ভবঘুরেকথা
কোন মানুষের করি ভজনা

কোন মানুষের করি ভজনা

মাই ডিভাইন জার্নি : বিশ

-মূর্শেদূল মেরাজ

আমি কি আসলেই ষোলোআনা বাঙালী! আমার নামই তো বাঙালী নয়। বাংলাভাষার শব্দমালা থেকে নেয়া হয়নি নামটি। নেয়া হয়েছে ভিন্ন ভাষার শব্দ থেকে। মুসলমান হওয়ার স্মৃতি বহন করার জন্য। আবার এখানেও একটা টুইস্ট আছে। মজার বিষয় হলো ‘মেরাজ’ শব্দটা কোরানে আছে কি নেই। তা নিয়েও আছে সংশয়।

কেউ বলে মেরাজের কথা বিস্তারে কোরান শরীফে নেই। এটা তাসাউফ তথা মারফতের কথা। ভেদের কথা। সাক্ষাতের কথা। যে সাক্ষাৎ হয়েছিল সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার। সেই সৃষ্টি, যে সৃষ্টির জন্য সমগ্র জাহানের বিস্তার। যার আত্মপ্রকাশের জন্যই, জগৎ প্রকাশিত।

অনেকে তর্ক করে বলেন, এসব মন ভুলানো কথা। এমন কথা শাস্ত্রে নেই। এসব অতি কল্পনা। আবার অনেকে বলেন, এ সকল কথাই আছে কোরান শরীফে। স্বল্প জ্ঞানীরা সেই ইশারা বুঝতে পারে না। অনেকে অবশ্য মেনে নেয় নবীজীর মেরাজের কথা। সপ্ত আসমানে ভ্রমণের কথা।

কিন্তু এর অন্তর্নিহিত যে অর্থ তাসাউফ বলতে চায়, সে তত্ত্ব মানতে রাজি নন। অনেকে আবার দেহের মাঝেই মেরাজ খোঁজেন। মেরাজ বুঝেন। মেরাজ বোঝান। অনেকে বলেন, এ বুঝতে গেলে বুঝতে হবে যুগল সাধনা। অনেকে ফু দিয়ে সেসব উড়িয়ে দিয়ে বলে, অর্জন করে হয় একা। নির্জনে। নিরবে। দুইয়ে বাঁধে গণ্ডগোল।

অনেকে ঘুরিয়ে বলেন, ‘এক শালিকে দুঃখ হয়, দুই শালিকে সুখ। আর তিন শালিকে এক হলে কেঁদে ভেসায় বুক!” তাই জানতে হয় দুজনে। মিলনেই জ্ঞান। বিচ্ছেদেই ক্রন্দন।

বাজান সাত্তার ফকিরের সাথে দেখা হলেই সাঁইজির বাণী উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মেরাজ সে তো প্রেমের ভুবন, গুপ্ত ব্যক্ত হয় আলাপন’। আমিও মনে মনে তখন স্মরণ করি, “ভাব দিয়ে ভাব নিলে মনে, সেই সে রাঙ্গা চরণ পায়।” এভাবে সবাই সবার মতো করেই বর্ণনা করে যায়। আমি কেবল শুনে যাই। বরাবরই শুনতে আমার বেশ লাগে।

যারা প্রেম ভাবে কথা বলে তাদের কথা শুনতে আমার বেশ লাগে। ক্রোধে, অহং-এ বললে অবশ্য বেশি সময় নিতে পারি না। স্থান ত্যাগ করতে হয়ে। তবে যে জ্ঞানী অহং মুক্ত। তার চরণে বসে অনন্তকাল শুনে যেতেও ক্লান্ত লাগে না। এমনকি শোনা কথাব শুনতে ভালো লাগে।

এই তো কয়েকদিন আগে এক সাধুসঙ্গে গেছি। মধ্যরাত। পাশেই সাঁইজির পদ পরিবেশিত হচ্ছে। সাধুগুরুরা দৈন্য পদ গাওয়া শেষ করার পর শিল্পীরা গাইতে শুরু করেছেন। দৈন্য যে আবেশ তৈরি করেছিল। শিল্পীরা তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলো না। গোলমাল হয়ে গেলো।

তাই পাশে বসা সাধুর সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। এই সাধুকে আগে দেখেনি কখনো। তিনি লালন ঘরের গুরু নাকি অন্য তরিকার তাও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গায়ে খিলকা দেখা যাচ্ছে বটে। কিন্তু লালন ঘরের সাধুগুরুরা সাধারণত সর্বকেশী হন।

১২ বছর পর তিনি জানতে পারেন, সেই গুরুর কোনো গুরু পরম্পরা নেই। তা জানতে পরে তিনি বুঝতে পারেন সেই গুরু আসলে ঠগ-প্রতারক। তাই তাকে ছেড়ে নতুন গুরু খুঁজতে শুরু করেন। এরপরে যাতায়াত শুরু করেন সুরেশ্বরী দরবার শরীফে। সেখান থেকে ঢাকা কেরাণীগঞ্জ ড. জাহাঙ্গীর বাবার ফকিরানি দরবারে প্রায় বছর চারেক আসা-যাওয়া করেন।

তারা দাঁড়ি-গোফ-চুল কাটেন না। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বী লালন সাধকদের অনেকে দাঁড়ি-গোঁফ রাখেন না। এই সাধু সুন্দর করে ঠোটের উপর পর্যন্ত গোঁফ কেটেছেন। দাঁড়িও গুছিয়ে কাটা। তাই আলাপ করবার ইচ্ছে জাগলো। প্রথম থেকেই খেয়াল করছিলাম। সাধুসঙ্গের নানান বিষয় নিতে উনার নানান সব অভিযোগ-অনুযোগ।

সেই সব কথা তিনি তার পাশের সাধুর সাথে করছিলেন। এটা-ওটা চাইবার জন্য হাকডাক দিচ্ছিলেন। বিষয়গুলো সাধুগুরুদের সাথে তেমন যায় না। সাধারণত সাধুসঙ্গে সেবার দায়িত্বে যারা থাকেন। তারা সবার দিকে। বিশেষ করে সাধুগুরুদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। সজাগ থাকেন।

চাইবার আগে সেবা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সর্বাত্তক চেষ্টায় থাকেন। তাই সাধুসঙ্গে কারো কোনো কিছু একান্ত প্রয়োজন হলে অপেক্ষা করাই বিধান। অপেক্ষা করলে ঠিকঠিকই চলে আসে। আর যদি একান্ত নাই আসে। তাহলে কোনো সেবককে কাছে পেলে নিচু স্বরে তার চাহিদার কথা বলে। তাতেই কাজ হয়।

সাধুগুরুরা তাও বলেন না। একান্ত প্রয়োজন হলে সেবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বাবা দেখো কারো কিছু লাগে কিনা। এইরূপ কথা বললে যিনি সেবা দিচ্ছেন, তিনি প্রথমে যিনি বলছেন তার দিকেই দৃষ্টি দেন। তাই তার যা প্রয়োজন তা তিনি পেয়ে যান।

