ভবঘুরেকথা
গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : সতের

‘আমি এখনো গুরু আশ্রিত হইনি’ বিষয়টি জেনে গুরুবাদী অনেকের কাছেই ধাক্কা লাগে। অনেকে বিষয়টি যেমন মানতে পারেন না। অনেকে আবার মানতেও চান না। অনেকে তাড়া দিয়ে বলেন, ‘ভাই যত দ্রুত সম্ভব দীক্ষাপর্বটি সেরে নিন। তারপর না যাত্রা। দীক্ষার পূর্বে তো যাত্রা শুরুই হয় না।’

বিষয়টা যে আমিও যে বুঝি না বা বিষয়টা আমাকে ভাবায় না, তা তো নয়। কিন্তু কি করে বোঝাই তাদের, প্রেমে না পড়লে প্রেম করি কেমন করে?

অনেকে বিষয়টি নিয়ে কটাক্ষ করতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না। পরিচিত অনেকে আড়ালে আবডালে এ নিয়ে নানান কথা বলে বেড়ায়। কেউ কেউ হাসি-তামাশাও করে। অনেকে আবার ভালোবেসে বলে, ‘ভাই যাই হোক একটা বিবেচনা করে দীক্ষাটা নিয়ে নেন।’

অনেক আখড়াতে এ নিয়ে আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবার চেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক গুরুর শিষ্যরা তো জোড় করে তার গুরুর কাছ থেকে পারলে তক্ষুণি দীক্ষা দিয়ে দেওয়ায় আর কি। অনেকে নিচু গলায় বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে দীক্ষা নেয়ার সুফল।

অনেকে বুঝিয়ে বলেন, দীক্ষা না নিলে সকল জ্ঞানই বৃথা। তাই প্রেম না হলেও প্রেমটা করে নেয়া দরকার। বন্ধন তৈরি হলে তারপরও তো প্রেমটা হতে পারে।

শিষ্য-ভক্ত-অনুরাগী-অনুসারীরা দীক্ষা নেয়ার বিষয়টি নিয়ে গুরুর সামনেও যখন বাড়াবাড়ি রকমের পীড়াপীড়ি শুরু করে। আর যখন গুরুজীরও এক ধরনের মৌন সম্মতি থাকে তাতে। তখন মনটা খুবই খারাপ হয়। বিষাদময় হয় জীবন।

শিষ্য-ভক্ত-অনুরাগী-অনুসারীদের পীড়াপীড়ি-টানাটানির বিষয়টা আমি বুঝি। তাতে আমি ব্যথিত হই না। তার মাঝেও অনেকের ভেতরই আমার প্রতি চরম ভালোবাসাও থাকে। চরম ভালোবাসে বলেই তারা চায় তাদের ঘরে তুলতে।

তার মায়া কাটিয়ে চলে আসতে পারছিলাম না কিছুতেই। কিন্তু সেই সন্ধ্যার পরিস্থিতিটা অসহ্য হয়ে উঠছিল ক্রমশ। তবে এসব কথা শুনে সুধাম সাধু অনেক পরে হাসতে হাসতে বলেছিল, “আরে ভাই কেউ যদি দীক্ষা দিতে চায় আপনি নিয়া নিবেন। এতো ভাবাভাবির কি আছে।

কিন্তু যখন তা আমার প্রতি তাদের অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বিষয়টা বাড়াবড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন বিব্রত হই বটে; কিন্তু মনক্ষুন্ন হই না মোটেও। তার মাঝেও তাদের ভালোবাসার ছিটেফোঁটা খোঁজার চেষ্টা করি।

কিন্তু ঐ যে বললাম গুরুজী যখন তাতে সম্মতি দেন বা নিরব থেকে শিষ্যদের আরো উৎসাহ দেন তখন বিষয়টি মানতে পারি না। মনে কষ্ট পাই। বিষয়টা ব্যথিত করে। কাতর করে তোলে। গুরুজী যদি আমাকে দীক্ষা দিতেই চান। তাহলে তো আমার মনের কথা তার বোঝা উচিত। তাই নয় কি?

তবে শিষ্যদের এমন টানাটানি বা জোড়াজড়ির সময় গুরুদের নিরব বা স্বরব সম্মতির বিব্রতকর পরিস্থিতিতে বহুবারই পরতে হয়েছে। এমন এমন ঘরেও এই আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেখানে এমন প্রত্যাশা মোটেও ছিল না।

আবার এর বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। জীবন আসলে অভিজ্ঞতার সঞ্চিত ভাণ্ডার। এখানে সব অভিজ্ঞতা যেমন মনোপুত হয় না। তেমনি সবকিছু অভিজ্ঞতা বলেও মূল্যায়িত হয় না।

একবার এক সাধুর আখড়ায় গেছি। থাকছি কয়েকদিন। প্রতিদিনই সেই আখড়ার গুরুজীর শিষ্যরা জানতে চায় কবে দীক্ষা নেবো। বিষয়টা বিরক্তির পর্যায়ে চলে গেলেও আমি হাসি মুখে আছি। তারাও পেয়ে বসলো। এক সন্ধ্যায় গুরুজীর সামনেই আমাকে চেপে ধরলো তারা।

সকলে মিলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে থাকলো, যেন আমি তক্ষুণি দীক্ষা কর্মটি সেরে নেই। সাধারণত এমন কোনো আচরণ কোনো ঘরে দেখলে আমি আগেভাগেই চলে আসি। কিন্তু সাধুটিকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গেছে; ব্যাপক ভাব জমেছে।

তার মায়া কাটিয়ে চলে আসতে পারছিলাম না কিছুতেই। কিন্তু সেই সন্ধ্যার পরিস্থিতিটা অসহ্য হয়ে উঠছিল ক্রমশ। তবে এসব কথা শুনে সুধাম সাধু অনেক পরে হাসতে হাসতে বলেছিল, “আরে ভাই কেউ যদি দীক্ষা দিতে চায় আপনি নিয়া নিবেন। এতো ভাবাভাবির কি আছে।

যার যার খুশি আপনারে দীক্ষা দিলো। যেখানে আপনার মন টানবে সেখান থেকে আপনি নিজের ইচ্ছায় নিবেন। বাকি যত খুশি দীক্ষা থাকলো ক্ষতি কি। আমাকে তো যে দীক্ষা দিতে চায় আমি সবার কাছ থেকেই নেই।”

সুধাম সাধুর এই ব্যাখ্যাটা বেশ মনে ধরেছিল। কিন্তু এ কাজটি যে আমাকে দিয়ে হবে না সেটাও আমি ভালোভাবেই বুঝেছিলাম। বিষয়টাকে এতো সহজভাবে এখনো নেয়ার মতো পর্যায়ে আমি পৌঁছুতেই পরিনি। কখনো পরবো কিনা তারও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তবে সেই সন্ধ্যায় আমার ফাঁদে পড়া ফড়িঙের মতো অবস্থা দেখে সাধুটি তার শিষ্যদের উদ্দেশ্য করে বলেছিল, “আরে শোন! প্রেম কি আর সাক্ষী মাইনা হয় রে। প্রেম করার জন্য কি চারজন সাক্ষী লাগে? চাল-পানির শপথ লাগে? প্রেম অনেক বড় বিষয়। সব কিছুর উপরে।

