ভবঘুরেকথা
শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়

যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়

এ বার ঘরে ফিরে যাও শ্যামাচরণ। আমারো কাজ শেষ, ডেরাডান্ডা গোটাতে হবে। শান্তস্বরে বললেন সন্ন্যাসী। সামনে দুনাগিরি পাহাড়ে ভোরের আলোর ছটা। অদূরে গগ্গস নদী ছুঁয়ে ভেসে আসছে নভেম্বরের ঠান্ডা হাওয়া। ব্রিটিশ সরকারের সামরিক পূর্ত দফতরের কেরানি শ্যামাচরণ লাহিড়ী এবার প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘ঘরে? না গুরুদেব, বাকি জীবনটা আপনার আশ্রয়েই যোগসাধনা করে কাটিয়ে দেব।’

‘না শ্যামাচরণ, তোমার কাজ হবে সংসারে থেকে যোগের প্রচার। যোগসাধনা শুধু সন্ন্যাসীদের জন্য নয়, সংসারী মানুষেরও তাতে সমান প্রয়োজন’, মৃদু হেসে হাতের জলপাত্র দেখালেন সন্ন্যাসী, ‘এই যে কমণ্ডলু, এটাও সংসারী মানুষের তৈরি, শ্যামাচরণ। তাদের যোগবঞ্চিত করার অধিকার আমাদের নেই।’

নভেম্বর, ১৮৬৮। কুমায়ুনের রানিখেতের কাছে এভাবেই কাঁশীর বাঙালী শ্যামাচরণ লাহিড়ী ও তাঁর গুরুদেবের কথাবার্তায় দূর হয়ে গেল কয়েকশো বছরের ভ্রান্তসংস্কার। তার আগে লোকে ভাবত, যোগসাধনা শুধু সন্ন্যাসীদের জন্যই, সংসারী গৃহস্থের তাতে অধিকার নেই। রামমোহন রায় মুগুর ভাঁজতেন ও বেদান্ত নিয়ে আলোচনা করতেন।

দেবেন্দ্রনাথ সংসার ছেড়ে হিমালয়ে বেরিয়ে ধ্যান করতেন, অখিলমাতার হস্তস্পর্শ অনুভব করতেন। কিন্তু যোগসাধনা এঁরা করতেন না।

শ্যামাচরণ লাহিড়ীকে সে দিন তাঁর গুরু বাবাজি মহারাজ সংসারে ফেরত না পাঠালে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গেরস্ত মানুষ যোগ অভ্যাসের অধিকার পেত না, মন্ত্রী থেকে পেয়াদা সকলে যোগদিবস উপলক্ষে দিল্লি থেকে ডালাস সর্বত্র যোগাসন করতে নেমে পড়তেন না।

উনিশ শতকের শুরুতে কলকাতার সিমলে পাড়ার বাসিন্দা দুর্গাপ্রসাদ দত্তকেও ধরতে পারেন। অ্যাটর্নি অফিসে চাকরি করতেন, কিন্তু সুন্দরী স্ত্রী, মাস ছয়েকের ছেলে সবাইকে ঘরে ফেলে যোগসাধনার জন্য সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। রানিখেতের পাহাড়ে যখন সন্ন্যাসী-শ্যামাচরণ কথাবার্তা চলছে, তখন দুর্গাপ্রসাদের ছেলে বিশ্বনাথ দত্ত ওকালতি করেন।

তাঁর বড় ছেলে, নরেন্দ্রনাথকে দেখে আত্মীয়রা অনেকে বলে, ‘একেবারে দুর্গাপ্রসাদ গো! মায়া কাটাতে না পেরে ফিরে এসেছে।’ বড় হয়ে সন্ন্যাসীবেশে এই নরেন্দ্রনাথই আমেরিকায় পতঞ্জলীর ‘রাজযোগ’ নিয়ে বক্তৃতা দেবেন। কিন্তু শুরুরও একটা শুরু থাকে।

শ্যামাচরণ লাহিড়ীকে সেদিন তাঁর গুরু বাবাজি মহারাজ সংসারে ফেরত না পাঠালে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গেরস্থ মানুষ যোগ অভ্যাসের অধিকার পেত না, মন্ত্রী থেকে পেয়াদা সকলে যোগদিবস উপলক্ষে দিল্লি থেকে ডালাস সর্বত্র যোগাসন করতে নেমে পড়তেন না।