সাধুর সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতেই অনেকটা সফল হলাম। আমি কথা বলতে শুরু করায়। এতো সময় ধরে পাশের যে সাধুর সাথে কথা বলছিলেন। তিনি সুযোগ পেয়ে টুপ করে বালিশ মাথায় দিয়ে চোখ মুদলেন। সাধু এবার আমাকে পেয়ে বসলেন। যথারীতি জ্ঞান দিতে শুরু করে দিলেন।

জ্ঞান নিতে আমার মন্দ লাগে না। তার উপর আমি নিজে যেচে যেয়ে যখন আলাপ করতে গেছি। এটুকু তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু তার কথা শুনতে গিয়ে বারবারই একটা কথা মনে আসছিল। জানার যে গড়িমা তা তিনি এখনো ছাড়তে পারেন নি। এই বিষয়টিই যা একটু খটোমটো লাগছিল।

সাধুর ভাষ্য মতে, গত পঁচিশ বছর ধরে তিনি লালনের পথে আছেন। যেদিন তিনি কুষ্টিয়ার মাটিতে পা রেখেছেন সেদিন থেকেই তিনি লালনের পথে আছেন। যদিও এই পঁচিশ বছরের প্রথম এক যুগের বেশি সময় তিনি চিশতিয়া তরিকার এক গুরুর শিষ্য ছিলেন।

১২ বছর পর তিনি জানতে পারেন, সেই গুরুর কোনো গুরু পরম্পরা নেই। তা জানতে পরে তিনি বুঝতে পারেন সেই গুরু আসলে ঠগ-প্রতারক। তাই তাকে ছেড়ে নতুন গুরু খুঁজতে শুরু করেন। এরপরে যাতায়াত শুরু করেন সুরেশ্বরী দরবার শরীফে। সেখান থেকে ঢাকা কেরাণীগঞ্জ ড. জাহাঙ্গীর বাবার ফকিরানি দরবারে প্রায় বছর চারেক আসা-যাওয়া করেন।

আমাদের নিজেদেরই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অনেক কিছুতেই জল ঢুকে গেছে। তা ধরে ধরে ঠিক করতে হবে। তুমি বরং একটা গুরুর হাতে হাত দাও। তারপর না শুরু করা যাবে। কি বলো?” আমার খুব ইচ্ছে করছিল বলি, আপনি বরং আমার জন্য একজন গুরু সাজেস্ট করেন, যার কাছে নতশিরে হাত দিতে পারি।

শেষে গত বছর চারেক আগে লালন ঘরের এক গুরুর হাতে হাত দেন। তবে এই বছর চারেক আগে গুরুর হাতে হাত দিয়েছিলেন বিষয়টাতে তিনি পুরো আলোচনায় এক মতে থাকতে পারেন নি। কখনো বলেছেন বছর দুয়েক আগে। কখনো বলেছেন বছর পাঁচেক আগে। কখনো ছয়। তবে সবচেয়ে বেশি বলেছেন বছর চারেক।

যাক সে কথা। যে কথা বলছিলাম। সাধুর ভাষ্য মতে- উনার গুরু উনাকে পেয়ে, উনার পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। কারণ তিনি লালন গানের প্রতিটি শব্দ নিয়ে বহু আগে থেকেই গবেষণা করতেন। গুরু উনাকে এই শর্তে দীক্ষা দেন যে, তাকে মাস খানেকের মধ্যেই খিলকা বা খেলাফত নিতে হবে। অর্থাৎ পোশাক নিতে হবে।

যথারীতি দীক্ষাপর্বের মাসখানেক পর থেকেই গুরু তাকে খিলকা নেয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন। তিনি নানা অজুহাতে গুরুকে ঘোরাতে থাকেন। শেষে বছর দুয়েক পরে বিশাল ধুমধামের মধ্য দিয়ে খিলকা নেন। পাঁচ কন্যার জনক এই সাধু খিলকা নেয়ার পর নিজ এলাকায় বহু কষ্ট করে সাধুসঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই হলো মোদ্দা কথা।

তবে এই পুরো আলোচনার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছিল তা হলো- উনার জ্ঞানের কাছে সকলেই ধরা। যদিও উনি বছর চারেক ধরে লালনের ঘরে পাকাপাকিভাবে প্রথাগত নিয়মে আবধ্য হয়েছেন। কিন্তু তার মতে তিনি ২৫ বছর ধরেই লালনের পথে আছেন।

কিন্তু তিনি এ কথা মানতে নারাজ আমি বা আমরা লালনের ঘরে আছি। কারণ আমি বা আমরা এখনো গুরুর হাতে হাত দেই নি। তাই আমি বা আমরা লালনের ঘরে নেই। কিন্তু মাত্র ৪ বা পাঁচ বছর ধরে লালনের ঘরে দীক্ষিত হলেও তিনিও ২৫ বছর ধরেই লালনের ঘরের মানুষ।

এইসব হিসেবগুলো মেলানো একটু না, বেশ কঠিন। এক সাধুগুরু ফোন করে কয়েকদিন আগে বললেন, “শোন বাপ! এভাবে মনের শঙ্কা কাটবে না। এখনি সময় গুরুর হাতে হাত দাও দেখো শঙ্কা কেটে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এতো প্রশ্ন থাকবে না।”

আমি বললাম, “যারা গুরুর হাতে হাত দিয়েছে তারা সকলেই কি শঙ্কা মুক্ত? শঙ্কা মুক্তির কি এটিই এক ও একমাত্র পথ?” সাধুর সাথে অনেক কথাই হলো। সেসবই তত্ত্ব কথা। বাস্তব উদাহরণ পাওয়া গেলো না। শেষে তিনিও বললেন, “বাপ আসলে আমাদের নিজেদেরই মডেল হতে হবে।

আমাদের নিজেদেরই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অনেক কিছুতেই জল ঢুকে গেছে। তা ধরে ধরে ঠিক করতে হবে। তুমি বরং একটা গুরুর হাতে হাত দাও। তারপর না শুরু করা যাবে। কি বলো?” আমার খুব ইচ্ছে করছিল বলি, আপনি বরং আমার জন্য একজন গুরু সাজেস্ট করেন, যার কাছে নতশিরে হাত দিতে পারি।

শেষে আর করা হলো না প্রশ্নটা। আগামী দিনের জন্য তুলে রাখলাম। আর তার আগে যদি গুরু প্রাপ্ত হয়ে যাই তাহলে তো কথাই নেই। ভাবি প্রশ্ন তো সাঁইজির মনেও উদয় হতো-

সব সৃষ্টি করলো যে জন
তাঁরে সৃষ্টি কে করেছে,
সৃষ্টি ছাড়া কি রূপে সে
সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে।।

সৃষ্টিকর্তা বলছো যারে
লা শরিক হয় কেমন করে,
ভেবে দেখো পূর্বাপরে
সৃষ্টি করলেই শরিক আছে।।

চন্দ্র সূর্য যে গঠেছে
তাঁর খবর কে করেছে,
নীরেতে নিরঞ্জন আছে
নীরের জন্ম কে দিয়েছে।।

স্বরূপ শক্তি হয় যে জনা
কে জানে তাঁর ঠিক ঠিকানা,
জাহের বাতেন যে জানেনা–
তাঁর মনেতে প্যাঁচ পড়েছে।।

