: সন্ন্যাস ভাল অবস্থা কিনা?
:: ভাল অবস্থা।
: তবে প্রকারান্তরে গাছতলায় কি পাহাড়ে যাইতে নিষেধ করিলেন কেন?
:: সন্ন্যাস-মনের অবস্থা, তাহা যাহার হয় নাই, তাহার গাছতলায় কি পাহাড়ে গেলেও হইবে না। যাহার হইয়াছে তাহার গাছতলায় কি সংসারে থাকিলেও হইয়াছে। অতএব যাহার হইয়াতে, তাহার স্থান পরিবর্ত্তনের প্রয়োজনাভাব। প্রয়োজন থাকিলে সন্ন্যাস হয় না, কারণ তোমার অভাববোধ আছে।
: সন্ন্যাস কাহাকে বলে?
:: “কার্য্য পরিত্যাগ” এবং “কার্য্য করা” এই উভয়কে যে একই অবস্থা মনে করে, সেই সন্ন্যাসী। অলসতা প্রযুক্ত কর্ম্মপরিত্যাগকে “সন্ন্যাসী” বলে না।
: পূর্ব্বে বলিলেন, “পরিবর্ত্তনের প্রয়োজনাভাব”; কিন্তু পরিবর্ত্তনে আপত্তিরই বা কারণ কি?
:: বিশেষ কোন আপত্তিরই কারণ নাই। তবে যিনি ভয়ে অথবা কোন প্রকার লোভে পরিবর্ত্তনের চেষ্টা বা ইচ্ছা করেন, তিনি নিকৃষ্ট লোক, সন্ন্যাসী হওয়াত দূরের কথা।
: ভয়ে অথবা লোভে পরিবর্ত্তনের ইচ্ছা কি অবস্থায় হয়?
:: এই সংসার ত্রিবিধ তাপে পূর্ণ। যথা- ১. বাক্যাবাণ, ২. বিত্তবিচ্ছেদবাণ ও ৩. বন্ধুবিচ্ছেদবাণ। যিনি এই তিনটি বাণ (ত্রিবিধ তাপ) সহ্য করিতে পারেন, তিনি মৃত্যুকে জয় করিতে পারেন। অনেকে এই ত্রিবিধ তাপের ভয়েই পরিবর্ত্তনের ইচ্ছা করে। এ দ্বিবিধ লোকই মোহে অন্ধ। অতএব তাহাদের কাহারও সন্ন্যাস হয় নাই।
: বিত্তত্যাগ করিয়া গেলে আর বিত্তনাশের আশঙ্কা রহিল না। বন্ধুত্যাগ করিয়া গেলে আর বন্ধু বিয়োগের ভয় থাকে না। বনে চলিয়া গেলে আর বাক্যবাণেরও আশঙ্কা রহিল না। তবে তাহাতে লাভ ভিন্ন লোকশান কি?
:: বনে যে পশু পক্ষী আছে তাহাতে আর তোমাতে প্রভেদ কি?
: তবে কি আপনি ঐ সকল তাপের ভিতরে থাকাই কর্তব্য মনে করেন?
:: হাঁ, মনে করি। কর্ম ত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়:।
: ঐ সকল তাপের কি কোন উপকারিতা আছে?
:: প্রচুর উপকারিতা। প্রহ্লাদ ও সীতাকে দেখ।
: প্রহ্লাদ ও সীতার কথা কি বলিলেন বুঝিলাম না।
:: কেন? অবতার কি উদ্দেশ্যে হয় তাহাত বুঝ? ভগবান ধর্ম্মরক্ষঅ করার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন এবং নিজে সেই ধর্ম্ম আচরণ করিয়া জীবকে শিক্ষা দেন।
: প্রহ্লাদের এবং সীতার সম্বন্ধেত দেখিলাম, তাহারা ভগবানকে পাইতে যাইয়া কত উৎকট বিদদেই না পতিত হইলেন।
:: হ্যাঁ সত্য। কিন্তু তাহারাত কখনও কষ্ট হয় নাই।
: তবে প্রহ্লাদ সম্বন্ধে, কি সীতা সম্বন্ধে, আপনার কথিত বাক্য দ্বারা কি উপদেশ পাইলাম?
