ভবঘুরেকথা
মীর্জা গালিব

মীর্জা গালিব

-রবিন জিয়াদ

দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও
আমি বিগত সময় নই যে আবার আসতে পারব না।

১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায় এক সামরিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন উর্দু ভাষার সাধক কবি মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ। সারা পৃথিবীতে যিনি মির্জা গালিব নামে জনপ্রিয়। মাত্র নয় বছর বয়স থেকে তিনি শের/গজল লিখা শুরু করেন। পরিণত বয়সে গালিবের লেখালেখি করার সময়কার অভ্যাস আয়োজন ছিলো বেশ অদ্ভুত।

তিনি লিখতেন সন্ধ্যাবেলা এবং প্রচুর মদ্যপান করে নিতেন। হাতের কাছে থাকতো সূতো। এক একটি লাইন লিখতেন আর সূতোয় এক একটি গিঁট দিতেন। এই গিঁট দেয়া সূতো নিয়ে রাতে ঘুমুতে যেতেন আর সকালে উঠে গিঁটগুলো খুলতেন।

বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের আনুকূল্য পাওয়া গালিব প্রথম জীবনে ছিলেন বেশ শৌখিন। যদিও সম্রাট শাহ্‌ জাফরের ইংরেজদের হাতে পতনের পর শেষজীবনে বেশ ভোগান্তির মধ্যে পরে যান। তবে আজীবন ছিলেন রসিক প্রকৃতির লোক। নিজের অবর্ণনীয় দুর্দশা উড়িয়ে দিতেন রসিকতায়। ৫০ বছর বাদশাহর আনুকূল্য পেয়ে দিল্লীতে বসবাস করেছেন কিন্তু নিজের জন্য একটি বাড়ি বানান নি। জীবনে প্রচুর বই পড়েছেন কিন্তু বই কিনেন নি।

জীবন তো এমনি কেটে যেত
কেন যে তোমার পথের কথা মনে পড়লো।।

মোগল পরিবারের পতনের পর ইংরেজ সৈন্যরা তাঁকে লালকেল্লা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির করেন কর্নেল ব্রাউনের আদালতে। সবাই নিশ্চিত ছিলো লালকেল্লার ঘনিষ্টজন হিসেবে গালিবের হয়তো ফাঁসিই হয়ে যাবে। কর্নেল ব্রাউন গালিবকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি মুসলিম কিনা। গালিব জবাব দেন তিনি অর্ধেক মুসলমান। কর্নেল ব্রাউন অবাক এবং বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেন, এ আবার কেমন মুসলমান?

গালিব জবাব দেন আমি মদ্য পান করি তবে শুকর খাইনা। সেই আদালত থেকে গালিব মুক্তি পান। তবে জীবনে নেমে আসে দুর্গতি। এতদিন বাদশাহর আনুকূল্যে জীবনধারণ করেছেন কিন্তু সেই পথ বন্ধ। কিছুদিন কলকাতায় এসেও বসবাস করেন। কিন্তু স্বাস্থের অবনতি হতে থাকে। দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে।

দিনে দিনে ঋণে জর্জরিত হতে থাকেন। কিন্তু তাঁর আত্মসম্মানবোধ তখনও প্রখর ছিলো। ইংরেজ রাজ কর্মচারীর অসম্মানের জন্য তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

নিজের জীবন নিয়ে খেয়ালি এই কবির বিরুদ্ধে সমকালীন সময়ে অভিযোগ ছিল তাঁর কাব্য দুর্বোধ্য এবং অসংলগ্ন। তাঁকে উপাধি দেয়া হয়েছিল ‘প্রলাপ বকা কবি’ বা ‘Poet of Nonsense’. এসবের উত্তরে গালিব বলতেন ‘আমি প্রশংসার কাঙ্গাল নই, পুরস্কারের জন্যে লালায়িত নই, আমার কবিতার যদি কোন অর্থও না থাকে তা নিয়েও আমার তোয়াক্কা নেই৷’ কিনবা-