প্রচারের ঢক্কানিনাদের এই যুগে তাঁর স্মৃতি আগলে রেখেছে বারাণসীর চৌষট্টি ঘাটের কাছে একটি সরু গলি। শ্যামাচরণ লাহিড়ী মার্গ। মসজিদ, বেনারসি শাড়ি বোনার কারখানা অধ্যুষিত মুসলিম পল্লীর এই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই তাঁর তিনতলা বাড়ি, সেখানে রয়েছে শিবমন্দির। বারাণসীর মজা এইখানেই।

মুসলিম পল্লীতে ক্রিয়াযোগের উদ্‌গাতা লাহিড়ীমশাইয়ের বাড়ি। তাঁর অন্যতম শিষ্য আব্দুল গফুর খাঁ ছিলেন মুসলমান। লাহিড়ীমশাই বলতেন, ‘হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান কেউ ম্লেচ্ছ নয়। মনই ম্লেচ্ছ।’

রামদেব, শ্রীরবিশঙ্করদের যোগ রফতানির এই যুগেও বাড়িটায় নেই কোনও যোগ-স্টুডিও। শ্যামাচরণের এ নিয়ে কঠোর নিষেধ ছিল: যোগ করতে হবে গোপনে, কাউকে না জানিয়ে। বাড়ির দরজা বন্ধ, শুধু গুরুপূর্ণিমা ও মহাষ্টমীর রাতে খোলা হয়। তাঁর প্রপৌত্র, ৭৮ বছরের শিবেন্দু লাহিড়ী চাকরি থেকে অবসরের পর আজকাল বেশির ভাগ সময় বিদেশে ক্রিয়াযোগ শেখানোয় ব্যস্ত থাকেন।

প্যারিস থেকে ফোনে বললেন তিনি, ‘বাড়িটায় গেছেন? ভাল। কিন্তু যোগ আর কোথায়? এখন বেশিরভাগই বিয়োগ।’ স্থানীয় এক পুরোহিত রোজ সকালে এই শরিকি বাড়ির শিবমন্দিরে পুঁজো সেরে, ফের দরজায় শিকল ও তালাচাবি দিয়ে যান।

বাকি জীবনটা এখানেই কেটে গেল। এ রকম সময়েই, ৪০ বছর বয়সে রানিখেতে বদলির অর্ডার। স্ত্রী, পুত্র কন্যাকে ছেড়ে তাই রানিখেত। সেনাছাউনী গড়ে উঠবে, তারই অ্যাকাউন্টস দেখতে হয় তাঁকে। তাঁবুতে থাকেন, অফিসের কাজ শেষে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।

এই বাড়িতেই রোজ সকাল-সন্ধ্যা গো-ভক্ষণ করতেন তিনি! লং ডিস্ট্যান্স কলেও আতঙ্কিত শোনাল শিবেন্দুবাবুর গলা, ‘সর্বনাশ! এ সব লিখবেন নাকি? লোকে তো অন্য কথা ভাববে।’ মুখের ভিতরের তালু হচ্ছে যোগীর চাবিকাঠি। জিভটাকে লম্বা করে তালুমূলে নিয়ে আসাই যোগীদের ভাষায় খেচরীমুদ্রা। এটাই গোমাংস।

হঠযোগ-প্রদীপিকাও জানাচ্ছে, গো মানে জিভ। ‘গোশব্দেনোদিতা জিহ্বা তৎপ্রবেশো হি তালুনি।’ লাহিড়ীমশাই এই কারণেই হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে শিষ্যদের বলতেন, ‘জিহ্বা উঠনেসে ইন্দ্রিয় দমন হোতা হ্যায়।’ আজ যাঁরা একই সঙ্গে যোগদিবস পালন করে শরীরী কসরত দেখান ও দাদরিতে গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগে পিটিয়ে খুন করেন, তাঁরা যোগদর্শনের এই বহুচিহ্নক সমন্বিত, বহু সংস্কৃতির ভাষাটাই জানেন না। লাহিড়ীমশাই জানতেন।  

