ভবঘুরেকথা

অশ্বিনীর ত্যাগের কথা
গুরুচাঁদ পোষা পাখি অশ্বিনী গোঁসাই।
হরিনাম ভিন্ন তার অন্য গতি নাই।।
সংসারেতে বাস করে সংসারী সাজিয়া।
সুখ দুঃখ সমজ্ঞান মনেতে ভাবিয়া।।
ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়।
দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে পরীক্ষা করয়।।
সংসারের দৈন্য দশা ক্রমেতে বাড়িল।
তবু নাহি হরিনাম ভুলিয়া রহিল।।
লহ্মীখালী বাস করে গোপাল সাধু।
দিবানিশি পান করে হরিনাম মধু।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অন্তরে ভাবিয়া।
দক্ষিণ দেশ মাতাল হরি নাম দিয়া।।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিলেন মন।
কয়জন ভক্ত সঙ্গে করিলেন গমন।।
ভাবে গদগদ চিত্ত বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত অশ্বিনীর বাড়ী।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী গলে বস্ত্র দিয়া।
ছল ছল আখি দু’টি কহিছে কান্দিয়া।।
শুন শুন ওরে ভাই আমার বচন।
অধমের নিবেদন করহে গ্রহণ।।
ঠাকুরের ঘর বাড়ী মোর কিছু নয়।
দিন গত আমি আছি তাহার আলয়।।
এইভাবে ভক্তি করি বসিবারে দিল।
হরিধ্বনি করি সবে আসনে বসিল।।
অশ্বিনীর চক্ষুজলে বক্ষ ভেসে যায়।
সকলের পদধুলি লইল মাথায়।।
তাই দেখে সে গোপাল কান্দিয়া কান্দিয়া।
অশ্বিনীর চরণেতে পড়িল ঢলিয়া।।
হরিভক্ত ছিল যত গোপালের সাথে।
গড়াগড়ি যায় সবে পড়িয়া মাটিতে।।
হরি হরি বলে সবে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে প্রেম সম্বরিল।।
তারপর সবে মিলে করিছে কীর্ত্তন।
তাই দেখে সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।।
ঘরেতে তণ্ডুল নাহি কি হবে উপায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
ধামা হাতে চলিলেন গ্রামের ভিতর।
বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করি আসিল সত্বর।।
কোন মতে ডাল ভাত রন্ধন হইল।
হরি বলে ভক্তগণে ভোজন করিল।।
অশ্বিনীর দৈন্য দশা গোপাল জানিয়া।
অশ্বিনীর হস্ত ধরে কহিছে কান্দিয়া।।
চল ভাই ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ ঠাই।
তার কাছে গিয়ে মোরা সকল জানাই।।
অশ্বিনী বলেছে ভাই তোমাকে শুধাই।
মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।।
ভক্তিহীন জ্ঞানহীন জগতে আসিয়ে।
সেবা করাইতে নারি হরিভক্ত পেয়ে।।
এই কথা বলে রত্ন কান্দিতে লাগিল।
গোপাল চরণ ধরে আবেগে কহিল।।
শুন শুন শুন ভাই তোমাকে জানাই।
তোমা সম হরিভক্ত এ জগতে নাই।।
প্রেমরসে তনু মাখা হরিভক্ত তুমি।
তোমার তুলনা দিতে নাহি জানি আমি।।
এইভাবে প্রেমালাপ হইতে লাগিল।
হরি কথা রসরঙ্গে সে নিশি কাটিল।।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়।
হাত মুখ ধুয়ে সবে পান্তা ভাত খায়।।
পান্তা সেবা করি শেষে মিলিয়া সকলে।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা হরি হরি বলে।।
পথে যেতে সকলেতে হরিগুণ গায়।
অশ্বিনীর চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।।
ঘৃতকান্দি গিয়ে সবে মনের আবেগে।
হরি হরি বলে সবে চলে দ্রুতবেগে।।
অশ্বিনী অনেক পিছে পড়িয়া রহিল।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লাগিল।।
সকলেতে লইয়াছে নানাবিধ দ্রব্য।
মোর কাছে কিছু নাই কোথা বা কি পাব।
মাঠ মধ্যে গিয়ে তিনি ভাবিতে লাগিল।
দুই হাতে দুই ঢেলা ধারণ করিল।।
