ভবঘুরেকথা
ডাবার পর মুগুর প'লে সেইদিনে গা টের পাবা

ডাবার পর মুগুর প’লে সেইদিনে গা টের পাবা

-মূর্শেদূল মেরাজ

ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন- “ভজো মানুষের চরণ দুটি / নিত্য বস্তু হবে খাঁটি”। বাউল-ফকির, পাগল-মস্তান, সাধু-গুরু, ভক্ত-সাধকশিল্পী সকলেই এই মন্ত্রে দীক্ষিত। তারা অপরের ক্ষতি হয় এমন কোনো পথে সাধন-ভজনও করে না। জীবনাচার পরিচালনাও করে না। তারা নিজেরাও সদাসর্বদা আনন্দে থাকতে চায়। সকলকেও আনন্দে রাখতে চায়।

তারা ভালোই জানে সুখ থেকে স্বস্তি ভালো। তারা সুখের আশায় অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পত্তির পেছনে ছুটে বেড়ায় না। তারা মনের আনন্দে সুর-সংগীত করে। সংগীতই তাদের আরাধনা-উপাসনা। এই মতে চলতে গিয়ে তাদের যাপিত জীবন যেমন হয় অন্যদের থেকে ভিন্ন। তেমনই আচার-আচরণ, সামাজিকতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশভূষায় আসে ভিন্নতা।

তথাকথিত সভ্যতার ঝুলানো মূলার পেছনে ইদুঁরদৌড়ে অংশ নেয় না বলে; কেবল মৌলবাদী শক্তিই নয় পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, জঙ্গীবাদ তথা সকল প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানের চক্ষুশূল হলো এই প্রেমিকরূপী ‘সাধককুল’। তারা সভ্যতার নিয়ম না মেনে নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় পরিচালিত হয়। নিজস্ব পোশাক-পরিচ্ছদ পরে।

নিজেদের মতো বেষভূষা ধারণ করে। নিজেদের মতো গান-বাজনা করে। গুরু-শিষ্য ভজনা করে। সাধন-ভজন করে জীবন পরিচালনা করে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হলেই তারা খুশি। নিয়ম মেনে সকাল-সন্ধ্যা অফিস-আদালতও করে না। সভ্যতার চাপিয়ে দেয়া বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরেও বেড়ায় না।

আর এটাই তথাকথিত বাণিজ্যিক সভ্যতার ঝাণ্ডাধারীরা মানতে নারাজ। আর মৌলবাদীদের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাই বারবার নানা রূপে তারা আঘাত করে সাধুগুরু, বাউল-ফকির, পাগল-মস্তানদের উপর। এই আঘাত যে কেবল বাউল-ফকির, পাগল-মস্তানদের উপর তা কিন্তু নয়। এই আঘাত মূলত আমাদের নিজস্বতার উপর।

আমাদের স্বাধীন চিন্তার উপর। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাধন-ভজন, চিন্তাশীলতার উপর। ভাববাদের উপর। আধ্যত্ম সাধনার উপর। এই আঘাত মানবিক পৃথিবীর উপর। এই আঘাত মানবাধিকারের উপর। এই আঘাত মানবতার উপর।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপদে আপন চিন্তা-চেনতা, ধর্ম-দর্শন, সাধন-ভজন পরিচালনা করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। যারা অন্যের ক্ষতি না করে আপন আপন ধর্ম-দর্শনে মত্ত্ব থাকে তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

নানা মতের মানুষ নিজস্ব চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা, ধর্ম-দর্শন নিয়ে একত্রে পাশাপাশি বসবাস করবে এটাই তো সভ্যতার রূপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সভ্যতা আমাদেরকে বাণিজ্যিক বিভাজন শিখিয়েছে মাত্র। যার সকল কিছুর মানদণ্ড আজ অর্থবিত্ত, ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সীমিত করেছে।

তথাকথিত এই সভ্যতার টিনের চশমা পরা মানুষগুলো ধার করা ভিনদেশী সংস্কৃতিতে এতোটাই মজেছে যে, নিজস্বতাকে আজ ছোটলোকের জীবনদর্শন মনে করে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে ধার করা সংস্কৃতিতে লোকদেখানো সুখ থাকলেও স্বস্তির জায়গা নেই। দিন শেষে প্রতিটি মানুষই একা। যখন প্রতিটা মানুষ নিজের মুখোমুখি হয়। তখন সে জানে সভ্যতার কলে পিষ্ঠ হয়ে সে আদোতে কতাটা সুখি!