আর সেই পরম প্রেমের সাক্ষী তো হইলো চন্দ্র-সূর্য। সেখানে মানুষের সাক্ষী, মাথার উপর পর্দা কিচ্ছু লাগে নারে পাগল। সেখানে আকাশই পর্দা। বাজানরে ত্যক্ত করিস না।”

অনেকে ঘড়ি বা প্রকৃতি দেখে কয়টা বাজে সেই সময়টা নির্ণয় করাকেই সময় মনে করে নেয়। আবার অনেকে ঘড়ি-ক্যালেন্ডার ছাড়িয়ে আরো গভীরভাবে বুঝতে চায় সময়কে। আর এভাবে গভীরভাবে বুঝতে গিয়ে ডুবে যায় সময়ের অতল ভুবনে। কালাকালে।

এই শুনে শিষ্যরা গুরুর উপর ভীষণ অভিমানে বলেছিল, তাহলে তাদের কেনো এতো ঘটা করে দীক্ষা দেয়া হলো। এতো আয়োজন, এতো সাক্ষী, এতো নিয়মকানুন কেনো তাদের সাথে? তবে কি তাদের সাথে প্রেম নেই?

আমার কানে অবশ্য সেই সব কথা বিশেষ যাচ্ছিল না। আমি ক্ষয়ে যাওয়া পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে সাধুকে মন থেকে ভক্তি দিতে দিতে ভাবছিলাম। এমন সাধুই তো প্রকৃত সাধু। যিনি এমন কথা বলতে পারেন। এমন সাধুর চরণে ভক্তি দেয়া যায় মন থেকে।

যিনি প্রেমকে রাখেন সকল শর্ত মুক্ত। সবার আগে। সর্বব্যাপী। এমন নি:স্বার্থ প্রেমের খোঁজেই তো এই যাত্রা। যার একটা নাম আমি দিয়েছি ‘মাই ডিভাইন জার্নি’। যার কোনো গন্তব্য নেই। যার কোনো শেষ নেই। আছে কেবল শুরু। যদিও লোকে বলে বিধি মোতাবেক সেই যাত্রা আমার শুরুই হয়নি।

আবার যে যাত্রা শুরুই হয়নি, সেই যাত্রা নিয়েই আমি লিখে চলেছি। এ যেন সময়ের পেছনে যেয়ে লিখতে শুরু করা। যে যাত্রাটা হয়তো কোনো এক সময় হবে বা কোনো এক জনমে হবে। সেটা নিয়ে আমি আজ লিখছি। নাকি যাত্রা করতে করতে লিখছি?

কে বলতে পারে এর সঠিক উত্তর কোনটি? সময়কে এখনো আমরা কি আসলেই বুঝতে পেরেছি? মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের যে যাত্রা শুরু হয়েছে। সেই থেকে যে সময়চক্র চলমান তার কতটা আমরা বুঝতে পেরেছি?

আমরা সময়কে সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা, দিন-সপ্তাহ-পক্ষ-মাস-বছর, মুর্হূত-প্রহর-লগ্ন-কাল কত কিছুতে ভাগ করেছি। কত গাণিতিক সূত্রে তাকে বুঝবার চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু সূর্য পশ্চিমাকাশে হারালে ‘রাত’ আর সূর্য পূর্বাকাশে উদয় হলে ‘দিন’ -এর বেশি তেমন কিছুই কি আদতে আমরা বুঝতে পেরেছি?

আমরা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার হিসেব কষে একটা সত্যকে ধরে এগিয়ে চলেছি মাত্র। কিন্তু ‘সময়’ বড়ই রহস্যময় এক চক্র। যার ভেদ বোঝা বড়ই শক্ত। যদি তাই না হতো তাহলে প্রযুক্তি তার টুটি টিপে ধরতো অনেক আগেই। কালে কালে তো ধারিত্রীর বেলা কম গড়ালো না।

আমরা এখনো সময়কে কেনো ঠিকঠাক মতো বুঝে উঠতে পারি নি সেটা নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে। আবার এভাবেও বলা যায়- সময়কে আমরা বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেছি। এর যে বাড়তি অংশটা বুঝতে চাইছি তা কেবলই কল্পনাপ্রসুত একটা পাগলামী ভিন্ন আর কিচ্ছু না।

হয়তো এটাও মিথ্যা না। আসলে সত্য-মিথ্যা বিষয়টাও তো ঘোলাটে। সত্য কি সকল জায়গায় সত্য? আর মিথ্যা? সেও কি? যাক সে কথা অনেক কথা। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সময়ের হিসেব যতটা সহজ, বিজ্ঞানের কাছে সময়ের হিসেব ততটাই জটিল।

অনেকে ঘড়ি বা প্রকৃতি দেখে কয়টা বাজে সেই সময়টা নির্ণয় করাকেই সময় মনে করে নেয়। আবার অনেকে ঘড়ি-ক্যালেন্ডার ছাড়িয়ে আরো গভীরভাবে বুঝতে চায় সময়কে। আর এভাবে গভীরভাবে বুঝতে গিয়ে ডুবে যায় সময়ের অতল ভুবনে। কালাকালে।

বিজ্ঞান যেমন সময়কে নিয়মিত অনুসন্ধান করে চলেছে। তেমনি প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন তথ্য প্রকাশ করছে। অন্যদিকে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের সাধুগুরুরাও তাদের মতো করে সময়ের ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। অবশ্য সাধুগুরুদের সেসব কথা শুনে বেশিভাগ মানুষই নাক সিটকায়।

আবার সেই সব কথাই যখন বিদেশী ভাষায়, ভিনদেশী শব্দে, পশ্চিমা জার্নালে, বিজ্ঞানী মহল প্রকাশ করে। তখন আমরা বিমোহিত হয়ে পড়ি। আবেগে আপ্লুত হই। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতি। পৃথিবী নতুন কিছু পেয়ে গেলো এই ভাবনায় ঘুমাতে পারি না।

যে কথাগুলো এতোকাল হাস্যকর মনে হচ্ছিল। তা বিজ্ঞানের মোড়কে উপস্থাপনে আমাদের কাছে তা বিশ্বাস হতে শুরু করে। এর জন্য অবশ্য কোনো পক্ষকেই বিশেষ দোষ দেয়া যায় না। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের মাথায় পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের যা কিছু তার কোনোটাই মূল সংস্কৃতি নয়।