১৮৬৮ সালের সেই সময়টায় গরুড়েশ্বরের এই বাড়ি কেনা হয়ে গিয়েছে। শ্যামাচরণের তখন দুই ছেলে, দুই মেয়ে। চাকরির পাশাপাশি বাঙালীটোলার স্কুলের প্রথম সেক্রেটারি। মায়ের মৃত্যুর পর কৃষ্ণনগরের ভিটে ছেড়ে বাবার হাত ধরে ছেলেবেলায় এক দিন বারাণসী চলে এসেছিলেন। তার পর স্কুল কলেজ চাকরি… বাকি জীবনটা এখানেই কেটে গেল।

এ রকম সময়েই, ৪০ বছর বয়সে রানিখেতে বদলির অর্ডার। স্ত্রী, পুত্র কন্যাকে ছেড়ে তাই রানিখেত। সেনাছাউনী গড়ে উঠবে, তারই অ্যাকাউন্টস দেখতে হয় তাঁকে। তাঁবুতে থাকেন, অফিসের কাজ শেষে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।

এরকম উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক বিকেলে তাঁর কানে ভেসে এল সেই ডাক। পাহাড়ের উপর থেকে এক সন্ন্যাসী হাতছানি দিয়ে ডাকছেন তাঁকে, ‘লাহিড়ী, ইধার আও।’

লোকটা তাঁর নাম জানল কী ভাবে? চোর ডাকাত নয় তো? টাকার ব্যাগ কুলিদের হাতে দিয়ে শ্যামাচরণ ওপরে উঠতে শুরু করলেন। সন্ন্যাসী তাঁকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ের আরেকটু ওপরে। ছিমছাম গুহা, ভেতরে একটা পশমের কম্বল আর কমণ্ডলু। ‘এগুলি চিনতে পারো?’

শ্যামাচরণের সাফ উত্তর, ‘না।’

‘আমাকে?’

‘না, কে আপনি?’ শ্যামাচরণের মনে হচ্ছে, এই সন্ধ্যায় অচেনা সন্ন্যাসীর কাছে নির্জন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি আসি। অফিসে কাজ আছে।’

পরের ঘটনা আরও আশ্চর্যের! কৌপীনধারী গুহাবাসী সন্ন্যাসী পরিষ্কার ইংরেজিতে বলেছেন, ‘মাই গড! অফিসকে তোমার জন্য এখানে আনা হয়েছে। তোমাকে অফিসের জন্য নয়।’

শ্যামাচরণ লাহিড়ী আবারও হতভম্ব। সাধু তাঁর কপালে আলতো করে হাত রাখলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা ভোজবাজির মতো দুলে উঠল। মিলিটারি অ্যাকাউন্টসের হেডক্লার্ক বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে। আপনি আমার গুরু বাবাজি মহারাজ। গত জন্মে আপনার কাছে যোগসাধনা করতাম, আমার নাম ছিল গঙ্গাধর। ওই তো আমার কমণ্ডলু আর আসন।’

শ্যামাচরণ তাঁকে রোজই ফিরিয়ে দিতেন। এক বৃদ্ধা একদিন হঠাৎ এসে একই অনুরোধ জানালেন। শ্যামাচরণ তাঁকে পরদিন সকালে আসতে বললেন। সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, ‘সে কী! বয়স্ক ভদ্রলোক তো রোজ ঘুরছেন।’ শ্যামাচরণ বললেন, ‘ওর এখনও সময় আসেনি।’ সময় কখন আসবে, না-আসবে সেটি গুরুই স্থির করবেন।

‘চল্লিশ বছরেরও বেশি অপেক্ষা করছি তোর জন্য’, বাবাজি জানালেন, ‘কৃষ্ণনগরে নদীর ধারে ছেলেবেলায় যখন খেলা করতিস, তখন থেকে নজরে রেখেছি তোকে।’ তারপর খানিকটা তেল দিয়ে বললেন, ‘মেখে নিয়ে নদীর ধারে শুয়ে থাক। তোর শুদ্ধি দরকার।’