:: অত উৎকট তাপও যখন প্রহ্লাদকে অণুমাত্রও স্পর্শ করিতে পারিল না, তখন হরি তাহাকে কোলে নিলেন; তাহার পূর্বে নেন নাই। অগ্নি পরীক্ষায় যখন সীতার অণুমাত্রও তাপ লাগে নাই, তখনই হরি সীতাকে গ্রহণ করিলেন; তাহার পূর্বে গ্রহণ করেন নাই।
তোমাদেরও যখন এই প্রকার অবস্থা হইবেক, যে অবস্থায় কোনও তাপ তোমাদিগকে কোলে নিবেন, তাহার পূর্বে নিবেন না। অতএব, তোমরা সংসার ছাড়িয়া যদি পশুর মত বনে যাইয়া থাকিতে ইচ্ছা কর, তবে সীতার ন্যায় তোমাদের পরীক্ষা হইল না; হরিকে পাওয়াও ঘটিল না। অতএব সমাজে থাকিয়াই সাধন করিতে হইবেক।
: তবে কি আপনি বলিতে চাহেন যে বদ্ধাবস্থাই শ্রেষ্ঠ অবস্থা?
:: বদ্ধাবস্থাকে আমি শ্রেষ্ঠ অবস্থা বলি নাই; এবং বদ্ধাবস্থা শ্রেষ্ঠ অবস্থাও নয়। তবে বদ্ধাবস্থায় সোপান। তোমার হাতে যদি বাঁধ না থাকে, তবে আর আমি কি খুলিয়া দিব? যদি তুমি মুক্ত হইতে ইচ্ছা কর, তবে তোমার পূর্বে বদ্ধ হইতে হইবেক। বদ্ধ না হইলে মুক্ত হওয়ার কোনও অর্থ থাকে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এইজন্যই মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত লোকস্থিতির অনুরোধে, আচার, জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত বিধান গুলি মানিয়া চলা একান্ত কর্তব্য। মুক্তাবস্থায় এই গুলি আপনা হইতেই চলিয়া যায়। তখন আর সংস্কারের কোন নাম গন্ধও থাকে না।
: জীবের কি কি অবস্থা হয়?
:: ত্রিবিধ অবস্থা- ১. মুক্তাবস্থা, ২. বদ্ধাবস্থা ও ৩. মুক্তাবস্থা। জীবের প্রথম অবস্থায় পিতা, মাতা, ভ্রাতা, বন্ধু ইত্যাদি বন্ধন, কি সমাজ বন্ধন থাকে না। যথা- পশুজীবন ও পর্ব্বতীয় মনুষ্যদের জীবন। দ্বিতীয় অবস্থায় পিতা, মাতা, স্ত্রী পুত্রাদি বন্ধন ও সমাজ বন্ধন থাকে; যথা- তোমার ও হরিচরণ প্রভৃতির।* তৃতীয় অবস্থা আবার মুক্তাবস্থা, অর্থাৎ যে অবস্থায় কোন বন্ধনই থাকে না। যথা- আমার ও তৈলঙ্গস্বামী প্রভৃতির।
……………………………
*হরিচরণ চক্রবর্ত্তী: ঢাকা জজকোর্টের উকিল ও ব্রহ্মচারী বাবার পরমভক্ত ও প্রিয় শিষ্য ছিলেন। তিনি ব্রহ্মচারীবাবার শ্রীমূর্ত্তি বক্ষে ধারণ করিয়া, তাঁহার রূপধ্যান ও নামজপ করিতে করিতে সজ্ঞানে দেহত্যাগ করিয়াছেন। শুনিয়াছি মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদিগকে তাঁহার সম্মুখে আসিতে নিষেধ করিয়াছিলেন।
…………………………….
: প্রথম ও তৃতীয় অবস্থার প্রভেদ কি?
:: প্রথম অবস্থা- জ্ঞানের অভাব, মোহ ও অন্ধতায় পরিপূর্ণ। সে অবস্থায় জীব আমি কে? কেন আসিয়াছি? আমার কার্য্য কি? ইত্যাদি কিছুই জানে না। তৃতীয় অবস্থা- বিজ্ঞানের অবস্থা।
: দ্বিতীয় অবস্থার সহিত অন্য দুই অবস্থার প্রভেদ কি?
:: দ্বিতীয় অবস্থা-মধ্যম অবস্থা। প্রথম অবস্থার ন্যায় অজ্ঞানের অবস্থাও নয়, তৃতীয় অবস্থায় ন্যায় বিজ্ঞানের অবস্থাও নয়। সে কথঞ্চিