ভবঘুরেকথা
শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

ডাক্তার নিশিকান্ত বসু পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পিতা। আমেরিকার চিকাগো শহরে হোমিওপ্যাথিতে এমডি পাস করে ডাক্তারি করতেন। ডাক্তার হিসাবে সেখানে বেশ নাম করেছিলেন তিনি।

একদিন নিশিকান্তবাবু যখন তাঁর চিকাগোর চেম্বারে বসেছিলেন, তখন হঠাৎ এক সভ্রান্ত আমেরিকান মহিলা এসে উপস্থিত হলেন। মহিলাটি বললেন- আমি হৃদরোগে আক্রান্ত, আমার রোগ সারাবার জন্য পাশ্চাত্য জগতে যত রকমের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে, তা সবই একের পর এক করিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই কোন পল হইনি- আমার রোগ সারেনি।

আপনি ভারতীয় বলে আপনার কাছে এলাম। অলৌকিক যোগশক্তির দেশ ভারত। আপনি কি প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে অথবা যোগশক্তির সাহায্যে আমার চিকিৎসা করুন।

নিশিকান্তবাবু তখন তাঁকে বললেন- আমি আমেরিকায় এসে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছি, আমি সেই শিক্ষা অনুসারেই এখানে প্র্যাকটিস করছি। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসা-পদ্ধতি অথবা যোগবিদ্যা সম্বন্ধে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।

এমন সময় হঠাৎ সেই মহিলা দারুণ বিস্ময়ে চিৎসার করে উঠলেন- আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনার পিছনে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, উনি কে?

মহিলাটি আরও বললেন- ডাক্তারবাবু দেখুন, আপনার পিছনে এক দীর্ঘাকায় জটাজুটধারী মহাযোগী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওঁর দিব্যদেহে মাংস নেই, কিন্তু চামড়া দিয়ে ঢাকা অস্থিগুলির কি অপরূপ প্রভা! ওঁর তিলচিহ্নগুলি লালবর্ণ ; ওঁর পলকহীন দু’চোখের দৃষ্টি স্থির ও অলৌকিক।

এ কথা শুনে নিশিকান্তবাবু বললেন- আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না, এমন পাগলামি করছেন কেন? আপনি শক্ত হোন।

তখন মহিলাটি বললেন- না ডাক্তারবাবু, আমি পাগল নই ; এই দেখুন, আমি আমার ওষুধ পেয়ে গেছি। দেখুন, ঐ মহাযোগী চকিতে আমার হাতে এই ভারতীয় ওষুধটি দিয়ে বললেন- এটা খেয়ে নে, তাহলেই তোর রোগ সেরে যাবে।

নিশিকান্তবাবু দেখলেন, সত্যিই তাঁর হাতে মধুর গন্ধবিশিষ্ট একটি ফুলের পাপড়ি রয়েছে।

নিশিকান্তবাবু তখন একটি কাগজে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম লিখে দিয়ে সেই ইংরেজ মহিলাকে বললেন- তুমি এই নাম সর্বদা স্মরণ করবে, আর কোন হাসপাতালে গিয়ে এই টিউমার অপারেশন করাবে, তাহলেই ভাল হয়ে যাবে। তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।

মহিলাটি বাড়ি ফিরে সেই ফুলের পাপড়িটি ভক্তিভরে খেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রোগ সেরে গেল চিরদিনের মত।

নিশিকান্তবাবু বুঝলেন, এই মহাযোগী হচ্ছেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তিনি এর আগে লোকনাথ বাবাকে চোখে না দেখলেও তাঁর যে ছবি দেখছেন, তার সঙ্গে মহিলাটির দেওয়া দেহের বর্ণনা সব মিলে গেল। মহিলাটিকে সে কথা জানালে, তিনি অনেক খোঁজ করে দেখলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি চিত্র যোগাড় করে নিজের ঘরে টাঙিয়ে রাখলেন।

আর একবার আমেরিকায় থাকাকালে নিশিকান্তবাবু যখন এক সেনিটোরিয়ামে চাকরি করতেন, তখন একদিন এক ত্রিশ বছর বয়স্ক ইংরেজ মহিলার চোকের সামনে লোকনাথ ব্রহ্মচারী আবির্ভূত হন। ঐ মিহলাটি তাঁর পেটের টিউমারের চিকিৎসার জন্য সেই সেনিটোরিয়ামে আসেন। কিছুদিন সেনিটোরিয়ামে চিকিৎসা করালেও কোন ফল হয়নি। ক্রমশ: তাঁর টিউমারের অবস্থা খারাপ হয়ে পরে।