তার সব কিছুই ‘লোক সংস্কৃতি’।

আমাদের যা কিছু ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সংস্কৃতি-সংস্কার সব কিছুই ব্রাত্য। সবকিছুই নিচু দরের। সব কিছুই কু-সংস্কার। এসব থেকে যতদূরে থাকা যায় ততই ভালো।

আমরাও ব্রিটিশ শিক্ষারীতিতে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের যোগ্যতর করে গড়ে তুলবার জন্য জান-পরান দিয়ে লেগে গেছি। এতে করে আমরা সমকালীন বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে শিখেছি সত্য। কিন্তু নিজেদের শেকড়কে অস্বীকার করার যে প্রবণতা; তা গুলে খেয়ে ফেলেছি।

তবে আমি নিজে মূর্খ বলে খুব বেশি পণ্ডিতি জ্ঞান জাহির করা লোকের সাথে তেমন মিশতে পারি না। আরো খোলসা করে বলতে গেলে বলা যায় আমি তাদের কাছে কোনোকালে বিশেষ কোনো পাত্তা পাইনি। পাইও না। করুণা বশতও নয়। আর স্বীকার করে নিলে বলতে হয়- চাইও না।

আমরা আমাদের নিজস্বতাকে-নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে অস্বীকার করার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গিয়ে ভুলে গেছি নিজেদের পরিচয়। ভারতবর্ষে নিজেদের চর্চাকে অস্বীকার করার প্রবণতা অবশ্য নতুন নয়। তার ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। যাক সেই ইতিহাসে না ঢুকি।

কিন্তু সমস্ত কিছুতে অস্বীকার করার যে প্রবণতা আমাদের, তা আমাদেরকে এখনো কোথাও পৌঁছাতে দেয় না। আমরা কোনো কিছু ভাববার আগেই তার সংজ্ঞা মুখস্থ করে বসে থাকি। আমরা কোনো কিছুকে বুঝতে চাওয়ার আগেই ভাবি আমরা সে সম্পর্কে অনেক অনেক অনেক জানি।

আর এই জানার আগেই জেনে যাওয়ার যে অসুস্থ চিন্তার ধারা তা আমাদের অস্থির করে তোলে। সেই চিন্তা থেকেই দীক্ষা নিয়েই ভেবে ফেলি আমি সব জেনে বসে আছি। গুরু আছে মানেই আমার আগের সকল কর্মফল বিয়োগ হয়ে গেছে। তার কোনো হিসেব হবে না।

আর এই জীবন শেষে গুরুই পার করে নিয়ে যাবেন। তাই যাকে তাকে, যা খুশি চাইলেই বলা যায়। যাকে তাকে নিয়ে যা তা ভাবা যায়। বিষয়টাকি আদৌ এমন? দেহধারী গুরু কি আদৌ কোথাও নিয়ে যেতে পারে?? দেহধারী গুরু কি আদৌ শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়???

নাকি দেহধারী গুরু কেবল পরমগুরুর সাথে সাক্ষাতের পথ দেখায়? দেহধারী গুরু সমর্পণ ভাবনা শেখায়?? বিনয়-ভক্তি-নমনীয়তা শেখায়। যাতে পরমের আরাধ্য করা সহজ হয়। নিজেকে জানা সহজ হয়। দেহধারী গুরু মধ্যস্থতাকারীর কাজ করে।

তিনি পরম আরাধ্য। তিনিই সেই গুরুর সাথে মিলনের পথ দেখায়। তার গুণ গেয়ে শেষ করার উপায় নেই। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মনে মনে মিলবে না ততক্ষণ ওজন ঠিক হবে না। আর মনের সাথে মন মিলিয়ে ওজন ঠিকমতো বুঝে না নিলে গুরু-শিষ্যের ধারায় কলঙ্ক তৈরি হয়।

তাই জোড় করে গুরু ধরা বা ধরতে হবে বলে ধরা এই নিয়ম আমি মানতে পারি না। মানতে পারবো কিনা তাতেও সংশয় থেকেই যায়। তারপরও বারবারই বলি- ‘গুরু সুভাব দাও আমার মনে/রাঙা চরণ যেন ভুলিনে।’

আসলে সময়ের গভীরে ডুব দিলে সব হিসেব পাল্টে যায়। তখন একটা অনন্ত সময়-অনন্ত জীবনের চক্রে পরে যেতে হয়।

সময় হীনতাকে বুঝতে গেলে শূন্যবাদকে বুঝতে হয়। আর শূন্যবাদকে বুঝতে গেলে নিজের সকল যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগকে আগে শূন্যে আনতে হয়। এটি বড়ই কঠিন ব্যাপার। সেই কঠিন ব্যাপারে না ঢুকে বরং সহজে যাত্রা করি…

তবে আমি নিজে মূর্খ বলে খুব বেশি পণ্ডিতি জ্ঞান জাহির করা লোকের সাথে তেমন মিশতে পারি না। আরো খোলসা করে বলতে গেলে বলা যায়, আমি তাদের কাছে কোনোকালে বিশেষ কোনো পাত্তা পাইনি। পাইও না। করুণা বশতও নয়। আর স্বীকার করে নিলে বলতে হয়- চাইও না।

তারপরও ঘটনাচক্রে একটা সময় আমাদের শাহবাগের আড্ডার মধ্যে পণ্ডিতি জ্ঞান জাহির করা কিছু মানুষ বিশেষ একটা কারণে ঢুকে পরেছিল। তারা আসার পর আমাদের আড্ডা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা বড় বড় চোখ করে তাদের কথা শুনি। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে চলে।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা টের পেলাম আমাদের আড্ডায় আমরাই মেহমান হয়ে গেছি। সেই মহাবিরক্তির কথা আর নাই বা বললাম। তাদের আলোচনা নিয়ে একটু বলি। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে তারা এক এক করে আসতে শুরু করতো।

সকলের হাতে-বগলে-ব্যাগে বিশাল বিশাল সাইজের একাধিক নিত্য নতুন বিদেশী ভাষার দামী দামী বই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আমাদের চলমান আলোচনার কোন একটা লাইন ধরে সে বিষয়ে পৃথিবীর কোন খ্যাতিমান ব্যক্তি কি বলেছেন; তা বিভিন্ন ভাষায় এবং তার অক্ষর বাই অক্ষর অনুবাদ করে শোনাতে শুরু করতেন।

আর সেই সূত্র ধরে তাদের আরেকজন সেটা কোন বইতে ছাপা হয়েছিল। কত সালে। কোন পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। কত নাম্বার প্যারায় তা ছিল। কোন প্রকাশনী থেকে তা সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রকাশনী কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লেগে যেত।

অন্যজন হয়তো ব্যাগ থেকে সদ্য প্রকাশিত কোনো বই বের করে মুচকি হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলো সেই প্রসঙ্গে আসলে এখন পৃথিবী ভিন্ন ভাবে ভাবছে। অমুক লেখক এভাবে বলেছেন। এভাবে তারা নিজেদের তর্কে জড়িয়ে পরতো।