মনে রাখা জরুরী, একজন সাধক নিজেকে জানার জন্য সাধনার পথে হাঁটলেও। সে প্রকৃতপক্ষে সকল সময়ই সকলের জন্য ভাবে। তার ভাবনা সামষ্টিক। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সে থাকে না। স্বার্থপরের মতো নিজের জন্য। নিজের পরিবারের জন্য সে সঞ্চয় করে সংকটে ফেলে না সকলকে। সে এমন এক জীবনব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন পরিচালনা করে। যার কারণে কোনো জীব এমনকি জড় পদার্থও যেন কষ্ট পেয়ে না যায়। সে মনের কোমল অনুভূতি নিয়ে কর্ম করে। মনের সুললিত অংশে তার বসবাস। তাই তারপক্ষে চাইলেও অন্যের ক্ষতি করা সম্ভব নয়।

আর এই আপন খেয়ালে মত্ত্ব, জিন্দামরার পথযাত্রীদের যারা আঘাত করে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী। যদিও সাধুগুরু, পাগল-মস্তান সকলকেই ক্ষমা করে দেয় শেষ বিচারে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব এরূপ অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে সমাজে সহবস্থানের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপদে আপন চিন্তা-চেনতা, ধর্ম-দর্শন, সাধন-ভজন পরিচালনা করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। যারা অন্যের ক্ষতি না করে আপন আপন ধর্ম-দর্শনে মত্ত্ব থাকে তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

আজকের এই বাউল-ফকিরদের উপর হামলা, বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি ধারাবাহিকভাবে বিচারহীনতায় অপরাধীরা দিন দিন যে আরো শক্তিশালী-বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারই বহিপ্রকাশ মাত্র? নাকি বাউল-ফকির, পাগল-মস্তানদের গায়ে হাত তোলা, তাদের বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া, তাদের খাতাপত্র পুড়িয়ে দেয়া এতোটাই স্বাভাবিক যে। যে যখন খুশি তা চাইলেই করতে পারে?

সেখান থেকেই নিজের মতো করে প্রতিবাদী হতে হবে। নিজের সংস্কৃতিকে চর্চায় নিয়ে আসতে হবে। যারা চর্চা করছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেবল মুখের কথা বললেই হবে না। চায়ের টেবিলে ঝড় তুললেই হবে না। কাগজকলমে প্রতিবাদ সীমিত রাখলেও চলবে না। নিজের সংস্কৃতি আগে নিজেকে। তারপর পরিবারে। তারপর সমাজে প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

এই সকল নিরীহ মানুষদের গায়ে হাত তুলতে গিয়ে ক্ষমতাধরদের হাত একটুকুও কাঁপে না? বাদ্যযন্ত্রে আঘাত দেয়ার আগে একবারও ভাবে না? একজন সাধকের দেহের অঙ্গের মতোই তার বাদ্যযন্ত্র? তার সারাজীবনের সাধনাই হলো তার গানের খাতা। যা একবার হারিয়ে গেলে এই মানবজাতি আর কোনোদিন সেই হারিয়ে যাওয়া লাইনগুলো ফিরে পাবে না?

এইভাবে যারা বারংবার আঘাত করে আসছে। তারা কি বাঙালীর সংস্কৃতিকে ধুয়েমুছে এমন এক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার পায়তারা করছে যেখানে সুর থাকবে না? সংগীত থাকবে না? চিত্রশিল্প থাকবে না? শিল্প-সংস্কৃতি থাকবে না? লালন থাকবে না? বাউল থাকবে না? ফকির থাকবে না? মুক্ত চিন্তার মানুষ থাকবে না?

কেবল ছাঁচে ফেলা গাঁধা শ্রেণী থাকবে। যাদের পিঠে বোঝা চাপালে তাদের পা কাঁপতে শুরু করলেই কেবল হাঁটতে শুরু করবে? আমরা যদি নিজেদের এমন ভবিষ্যত চাই। বা ভবিষ্যত প্রজন্মকে এমন ছাঁচে ফেলা গাঁধার অনুলিপি বানাতে চাই। তাহলে কোনো কথা নেই। আর যদি তা না চাই। তাহলে যে যে অবস্থানে আছি।