একদিন সেই মহিলা নিশিকান্তবাবুকে একা পেয়ে তাঁকে বললেন- ডাক্তার বোস, এখন বল আমি কি করব? এখানকার চিকিৎসায় তো কিছু হলো না।

এমন সময় মহিলাটি বলে উঠলেন- ডাক্তার বোস, চুপ করো! আমি তোমার পিছনে মাথার উপরে একজন সাধুকে দেখছি। তাঁর চুলগুলি মাথার উপর জড়ানো, তাঁর দাড়ি-গোঁফ আছে। তাঁর চোখের দৃষ্টি অপলক। ইনি নিশ্চয় তোমার স্পিরিচুয়াল গাইড অর্থাৎ আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক।

নিশিকান্তবাবু পিছনে না তাকিয়েই বুঝলেন, লোকনাথ বাবা আবির্ভূত হয়েছেন সূক্ষ্মদেহে। তাঁর অসীম করুণা। লোকনাথ বাবা ঐভাবে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর ভক্তি-বিশ্বাস বাড়াবার জন্যই এই লীলা করেছেন।

নিশিকান্তবাবু তখন একটি কাগজে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম লিখে দিয়ে সেই ইংরেজ মহিলাকে বললেন- তুমি এই নাম সর্বদা স্মরণ করবে, আর কোন হাসপাতালে গিয়ে এই টিউমার অপারেশন করাবে, তাহলেই ভাল হয়ে যাবে। তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।

বাবা লোকনাথের অপার যোগবিভূতির কথা লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকে দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা নিয়ে। বাবা অপৃপণভাবে তাদের সব আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ করেছেন। তাঁর কাছে এসে কেউ বিমুখ হয়ে ফিরে যায়নি।

এই বলে তিনি একজন নার্সকে সঙ্গে দিয়ে মহিলাটিকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে তাঁর টিউমার অপারেশন হলো, তিনি সেরে উঠলেন।

এইভাবে শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরেও অনেকে বাবার অযাচিত কৃপা লাভ করে ধন্য হয়েছেন। সিদ্ধযোগী লোকনাথ বাবা কি দূরের, কি কাছের – সকল আর্ত নরনারীর স্ফুট-অস্ফুট সব ধ্বনি শুনতে পেতেন ও বুঝতে পারতেন। সেই সব কাজও করতেন। তাঁর মনের গতি সর্বত্র ; তাঁর মন যেখানে যায়, তাঁর দেহও সূক্ষ্ম হয়ে সেখানেই যায়।

এরপর নিশিকান্তবাবু বারদীতে গিয়ে লোকনাথ বাবাকে দর্শন করে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। নিশিকান্তবাবুর মাতা বারদীর বড় জমিদার কালীকিশোর নাগের কনিষ্ঠা কন্যা। লোকনাথ বাবার পরম ভক্ত বারদীর অন্যতম জমিদার অরুণাকান্তি নাগ, নিশিকান্তবাবুর পিসতুতো ভাই। একদিন অরুণকান্তিই নিশিকান্তবাবুকে বারদীর আশ্রমে বাবা লোকনাথকে প্রথম দর্শন করাতে নিয়ে যান।

নিশিকান্তবাবু লোকনাথ বাবাকে দেখেই বুঝতে পারেন, এই মহাযোগী মহাপুরুষই সূক্ষ্মদেহে সুদূর আমেরিকায় গিয়ে সেই মার্কিন মাহিলা ও ইংরেজ মহিলাকে দর্শন দিতে তাঁদের দূরারোগ্য রোগ সারিয়ে দেন।

সেই থেকেই নিশিকান্তবাবু সারাজীবন ধরে লোকনাথ বাবার পরম ভক্ত হয়ে যান। উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে গুরু-শিষ্যের এক মধুর সম্পর্ক।

বাবা লোকনাথের অপার যোগবিভূতির কথা লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকে দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা নিয়ে। বাবা অপৃপণভাবে তাদের সব আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ করেছেন। তাঁর কাছে এসে কেউ বিমুখ হয়ে ফিরে যায়নি।

<<লোকনাথ বাবার লীলা : নয় ।। লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো>>

………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা

……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!