আপনার শক্তির জোরে
নিজ শক্তির রূপ প্রকাশ করে,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোরে
নিতান্তই ভূতে পেয়েছে।।

যাই হোক সেই সাধুসঙ্গ থেকেই আরেক সাধুগুরুর আখড়ায় গেলাম। সেখানে আছি কয়েকদিন। অলস সময় কেটে যাচ্ছে। খাচ্ছি, গান শুনছি, ঘুমাচ্ছি। সময় মতো চাল-জল নেওয়া, একটু-আধটু ঘোরাঘুরি আর সাধুর ভাব উদয় হলে দু-চার কথা শোনা।

সময় কাটছিল বেশ। এরমাঝে বিভিন্নজন আসছে যাচ্ছে। একদিন অল্প বয়সী এক ছেলে এসে উপস্থিত। অন্য এক ফকিরের ভক্ত। চাল-জলের পর সন্ধ্যা ভক্তির সময় সেই ছেলেও গুরুভক্তি দিতে এগিয়ে গেলো সকলের মতো। হয়তো কোনো কারণে ভক্তিতে ছেলেটি একটু ভুলচুক করে ফেললো।

গুরুজী কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন। জানতে চাইলেন গুরুপাঠ কোথায়। সাথে আরো অনেক কিছু। গুরুপাঠ নিয়েছে কিন্তু ভক্তি দেয়ার সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেনি বলে কয়েক কথা শোনালেন। গুরুজীর কণ্ঠে খানিকটা যেন ভৎসর্না টের পেলাম; বিষয়টায় বেশ মন খারাপ হলো।

যে কোনো করাণেরই ছেলেটা ভক্তি রপ্ত করে উঠতে নাই পারতে পারে। তার জন্য অনেক বেশি প্রেমে শিখালে দেখতে ভালো লাগতো। বিষয়টা সুন্দর হতো। কিন্তু হলো না। পরিবেশ একটু থমথমে হয়ে উঠলো। মনটা আরো খারাপ হলো।

যখন গুরুজীর প্রধানতম ভক্ত অনেকটাই কতৃর্ত্বের সুরে সেই ছেলেকে ভক্তি দেওয়া শিখাতে লাগলো। এসব দেখে আরো খারাপ বেশি লাগে। তুমি জানতেই পারো। অনেকটা বেশি। তাই বলে তার জন্য বড়াই কেনো করতে হবে?

মন থেকে ভক্তি আসলে তো দিতেই হয়। তা যদি না হয়। বা নিজের গুরু যদি না থাকে। বা যতদিন নিজগুরু না হয়। ততদিন নতশিরে ভক্তি দিলে সেটা সঠিক জায়গায় পড়ে না বেটা। তাই না বুইঝে সকলের দেখাদেখি কোনো কিছু করে ফেললেই হবে না গো। আগে বুইঝা পরে মজা’ই ভালো গো।

তুমি জানো, তাই তোমার আরো অনেক বেশি বিনীত হওয়াই উচিৎ। নম্র হওয়া উচিৎ। দায়িত্বটা তোমার। তুমি জানো বলেই তোমার কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা। তাই না!

আমার মতো যারা গুরুহীন-গৃহহীন অর্থাৎ গুরুগৃহহীন তাদেরকে সাধুগুরুর আখড়ায় নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরতেই হয়। সেসব মেনে নিয়েই আমরা সাধুগুরুর আখড়ায় যাই। সাধুসঙ্গ করি। সাধুগুরুর সাথে আলাপচারিতা করি। থাকি, খাই-দাই ঘুমাই। ফিরে আসি। পাশাপাশি ভালোবাসা-প্রেমও পাই অফুরন্ত; সেকথাও না বললে নয়।

তারপরও সাধুগুরুদের আখড়ায় গেলে সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর যে পরিস্থিতিতে পরতে হয়; তা হলো গুরুভক্তির সময়। গুরুকে একক ভক্তি দেয়ার সময়। সকলে যখন একে একে একক গুরুভক্তি দিতে থাকে। যখন ঘুরে ঘুরে হিসেবের কাটা আমার দিকে এসে থেমে যায়। তখন দেখা যায় বেশিভাগ সময়ই আমি চুপটি করে বসে আছি।

তখন আশপাশের নবীন ভক্তকুল নড়ে চড়ে বসে। কোনো কোনো সাধুগুরুও সরু চোখে তাকায়। অনেকে অপেক্ষা করে এরপর আমি যাচ্ছি কিনা; তা দেখবার জন্য। অনেকে আবার ভক্তি দিয়ে ফিরে এসে গায়ে আলতো ছোঁয়ায় বুঝিয়ে দেয়; এবার আপনার পালা।

আমি অবশ্য ঠাঁয় বসে থাকি। বসে বসে ভাবি কখন ‘সাধুগুরুর সর্বচরণে ভক্তি দিয়ে’ এই পর্ব শেষে পরবর্তী পর্বে প্রবেশ করবে সঙ্গ। অনেকে অবশ্য অন্যের দেখাদেখি ভক্তি দিয়ে থাকে। আমি ঠিক নতশিরে ভক্তি দিয়ে উঠতে পারি না সকলকে। আসলে মন থেকে না হয়ে উঠলে আমি কিছু করতে পারি না।

আর সাধুগুরুদের সাথে তো নয়ই। ঢাকার এক আদি কবি ছিলেন। কোন এক বইতে পড়েছিলাম তার উর্দু বা ফার্সি শের-এর অনুবাদ। কবির নামও ভুলে গেছি। কবিতার নামও। (সম্ভবত যায়গাম বা তার সমসাময়িক কোনো কবি)। কবিতাটি ভুলে গেলেও তার মর্মাথ আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে।

সম্ভবত তিনি লিখেছিলেন- “আমার পাপ যদি তোমার উপাসনায় অপবিত্র করে। তাই আর সে পথে পা বাড়াই নি। আমি তোমাদের পবিত্রতাকে সম্মান করি, তোমরাও আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করো।” আমিও তেমনি। সকল সাধুগুরুকে ভক্তি দেয়াটা আজও আমি ঠিক শিখে উঠতে পারিনি।

বছর কয়েক আগে কুষ্টিয়ারই আরেক সাধুর আখড়ায় গেছি। সন্ধ্যা ভক্তি পর্ব চলছিল। যথারীতি একে একে সকলেই ভক্তিপর্ব সারলেন। ভক্তিপর্ব শেষে সাধুগুরু আনন্দিত হয়ে বলেছিল- বেটা তুমি সকলের দেখাদেখি কোনো কাজে ডুবে যাওনি সেটা ভালো লাগলো।

মন থেকে ভক্তি আসলে তো দিতেই হয়। তা যদি না হয়। বা নিজের গুরু যদি না থাকে। বা যতদিন নিজগুরু না হয়। ততদিন নতশিরে ভক্তি দিলে সেটা সঠিক জায়গায় পড়ে না বেটা। তাই না বুইঝে সকলের দেখাদেখি কোনো কিছু করে ফেললেই হবে না গো। আগে বুইঝা পরে মজা’ই ভালো গো।

যাতে সব প্রকাশে অহং চইলে না আসে। তোমার সকল গুণ জানতে পারলে লোকে তোমাকে মান্য করবে। সেই মান্য থেকেও অহং আসতে পারে গো বাপ। এই পথ সহজ পথ। কঠিন কইরো না। অহং-এর পোশাক গায়ে পইরা কিছু করা এই পথের কাম না। লোকরে দেখানোর জন্য কিছু কইরো না এই পথে।

বিষয়টা বেশ স্বস্তিকার ছিল আমার জন্য। বা আমার মতোদের জন্য। অনেক আগে একবার এক সাধুর আখড়ায় গেলাম। সেখানে আমার মতো গুটিকয়েক গুরুগৃহহীন মানুষও ছিল। গুরুজী আমাদের দিতে তাকিয়ে প্রথমেই বলে দিলেন।

বাপ তোমাদের যাদের গুরু নাই। তারা পরমের নামে। নিজ পিতা-মাতার নামে। নইলে যাকে গুরু মানো মনে মনে তার নামে। বা নিজের নামে ভক্তি দিতে পারো। ভক্তি দিলেই হবে না কো বাপ। ভক্তি দেয়া জানতে হবে। নত হইতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ করে আসতে হয়।

অহং ত্যাগ না করতে পারলে নত হওয়া যায় না। নত হওয়ার অভিনয় করলে বিপদ। একসময় বলা হতো- ‘ফলের ভারে বৃক্ষ নত হয়। তেমনি জ্ঞানের ভারে বিদ্যান নত হয়।’ কিন্তু এখন সবকিছুতেই ভেজাল ঢুকে গেছে গো। এখন জ্ঞানী নত হইতে পারে না। অহং বাধা দেয়।

যে জ্ঞান অহংকার থেকে প্রাপ্ত হয় সেখানে বিনয় থাকে না। জ্ঞান কার কাছ থেকে কিভাবে নিবা তার বিবেচনা দরকার। তা না হলে অহং কাটবে না। তাতে নত হইলেও সেটা অহং থেকেই নত হওয়া হয়। মানুষকে দেখিয়ে বেড়ানো। দেখ বেটা আমি নত হইতে পারি।

কিন্তু বিষয়টা তেমন না। বিষয়টা হলো তুমি নিজকে সেই পরমের কাছে সর্বতুচ্ছ মেনে। তার চরণে পরে। তার পরমগুণে যাতে গুণাত্বিত হতে পারো; সেই প্রার্থনায় রত হও। সেখানে যদি তুমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাও। নিজের অহংকে প্রকাশ করতে থাকো। তাহলে আখেরে কিছুই পাবা না। সবই ফাঁকি।

সাধুগুরুর চরণে ভক্তি তেমনি ব্যাপার গো বাপ। সেখানে সাধুগুরুরা তোমার ভক্তি দেখে। ভক্তি দেয়ার ভঙ্গিকে নয়। ভঙ্গি শুদ্ধ হইলে ভালো। খুবই ভালো। অতি উত্তম। সেটা হওয়াই উচিৎ। কর্তব্য। কিন্তু তাকে শুদ্ধ ভক্তি আছে কিনা সেটা আরো অনেক বেশি জরুরী। নইলে তো ফরমায়েশী হইয়া গেলো। লোক দেখানো হইয়া গেলো।

লোকেরে দেখানোর জন্য তো এই পথে তুমি আসো নাই বাপ। এই পথ হইলো সাপ খেলা দেখানোর মতো। ল্যাঞ্জা দেখায়া দিন পার। সাপ দেখা যায় না। এই পথে তুমি যতটা জানো তার এক আনা দেখাতেই পারো। তাও যদি অতি প্রয়োজন হয়। বাকি পনেরো আনাই আড়ালে রাখতে হয়।

যাতে সব প্রকাশে অহং চইলে না আসে। তোমার সকল গুণ জানতে পারলে লোকে তোমাকে মান্য করবে। সেই মান্য থেকেও অহং আসতে পারে গো বাপ। এই পথ সহজ পথ। কঠিন কইরো না। অহং-এর পোশাক গায়ে পইরা কিছু করা এই পথের কাম না। লোকরে দেখানোর জন্য কিছু কইরো না এই পথে।

বিশ্বের মোড়লরা তা করবেও না। নিজেদের অপকর্মকে ঢাকতে অন্যের অপরাধের টুটি চেপে ধরে প্রমাণ করতে চায় তারা অনেক বেশি মানবিক। অপরের অপকর্ম ধরতে চাইলেও নিজেদের অপকর্মকে ঠিকই আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে ঘটে যাওয়া নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার বিচারও শুরুই হয়নি।

বিশেষ কইরা সাধুগুরুপাগলের সাথে তো নয়ই। তাইলে কিন্তু ধরা খাইয়্যা যাইবো। অলিআউলিয়াপীরফকির এরা কিন্তু সবই দেখতে পারে। যদি তারা নিজেরা সঠিক হয়। তারা তোমার ভেতরের শুদ্ধতা ঠিক ঠিকই বুইঝ্যা নিবো। তাগের সাথে চালাকি চলবো না। তাই এই পথে অন্যের দেখাদেখি কিছু জোর করে না করাই ভালো।

অন্যের দেখাদেখি যেই জিনিস তোমারে শান্তি দেয়, আরো শুদ্ধ করে, আরো বিনয়ী করে সেই সব শিখবা। সেই সব শিখার জন্যই তো এই সব স্কুল। মানে আখড়া-আশ্রম। এইখান থেকে শিখতে না পারলে আর কই থেকে শিখবা? আর সাধুসঙ্গ হইলো পরীক্ষার হল। সেখানে যায়া পরীক্ষা দিবা। যাতে ভুল না হয়।

আর যদি ভুল হইয়্যাও যায়। তাতেও যাতে যোগ্যতম সাধুগুরুপাগলের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার মনোবাসনা থাকে। মনরে সেই মতে তৈয়ার করবা। দেখবা সব ঠিকঠাক।”

যাই হোক আমি এইবারও সমবেত ভক্তিপর্বের পর গুরুভক্তির সময় বসে আছি আপন আসনে। পাশের বন্ধুবর ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সাধুগুরুকে ভক্তি দিতে গেলেন। সেই সাধুগুরুই তাকে কোমল স্বরে বললেন, “বাপ অন্যের দেখাদেখি ভক্তি দিতে নাই। আগে বোঝ পরে মজো।”

আসলে সাধুগুরুরা এভাবে প্রেমে-স্নেহে আমাদের ভুল গুলো ধরিয়ে দেবেন। আমাদের শুধরে নেবার সুযোগ করে দিবেন। এমন ভাবে বলবেন, যাতে বাকি জীবনে আর তা ভুলে না যাই। এটাই আমার কাছে সভ্যতা। আমার মনে হয় এমন একটা সমাজের কথাই ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন। এই সভ্যতার স্বপ্নই আমি দেখি।

সমাজে যে সভ্যতা চলছে সেই সভ্যতার চূড়ামণির দাবীদাররাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। তারা সভ্যতার শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে। তবে প্রথাগত ফ্রেমে বাঁধা যে সভ্যতার ছক কাটা হয়েছে। সেই দৌড়ে অনেকেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