সেখান থেকেই নিজের মতো করে প্রতিবাদী হতে হবে। নিজের সংস্কৃতিকে চর্চায় নিয়ে আসতে হবে। যারা চর্চা করছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেবল মুখের কথা বললেই হবে না। চায়ের টেবিলে ঝড় তুললেই হবে না। কাগজকলমে প্রতিবাদ সীমিত রাখলেও চলবে না। নিজের সংস্কৃতি আগে নিজেকে। তারপর পরিবারে। তারপর সমাজে প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

এই যে আমাদের প্রতিবাদ। কোনো আজ এই প্রতিবাদ। এই বিষয়গুলো জানার আগে একটু ফিরে দেখি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের উপর যে সকল হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট হয়েছে তার গুটিকয়েক ঘটনা। যদিও অগনিত ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ স্থানে মৌলবদীদের আস্ফালনে গান করা যাচ্ছে না। বাদ্যযন্ত্র বাজানো যাচ্ছে না। সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠানে বাঁধা আসছে। বাউল-ফকির বেশ ধরে রাখা যাচ্ছে না। সেসব নিরবে-নিভৃতিতেই থেকে যাচ্ছে। এরমধ্যে গুটিকয়েকটি খবর যে প্রচারে এসেছে সেগুলো একটু ফিরে দেখলে দেখা যায়-

 

দৌলতপুরে সাধুসঙ্গে হামলা-ভাঙচুর:

গত ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে দৌলতপুর উপজেলার লাউবাড়িয়ায় এক ভক্তের বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সাধুগুরু। তখন হঠাৎ স্থানীয় জামে মসজিদের সভাপতি একরাম হোসেনের নেতৃত্বে শতাধিক লোক অতর্কিতে হামলা চালায়। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে সাধুসঙ্গের আখড়াবাড়িটি ভাঙচুর করেন। সাধুদের মারধর করেন। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ৯০ বছর বয়সী বাউল ফজল ফকিরও ছিলেন।

ফজল ফকির বলেন, “আমরা সেখানে মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে নিজেদের কুশল বিনিময় করছিলাম; হঠাৎ ঘরের চালে দুমদাম করে ইট পাটকেল এসে পড়ছিল। এরপর একসঙ্গে ‘নারায়ে তাকবির’ বলে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে ভিতরে ঢুকে নির্বিচারে লাঠি ও রড় দিয়ে পেটানো শুরু করে। আমি তাদের কাছে জোড় হাত করেও রক্ষা পাইনি। হাইসু [হাসুয়া] দিয়ে কুপিয়ে এবং লাঠিসোটা দিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে সাধুসঙ্গ ভন্ডুল করে দেয়।”

 

চুয়াডাঙ্গায় বাউল আখড়ায় হামলা-অগ্নিসংযোগ:

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি মুসলিমপাড়া এলাকায় ‘মুনতাজ শাহর মাজার ও দরগা শরিফ’ নামে পরিচিত বাউল আখড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটনা ঘটে। এসময় হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ঘরের টিনের বেড়া নষ্ট, বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন, ফল ও ফুলের গাছ কর্তন, দানবাক্স লুটসহ অন্তত ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

আখড়াবাড়ির সভাপতি মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাউলরা যাতে সংগঠিত হতে না পারেন, সে জন্য স্থানীয় একটি গোষ্ঠী এ হামলা চালাতে পারে।

 

নড়াইলে হারেজ ফকিরের উপর হামলা ও বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর:

২০২২ সালের ২৭ অগাস্ট নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া ইউনিয়নে লালন সাধক হারেজ ফকিরকে মারধর ও গালিগালাজ করা হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর পুরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মণির অফিসে সালিশ বসে। সালিশ শেষ হওয়ার পর রাত ১১টার দিকে ১০-১৫ জনের একটি দল পুরুলিয়া বাজে-বাবরা গ্রামে হারেজ ফকিরের ‘শরিফা বাউল আশ্রমে’ ভাঙচুর চালায়। আস্তানায় থাকা হারমনিয়াম, একতারা, চাকি, খোল-করতাল, নাল, ডুগি-তবলাসহ সকল লোকবাদ্যযন্ত্র গুঁড়িয়ে দেয়।

ফকিরের অভিযোগ, চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মণির বড়ভাই মো আলী মিয়া শেখের নির্দেশে চাচাতো ভাই মিন্টু শেখের নেতৃত্বে ওই হামলা করা হয়।