হে খোদা, সে না বুঝতে পারে আমাকে
না বুঝতে পারে আমার কথা,
তাকে দাও ভিন্ন হৃদয়
অথবা আমাকে দাও ভিন্ন বাচনভঙ্গি।।

প্রচলিত ধর্মমতের উপর তাঁর আস্থা তো ছিলই না বরং মোল্লা পুরোহিতদের নিয়ে হাসাহাসি করতেন। মদ্যপান জুয়া এবং সর্বোপরি বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য এই সাধককে কারাবাসেও থাকতে হয়েছিল। একবার রমজান মাসে বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে জুয়ার আসর বসিয়েছেন।

তখন আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুফতি সদরুদ্দিন এসে গালিবকে তিরস্কার করতে থাকেন যে রমজান মাসে ত শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়… গালিব উত্তর দেন, শয়তান এই কক্ষেই বন্দী আছে…

সবকিছু নিয়ে অভিযোগ চলে যায় ইংরেজ সরকারের কাছে। ১৮৪১ সালে প্রথমবার গালিবকে জরিমানা করে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয় কিন্তু কিছুদিন পর আবারও জুয়ার আসরে টহলরত কোতোয়ালের কাছে ধরা পরে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। যদিও তিন মাস পরেই তিনি মুক্তি পান কিন্তু এই ঘটনায় স্পর্শকাতর কবি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেন।

কারামুক্তির পর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেন যে তিনি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন আর যদিওবা বেঁচে থাকতে হয় তিনি এই শহর এই দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। মিশর, ইরান, বাগদাদ কিনবা মক্কায় গিয়ে বসতি করবেন।

বিস্ময়ে সব কিছু হারানোর এই তামাশা দেখে যাও
প্রিয়র লীলাময় বিচরণের পদচিহ্ন হয়ে পড়ে আছি।।

একবার এক বারবনিতার প্রেমে পড়ার পর এক বন্ধু গালিবকে খুব তিরস্কার করেন। এর উত্তরে গালিব যা বলেন তা উর্দু সাহিত্যে প্রবাদের মতন জনপ্রিয় হয়ে আছে-

ইশক্ পর জোর নেহি; হৈ য়েহ্ বোহ্ আতশ, গালিব-
জো লগায়ে নহ্ লগে, অওর বুঝানে নহ্ বুঝে।

অর্থাৎ-

প্রেমের উপর জোর খাটেনা, এ সেই আগুন, গালিব-
যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না।

গালিবকে সবাই মদ্যপ জুয়ারি লম্পট হিসেবে জানত। অথচ তাঁর কাব্যে বারবার নারী প্রেমের সাথে আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ঈশ্বরের সাথে মিলনের আকুতি প্রকট হয়ে উঠেছে। স্রষ্টার সাথে মিলনের এমন আকুতি থাকে যার কাব্যে, স্বয়ং দিল্লীর বাদশাও তাঁকে নিজের মুর্শিদ রূপে বরণ করে নেন।

মিলন হবে কখন কবে
প্রিয়ার স্মৃতি নেইতো মনে
প্রেমের ফাগুন জ্বাললো আগুন
ছাই হল সব সেই আগুনে।

১৮৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি গালিব দেহত্যাগ করেন। তাঁকে দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।

তোমার দরজার সামনেই ঘর বানিয়ে নিয়েছি আমি
এবারও কি বলবে আমার ঘরের ঠিকানা জানো না তুমি!!

………………………….
কবিতার অনুবাদ: গুগল থেকে সংগৃহীত

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
সাধক কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
কাওয়ালির জনক আমির খসরু
মহান সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়
সাধক কমলাকান্ত
বাঙালির প্রাণনাথ বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খাঁ
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ৪৭তম মহাপ্রয়াণ দিবস
মীর্জা গালিব
ফকির আব্দুল খালেক
অচেনা যোগী কাজী নজরুল
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!