন হয়, সে জন্য কেবল আচার্য্য ও উপাসকমণ্ডলীর কর্ম্মচারীগণ নহেন, কিন্তু প্রত্যেক ব্রাহ্মই সর্ব্ব প্রযত্নে চেষ্টা করিবেন।

ব্রাহ্মসমাজ সমবেত উপাসনা ব্যতীত সমবেত ধর্ম্মচিন্তা, সমবেত ধর্ম্ম-প্রসঙ্গ, সমবেত আলোচনা প্রভৃতিতে বিশ্বাস করেন। এ জন্য ব্রাহ্মগণ এ সকল স্থলে মন দিয়া অপরের কথা শ্রবণ করিবার অভ্যাস করিবেন। এই অভ্যাস প্রত্যেক ব্রাহ্মের অবশ্য সাধনীয়।

বিশেষত: সমবেত উপাসনায় আচার্যের কথা শ্রদ্ধার সহিত ও মন দিয়া শ্রবণ করা প্রত্যেক ব্রাহ্মের একটি পবিত্র কর্ত্তব্য। এ অভ্যাসও সাধন সাপেক্ষ। নিজে উপাসনা করিতে অভ্যস্ত হইলেই এ অভ্যাস সাধন সহজ হয়।

শিশুদিগের মনে ধর্ম্মভাব উদ্দীপ্ত করিবার জন্য ব্রাহ্ম পিতামাতার ও ব্রাহ্ম অভিভাবকদিগের বিশেষ যত্ন করা উচিত। প্রত্যেক পরিবারে এবং মন্দিরে সে বিষয়ে কিছু আয়োজন থাকা উচিত। জননীগণ ও জ্যেষ্ঠা ভগিনীগণ নিজ নিজ পরিবারে এবং সম্মিলিতভাবে মন্দিরে, এই কার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেই তাহা উত্তমরূপে সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা। সমুদয় উন্নতিশীল দেরেশ এইরূপ ব্যবস্থাই প্রচলিত। আর্চার্য্যের নিকট হইতে এই পবিত্র কার্য্যটীর জন্য পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

মন খুলিয়া ধর্ম্ম বন্ধুদের সঙ্গে ধর্ম্মপ্রসঙ্গ করিলে ধর্ম্মভাব উদ্দীপ্ত হয় ও ধর্ম্মবন্ধুতা প্রগাঢ় হয়। ধর্ম্মপ্রাণ ব্রাহ্মগণ ‘সঙ্গতে’ মিলিত হইয়া ধর্ম্মপ্রসঙ্গ করিবার জন্য যত্ন করিবেন।

সমাজক হইতে প্রকাশিত ধর্ম্মবিষয়ক পত্রিকা ও পুস্তক ব্রাহ্মগণ আগ্রহের সহিত পড়িবেন এবং তাহা লইয়া আলোচনা করেবেন। সমুদয় ব্রাহ্মগণের সাগ্রহ মনোযোগ না থাকিলে সমাজের দ্বারা প্রচারিত পুস্তক পত্রিকাদি সুলিখিত ও সুপ্রকাশিত হইতে পারে না।

যেখানে সম্ভব প্রত্যেক ব্রাহ্মসমাজের সংশ্রবে একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করিবার জন্য ব্রাহ্মগণ যত্ন করিবেন। ধর্ম্মগ্রন্থ জ্ঞানগত নানা বিষয়ের গ্রন্থ কয়েকজনে মিলিয়া পাঠ করিলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তাহা সংসারে দুর্ল্লভ।

ধর্ম্ম প্রচার কেবল প্রচারকেদের কাজ নয়। প্রত্যেক ব্রাহ্মই নিজ আচরণের দ্বারা চারিদিকে ব্রাহ্মধর্ম্মেূর প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন। জনসাধারণের মধ্য বিশেষত: সাংসারিক কর্ম্মসূত্রে যাঁহাদের সহিত মিলিত হইতে হয় সেই সকল লোকের মধ্যে, কিরূপে ব্রাহ্ম স্বীয় আদর্শ রক্ষা করিবেন, সে বিষয়ে সমাজের আচার্য্য ও জ্যেষ্ঠগণের সহিত পরামর্শ করিলে ভাল হয়।