অনেকেই অনেক অসভ্যতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে। এমন একটা সভ্যতার ইমেজ তৈরি করতে পেরেছে। দান-দক্ষিণার চালচিত্র আর বিজ্ঞাপনের বুলিতে আড়াল করে রেখেছে পূর্বের কৃত অগনিত অপকর্ম। সে সকল স্বীকৃত অপকর্মের জন্য আজ পর্যন্ত তারা নূন্যতম ক্ষমা প্রার্থনা বা দু:খ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি।

বিশ্বের মোড়লরা তা করবেও না। নিজেদের অপকর্মকে ঢাকতে অন্যের অপরাধের টুটি চেপে ধরে প্রমাণ করতে চায় তারা অনেক বেশি মানবিক। অপরের অপকর্ম ধরতে চাইলেও নিজেদের অপকর্মকে ঠিকই আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে ঘটে যাওয়া নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার বিচারও শুরুই হয়নি।

এমনকি সেগুলো যে অপরাধ সেটাও বিবেচনায় নিতে পারেনি বিশ্ব আদালত। আর ক্ষমা চাওয়া তো বহুদূরের কথা। তবে সভ্যতার দাবীদার রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নাগরিকদের জন্য কিছু আইন তৈরি করতে পেরেছে। যা দিয়ে অনেকখানিই ব্যক্তি অধিকার সংরক্ষিত হয়।

তবে একই আইন দিয়ে সকলের অধিকার সংরক্ষিত হয় না। সেখানেও দেখা যায় নানা ভাগ-বিভাগ। তারপরও তারা যে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে অনেক এগিয়ে আছে সমতায়। তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দীর্ঘ বিচারের প্রকৃয়া শেষে সেই পুলিশ সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। তবে এখনো বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়নি। রায় যাই হোক না কেনো কৃষ্ণঙ্গ হত্যায় স্বেতাঙ্গ পুলিশকে এই প্রথম দোষী সাব্যস্ত করেছে আমেরিকার আদালত এতেই অনেকে আনন্দিত।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উজ্জাপনের পরও আমাদের সকল ক্ষেত্রেই বলতে হয়, করতে হবে, করবো ইত্যাদি। এখনো আমরা শিরদাঁড়া টানটান করে বলতে পরিনি ‘করেছি’। মাঠ গরম করার জন্য অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু বাস্তবচিত্রে যে এখনো আমরা আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে পারিনি; তা তো মেনে নিতেই হবে।

অনেক সম্ভবনাকে আমরা নিজেরাই অঙ্কুরে বিনষ্ট করেছি। অনেক অর্জনকেই দুর্নীতির ঘোলাজলে ডুবিয়ে দিয়েছি। আবার অনেক অর্জনকে নিজেদের পারস্পরিক বিশ্বাসের মতভেদের কারণে বিতর্কিত করে তুলেছি। গর্ব করার মতো যা কিছু আছে তাকেও আমরা নিরপেক্ষ রাখতে পারিনি।

তবে শুধু আমরা কেনো বিশ্ব মোড়লরাও যে মানবতা-সমতা-সভ্যতার বাজারজাত করে তাদের ইতিহাস এমনকি বর্তমানও খুব বেশি সুখকর নয়। কাগজ কলমে দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও। উন্নত দেশগুলো এমন কি প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেও বর্ণবৈষম্য বিলীন হয়ে গেছে তা জোড় গলায় বলা যাবে না।

সেই বৈষম্য কেবল আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের উপর সীমাবদ্ধ আছে তাও কিন্তু নয়। প্রায়ই পত্রিকার পাতায় ধর্ম বিশ্বাসের উপর সহিংসতা। এশীয়দের উপর নির্যাতন। দক্ষিণ আমেরিকানদের উপর নিপিড়নসহ কত রকম খবর সামনে আসে।

তবে এ কথাও পাশাপাশি বলতে হবে। সমাজের সচেতন মানুষ সেই সব নির্যাতন-নিপিড়নের প্রতিবাদও করে। রাস্তায় নামে। অনেক দেশে বিচার-আচারও হয়। মাঠ গরম করা বাণীও দেয় অনেকে। নতুন আইনও প্রণয়নও হয় কোথাও কোথাও।

সম্প্রতি আমেরিকায় গ্রেপ্তারের পর ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েড নামের এক নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হাঁটু দিয়ে গলা চেপে পুলিশ মেরে ফেলে। মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন ফ্লয়েড।

এক ভিডিও ফুটেজে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি ছড়িয়ে পরলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় নাগরিক আন্দোলন শুরু হয় ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর। শ্বেতাঙ্গ পুলিশদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-নৃশংসতার অভিযোগ ওঠে।

দীর্ঘ বিচারের প্রকৃয়া শেষে সেই পুলিশ সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। তবে এখনো বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়নি। রায় যাই হোক না কেনো কৃষ্ণঙ্গ হত্যায় স্বেতাঙ্গ পুলিশকে এই প্রথম দোষী সাব্যস্ত করেছে আমেরিকার আদালত এতেই অনেকে আনন্দিত।

কিন্তু সেই সময় আমেরিকায় হাতে গোনা কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি করবার সুযোগ ছিল। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ ছিল। তার করা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম আবেদন এই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি বাতিল করে দেয় যে, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ।

তবে মানসিকতা পরিবর্তন না হলে কেবল বিচারেই কি অপরাধ কমে? না কমে না। সেটা প্রমাণ করতেই যেন এই বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরের কাছে ২০ বছরের ডন্টে রাইটকে তুচ্ছ কারণে গুলি করে মারে পুলিশ।

এতো গেল সাম্প্রতিক ঘটনা। যখন কৃষ্ণাঙ্গরা আন্দোলন করার শক্তি যোগার করতে সমর্থ হয়েছে। সংগঠিত হয়েছে। তবে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধ এক দিনে আসেনি। কেউ তাদের তা দিয়ে সম্মানিতও করে নি। রাতারাতি তা প্রাপ্তও হওয়া যায়নি।

এর ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ। সেই ইতিহাসও খুব সুখকর নয় মোটেও। এরজন্য অনেক নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা-নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে; প্রচুর ত্যাগ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে তাদের।

একটা সময় ছিল যখন আমেরিকার মাটিতে স্বাধীনভাবে হাঁটবার অনুমতিও ছিল না আফ্রিকা থেকে জোর করে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের। ছিল না স্বাধীনভাবে চিন্তা-চেতনার অধিকার। ছিল না পড়ালেখা করবার অধিকার। আরো কত কিছু। কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে তারা নিজেদের জায়গা নিজেরাই করে নিতে থাকে।

এমনি এক ঘটনার কথা জানা যায় ইতিহাস থেকে, ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও শুধু গায়ের রঙ কালো ছিল বলে জর্জ ম্যাকলাউরিন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রকে সাদা চামড়ার সহপাঠীদের সাথে বসতে দেয়া হয়নি। সাদা চামড়ার সহপাঠীদের থেকে দূরে তাকে এক কোণে বসতে বাধ্য করা হয়।

জর্জ ম্যাকলাউরিন নিজের ভাষায় এই ঘটনার বর্ণনা করেছেন এভাবে, “কিছু সহপাঠী আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতো যেন আমি বন্যপশু। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতো না। শিক্ষকদের ব্যাবহারও এমন ছিল যে, আমি যেন ক্লাসে থেকেও নেই, তারা আমার প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে যেত।

তারপর আমি কঠোর পরিশ্রম করে ভাল ফল করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আমার সহপাঠীরা যেকোনো কঠিন তথ্যের ব্যাখ্যার জন্য আমার কাছে সাহায্য চাইতে আসতে লাগল।”

জর্জ ম্যাকলাউরিন আমেরিকার আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগেই স্নাতক পাস করেছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যই। একটি চাকরিও করছিলেন। কিন্তু ৬১ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি পিএইচডি করবেন।

কিন্তু সেই সময় আমেরিকায় হাতে গোনা কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি করবার সুযোগ ছিল। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ ছিল। তার করা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম আবেদন এই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি বাতিল করে দেয় যে, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ।

পরবর্তীতে তিনি এর সুরাহা করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালতের রায়ে তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালটিতে ভর্তির সুযোগ পান। পরবর্তীতে জর্জ ম্যাকলাউরিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর সেরা শিক্ষার্থী হিসাবে বিবেচিত হন।

কিন্তু খেলার মাঠে ছাড়া কেহই তাকে তেমন বন্ধু মনে করতো না। খেলার মাঠে সিরাজুলকে সবাই নিতে চাইতো। ও যে দলে থাকবে সেই দলই জিতবে। তারপর একদিন সিরাজুল স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরাও খোঁজ নেই নি। হারিয়ে গেছে সিরাজুল আমাদের বর্তমান থেকে।

চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন, ‘এই কুৎসিত পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী না, এমনকি আমাদের দুর্দশাও না।’ সভ্যতার মুখে ঝামা ঘঁষে দেয়া আরেক মর্মভেদী চরিত্র এই চার্লি চ্যাপলিন। যিনি সকল বয়সী এমনকি তার শত্রুর মনেও আশ্রয় করে আছেন। ছিলেন। থাকবেন।

বিষয়টা এমনই। মানুষ হয় কোটিতে গুটি। মানে কোটি কোটি লোকের ভীড়ে মানুষ হয় মাত্র কয়েকজনই। বাকিরা তো কেবল সংখ্যা। জনতা। লোক। যারা পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে খাবার সংগ্রহ করে বেড়ায়। আর যৌনতার জন্য সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে ব্যস্ত সময় কাটায়।

তারাও তুচ্ছ নয় মোটেও। তারাই তো জনসংখ্যা টিকিয়ে রাখবার ধারা টেনে নিয়ে যায়। ধারিত্রীতে সকলে একই কাজ করার জন্য জন্মায় নি। সকলেরই আছে পৃথক কর্ম। কিন্তু প্রথাগত সভ্যতা তা অনেকক্ষেত্রেই মানতে চায় না। মানতে দেয় না। তারা সকলের জন্যই একই আইন এটি প্রচলন করতে চায়। তাতেই বাঁধে দ্বন্দ্ব। বাঁধে গণ্ডগোল।

আমাদের ক্লাসেও ‘জর্জ ম্যাকলাউরিন’-এর মতোই একজন সহপাঠী ছিল। ওর নাম ছিল সিরাজুল ইসলাম। আমরা ডাকতাম সিরাজ। সেই সিরাজ প্রমিত ভাষায় কথা বলতে পারতো না কিছুতেই। একেবারে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতো। লেখার সময় শুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করলেও জবানিতে ছিল খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষা।

বিষয়টা নিয়ে শুধু ছাত্ররা না শিক্ষকরাও বেশ মজা নিতো। প্রায়শই তাকে দাঁড় করিয়ে এমন কিছু আচরণ করা হতো। যাতে সমগ্র ক্লাসের কাছে সে হাসির পাত্র হয়। বিষয়টা সকলে বেশ উপভোগও করতো। সিরাজুল কেবল অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।

আমাদের অনেকের থেকেই বেশি লম্বা-চওড়া ছিল সিরাজুল। গায়ের রংও ছিল ভীষণ কালো। দাঁতগুলোও ছিল অনেকটাই বড়। পড়ালেখাতেও ছিল একটু পিছিয়ে। তাই সকলেই তার সাথে মজা করতো। সে অবশ্য সব সময়ই সকলের সাথে মিশে থাকার চেষ্টা করতো।

কিন্তু খেলার মাঠে ছাড়া কেহই তাকে তেমন বন্ধু মনে করতো না। খেলার মাঠে সিরাজুলকে সবাই নিতে চাইতো। ও যে দলে থাকবে সেই দলই জিতবে। তারপর একদিন সিরাজুল স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরাও খোঁজ নেই নি। হারিয়ে গেছে সিরাজুল আমাদের বর্তমান থেকে।

সিরাজুল এখন কি করে তা জানি না। তবে সে জর্জ ম্যাকলাউরিন হয়ে উঠতে পারেনি। পারলে হয়তো সেও উদাহরণ হয়ে উঠতো। আসলে ব্যর্থরা উদাহরণ হতে পারে না। ব্যর্থদের কেউ স্মরণে রাখে না। সকলেই মনে রাখতে চায় চাঁদে কে আগে পা দিয়েছিল। সাঁইজি বলেছেন-

তুমি কার আজ কেবা তোমার এই সংসারে।
মিছে মায়ায় মজিয়ে মন কি কর রে।

এত পিরিত দন্তে জিহ্বায়
কায়দা পেলে সেও সাজা দেয়;
স্বল্পতে সব জানিতে
হয় ভাব-নাগরে।

সময়ে সকলি সখা
অসময়ে কেউ দেয় না দেখা,
যার পাপে সে ভোগে
একা চার যুগ রে।

আপনি যখন নাই আপনার
কারে বল আমার আমার,
সিরাজ সাঁই কয়
লালন তোমার জ্ঞান নাহি রে।

রূপকথা গল্পের রাজার একটাই দু:খ। সে নি:সন্তান। বা পুত্র সন্তানহীন। আর এই দু:খকে কেন্দ্র করেই তার হাতি শালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর রাজকোষ ভরা সম্পদ-সম্পত্তিতেও তার মনে সুখ নেই শান্তি নেই। একটা সন্তানের জন্য যে বনবাসে যেতে পারে।

গণ্ডায় গণ্ডায় বিয়ে করতে পারে। অবিশ্বাসী হলেও বিশ্বাস করে মুনি-ঋষি-ফকিরের দেয়া পথ্য খেতে পারে বা খাওয়াতে পারে। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তার সন্তান চাই। বিশেষ ক্ষেত্রে রাজত্ব ছাড়তেও তার আপত্তি নেই। আবার কোন কোন রাজা মেনে নেয় এমন সব শর্ত যার জন্য কেবল নিজেকেই নয়।

গোটা রাজ্যকেও ফেলে দেয় অন্ধকারের ঘোর নিশায়। সন্তান প্রাপ্তির আশায় ঠগ-প্রতারক-জোচ্চরের জোচ্চরি বুঝতে পেরেও যদি ফল পাওয়া যায় তার ফাঁদে পা দিতেও পিছপা হয় না অনেক রাজা। অনেকক্ষেত্রে রাণীও তার সীমা অতিক্রম করতে কুণ্ঠা হন না।