ঠান্ডা হাওয়া, গগ্গস নদীর ঠান্ডা জল মাঝেমাঝে শ্যামাচরণের তৈলাক্ত, আদুড় গায়ের হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাত বারোটা নাগাদ অদূরে আচমকা এক উজ্জ্বল আলো। আর এক সন্ন্যাসী এসে বললেন, ‘চলুন।’

কিন্তু আলোটা? রাত বারোটাতেই আজ সূর্য উঠল নাকি! সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘বাবাজি মহারাজের তৈরি সোনার রাজপ্রাসাদ। তোমার জন্যই। গতজন্মে তুমি এই প্রাসাদ দেখতে চেয়েছিলে। এখানেই আজ তোমার কর্মবন্ধন ছিন্ন হবে।’

সেই রাতেই সোনার প্রাসাদে বাবাজি মহারাজের কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হলেন শ্যামাচরণ লাহিড়ী। পরদিন সকালে সেই প্রাসাদ আর নেই। গুরু তাঁকে সংসারে ফেরার আদেশ দিলেন। ক্ষুণ্ণ মনে অফিস ফিরে আরও হতভম্ব। রানিখেতের পাট এবার গোটাতে হবে, আচমকা বদলীর অর্ডার এসেছে। সহকর্মীরা ততক্ষণে তাঁকে দেখে আনন্দে হইচই করে উঠেছেন। তাঁদের ধারণা ছিল, অন্ধকার পাহাড়ে পথ হারিয়ে লাহিড়ী নির্ঘাত বাঘ-ভাল্লুকের শিকার।

এই অলৌকিক গল্পেই বাবাজি এবং শ্যামাচরণ লাহিড়ী পরম্পরার ক্রিয়াযোগের বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে। ক্রিয়া অভ্যাস করতে করতে অসুস্থ হয়ে গেলাম, মরে গেলাম। তবু ফল নষ্ট হবে না। পরজন্মেও পাওয়া যাবে।

এখান থেকেই গল্পের গরু গাছে ওঠে। ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত, রবিনসন স্ট্রিটের যুবক একুশ শতকেও দিনের পর দিন দিদির মরদেহ খাটের নীচে ফেলে রাখে। কিন্তু শ্যামাচরণ লাহিড়ী এসব বলে যাননি। তাঁকে মণিকর্ণিকার ঘাটে দাহ করা হয়েছিল।

পরম্পরার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, যাবতীয় লৌকিক, অলৌকিক নিয়েও এই যোগ একেবারে গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুই বুঝবেন, আপনি ক্রিয়া পাওয়ার উপযুক্ত কি না! বাবাজি একদিন শ্যামাচরণকে দুনাগিরি পাহাড়ে ডেকে নিয়েছিলেন। সেভাবেই বহুপরে বারাণসীর রানামহল ঘাটে এক বৃদ্ধ রোজ শ্যামাচরণের কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দেওয়ার অনুরোধ জানাতেন।

শ্যামাচরণ তাঁকে রোজই ফিরিয়ে দিতেন। এক বৃদ্ধা একদিন হঠাৎ এসে একই অনুরোধ জানালেন। শ্যামাচরণ তাঁকে পরদিন সকালে আসতে বললেন। সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, ‘সে কী! বয়স্ক ভদ্রলোক তো রোজ ঘুরছেন।’ শ্যামাচরণ বললেন, ‘ওর এখনও সময় আসেনি।’ সময় কখন আসবে, না-আসবে সেটি গুরুই স্থির করবেন।

ইংল্যান্ডে সাহেবের স্ত্রী অসুস্থ, গত একমাস তাঁর খবরাখবর, চিঠিপত্রও নেই। হেডক্লার্ক বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। আমি একটু পরে বলে দেব।’ প্রায় আধঘণ্টা পরে জানালেন, মেমসাহেব ভাল আছেন। এখন স্বামীকে চিঠি লিখছেন। চিঠিতে এই-এই লেখা।