আসলে মূল সমস্যাটা হলো মেনে নেয়া আর মনে নেয়া। শব্দটা লিখতে একটা একারের ব্যবহার হলেও বিষয়টা জীবন মরণের। বিশ্বাস-আস্থা-ভক্তি-প্রেম এক নিমিষে সব উড়ে যায় যদি মনে না নিয়েও মেনে নিতে হয়। এ বড়ই জটিল সমীকরণ।

মূল বক্তব্য আমরা সেভাবে কোনোদিন শুনতে পেরেছিলাম কিনা মনে পরে না। তবে তারা যে বইয়ের প্রতিটি অক্ষর গুলে খাওয়া লোকজন; তা বুঝতে আমাদের দেরি হয়নি। অবাক হয়ে ভাবতাম- সেই ছোট্ট বেলা থেকে ‘দ্যা কাউ’ রচনা আজো গুছিয়ে মুখস্থ বলতে পারলাম না।

কিন্তু উনাদের কি মেধা! বিশ্ব সাহিত্য-শিল্প-দর্শন-সংস্কৃতির কথা সব তাদের নখর্দপনে। কোথায় কে কি লিখছে, কে কি ভাবছে সব কিছুর খবর রাখেন তারা। কোন বই কবে প্রকাশ হয়েছে। কবে প্রকাশ পাবে। কোনো লেখক এখন কোথায় বসে তার নতুন বই লিখছেন। তার সাথে কারা কারা আছে বিস্তারিত সবই তাদের জানা।

তবে কিছুদিন পরই মনে হতে লাগলো তারা একে অন্যকে পাল্লা দেয়ার জন্যই এই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। নিজের মুখস্থ বিদ্যা জাহির করাই তাদের অন্যতম কাজ। এটি মনে হওয়ার কারণ হলো। তারা যখনই একা থাকতো তখন তাদেরই বন্ধুদের জ্ঞান নিয়ে নানা খিস্তি খেউরি করতো।

কিন্তু সামনাসামনি অতি বিনয় আর সম্মানের ভঙ্গিতে কথা বলতো। যদিও তাদের ব্যাপক তর্ক হতো। কিন্তু সেটাও তারা চূড়ান্ত রূপে যাওয়ার পরিক্রমা হলে, কাজ আছে বলে আড্ডা ত্যাগ করতো কেউ কেউ। তারপর অন্যারা তাকে নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠতো।

এই বিদ্যা জাহিরের নোংরামিটা আমরা আর নিতে না পেরে আমাদের আড্ডার স্থান পরিবর্তন করে ফেললাম। তাদের কাছ থেকে পিছু ছাড়ানোর আর কোনো উপায় না পেয়ে। সম্ভবত আমরা তাদের কথার মধ্যে কখনো ঢুকবার সাহস না করে কেবল শুনে যেতাম বলে তারা আমাদের আড্ডায় আসতে পছন্দ করতো।

আমরা তাদের পাণ্ডিত্যকে সেলাম জানিয়ে মানে মানে কেটে পরলাম। অবশ্য তার আগে বেশ কিছুদিন একটা দর্শনচর্চা ক্লাসে যেতাম। সেখানে যেয়ে চুপচাপ এক কোণে বসে বসে শুনতাম। কখনো প্রশ্ন করার সাহস করি নাই। কারণ যারা প্রশ্ন করতেন তাদের জ্ঞানের বহন দেখে আমার সামান্য প্রশ্ন আর কখনো করা হয়ে উঠে নি।

তিনি যিনি ক্লাস নিতেন অর্থাৎ ড. লিয়াকত আলী। তার বলবার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করতো। অনেক সময় ধরে একটা বেশ কঠিন বিষয় সম্পর্কে শুনে যেতেও ক্লান্তি লাগতো না। ক্লাস চলতো চিন্তার ইতিহাস নিয়ে। সেখানে বহু দিন ক্লাস করলেও সেভাবে কিছুই অর্জন করতে পারিনি নিজের গ্রহণ করার ব্যর্থার কারণে।

কিন্তু লিয়াকত ভাইয়ের একটা কথা খুব গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনায় নিয়েছিলাম। সেটা হলো- “কি পড়বো আর কি কি পড়ে নেয়া উচিত। সেটার একটা ধারণা থাকা ভালো।” আদতে তা করতে পেরেছিলাম কিনা বা সেটা আদৌ করা সম্ভব কিনা সেই বিবেচনায় যাচ্ছি না।

আসলে মূল সমস্যাটা হলো ‘মেনে নেয়া’ আর ‘মনে নেয়া’। শব্দটা লিখতে একটা একারের ব্যবহার হলেও বিষয়টা জীবন মরণের। বিশ্বাস-আস্থা-ভক্তি-প্রেম এক নিমিষে সব উড়ে যায় যদি মনে না নিয়েও মেনে নিতে হয়। এ বড়ই জটিল সমীকরণ।

তবে গতানুগতিক সামাজিক কাঠামোয় সমাজের বেশিভাগ মানুষই মেনে নিতে শিখে যায় একটা সময়। উল্টোভাবে বলতে গেলে, মানুষকে মানতে বাধ্য করানো হয়। অনেকে আবার তা বরণ করে নেয় সানন্দে।

তবে একটা বিষয় কি, কারো কথায়, কাউকে খুশি করতে বা বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও খুব গোপনে একটা ব্যথা, বেদনা, অজানা হাহাকার থেকেই যায়। যা না যায় কাউকে বলা। না যায় সহ্য করা।

আবার মেনে না নিলেই যে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। ছকে বাঁধানো জীবন হয়; তাও নয়। আসলে মেনে নেয়া না নেয়া ব্যক্তি চরিত্রের উপর নির্ভর করে। কেউ কেউ মেনে নেয়ার জন্যই জন্মায়। কেউ কেউ মানতে বাধ্য হয়। কেউ মানার জন্য রাজিই থাকে মনে মনে, উপরি উপরি না মানার ভণিতা করে মাত্র।

একটা লম্বা বিরতি নিলে। চিন্তার অনেকটা দূরত্বে গেলে হয়তো ভাবনায় স্বচ্ছতা আসবে। হঠাৎ ক্ষিপ্র হওয়া অশান্ত মনে হুটহাট করে কি ভেবে ফেলার চেয়ে। একটু সময় নিয়ে ভাবলে ভাবনাটা অনেক বেশি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

আর কেউ কেউ মানতেই চায় না। তবে এই মানা না মানার বিষয়ে সকলক্ষেত্রে, সকলের ক্ষেত্রে একই থাকে তাও নয়। এখানেও এসে উপস্থিত হয় সেই দেশ, কাল ও পাত্র। যিনি মানতেই চান না। তিনিও হয়তো অনেক বড় বড় বিষয়কে তেমন পাত্তা দেন না।

কিন্তু ছোট্ট কোন বিষয়কে না মানার জন্য সারা জীবন লড়ে যান। আসলে মানা না মানার বিষয়টা আদর্শের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। মূল আদর্শের-আত্মসম্মানের প্রশ্ন যেখানে তীব্র হয় সে বিষয়টি মানুষ মানতে পারে না। তখন মানুষ বেঁকে বসে।

আমিও হয়তো সেই না মানার দলেরই একজন। হুটহাট করে মেনে নেয়ার দল থেকে আমি অনেক অনেক যোজন যোজন পিছিয়ে। তাই মনে না নিলে ঠিক মেনে নিতে পারি না। মেনে নিতেও চাই না। যা মনে ধরে না তা মানতে হবে কেনো?