হারেজ ফকির বলেন, “আমি ৪০ বছর ধরে এখানে সাধনা করি। কারও সঙ্গে-পাছে নাই। আমার কিছু ভক্ত আছে। তারা প্রতি বৃহস্পতিবার আমার এখানে গান-বাজনা করতে আসে। এটা নাকি করা যাবে না। আমার গায়ে তাই ওরা হাত তুলেছে। আস্তানায় ভাঙচুর চালিয়ে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলেছে।”

 

কিশোরের মেহেদী বাউলের মাথা ন্যাড়া করা:

২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে কিশোর বাউল মেহেদীকে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছর বয়সী ওই কিশোর পড়ালেখার পাশাপাশি স্থানীয় মতিন বাউলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাউল গান করত। তার বেশভূষা, লম্বা চুল নিয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রক ধর্মান্ধরা প্রায়শই নানান উষ্কানিমূলক মন্তব্য করতো।

ঘটনার দিন তারা মেহেদীকে মারধর করে জোরপূর্বক চুল কেটে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। বাউল গান ছাড়তে নির্দেশ জারি করে। মাথার চুল আবার বড় করলে মেহেদীকে গ্রামছাড়া করার হুমকি দেয়া হয়। তার পাশে কেউ দাঁড়াতে সাহস পর্যন্ত পায়নি।

 

রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আগুন:

২০২০ সালের ১৭ মে সুনামগঞ্জে বাউল শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আগুন দেয় উগ্রবাদীরা। গভীর রাতে দেয়া আগুনে ‘বাউল আসর’ ঘর পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পুড়ে যায় ঢোল, ছইট্টা, দোতরা, বেহালা, হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। আগুনে তার নিজের লেখা শতাধিক গান পুড়ে হয়ে যায়।

 

চাটমোহরে লালন একাডেমিতে হামলা:

২০২০ সালের ১১ সেপ্টম্বর পাবনার চাটমোহরে লালন একাডেমীতে লালন ফকিরের ভাব সঙ্গীত চলাকালীন সময় বাউলদের উপর হামলা চালায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।

 

ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর সংগীতাঙ্গনে আগুন:

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে ২০২১ সালের ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন জেল রোডের প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। দুর্লভ নথিপত্রসহ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজরিত সকল বাদ্যযন্ত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে থাকা দুর্লভ আড়াইশ’র মতো বই, আড়াই হাজার ছবি, দলিলপত্র, আলাউদ্দিন খাঁর লেখা সংগীতের পাণ্ডলিপি, দুর্লভ ছবি, সংগীতের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, বেহালা, খুঞ্জন ও বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র সরোদ ছিল। সব মিলিয়ে অন্তত ৩৫ লাখ টাকার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

 

বাউল শিল্পী শামসুল হক চিশতির উপর হামলা:

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় উন্নয়ন মেলার গান গাওয়ার সময় চিশতি বাউল নামে প্রবীণ শিল্পীর উপর অতর্কিতে হামলা চালায় একদল মাদ্রাসাছাত্র। উগ্রবাদীরা মঞ্চ, মাইক ও গাড়ি ভাঙচুর করে।

 

যশোরে বাউল আসরে হামলা ও হত্যা:

২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যশোরের সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের ডুমদিয়ার মালেকের আমবাগানে ৮/১০ জন মিলে বাউল গানের আসর বসিয়েছিল। রাত ১১টার দিকে ৫/৬টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আসরে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মুক্তার হোসেনকে উপর্যুপরি আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই বাউল শিল্পী মুক্তার হোসেন মারা যান। আহত হন তবলা বাদক ছাব্বির ও স্থানীয় বাসিন্দা বসির।

মোহম্মদ ফকির সহ বাউল চুল কাটা:

২০১১ সালের রাজবাড়ির পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের চররামনগর গ্রামে মোহম্মদ ফকিরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাধুসঙ্গে আক্রমণ চালায় উগ্রবাদীরা। মোহম্মদ ফকির দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ তার বাড়িতে এই সাধুসঙ্গ পালন করে আসছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় শতাধিক বাউল সাধক। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন ৫ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে চৌবাড়িয়া মাদ্রাসা ও পাড়া বেলগাছি গ্রামের জনৈক ব্যক্তির নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক মোহম্মদ ফকিরের বাড়িতে অর্তকিতে হামলা চালিয়ে বাউলদের এলোপাতাড়ি মারধর করে।