গুরুর কাছ থেকে পাওয়া নিভৃত, ব্যক্তিগত সাধনা। কিন্তু ক্রিয়াযোগ কখনও মুফতে পাওযা যায় না। শ্যামাচরণ লাহিড়ী জনপ্রতি পাঁচ টাকা দক্ষিণা নিতেন। তাঁর কিছু গরিব শিষ্যও ছিল। প্রথম শিষ্যই বারাণসীর ঘাটে এক ফুলবিক্রেতা। এঁদের হাতে শ্যামাচরণ আগের দিন পাঁচ টাকা ধরিয়ে দিতেন।

আর মানসপ্রত্যক্ষ রূপকথার ওই সোনার প্রাসাদ? সেটি বুঝতে যোগী হওয়া দরকার। ‘যোগী এমন এক অবস্থায় উপনীত হতে চান, যেখানে ‘প্রকৃতির নিয়ম’ তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না’, বলছেন বিবেকানন্দ। প্রকৃতির এই নিয়ম-বেনিয়ম তাঁর জীবনের ছত্রেছত্রে ছড়ানো। রানিখেত থেকে ফিরে গাজিপুরে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন শ্যামাচরণ, একদিন দেখলেন তাঁর ওপরওয়ালা ইংরেজ সাহেব খুব চিন্তিত।

ইংল্যান্ডে সাহেবের স্ত্রী অসুস্থ, গত একমাস তাঁর খবরাখবর, চিঠিপত্রও নেই। হেডক্লার্ক বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। আমি একটু পরে বলে দেব।’ প্রায় আধঘণ্টা পরে জানালেন, মেমসাহেব ভাল আছেন। এখন স্বামীকে চিঠি লিখছেন। চিঠিতে এই-এই লেখা।

সাহেব অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন। সপ্তাহকয়েক পরেই এল স্ত্রীর চিঠি। আশ্চর্য! কেরানিবাবু যা বলেছিলেন, চিঠিতে হুবহু তা লেখা। পরের ঘটনাটা আরও আশ্চর্যের! জীবনে প্রথমবার ভারতে, স্বামীর কাছে এসে শ্যামাচরণকে দেখে চমকে উঠেছেন বিদেশিনী, ‘আরে, ইনিই তো সেই ভদ্রলোক, যিনি আমার অসুস্থতার সময়ে এসেছিলেন!’ স্থূলদেহ অফিসে পড়ে থাকলেও সূক্ষ্মদেহে আলোরগতিতে যত্রতত্র যেতে পারতেন শ্যামাচরণ।

বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের বড়সাহেব ভগবতীচরণ ঘোষও সেকথা টের পেয়েছিলেন। ভগবতীবাবুর অধস্তন কর্মচারী ছুঁটি নিয়ে বারাণসী যাবেন তাঁর গুরু শ্যামাচরণ লাহিড়ীর কাছে। ভগবতীবাবু ছুঁটি দেননি, বিকেলবেলা বাড়ি ফেরার পথে তাঁর চোখে পড়ল, সেই কর্মচারী মাঠের রাস্তা ধরে বিষণ্ণভাবে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।

তাঁর আর এক কীর্তি: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে  সাংখ্যদর্শন, বেদান্ত, পতঞ্জলীর যোগসূত্র, গুরু নানকের জপজি, কবীরের দোঁহা, তন্ত্রসার ইত্যাদি ২৬টি বইয়ের যোগভাষ্য। গীতার প্রথম শ্লোকটাই ধরা যাক: ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে… লাহিড়ীমশাইয়ের যোগব্যাখ্যা: এখানে দেহের কথা বলা হচ্ছে। সকল প্রকার ধর্ম এবং কর্ম এই দেহরূপ ক্ষেত্র দিয়েই সম্পন্ন হয়।

তিনি পালকি থেকে নেমে তাঁকে ‘অযথা ছুঁটি কেন নেবে? চাকরিতে উন্নতি করো’ ইত্যাদি বোঝাচ্ছেন। আচমকা সেই মাঠে শূন্য থেকে ফুটে উঠল একটি লোক। কণ্ঠে ভর্ৎসনা, ‘ভগবতী, তুমি কর্মচারীদের প্রতি খুব নির্দয়।’ পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল সেই মূর্তি। অধস্তন কর্মীটি ততক্ষণে আবেগ চেপে রাখতে পারেননি, গুরুদেব বলে কেঁদে ফেলেছেন।