তবে এ নিয়ে যে তীব্র বিতৃষ্ণা-ঘৃণা-বিরক্তি পুষে রাখতে হবে। নিতে হবে প্রতিশোধ। গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। সব সময় তার বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হতে হবে। সবাইকে উত্তেজিত করে তুলতে হবে সেই সব কথা বলে বলে। সে সবেরও মানে নেই আমার কাছে।

যে বিষয়টা মনে নিতে পারি না। সে বিষয়টা যদি তুচ্ছ কোনো বিষয় হয়। বা এমন কোনো বিষয় হয় যার সাথে আমার চিন্তা চেনতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তা যতদ্রুত সম্ভব ভুলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করি। তা সে দেশ-কাল-পাত্র যাই হোক।

কিন্তু বিষয়টা যদি আমার ভাব-ভাবনা-চিন্তা-চেতনার সাথে সম্পর্কিত হয়। তাহলে আমি দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে পাল্টে দেখবার চেষ্টা করি। বুঝবার চেষ্টা করি আসলেই আমি যা দেখছি তা কি আমি আসলেই দেখছি। তাই কি সত্য?? নাকি এসবই আমাকে দেখানো হচ্ছে?? বড্ড বেশি পরিকল্পনা করে???

বিষয়টাকে আর কত ভাবে ভাবা যায়? তাই ভাববার চেষ্টা করি। সব সময় যে পারি তাও না। তাও চেষ্টা করার চেষ্টা করি। আর তাও না পারলে লম্বা সময় নেই। পরিবেশ পাল্টাই। মানুষ পাল্টাই। বায়ু পরিবর্তন করি। তারপর ভাববার চেষ্টা করি।

একটা লম্বা বিরতি নিলে। চিন্তার অনেকটা দূরত্বে গেলে হয়তো ভাবনায় স্বচ্ছতা আসবে। হঠাৎ ক্ষিপ্র হওয়া অশান্ত মনে হুটহাট করে ভেবে ফেলার চেয়ে। একটু সময় নিয়ে ভাবলে ভাবনাটা অনেক বেশি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

অশান্ত মনে সিদ্ধান্তগুলো বেশিভাগ সময়ই ছেলে মানুষী হয়ে যায়। তারপরও মন কি আর বুঝ মানে? ফকির লালন যেন ভাবনার এই স্তরে আমার জন্যই লিখে গেছেন-

বিষয় বিষে চঞ্চলা মন দিবা রজনী।
মনকে বোঝালে বুঝ মানেনা ধর্মকাহিনী।।

বিষয় ছাড়িয়ে কবে
আমার মন শান্ত হবে,
আমি কবে সে চরণ করিব স্মরণ
যাতে শীতল হবে তাপিত পরানি।।

কোনদিন শ্মশানবাসী হব
কি ধন সঙ্গে লয়ে যাব,
কি করি কি কই ভূতের বোঝা বই
একদিন ভাবলাম না গুরুর বাণী।।

অনিত্য দেহেতে বাসা
তাইতে এত আশার আশা,
লালন ফকির বলে দেহ নিত্য হলে
আর কতো কি করতাম না জানি।।

মহাজাগতিক খেলায় তা কতটা বাস্তব আর কতটা ফাঁকি। সেটাও ধরা জরুরী। নইলে আরো বৃহৎ ফাঁকিতে পরতে হয়। যাক সে সব কথা। এবার মূল কথায় প্রবেশ করা যায় কিনা সেই চেষ্টা নেয়া প্রয়োজন।

সময়ের এই ফাঁদে আমার ‘মাই ডিভাইন জার্নি’ টা হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়ালো। হ্যা থমকে দাঁড়ালো। এই কাহিনীটা বলা আমার জন্য মোটেও সহজ নয়। তাই দীর্ঘ সময় সকল লেখালিখি বন্ধ করে বসে থাকলাম। যাতে লিখতে গিয়ে সেই ধাক্কার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কোনো একপেশে লেখা না লিখে ফেলি।

দোল পূর্ণিমার সাধুসঙ্গ শেষ করে ভেবেছিলাম লম্বা একটা ঘোরাঘুরি দিয়ে তবে শহরে ফিরবো। কিন্তু অনুষ্ঠান চলাকালীনই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরা করোনা অতিমারীর আতঙ্ক এদেশেও আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছিল। সাঁইজির দোল উৎসবেও তার রেশ পরা শুরু করলো।

মানুষজনের সংখ্যা প্রতিবারের তুলনায় অনেকটাই কম। দর্শনার্থীর সংখ্যা কম। এতে অবশ্য আমাদের বেশ আরামই হলো। আমরা বেশ করে। অনেকটা ছড়িয়ে। গড়াগড়ি দিয়ে। আনন্দ-উৎসবে সাধুসঙ্গ পর্ব শেষ করলাম।

৮ মার্চে শুরু হওয়া সাধুসঙ্গ তিন দিন পর শেষ হলেও আমার সঙ্গটা শেষ হয় হয় করেও আর হয় না। কিন্তু চারদিকে একই রব। যে কোনো সময় লকডাউন হবে। শহরে ফেরা যাবে না। শহরে করোনা রুগী সনাক্ত করা হয়েছে। শহর থেকে তাড়া আসতে লাগলো।

সাঁইজির তিরোধানে ছেঁউড়িয়া যেতে হবে সেটাই বড় কথা। তার উপর এই জীবাণুর নির্বাসনটাকেও কাটাতে হবে ঘটা করে। যেই ১৫ তারিখে কুষ্টিয়া থেকে এসেছিলাম মার্চে। সেই ১৫ তারিখের অক্টোবরে বাসে চেপে বসলাম ধামের উদ্দেশ্যে।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত ১৫ তারিখে এসে শহুরে ঘরে ঢুকলাম। তারপর থেকে এক এক করে নগরের ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে কেটে গেলো সাত সাতটা মাস। দেখতে দেখতে পঞ্জিকার হিসেবে চলে আসলো কার্তিক মাস। আর কার্তিকের ১ তারিখ হলো ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজির তিরোধানের দিন।