এই মাটি লযে আমি শ্রীধামেতে যাব।
তাতে কিবা আমি ভারী অপরাধী হবো।।
মাটি গলে মাটি হবে শ্রীধামেতে রবে।
এইটুকু উপকার মোর দ্বারা হবে।।
আগে আগে সবে যারা শ্রীধামে উঠিল।
গুরুচাঁদ পদে গিয়ে প্রণাম করিল।।
হরি বলে গুরুচাঁদ আশীর্বাদ দিল।
সকলে মঙ্গলে থাক মুখেতে বলিল।।
যেবা যাহা নিয়েছিল রাখিল তথায়।
গুরুচাঁদ চরণেতে সকল জানায়।।
গদিঘর পিছনেতে অশ্বিনী বসিয়া।
নয়নের জলে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
প্রেমভরে স্তুতি করে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
আমি বড় অভাজন কোন কিছু নাই।
কি দিয়া বাসিব ভাল চরণে জানাই।।
ওদিকেতে গদিঘরে গুরুচাঁদ কয়।
তোমরা আসিলে সবে অশ্বিনী কোথায়।।
তোমরা আনিলে যাহা দেখিবারে পাই।
অশ্বিনী আনিবে যাহা আগে খাব তাই।।
একজন বলে এসে গুরুচাঁদ কাছে।
ঘরের বাহিরে বসে অশ্বিনী রয়েছে।।
দুই দলা ঢেলা মাটি দুই হাতে ধরি।
বসে বসে কাঁদিতেছে বলে হরি হরি।।
তাই শুনে গুরুচাঁদ বাহিরেতে যায়।
দুই খন্ড মিছরি হাতে দেখিবার পায়।।
তাই নিয়ে গুরুচাঁদ মুখেতে পুরিল।
কড়মড় শব্দ করি খাইতে লাগিল।।
অশ্বিনী পড়িল ঢলে গুরুচাঁদ পায়।
কেঁদে কেঁদে চরণেতে গড়াগড়ি যায়।।
অশ্চর্য্য দেখিয়া সবে কাঁদিতে লাগিল।
কেঁদে কেঁদে গুরুচাঁদ চরণে পড়িল।।
কেহ কেহ কেঁদে বলে ওগো দয়াময়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।
শান্ত হযে সবে মিলে গদি ঘরে চল।।
এই কথা বলে প্রভু গদিতে বসিল।
শান্ত হয়ে সবে গিয়ে প্রণাম করিল।।
প্রণাম করিয়া সবে চারিদিকে বসে।
অশ্বিনী পিছনে বসে আখি জলে ভাসে।।
কাঁদিয়া গোপাল বলে গুরুচাঁদ ঠাই।
শুন শুন শুন প্রভু তোমাকে জানাই।।
অশ্বিনী দাদার কথা জানাই চরণে।
ভিক্ষা করে খেতে দেয় হরি ভক্তগণে।।
করজোড়ে ওগো প্রভু তোমাকে জানাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
তাই শুনি গুরুচাঁদ হাসি হাসি কয়।
অশ্বিনীকে ডেকে আন দিব যাহা চায়।।
তাই শুনি অশ্বিনীকে ডাকিয়া আনিল।
করোজোড়ে সে অশ্বিনী আসিয়া দাঁড়ায়।।
গুরুচাঁদ ডেকে বলে শুন হে অশ্বিনী।
মোর কাছে কিবা চাও বল তাই শুনি।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কেঁদে কেঁদে কয়।
এক নিবেদন করি তব রাঙ্গা পায়।।
অভাবের তাড়নায় ভিক্ষা লাগি যাই।
তাও যেন নাহি দেয় এই বর চাই।।
অন্য কিছু নাহি চাই চরণে জানাই।।
অন্তিত কালেতে যেন শ্রীচরণ পাই।
প্রেম ভক্তি কিছু নাই ওগো দয়াময়।
দয়া করে অধমের রেখ রাঙ্গা পায়।।
অশ্বিনীর কথা শুনে গুরুচাঁদ কয়।
শুন শুন ও গোপাল বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীর কথা কিছু শুনিলে এখন।
আমি তারে কি করিব বল বাছাধন।।
হরিকল্প তরুমূলে বাসনা যে করে।
মনের বাসনা পূর্ব আমি করি তারে।।
শুনিয়া গোপাল বড় বিস্ময় মানিল।
মনের বেদনা তার মনে রয়ে গেল।।
অশ্বিনীর কাছে গিয়ে সে গোপাল কয়।
শুন শুন ওগো দাদা বলি যে তোমায়।।
তোমার মনের কথা আমি জানি নাই।
তোমা সম হরিভক্ত খুঁজিয়া না পাই।।
করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা কর মোরে।
চরণ ধরিয়া তারে সান্তনা করায়।।
তারপর সবে মিলে গুরুচাঁদ কয়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
যে যাহার মন কথা গুরুচাঁদ বলি।
পরদিন সবে মিলে দেশে গেল চলি।।
এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!