সে দিনই ছুঁটি মঞ্জুর। পুরো রহস্যটা ভালভাবে বুঝতে সেই কর্মচারীর সঙ্গে সস্ত্রীক বারাণসীতে রওনা হলেন ভগবতীবাবু। গিয়ে দেখেন, চৌকিতে পদ্মাসনে বসা সেই লোক, ফের গম্ভীর ভাবে সে বলল, ‘ভগবতী, তুমি কর্মচারীদের প্রতি খুব নির্দয়।’ সে দিনই সস্ত্রীক লাহিড়ীমশাইয়ের কাছে দীক্ষা নিলেন ভগবতীবাবু।

ভবিষ্যতে এই ভগবতীবাবুর ছেলে মুকুন্দচরণ, লাহিড়ী মশাইয়ের শিষ্য যুক্তেশ্বর গিরির কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা নেবেন। তাঁর নাম হবে পরমহংস যোগানন্দ। ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে ক্রিয়াযোগের প্রচার করে ‘যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি’ স্থাপন তাঁরই কীর্তি। এই মুকুন্দচরণের ছোট ভাই বিষ্ণুচরণ ঘোষ ব্যায়ামবিদ।

কুস্তি, যোগাসনের জন্য এই বিষ্টু ঘোষের আখড়া একসময় কলকাতায় বিখ্যাত ছিল। সেই আখড়াতে হঠযোগ শিখেই জাপান, আমেরিকা পাড়ি দিয়েছেন বিক্রম চৌধুরী, আজকের ‘বিক্রমযোগা’র স্রষ্টা। আধুনিক যোগের ইতিহাসে শ্যামাচরণ লাহিড়ীর পরম্পরা এই ভাবেই ছড়িয়ে গিয়েছে বিভিন্ন ঘাটে।

ঘাট আছে, কিন্তু স্রোতটাই নেই। লাহিড়ীমশাই মানে আজকের বিক্রমযোগ, পাওয়ারযোগ গোছের শরীরচর্চা নয়, স্থূলদেহ-সূক্ষ্মদেহের অলৌকিক গল্পও নয়। আরো কিছু বেশি। এই গরুড়েশ্বরের বাড়ি থেকে উত্তরে হাঁটতে শুরু করলে দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা ঘাট পেরিয়ে পঞ্চগঙ্গা ঘাট। সেখানে আজও আছে ত্রৈলঙ্গস্বামীর শিবমন্দির।

এক শিষ্যের অনুরোধে শ্যামাচরণ সেখানে ত্রৈলঙ্গস্বামীর কাছে এসেছেন। মৌনী সন্ন্যাসী তাঁকে দেখেই সানন্দে জড়িয়ে ধরলেন। এক শিষ্য পরে তাঁর এহেন আনন্দের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। ত্রৈলঙ্গস্বামী স্লেটে লিখে দিলেন, ‘আনন্দ হবে না? যাঁকে পেতে সাধুদের কপনি পর্যন্ত ছাড়তে হয়, এই মহাপুরুষ সংসারে থেকেই তাঁকে পেয়ে গেছেন।’

তাঁর আর এক কীর্তি: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে  সাংখ্যদর্শন, বেদান্ত, পতঞ্জলীর যোগসূত্র, গুরু নানকের জপজি, কবীরের দোঁহা, তন্ত্রসার ইত্যাদি ২৬টি বইয়ের যোগভাষ্য। গীতার প্রথম শ্লোকটাই ধরা যাক: ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে… লাহিড়ীমশাইয়ের যোগব্যাখ্যা: এখানে দেহের কথা বলা হচ্ছে। সকল প্রকার ধর্ম এবং কর্ম এই দেহরূপ ক্ষেত্র দিয়েই সম্পন্ন হয়।

তা হলে শঙ্করাচার্যের বৈদান্তিক বা শ্রীধরস্বামীর ভক্তিবাদী ভাষ্য? লাহিড়ীমশাই জানাচ্ছেন, ওগুলি পড়তেই হবে। কিন্তু ওগুলি বাইরের লক্ষণ দেখে তৈরি ভাষ্য। আগে বাইরের লক্ষণ জানো, তারপর অন্তর্গত যোগভাষ্য। উনিশ শতকের গৃহস্থ যোগীপুরুষও গীতার বহু ভাষ্য স্বীকার করতেন, এই বইটি একমেবাদ্বিতীয়ম্ জাতীয় গ্রন্থ হওয়া উচিত গোছের আবদার ধরতেন না।