সেই হিসেবে সাধুসঙ্গের পর্ব শুরু। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে সাধুসঙ্গ হবে কি হবে না; তা নিয়ে সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারছে না। তার উপর ফকির লালন সাঁইজির ধাম এখন কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়ে চলছে একটা নিরব স্নায়ু যুদ্ধ। সেই পক্ষ-বিপক্ষ বাহিনী। ফকিরদের দমন ষড়যন্ত্র। মৌলবাদীদের হুংকার।

সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য বিধির দোহাই দিয়ে ঘোষণা করা হলো এবার লালন সাঁইজির সঙ্গ হবে না। এমন বার্তাই সমস্ত মহলে। যদিও ততদিনে দেশের অনেক দরগা, মাজার, মন্দির খুলে দেয়া হয়েছে। বিশাল বিশাল জানাজা হয়েছে।

তারপরও শেষ একটা আশা ছিল, ছোট করে হলেও হয়তো একটা সঙ্গ হবে। হয়তো সকলের প্রবেশাধিকার থাকবে না। তারপরও ১২৯ বছর ধরে চলে আসা এই সাধুসঙ্গ ১৩০-এ এসে বন্ধ হয়ে যাবে না। হতে পারে না। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেলো, বেশি মানুষের চাপ যাতে না হয় তার জন্য কড়কড়ির কথা বলা হচ্ছে।

কিন্তু শেষে ঠিক ঠিক খুলে দেয়া হবে। ছোট করে আয়োজন করা হবে চব্বিশ ঘণ্টার সাধুসঙ্গ। তারপর আবার বন্ধ করে দেয়া হবে।

কিন্তু দিন যত এগিয়ে আসতে থাকলো ততই যারা চায় না লালনের সাধুসঙ্গ হোক তারা আগ্রাসী হতে লাগলো।

দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলো চব্বিশ ঘণ্টার সাধুসঙ্গ হবে কিনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লালন ধামে সাধুসঙ্গ হবে না কিন্তু দেশের বিভিন্ন শিল্পকলায় সাধুসঙ্গ, লালন মেলা, লালন গানের অনুষ্ঠান হবে। সেখানে শিল্পীরা আসবেন। দুই এক জায়গায় সাধুগুরুরাও আসবেন বলেও জানা গেলো।

কেউ কেউ বললো আগে থেকে কিছুই হবে না। কার্তিকের এক তারিখে ঠিক ঠিকই ধামের প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হবে ভক্তকুলের জন্য। স্বাস্থ্য বিধি মেনে ভক্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার থাকবে কি থাকবে না এসব ভাববার সময় নেই তখন।

সাঁইজির তিরোধানে ছেঁউড়িয়া যেতে হবে সেটাই বড় কথা। তার উপর এই জীবাণুর নির্বাসনটাকেও কাটাতে হবে ঘটা করে। যেই ১৫ তারিখে কুষ্টিয়া থেকে এসেছিলাম মার্চে। সেই ১৫ তারিখের অক্টোবরে বাসে চেপে বসলাম ধামের উদ্দেশ্যে।

যখন আমি আর বন্ধুবর আসিক আফজাল কুষ্টিয়ার মজমপুর নামলাম তখনো আকাশ পরিষ্কার হতে অনেক দেরী। আলো ফোটার জন্য আর তর সইছিল না। এতো কাছে এসে দূরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তাই রিক্সা করে রওনা দিয়ে দিলাম লালন আখড়ার উদ্দেশ্যে। মনে মনে বলছিলাম-

কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারী
এ ভব তরঙ্গে এসে কিনারায় লাগাও তরী।।

তুমি হও করুণাসিন্দু
অধম জনার বন্ধু,
দাও গো এসে পদরবিন্দু
যাতে তুফান ত্বরিতে পারি।।

পাপী যদি না ত্বরাবে
পতিতপাবন নাম কে লবে,
জীবের দ্বারায় এহি ভবে
নামের ভ্রম যাবে তেমার।।

ডুবাও ভাসাও হাতটি তোমার
এই জগতে কেউ নাই আমার,
ফকির লালন বলে দোহাই তোমার
তোমার চরণে ঠাই দাও হে হরি।।

পথ থেকে উঠিয়ে নিলাম স্নেহের ছোটভাই রানাকে। তিন জনে যখন আখড়ার গেটে এসে পৌঁছালাম তখনই মনটা চরম ভালো হওয়ার উল্টো চরম খারাপ হয়ে গেলো। কারণ সেখানে তখন অলিখিত ১৪৪ ধারা জারি করে দেয়া হয়েছে। নাইটগার্ডের আগ্রাসী, উগ্রমূর্তি নিমিষে মন খারাপ করে দিলো।

তারা কিছুতেই আমাদের এক সেকেণ্ডের জন্যও দাঁড়াতে দেবে না। তাদের প্রতি তাই আদেশ। দাঁড়ালেই নাকি বিপদ। কিছু সময় আগেই নাকি পুলিশ এসে সাধুগুরুপাগল যারা এসেছিল রাতে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্রী ব্যবহার করেছে।

সদর গেটের বাইরে থেকেই ভক্তি দিয়ে রানার দাদীর ঘরের দিকে রওনা দিলাম। সিদ্ধান্ত হলো ব্যাগপত্র রেখে গড়াগড়ি দিয়ে একটু বেলাবেলা আবার ফিরবো। কিন্তু সেই ফেরাটা যে এতো যন্ত্রণাদায়ক হবে তখনো কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম?

শেষ পর্যন্ত লালন আখড়া গেট খোলা হয়নি। ১৩০ বছর পর সাঁইজিকে দেয়া গেলো না ভক্তি। দরজার সামনে থেকে ফিরে আসতে হলো সকলকে। মজার বিষয় হলো করোনা সংক্রামণের জন্য নাকি লালন আখড়ার দরজা খোলা হবে না।

যখন আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তখন প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর থেকে মেজাজ খারাপের রেষটা গিয়ে পরলো সাধুগুরুদের উপর। কি করছে সাধুগুরুরা? তারা কেনো এক ছায়া তলে আসতে পারলো না?? প্রত্যেক ভক্ত আপন আপন গুরু নিয়ে মেতে আছে।

অথচ শহরে মাইকিং চলছে ১৮ তারিখের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে দলে দলে যোগ দেয়ার জন্য। আসলে লালন আখড়াকে বন্ধ করাই ছিল উদ্দেশ্য। নইলে প্রসাশন আগত সাধুগুরুপাগলদের সাথে নূন্যতম ভালো ব্যবহার করতো। অনুরোধ করে বলতে পারতো।

কিন্তু তারা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ভঙ্গিতে। সাঁইজির গেটের সামনে উচ্চস্বরে সাইরেন বাজিয়ে মোটরসাইকেল শো ডাউন করে লাঠি দিয়ে তেড়ে আসছিল সাধুগুরুপাগলভক্তদের তাড়িয়ে দিতে। যাদের অনেকের পকেটেই হয়তো ফিরে যাওয়ার ভাড়ার টাকা পর্যন্ত নেই।