যাকে চাইলেও অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করা উচিৎও নয় সামাজিক বিচারে। সভ্যতার নিয়মানুযায়ী পিতা-মাতার সম্পদ-সম্পত্তির অধিকার থাকে নিজ ঔরসজাত সন্তানের। আইনেও বেশিভাগ ক্ষেত্রে সেই কথাই বলে। এখানে ভক্তকুলের কোনো অধিকার থাকে না। থাকবার কথা না।

অন্যদিকে এর সম্পূর্ণ বিপরীত হলো ফকির। রাজার বিপরীত তো ফকিরই হবার কথা। তবে তা কেবল মুখের কথাতেই নয়। আচরণেও তাই। রাজা যেমন তার রাজত্ব ধরে রাখবার জন্য পৌরুষ প্রমাণ করতে সন্তান সন্তান করে মাথা ঠুকে মরে।

অন্যদিকে ফকির সন্তান জন্ম না দেয়ার ব্রত পালন করেন। জন্মে আত্মা খণ্ডন হয়। আর আত্মার খণ্ডন হলে তাকে গুটিয়ে আনা সহজ হয় না। খণ্ড আত্মার পূর্ণতা প্রাপ্তির পথে প্রধান বাধা। আবার সামাজিক ভাবেও আত্মার খণ্ডন হয় ভয়াবহ।

ফকিরের পারিবারিক পিছুটান থাকতে নেই। তাহলে ফকিরি হয় না। বিশেষ করে নিজ সন্তান-সন্তুতি থাকলে মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পরে। অনেক কিছুতে ভেদ করে ফেলে। নিজ সন্তান আর ভক্ত সন্তানে ভেদ দেখা যায়। এতে অনেক ক্ষেত্রে ফকিরের মাঝে রাজার স্বভাব বিরাজ করে।

সে ফকির। ভক্তদের নিয়েই তার কাজ-কারবার। কিন্তু সম্পত্তির বিলিবন্টনের ক্ষেত্রে নিজ সন্তান গুরুত্ব বহন করে। বেশিভাগ সাধারণ মানুষই পুত্র সন্তানের প্রত্যাশা এই কারণেই করে। যেন তার সম্পত্তি তার নিজের ঔরসের হাতেই থেকে যায়। সম্পত্তি রক্ষা হয়।

কিন্তু ফকিরের কাছে পার্থিব সম্পত্তির তো গুরুত্ব থাকে না বা থাকবার কথা না। অপার্থিক কর্মের জন্য যে সম্পদ বা সম্পত্তি তার জন্যই তো ফকির লড়ে যায়। ভক্তদের সেবাই তো ফকিরের কর্ম। ভক্তরা যাতে সেই পবিত্র মতকে এগিয়ে নিতে পারে তার জন্যই তার যা কিছু প্রাপ্তি তার বিলিবন্টন।

কিন্তু নিজ ঔরসজাত সন্তান থেকে গেলে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। শেষ বিচারে সামাজিকতা রক্ষার্থের কথা বলে নিজ সম্পত্তির সবটা বা বেশি অংশটা নিজ সন্তানকেই দান করে থাকেন। এতে হয়তো ভক্তকুল মনে কষ্ট পায় না। তারা ভেবেই নেয় এমনটাই রীতি।

কিন্তু এতে যে ভক্তকুল আর সন্তানকুলের সাথে দ্বৈতনীতি গ্রহণ করা হয় তাতে দ্বিমত থাকবার কথা নয়। অনেকে আবার বলেন, ফকির হওয়ার আগে অর্থাৎ খেলাফত নেয়ার আগেই তো সম্পত্তি নিজ নিজ সন্তানকে দিয়ে তবে ফকিরি নিয়েছে। তাহলে আর তার সম্পত্তিতে ভক্তকুলের অধিকার থাকবে কেনো!

আত্মার খণ্ড হলে মায়া-মোহ-লোভ ষড়রিপুর এই ত্রয়ীরিপু থেকে মুক্তি মেলা ভার। আসলে সম্পর্ক মানুষকে সামাজিক মুক্তি দিতে চায় না কিছুতেই। তার উপর যদি ঔরসের প্রশ্ন আসে তাহলে তো কথাই নেই। ঔরস এমন এক বন্ধন। এমন এক পিছুটান।

যাকে চাইলেও অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করা উচিৎও নয় সামাজিক বিচারে। সভ্যতার নিয়মানুযায়ী পিতা-মাতার সম্পদ-সম্পত্তির অধিকার থাকে নিজ ঔরসজাত সন্তানের। আইনেও বেশিভাগ ক্ষেত্রে সেই কথাই বলে। এখানে ভক্তকুলের কোনো অধিকার থাকে না। থাকবার কথা না।

পিতার দায়িত্ব তো তাকে পালন করতেই হবে। এসব হলো দুনিয়াতি কারবার। দুনিয়াতি কারবার হয় নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে। অর্থাৎ এসবই পার্থিব হিসাব-নিকাশ। আর ভক্তের সাথে গুরুর সম্পর্ক হলো অপার্থিব। জন্মজন্মান্তরের।

কিন্তু যেখানে নিজের বলে কিছু থাকে না। সেখানে আপন-পরের প্রশ্ন আসে না। ফকির হওয়ার মনোবাঞ্ছা নিয়েই তো এই পথে সাধক এগিয়ে যায়। দীক্ষার প্রথম দিনই রিপু থেকে মুক্ত কেউ হতে পারে না সত্য। কিন্তু দিন যত যায় ততই তো রিপু নিয়ন্ত্রণের দিকেই এগিয়ে যাওয়ার কথা। যদি গুরু প্রদত্ত সাধন-ভজন করে যায়।

আর যে শিষ্য আপন রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। এবং পরের রিপু নিয়ন্ত্রণে পথ প্রদর্শক করতে পারে। তাকেই তো গুরু খেলাফত দিয়ে নতুন গুরু রূপে বরণ করে নেয়। যিনি রিপু-ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত তার কাছে কি তখনো আপন-পর বলে বিষয়াদি থাকে? সম্পদ-সম্পত্তি ভেদ থাকে??

নিজ সন্তান আর ভক্ত সন্তানের মধ্যে পার্থক্য থাকে? যদি থাকে তাহলে কি কাউকে রিপু-ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত বলে মনে করা যৌক্তিক? আবার শিষ্যের সকল সম্পদের উপরই যদি গুরুর হক থাকে। তবে শিষ্য যখন নিজে গুরু হয়ে যান। তখন সেই সম্পদের হক তার নিজ সন্তানের কাছে চলেই বা যায় কেনো?