শিশুদিগের মনে ধর্ম্মভাব উদ্দীপ্ত করিবার জন্য ব্রাহ্ম পিতামাতার ও ব্রাহ্ম অভিভাবকদিগের বিশেষ যত্ন করা উচিত। প্রত্যেক পরিবারে এবং মন্দিরে সে বিষয়ে কিছু আয়োজন থাকা উচিত। জননীগণ ও জ্যেষ্ঠা ভগিনীগণ নিজ নিজ পরিবারে এবং সম্মিলিতভাবে মন্দিরে, এই কার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেই তাহা উত্তমরূপে সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা। সমুদয় উন্নতিশীল দেরেশ এইরূপ ব্যবস্থাই প্রচলিত। আর্চার্য্যের নিকট হইতে এই পবিত্র কার্য্যটীর জন্য পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

উপাসনা, উপদেশ দান, বক্তৃতা, সভা-সমিতি পরিচালন প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ কার্য্যই ব্রাহ্মসমাজের কাজ নহে। এসকল ব্যতীত প্রত্যেক ব্রাহ্মসমাজে কত ছোট ছোট কার্য্য করিবার থাকে। সমবেত উপাসনার স্থানটি পরিস্কার রাখা, আসনগুলি শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া পাতা, সঙ্গীত করা, রোগীর পরিচর্য্যা করা, দু:স্থদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করা- এ সকলও ব্রাহ্মসমাজের কাজ, এ সকলও ঈশ্বরের কাজ। ঈশ্বরের কাজ বলিয়া এরূপ যে কোন একটি ক্ষুদ্র কর্ম্ম নিষ্ঠার সহিত সম্পন্ন করিলে তাহাতে আত্মার কল্যাণ হয়।

ব্রাহ্মগণ পরস্পরকে ধর্ম্মভ্রাতা ধর্ম্মভগিনী জ্ঞান করিবেন, পরস্পরের সুখে সুখি ও দু:খে দু:খী হইবেন।

প্রাচীনকালে দু:খীর সাহায্য কেবল ব্যক্তিগতভাবে করা হইত। কিন্তু বর্ত্তমান কালে এক সমাজভুক্ত দু:স্থ মানুষ ও দু:স্থ পরিবারগণের সাহায্যের জন্য সমাজের সংশ্রবে ‘ফণ্ড’ স্থাপন করাই শ্রেষ্ঠ প্রণালী বলিয়া বিবেচিত হয়। প্রত্যেক ব্রাহ্মসমাজের সদস্যগণ দেখিবেন যেন সেরূপ ফণ্ড স্থাপিত হয় ও উহা সুপরিচালিত হয়। সেইরূপ ফণ্ডে যথাশক্তি সাহায্য দান করা প্রত্যেক ব্রাহ্ম ও প্রত্যেক ব্রাহ্ম পরিবার স্বীয় পবিত্র কর্ত্তব্য বলিয়া জ্ঞান করিবেন।

যেখানে যেখানে ব্রাহ্মসমাজ আছে ও তাহার অফিস, কর্ম্মচারী বার্ষিক নির্ব্বচন সভা, কার্য্যনির্ব্বাহক সভা প্রভৃতির আয়োজন আছে, সেই সকল স্থলে প্রত্যেক ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মিকার উচিত যে সেই সকল কার্য্যে শ্রদ্ধা ও আগ্রহের সহিত সাহায্য দান করেন ও স্বীয় অধিকার অনুসারে কার্য্যে যোগদান করেন।

প্রত্যেক ব্রাহ্ম যদি মধ্যে মধ্যে চিন্তা করেন যে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সাহায্যের জন্য কি করিতে পারেন, প্রত্যেক ব্রাহ্ম যদি মনে করেন সমাজের যে-কোন কাজে খাটিতে পাইলে আমি ধন্য হইব, প্রত্যেক ব্রাহ্ম যদি মনে করেন আমি প্রশংসা পাই বা না পাই সমাজের জন্য প্রাণপণে ও নিখুঁত করিয়া খাটিয়া যাইব-তবেই ব্রাহ্মের উপযুক্ত মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হয়।

উপাসনা, উপদেশ দান, বক্তৃতা, সভা-সমিতি পরিচালন প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ কার্য্যই ব্রাহ্মসমাজের কাজ নহে। এসকল ব্যতীত প্রত্যেক ব্রাহ্মসমাজে কত ছোট ছোট কার্য্য করিবার থাকে। সমবেত উপাসনার স্থানটি পরিস্কার রাখা, আসনগুলি শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া পাতা, সঙ্গীত করা, রোগীর পরিচর্য্যা করা, দু:স্থদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করা- এ সকলও ব্রাহ্মসমাজের কাজ, এ সকলও ঈশ্বরের কাজ। ঈশ্বরের কাজ বলিয়া এরূপ যে কোন একটি ক্ষুদ্র কর্ম্ম নিষ্ঠার সহিত সম্পন্ন করিলে তাহাতে আত্মার কল্যাণ হয়।