তাদের অনেকেই শতশত মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছিল একটি বার সাঁইজিকে ভক্তি দেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষ হয়তো এই আবেগটা বুঝবে না। আসলে যে প্রেমে পরেছে সেই বুঝবে প্রেমের করণ। যে প্রেমে পরে নাই সে প্রেমের মহিমা-প্রেমের রোদন-প্রেমের তাড়নাটা বুঝতেই পারবে না।

তাই সাঁইজি বলেছেন-

যে করে কালার চরণের আশা
জানো নারে মন তার কি দুর্দশা।।

আসলেই তাই তখন আমাদের দুর্দশা দেখবার-বুঝবার-শুনবার কেউ নেই। প্রশাসন কি পারতো না এইটুকু ব্যবস্থা নিতে? যারা চলে এসেছে তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটু ভক্তি দেয়ার ব্যবস্থাটা করে দিতে?? বা নূন্যতম একটু হাসি মুখে-বিনিত ভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে।

কিন্তু তারা লাঠি তুলে নিয়েছিল সাধুগুরুদের তাড়াতে। মুখে এনেছিল কাঠিন্য। ভঙ্গিতে এনেছিল মারমুখি ভাব। তারা একবারও কি ভেবেছিল যারা জিন্দা মরা। তাদের মেরে কি হবে??

সময় যত গড়াচ্ছিল ততই অসহ্য হয়ে উঠছিল চারপাশের পরিবেশ। আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর আচরণ ততই মারমুখি-উগ্র-হিংস্র হয়ে উঠছিল।

ঘোষণা দেয়া হলো মাইল খানেকের মধ্যেও কাউকে থাকতে দিবে না। দোকানপাট খোলা রাখতে দিবে না। আমার তাতে আপত্তি নেই মোটেও। কিন্তু তাদের ব্যবহার কেনো এমন হবে? ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালনের দরবারে এসে তারা কেনো এমন আচরণ করবে??

সন্ধ্যা গড়াতে গড়াতে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিতে লাগলো। মনে হচ্ছিল এর চেয়ে মরণ ভালো। দেশ কি তবে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে ঘোষণা দিয়ে? যেখানে অন্য কোনো মতাদর্শ তাদের করণকার্য করতে পারবে না?? পারবে না পরম গুরুর তীর্থ দর্শন করতে?? পারবে না তাকে ভক্তি নিবেদন করতে???

যখন আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তখন প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর থেকে মেজাজ খারাপের রেষটা গিয়ে পরলো সাধুগুরুদের উপর। কি করছে সাধুগুরুরা? তারা কেনো এক ছায়া তলে আসতে পারলো না?? প্রত্যেক ভক্ত আপন আপন গুরু নিয়ে মেতে আছে।

কিন্তু মহাগুরুর প্রয়োজনে তারা কেনো এক হবে না? তারা কেনো সম্মিলিত কণ্ঠে এ কথাটুকু বলতে পারবে না- সাধুগুরুপাগলভক্তদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন করা যাবে না। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।

তারা প্রেমিক মানুষ। পাগল মানুষ। তাদের বুঝিয়ে বললেই চলে যাবে। তাদের জন্য লাঠির বাড়ি দেয়ার প্রয়োজন নেই।

বা এ কথা কেনো বলবে না, “সাঁইজির আখড়ায় প্রবেশ আমাদের অধিকার। আমরা স্বাধ্যবিধি মেনে সকল কিছু করবো। সেই ব্যবস্থা আমাদের করে দিতে হবে। আমাদের সুযোগ দিতে হবে আমাদের পরমগুরুকে ভক্তি জানাবার পর্ব পালন করতে।

একশ ত্রিশ বছরে এসে সাধুসঙ্গ বন্ধ হয়ে যেতে পারে না। এইটা আমাদের অবশ্য পালনীয়। এটা আমাদের করতে দিতে হবে। তবে আমরা অবশ্যই সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করবো।”

তবে কেনো বারবার আপনার সাধুসঙ্গে আসবার জন্য ভক্তদের বা আমাদেরকেও তাগাদা দেন। আপনি তো আপনার ভক্তদের স্মরণে সব সময়ই আছেন। তারা তো হাজার মাইল দূর থেকেও আপনাকে অনুভব করতে পারে। তবে কেনো আপনার কাছে আসতে হবে?

সাধুগুরুদের কাছে কি আমরা একটুকু আশা বা প্রত্যাশা করতে পারি না?? নাকি তারা যার যার মতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে?? …

তখন আবার মনে হচ্ছিল। আসলে আমি কাদের কাছে প্রত্যাশা করছি! যারা একে অপরের সাথে কথা বলে না। পরস্পর দেখা হলে সৌজন্য ভক্তিটুকু দেয় না?? তাদের কাছে প্রত্যাশা করছি??? যারা নিজ নিজ গণ্ডির সাধুদের সাথেই কিছুটা সম্পর্ক রাখে বটে।

কিন্তু গণ্ডির বাইরের কারো সাথে সম্পর্ক তৈরি করে না। এমনকি সাঁইজির ধামে এসেও বা পাশাপাশি বসেও সৌজন্যতা রক্ষা করে না। পারস্পরিক প্রেমের কথা নাই বা বল্লাম। নিতান্ত সৌজন্যতা তো তাদের কাছে প্রত্যাশা করতেই পারি।

সকলেই তো সাঁইজির পথের ভিখারি। সকলেই তো জিন্দামরার দাবীদার। তাহলে মহাগুরুর দরবারে এসেও এই যে একে অপরকে এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি তারা সৃষ্টি করেছে এটা কি অহংকার? নাকি দৈন্যতা?? নাকি এটাই করণকারণ। এটাই শেখায় গুরু! নিজ গুরু ভিন্ন অন্যদের ছায়াও মারানো যাবে না??

এটাই কি শুদ্ধতার চর্চা? আমি কি এই সাধুগুরুদের পদতলে বসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন শুদ্ধতার কথা শুনেছি? মানবতার কথা শুনেছি?? সম্প্রতির কথা শুনেছি???

পরে এ নিয়ে যখন সাধুগুরুদের দুই একজনকে প্রশ্ন করেছি তারা বিষয়টি ঘুরিয়ে বলেছেন, লালন তো আমার মনে থাকে। তাকে কেনো আখড়াতে গিয়েই ভক্তি দিতে হবে। আমি তো মনে মনেই তাকে ভক্তি দিতে পারি।

বিষয়টি আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিল। কিন্তু যদি তারা কষ্ট পেয়ে জান তাই বলা হয়নি এর পাল্টা প্রশ্নগুলো। তবে ভবিষ্যতে যে বলবো না তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। তাদের আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল, তবে এতো বছর কেনো ঘরে বসে ভক্তি না দিয়ে ধামে গেলেন?