প্রশ্ন উঠতেই পারে এসব ছেলেমানুষী অবান্তর প্রশ্ন মনে জাগ্রত হচ্ছে কেনো? এসব তো গুরু-শিষ্যের বিষয়াদি। বাইরের মানুষ হয়ে আমার কেনো এতো আগ্রহ। আসলে এসব প্রশ্ন একদিনে আসে নি। এসব প্রশ্নগুলো বহুদিন ধরে একটু একটু করে জন্ম নিয়েছে।

এই যেমন কিছু দিন আগে মেহেরপুরে এক সাধুসঙ্গে গেলাম। বিশাল বাঁশ বাগানের মাঝে অল্প পরিসরে সাধুর থাকবার কয়েকটা কামরা। আমরা সকলেই সেই সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে সেই রাতেই চর্ট নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। আহ্ কি সুন্দর। কি সুন্দর।

এতো বিশাল জায়গা নিয়ে ছড়ানো বাঁশ বাগানের মাঝে যদি একটা আখড়া গড়ে উঠে তাহলে কতই না সুন্দর হবে। হয়তো দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত আখড়াও হয়ে উঠতে পারে। আমরা তো মনে মনে পরিকল্পনাও করে ফেলতে লাগলাম, এই বাঁশবাগানের ভেতরে বাঁশ না কেটে কি কিরে একটা আখড়ার নকশা করা যায়।

ভোরের প্রথম আলোতেও আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দিনের আলোত মুগ্ধতা আরো বাড়তে লাগলো। নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠলাম। কি করে পুরো জায়গাটা নিয়ে একটা আখড়া গড়ে তোলার দিকে চিন্তা-চেতনা-আলোচনা এগিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সাধুসঙ্গের পুণ্যসেবার আগেই যখন শুনলাম সাধুগুরু কয়েককাঠা জায়গা ভক্তদের জন্য রেখে।

বাকি সবটাই তিন সন্তানদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দিয়েছেন। সেই কয়েককাঠা জায়গাতে ভক্তরা আখড়া করবেন; নিজ উদ্যোগে। তা কবে হবে কেউ জানে না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। পাশের বন্ধুটি বললেন, আরে সাধুগুরু হলেও তো তিনি একজন বাবা। একজন পিতা।

পিতার দায়িত্ব তো তাকে পালন করতেই হবে। এসব হলো দুনিয়াতি কারবার। দুনিয়াতি কারবার হয় নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে। অর্থাৎ এসবই পার্থিব হিসাব-নিকাশ। আর ভক্তের সাথে গুরুর সম্পর্ক হলো অপার্থিব। জন্মজন্মান্তরের।

তাঁরা সেই পথে চলেছিলেন এইটেই সত্য। সুতরাং পথে বসলে গম্যস্থানকে পাব না, পথে চললেই পাব। উপরের থেকে সেই চলবার ডাকটিই আসছে। সেই বাণীই বলছে : তুমি বসে থেকে কিছু পাবে না; চলো, আরো চলো; আরো আছে, আরো আছে।”

সেখানে কি আর সম্পদ-সম্পত্তির হিসাব হইবো? সেটা হবে সিদ্ধি, মোক্ষ, মুক্তি বা নির্বাণের। গুরুর জাগতিক সম্পদের লোভে তো আর শিষ্যরা গুরুর চরণে আশ্রয় নেয় না। গুরুর অতিন্ত্রীয় গুণাবলীর কাছেই ভক্তকুল আশ্রিত হয়। তাই ভক্তকুল সেই অতিন্ত্রীয় গুণাবলীর অংশীদার হয়। জাগতিক সম্পত্তির নয়।

এমন অনেক তত্ত্ব কথাই শোনা হলো অনেকটা সময় জুড়ে। ঐ যে আগেই বলেছি শুনতে আমার খারাপ লাগে না। তাই শুনে যাই। তবে সাথে আরেকটা সমস্যা যে আছে তার কথাও তো আগেই বলেছি। সব কিছু বিনা বিচার-বিবেচনায় মেনে নিতে বা মনে নিতে শিখিনি আজও।

তাই শঙ্কা কাটে না। শঙ্কা থেকেই যায়। কেনো যেন সকল হিসেব উল্টে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, আমার সকল কিছুই যেমন গুরুর। তেমনি গুরুর সকল কিছুই আমার। আমি যেমন আমার সকল কিছুই গুরুর জন্য। গুরুর সম্মত্তিতে দেখভাল করি। ভোগদখল করি।

তেমনি গুরুর সকল কিছুরও দেখভালের দায়িত্বও আমার উপরই বর্তায়। আর সেখানে যখন ভাগাভাগি হয়ে যায় রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে। তখন একটা খটকা লাগে। এই জন্যই কি আত্মার খণ্ডন না করার জন্য বারবার বলা হয়েছে? আর যারা এই কর্মে বিচ্যুত হয়েছেন বা হচ্ছেন তারাই এই বিকল্প পন্থা আবিষ্কার করেছেন!!

পার্থিব আর অপার্থিব সম্পদের ভেদে সভ্যতার কৃত পথকেই আমলে নিয়েছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘অগ্রসর হওয়ার আহ্বান’ প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন- “কালে কালে মহাপুরুষেরা কী দেখান। তাঁরা দেখান যে, তোমরা যাকে ধর্ম বলে ধরে রয়েছে ধর্ম তার মধ্যে পর্যাপ্ত নন। মানুষকে মহাপুরুষেরা মুক্তির পথ দেখিয়ে দেন; তাঁরা বলেন : চলতে হবে।

কিন্তু, মানুষ তাঁদেরই আশ্রয় করে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে যায়, আর চলতে চায় না। মহাপুরুষেরা যে পর্যন্ত গিয়েছেন তারও বেশি তাঁদের অনুপন্থীরা যাবেন, এই তো তাঁদের ইচ্ছা। কিন্তু, তারা তাঁদের বাক্য গলায় বেঁধে আত্মহত্যা সাধন করে। মহাপুরুষদের পথ হচ্ছে পথ, কেবল মাত্র পথ।

তাঁরা সেই পথে চলেছিলেন এইটেই সত্য। সুতরাং পথে বসলে গম্যস্থানকে পাব না, পথে চললেই পাব। উপরের থেকে সেই চলবার ডাকটিই আসছে। সেই বাণীই বলছে : তুমি বসে থেকে কিছু পাবে না; চলো, আরো চলো; আরো আছে, আরো আছে।”

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি সেই পথে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছি? নাকি অনেকটা এগিয়েছি?? নাকি অনেকটা পিছিয়ে আছি??? ফকিরকুরের শিরোমণি লালন সাঁইজিকে, তাঁর মতাদর্শকে আসলেই কি আমরা এগিয়ে নিয়ে চলেছি? নাকি আমাদের নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে যাচ্ছি? যার যার নিজস্ব যুক্তিতে???

ওগো মানুষের তত্ত্ব বলো না।
ভাবের মানুষ কয়জনা।।

এই মানুষে আছে রে মন
যাঁরে বলি মানুষ রতন,
মনের মানুষ অধর মানুষ
সহজ মানুষ কোনজনা।।

ওগো অটল মানুষ
রসের মানুষ, সোনার মানুষ,
ভাবের মানুষ, সরল মানুষ
সেই মানুষটি কোনজনা।।

ফকির লালন বলে
মানুষ মানুষ সবাই বলে,
এই মানুষে সেই মানুষ
কোন মানুষের করি ভজনা।।

(চলবে…)

<<মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই ।। মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ :: এসব দেখি কানার হাটবাজার>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
মাই ডিভাইন জার্নি : আঠার:: রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই
মাই ডিভাইন জার্নি : বিশ :: কোন মানুষের করি ভজনা
মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ :: এসব দেখি কানার হাটবাজার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!