ধর্ম্মসমাজের কার্য্য কেবল বৃত্তিভোগী কর্ম্মচারীদিগের দ্বারা কখনও সুপরিচালিত হইতে পারে না। সমুদয় সদস্যগণের অনুরাগ, মনোযোগ ও পরিশ্রম বিনা ব্রাহ্মসমাজের কাজ ভাল চলিতে পারে না।

ব্রাহ্মগণ কমিটি ও অন্যান্য সভা-সমিতিতে পরস্পরের মতের সম্মান করিবেন। নিজের প্রিয় ভ্রাতাও যদি স্বাধীন চিন্তা ও বিবেকের বশবর্ত্তী হইয়া কোন বিষয়ে বিরুদ্ধ মত প্রদান করেন, তাহাতেও ক্ষুন্ন হইবেন না। মত পার্থক্যের জন্য যেন কখনও হৃদয়ের বিচ্ছেদ না ঘটে, সে বিষয়ে ব্রাহ্ম সর্ব্বদা সতর্ক থাকিবেন।

প্রত্যেক ব্রাহ্ম প্রয়োজনীয় বয়স ও যোগ্যতা প্রাপ্ত হইলেই সমাজের সদস্য হইবার জন্য প্রার্থী হইবেন। সদস্য নির্ব্বাচিত হইলে নির্দ্দিষ্ট (মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাষিক বা বার্ষিক যেরূপ হউক) দেয় নিয়মিত রূপে দান করিবেন। এই দেয় অর্থকে ‘চাঁদা’ বা অনুগ্রহ প্রদত্ত দান বলিয়া মনে করিবেন না ; পিতৃমাতৃস্থানীয় ও আশ্রয়স্থানীয় সমাজের প্রতি অবশ্য শোধ্য ঋণ বলিয়াই দর্শন করিবেন।

প্রত্যেক ব্রাহ্ম যোগ্য ব্রাহ্মবন্ধুদিগকে ব্রাহ্মসমাজে রসদস্য হইতে অনুরোধ করিবেন।

ব্রাহ্ম গৃহস্থগণ আপনাদের সমুদয় গার্হস্থ অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মসমাজকে যথাশক্তি অর্থ দান করিবেন। কাহারও বহু ব্যয়শীল হওয়া উচিত নহে; কিন্তু অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিষয়ে যত ব্যয় হইবে, ধর্ম্মার্থে দান তাহার দশমাংশের ন্যূন হওয়া উচিত নয়।

ব্রাহ্মগণ কমিটি ও অন্যান্য সভা-সমিতিতে পরস্পরের মতের সম্মান করিবেন। নিজের প্রিয় ভ্রাতাও যদি স্বাধীন চিন্তা ও বিবেকের বশবর্ত্তী হইয়া কোন বিষয়ে বিরুদ্ধ মত প্রদান করেন, তাহাতেও ক্ষুন্ন হইবেন না। মত পার্থক্যের জন্য যেন কখনও হৃদয়ের বিচ্ছেদ না ঘটে, সে বিষয়ে ব্রাহ্ম সর্ব্বদা সতর্ক থাকিবেন।

…………………………
ব্রাহ্মধর্ম্ম ও ব্রাহ্মসমাজ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………
আরও পড়ুন-
ব্রাহ্মসমাজ
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হইবার যোগ্যতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মূল সত্য
ব্রহ্ম মন্দিরের ট্রাস্টডিড
ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল সত্য
আত্মা
মানুষের ভ্রাতৃত্ব
উপাসনা ও প্রার্থনা
শাস্ত্র
গুরু
মধ্যবর্ত্তী ও প্রেরিত
সুখ-দু:খ : দু:খবাদ ও আনন্দবাদ
পাপ ও পুণ্য
পুনর্জ্জন্ম
পরকাল
স্বর্গ ও নরক
ধর্ম্ম রক্ষা
পরিবারে পুরুষ ও নারীর অধিকার-সাম্য
ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য
সমবেত উপাসনা
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ 
স্তুতি
বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা
নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান
সন্তান জন্ম
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ
ধর্ম্মসাধন ব্রতে দীক্ষা
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ধর্ম্মদীক্ষা
বিবাহ ও তাহার আনুসঙ্গিক অনুষ্ঠান
বিবাহের বাগদান
বিবাহ
মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া
শ্রাদ্ধ
গৃহ প্রবেশ
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ
ব্রহ্ম ধ্যান
ব্রাহ্মধর্ম
সকলেই কি ব্রাহ্ম?
ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি
আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও “নব হিন্দু সম্প্রদায়”
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!