তবে কেনো বারবার আপনার সাধুসঙ্গে আসবার জন্য ভক্তদের বা আমাদেরকেও তাগাদা দেন। আপনি তো আপনার ভক্তদের স্মরণে সব সময়ই আছেন। তারা তো হাজার মাইল দূর থেকেও আপনাকে অনুভব করতে পারে। তবে কেনো আপনার কাছে আসতে হবে?

হয়তো এর উত্তরে সাধুগুরুরা বলবেন, তাদের তো এখন গুরু ভজার সময়। তারা তো গুরু হয়ে উঠে নি।

এই কথার উত্তরে কি তবে এই কথা বলা চলে- যাদের আপনি গুরুরূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন অর্থাৎ খিলকা দিয়েছেন তারা আপনার দরবারে না আসলে কি আপনি মেনে নিবেন??

নাকি নিজ গুরুর সাথে সেটা ভিন্ন কথা। তার কাছে আসতেই হবে। মহাগুরুর কাছে না আসলেও হয়?

এরূপ অসংখ্য প্রশ্নের জালই হয়তো তৈরি করা যায়। আবার সাধুগুরুরাও নিজ নিজ পক্ষে অগনতি যুক্তিও হয়তো উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন বা রাখবেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন যে উঠেছে তা কিন্তু কোনো পক্ষই অস্বীকার করতে পারবে না।

সেই প্রশ্নটি হলো ‘লালন কার’?

লালন কি কেবল খিলকাধারী সাধুগুরুদের? দীক্ষাধারী শিষ্যদের?? নাকি আমাদের মতো সাধারণ মানুষও লালনকে ধারণ করতে পারে। যারা কেবল ভালোবাসে লালনকে। যাদের ধ্যান-জ্ঞান কেবল লালন। যদিও আপাত বিচারে সাধুগুরু ও দীক্ষাধারী শিষ্যরা আমাদেরকে প্রথমেই ছাটাই করে দেন।

নিশ্চিত করে বলে দেন, বাপু তুমি তো গুরুর হাতে হাত দাও নাই। তুমি লালন ঘরের লোক না। কিন্তু যখন এমন সব সমস্যা অবতীর্ণ হয় সমাজে। যখন সাঁইজির দরজায় তালা পরে। যখন সাধুসঙ্গ বন্ধ হয়ে যায়। তখন সাধুগুরুরা বলে তোমরা কিছু করো পারলে!

আচ্ছা বিষয়টা কি এমন হতে পারে না? ১৩০ বছরের প্রান্তে এসে সাঁইজি স্বয়ং তার দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন আমাদের জন্য! লাগবে না তার এমন ভক্তি! এমন ভক্ত! এমন সাধুগুরু! এমন পাগল! এমন বৈষ্ণব! এমন অনুরাগী! এমন অনুসারী! এমন শিষ্য! এমন গুরু!

আরে গুরুজী, আমরা তো করতেই চাই। যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু করবোও। সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন। তার ব্যত্যয় ঘটবে না। তবে লালনকে আপনারা যে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছেন সেই বিষয়টি আগে খোলসা করেন।

লালন কি সেই জন? যাকে দীক্ষার মায়াজালে বন্দি করে রাখা যাবে?? খিলকার বিচারে লালন বন্দি থাকবে??? বিষয়টা একটু ভাববেন মশাই। লালনকে যে ধারণ করতে পারবে লালন তারই হবে। আপনাদের বিচ্ছিন্নতা তো আমাদের মতো নি:স্ব-রিক্ত নাগরকিদের থেকেও নিম্নগামী।

আমরা তো পরিবেশ-প্রতিবেশের কবলে পরে। বিষয়বাসনা-ভোগের সমুদ্রে ডুবে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরি। আপনারা কেনো একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন? কেনো আপনারা একই মহাগুরুর ছায়াতলে এক হয়ে বসতে পারেন না??

এই সব ভাবতে ভাবতেই যখন ধামের এলাকা ছেড়ে আমরা বহুদূরে এক দোকানে বসে চা পান করছিলাম। সেখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হানা। সেখানেও বসা যাবে না। লালন আখড়ায় এসেছে এমন কাউকেই এলাকায় অবস্থান নিতে দেয়া হবে না।

বন্ধ করে দেয়া হবে সকল দোকানপাট। এরপরও হয়তো থাকাই যেত। কিন্তু সত্যি বলছি এই বিভীষিকা আর নিতে পারছিলাম না। আখড়ার গেটের কাছে গিয়ে আবার সাধুগুরুদের সাথে করা দুর্ব্যবহার দেখে সেটা সহ্য করা সম্ভব হবে না।

তাই বাজানের আখড়ার দিকে রওনা দিলাম। অর্থাৎ সাত্তার ফকিরের আখড়ায় গিয়ে মনটা ফকিরের হাসি দেখে ভরে উঠলো বটে। কিন্তু সেই অস্বস্তিটা কিছুতেই কাটছিল না। এতো কাছে এসেও সাঁইজির ধামে একটা ভক্তি দিতে পারলাম না! একটু ঢুকতে পারলাম না!! চোখের দেখা দেখতে পেলাম না!!!

সেই আক্ষেপটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। যন্ত্রণা যখন তীব্র হচ্ছিল। যখন আশপাশের কারো সাথেই কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না। তখন হঠাৎ চিন্তা করলাম। আচ্ছা ভাবনাটা উল্টে দিলে কেমন হয়? মানে ভাবনার একমুখো চিন্তা পাল্টে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কি বিষয়টাকে ভাবা যায়??

আচ্ছা বিষয়টা কি এমন হতে পারে না? ১৩০ বছরের প্রান্তে এসে সাঁইজি স্বয়ং তার দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন আমাদের জন্য! লাগবে না তার এমন ভক্তি! এমন ভক্ত! এমন সাধুগুরু! এমন পাগল! এমন বৈষ্ণব! এমন অনুরাগী! এমন অনুসারী! এমন শিষ্য! এমন গুরু!

এ যাত্রায় আর কিছু লিখতে পারছি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মন ঝাপসা হয়ে আসছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। বাকিটা না হয় পরের লেখায় লেখা যাবে। আজ বারবার সেই চরণে কেবল ক্ষমা ভিক্ষা-

এমন সৌভাগ্য আমার কবে হবে।
দয়াল চাঁদ আসিয়ে মোরে পার করে নিবে।।

সাধনের বল কিছুই নাই
কেমনে সে পারে যাই,
কূলে বসে দিচ্ছি দোহাই
অপার ভেবে।।

পতিত পাবন নামটি তোমার
তাই শুনে বল হয় গো আমার,
আবার ভাবি
এ পাপীর ভার সে কি নেবে।।

গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
রইলাম চিরদিন,
লালন বলে
কী করিতে এলাম ভবে।।

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
মাই ডিভাইন জার্নি : আঠার:: রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!