২৬খণ্ড ডাইরীর কোথাও লেখা, ‘আজ প্রাণায়াম থোড়া হুয়া-ওঁকারকা ধ্বনি পিছে তরফ সুনাতা হ্যায়।’ আর এক জায়গায়: ‘আজ জেয়াদা দেরতক দম বন্ধ রহা, হম হি সূর্য ভগবান।’

সংসারে তিনি রাজা জনকের মতোই। কামকে অস্বীকার করেননি, রানিখেত থেকে ফিরে আসার পরও তিন কন্যার জন্ম দিয়েছেন। এই কি নয় প্রকৃত ভারতীয় ট্রাডিশন, যেখানে যোগী কখনও অস্বীকার করবেন না কামকে? গৃহী যোগী লাহিড়ীমশাই সেই হারিয়ে যাওয়া পরম্পরার উত্তরসূরি, কোনও দায়িত্বেই নন পরাঙ্মুখ।

১৮৮০ সালে অবসর নেওয়ার পর তাঁর পেনশন ২৯টাকা চার আনা ছয় পাই। সংসার চালাতে নেপালের রাজপুত্র ও কাশীর রাজপুত্রের প্রাইভেট টিউটর।

তাঁর আর এক ঐতিহ্য ভাবলে অবাক লাগে। আর পাঁচজন ইংরেজিশিক্ষিত ভারতীয়ের মতো লাহিড়ীমশাইও ডাইরি লিখতেন। কিন্তু সেই ডাইরীতে কী খেলাম, কী পরলাম নয়। যোগসাধনে কী অনুভূতি হচ্ছে, সেটিই লম্বা খেরোর খাতায় বাংলা হরফে হিন্দি ভাষায় লেখা। ২৬খণ্ড ডাইরীর কোথাও লেখা, ‘আজ প্রাণায়াম থোড়া হুয়া-ওঁকারকা ধ্বনি পিছে তরফ সুনাতা হ্যায়।’ আর এক জায়গায়: ‘আজ জেয়াদা দেরতক দম বন্ধ রহা, হম হি সূর্য ভগবান।’

ডাইরীগুলি বংশ পরম্পরায় এখন শিবেন্দুবাবুর কাছে, ‘কী আর বলব? পাঁচখানা ডাইরী নেই। আমারই আত্মীয়রা মেরে দিয়ে এখন ক্রিয়াযোগের বিশারদ হয়েছে।’

শিবেন্দুবাবু বিদেশে ক্রিয়াযোগের শিবির করে দীক্ষা দেন। ওয়েবসাইটে কে যেন তাঁর সম্বন্ধে লিখে রেখেছে, ‘মিথ্যা যোগী। লাহিড়ীমশাই শিবির করতে বলেননি, আলাদা ভাবে আধার বুঝে ক্রিয়া দিতে বলেছিলেন।’ শিবেন্দুবাবু ফোনে পালটা জানালেন, ‘আমি তো রেট বেঁধে দীক্ষা দিই না মশাই। লাহিড়ীমশাই পাঁচ টাকা নিতেন, এখন সময় বদলেছে। আমি বলি, যার যা সামর্থ্য।’

মহাযোগীদের বোধহয় এ রকমই হয়। তাঁদের থাকে আত্মস্থ ক্রিয়া, উত্তরপুরুষে আকচাআকচির প্রতিক্রিয়া।

………………………..
তথ্য : আনন্দবাজার পত্রিকা
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………
আরও পড়ুন-
যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি
তারা মায়ের আদরের দুলাল ‘বামাক্ষেপা’
মহর্ষি মহেশ যোগীর কথা
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের দর্শনলাভ : যোগী-কথামৃত থেকে
‘বাবাজী’ আধুনিক ভারতের মহাযোগী
বিনিদ্র সাধু
রামদাস বাবাজী
সীতারাম
তারাপীঠের ‘বামদেব’
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: এক
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!