অনুষ্ঠান স্থল থেকে জোড়পূর্বক ২৮ বাউলকে তুলে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে পাশবিক নির্যাতনের পর জোর করে পাশের মসজিদে নিয়ে তওবা পড়ানো হয় এবং বাউলদের চুল-গোঁফ কেটে দেয়া হয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা অকত্থ্য ভাষায় গালাগালি করে বাউলদের। হুমকি দেয়া হয় ভবিষ্যতে যেন আর গানবাজনা না করা হয়। এসময় তারা বাউলদের বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে।

আজম শাহ্ চিশতী দরবার ভাঙচুর:

করোনা চলাকালীন সময় লকডাউন চলাকালীন সময়ে ৩০/৩৫ জন এসে আজম শাহ্ চিশতী দরবার শরীফ ভাঙচুর করে। ভাঙচুরের পাশাপাশি টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র সব লুটপাট করে নিয়ে যায়। কে করবে এর বিচার? ঘটনাটি ঘটে কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার চান্দের চর ইউনিয়নের শোভারামপুর গ্রামে। এই দরবারে তরিকতপন্থী, পাগল-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসী ও সমাজের সাধারণ মানুষের আসা যাওয়া ছিল। যা স্থানীয় ক্ষমতাধর মৌলবাদীদের পছন্দের ছিল না। এই দরবারে মোট ৩ বার আক্রমণ করা হয়। প্রথম আক্রমণ হয়েছিল এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ ২০২০ সালে।

 

দৌলতখানে দরবার শরিফে হামলা:

ভোলার দৌলতখান উপজেলায় বাংলাদেশ হাক্কানি মিশনের মিয়ারহাট দরবার শরিফে ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ সালে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মিয়ারহাট ইমান-আক্বিদা সংরক্ষণ কমিটির অভিযোগ, ঢাকা থেকে আসা হাক্কানি মিশনের চার শতাধিক নারী-পুরুষ দরবারে ঢোল বাজিয়ে নাচ-গান করেন। দরবার শরিফের এসব কর্মকাণ্ড ইসলাম ও শরিয়তবিরোধী আখ্যা দিয়ে কমিটি আন্দোলনের ডাক দেয়।

হাক্কানি মিশনের দৌলতখান দরবারের প্রধান জোবায়ের হোসেন চৌধুরী জানান, কোনো অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন। কিন্তু ইমান-আক্বিদা সংরক্ষণ কমিটির লোকজন তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তাঁদের উৎখাতের চেষ্টা করছেন। এ উদ্দেশ্যে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে শুক্রবার মাগরিবের নামাজের আগে কয়েক হাজার মানুষ দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে তিনি ছাড়াও তাঁদের পক্ষের আটজন আহত হন।

 

বাউল শিল্পীদের গ্রেফতার:

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে শরিয়ত সরকার নামের এক বাউলকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। জানা যায়, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কোরানের কোন আয়াতে গান নিষিদ্ধ করা হয়েছে? চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তিনি গান ছেড়ে দেবেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে সেই শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যার প্রেক্ষিতে শিল্পীকে জেলে যেতে হয়।

নরসিংদীর বেলাবতে বাউলদের উপর হামলা:

এবার আজকের প্রতিবাদ যে ঘটনা নিয়ে সেই সাম্প্রতিকতম ঘটনাটিতে নজর দেয়া যাক। গত ৭ মে নরসিংদীর বেলাবতে লালন আখড়ার সাধুসঙ্গ প্রস্তুতির সময়কালে হামলা চালিয়ে সকল বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং বাউলদের উপর নেক্কারজনক আক্রমণ চালানো হয়।

তাই মাঝেমধ্যেই দেখা যায় যে কেউ চাইলেই রাস্তার পাগল-মস্তানদের ধরে তাদের সারাজীবনের সাধনা চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কেটে ভদ্রস্থ বানানোর চেষ্টা করে। মহান কাজ করেছে এমন হাসিহাসি মুখ করে ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু একজন পাগল-মস্তানের সারাজীবনের জীবনব্যবস্থাকে যারা এভাবে মলিন করে দেয় তাদের কোনো শাস্তি তো হয়ই না। বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে প্রশাসনও এতে মমদ দেয়।

দুপুর আড়াইটার দিকে আখড়ায় লালনভক্ত বেলাব বাজারের প্রয়াত ব্যবসায়ী সুমন মিয়ার চল্লিশা অনুষ্ঠান উপলক্ষে মিলাদ ও ভক্তিমূলক গানের আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় মাতাল অবস্থায় আখড়ায় প্রবেশ করে স্থানীয় মজনু শেখের ছেলে জাহাঙ্গীর শেখ। সে মাতলামি করতে থাকলে আখড়ার লোকেরা তাকে জোর করে আখড়া থেকে বের করে দেয়। পরে বাড়িতে গিয়ে জাহাঙ্গীর তাকে মারপিট করেছে এমন অভিযোগ দিলে শাহীন শেখ, জাহাঙ্গীর শেখ, শরীফ শেখ, ফজুলু শেখসহ ৬ থেকে ৭ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে।

