ভবঘুরেকথা

সতী মা

গোবিন্দপুর নিবাসী গোবিন্দ ঘোষের কন্যা এবং রামশরণের স্ত্রী স্বরসতী দেবীই পরবর্তীকালে সতীমা নামে পরিচিতি লাভ করেন। সতীমাতা আনুমানিক ১৭৩৫ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সতীমা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ঠাকুর আউলচাঁদ মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করেন এবং তার আশির্বাদ স্বরূপ ‘সত্যরত্ন’ পেয়ে অলৌকিকশক্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন।

আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা সত্যধর্ম সর্বপ্রথম গ্রহণ করে সতীমা, তারপর তার স্বামী রামশরণ পাল। পরবর্তীতে কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ তার মতাদর্শ গ্রহণ করে আউলচাঁদের ভক্ত হয়েছিলেন। ঠাকুরের অসংখ্য ভক্তের মধ্যে বিশেষ ভক্ত ছিলেন ২২ জন এরা বাইশ ফকির নামে পরিচিত। কর্তাভজা সত্যধর্ম সনাতন ধর্মের একটি বিশেষ অংশ।

সনাতন ধর্মের মধ্যে স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম-কর্মে বহুদেবতা বাদের প্রচলন ধর্মের নামে জীব হত্যা (পশু বলি), মদ-গাঁজার অবাধ ব্যবহার ও সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক ৪ জাত ৩৬ বর্ণ বংশগত কঠোর জাতিভেদের প্রতিবাদ স্বরূপ শ্রীচৈতন্যদেবের পরে যতগুলি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল কর্তাভজা সম্প্রদায় তাদের মধ্যে অন্যতম।

কর্তাভজা ভক্তদের কাছে সতীমা পরম পূজনীয়। তবে সতীমাতা মালিক বা সৃষ্টিকর্তা নন, সতীমা নিজেকে মালিকের অবতার বলে প্রকাশ করেননি। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী এবং বাকসিদ্ধা সতীমার কৃপায় ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়ে থাকে। অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়, খোড়া চলার শক্তি ফিরে পায়, বোবার বোল ফোটে, বহু দুরারোগ্য ব্যধি নিরাময় হয়, বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করে আনন্দ মনে সতীমার জয়গান করে।

সতীমা এ জাতীয় অসংখ্য অলৌকিক মহিমা প্রদর্শন করে গেছেন, এমন কি সতীমার দেহান্তরের পরেও অদ্যাবধি তাঁর সমাধীক্ষেত্রে এ জাতীয় মনোবাসনা পূরণের প্রত্যাশায় আজও ভক্তরা মিলিত হয়। এদের অনেকে সতীমা, ঘোষপাড়া, কর্তাভজা সম্প্রদায় সম্পর্কে বহু-প্রশস্তি বাচক গীত রচনা করেছেন, এই গীত গুলোকে বলা হয়, “ভজনতত্ত্ব গীত”।

রামশরণ যখন ইংরেজী ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে দেহ রক্ষা করেন তখন সতীমার একমাত্র পুত্র সন্তান দুলাল চাঁদের বয়স মাত্র সাত বছর, এমতাবস্থায় সতীমা শক্ত হাতে সম্প্রদায়ের হাল ধরেন, দুলাল চাঁদের ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সম্প্রদায় প্রধান। ১৮৩৩ সালে দুলাল চাঁদের পরলোক গমণের পর পুনরায় তাকে সম্প্রদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল। সতীমার লীলা সম্বরণের পূর্বেই তাঁর ধর্মমত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে।

স্বরসতী একজন ব্যক্তি বা মানুষের নাম, আর সতীমা হচ্ছে উপাধি বিশিষ্ট নাম। অনেকে বলেন যিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করেছেন, তিনি আবার সতী হন কি করে? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

যে নারী পতির অনুগত-তিনিই সতী।
যে নারী অতিশয় সৎ-তিনিই সতী।
যিনি অতিশয় সহ্য, ধৈর্য্য ও সহনশীলতা গুণের অধিকারিণী তিনিই সতী।

যিনি সত্যকে ধারণ করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ ও
পরমসত্য জগৎ কর্তার কৃপা লাভ করে পরম সত্যে লীন হয়েছেন তিনিই সতী।

যিনি জগতের সকল সন্তান নিজের সন্তান মনে করে মাতৃস্নেহ, দিয়ে সন্তানের অধিদৈবিক, আদিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপ জ্বালা প্রশমিত করতে পারেন তিনিই সতীমা। উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ, ধনী-গরীব, অস্পৃশ্য পতিত, সতীমার কাছে সবাই সমান। সতীমার তিরোধানের শতশত বৎসর পরে আজও মনস্কামনা পূরণের আশায় লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান, মহাতীর্থ নিত্যধাম ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের সমাধিতে উপস্থিত হয়। 

…………………………………..
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা: 
১. ভবের গীত
২. কর্তাভজা সত্যধর্ম

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা সত্যধর্মের ৩০ ধারা
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষাগ্রহণ
সতী মা
কর্তাভজা সত্যধর্ম
কর্তাভজার দশ আজ্ঞা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
ডালিম তলার মাহাত্ম্য
বাইশ ফকিরের নাম
কর্তা
দুলালচাঁদ
কর্তাভজা সত্যধর্মের পাঁচ স্তম্ভ
সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
ভাবেরগীত এর মাহাত্ম্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!