এ সময় তারা একতারা, ডুগি, হাতবাড়া, খমক, দোতারা, সারিন্দা, তবলা উকুলেলে, গিটার, বাঁশিসহ সব বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে ও সাধুদের মারধর করে। তাদের মারধরে সাধু রিয়াদ ভূইয়া, খোকন চিশতী, মিন্টু, সজীব, রকিবসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়।

উপরোক্ত যে কয়টি ঘটনার যৎকিঞ্চিৎ তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট। কেবল মৌলবাদী শ্রেণীই নয়। সমাজের ক্ষমতাশালীদের লক্ষ্যবস্তু আজ নিরীহ বাউল-ফকির, পাগল-মস্তানরা। তাই মাঝেমধ্যেই দেখা যায় যে কেউ চাইলেই রাস্তার পাগল-মস্তানদের ধরে তাদের সারাজীবনের সাধনা চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কেটে ভদ্রস্থ বানানোর চেষ্টা করে। মহান কাজ করেছে এমন হাসিহাসি মুখ করে ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু একজন পাগল-মস্তানের সারাজীবনের জীবনব্যবস্থাকে যারা এভাবে মলিন করে দেয় তাদের কোনো শাস্তি তো হয়ই না। বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে প্রশাসনও এতে মমদ দেয়।

আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়তো আপনাদের মতো মারামারি, কাটাকাটি, হাতাহাতি হবে না। আমাদের প্রতিবাদের ভাষাও হবে প্রেমেরই। কারণ আমরা প্রেম ভিন্ন অন্য কিছুরই চাষাবাদ করি না। লালনপালন করি না।

নিরীহ বাউল-ফকির-সাধক-পাগল-মস্তানদের উপর এইরূপ হামলা করে যারা আস্ফালন করে। আর এই আস্ফালন দেখে যারা হাতে তালি দিয়ে উপভোগ করে। তারা সকলেই আমাদের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-পরম্পরার জন্য হুমকি। আর এই হুমকিকে যদি আমরা হালকা করে নেই। তাহলে আজ যেটা আমাদের সাথে ঘটছে। কাল হয়তো আপনাদের সাথেও ঘটবে। তাই সময় এসেছে আমাদের একত্ব প্রকাশ করার। সময় এসেছে আমাদের বিচ্ছিন্নতাকে দূর করার।

সকলে একসাথে একাত্মা হয়ে গর্জে ওঠার। এই গর্জন অহমিকার বা অহংকারের নয়। এ গর্জন কেবল জানান দেয়ার এরপর আর সহ্য করা হবে না। আমরা একা নই। এটা প্রমাণ করা জরুরী। তাই যারা আমরা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চাই। মুক্ত-স্বাধীন চিন্তাকে বাঁচতে দিতে চাই। নিজের ধ্যান-ধারণা, নিজস্বতা নিয়ে বাঁচতে চাই। আজ সময় এসেছে তাদের একত্রিত হওয়ার। একই ছায়াতলে এসে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার।

শেষ করছি মাওলানা রুমির পদ দিয়ে। তিনি পরিস্কার করে বলেছেন- “স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর অজস্র পথ আছে, তার মাঝে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম।” আর এই সূত্র ধরে বলতে চাই সকলকে। আমরা প্রেমের পথ বেছে নিয়েছি বটে। তাই বলে আমরা চিরোকাল মার খেয়ে যাবো বিষয়টা ভেবে নিলে আপনারা বোকার স্বর্গে অবস্থান করছেন। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়তো আপনাদের মতো মারামারি, কাটাকাটি, হাতাহাতি হবে না। আমাদের প্রতিবাদের ভাষাও হবে প্রেমেরই। কারণ আমরা প্রেম ভিন্ন অন্য কিছুরই চাষাবাদ করি না। লালনপালন করি না।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
মাই ডিভাইন জার্নি : আঠার:: রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই
মাই ডিভাইন জার্নি : বিশ :: কোন মানুষের করি ভজনা
মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ :: এসব দেখি কানার হাটবাজার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!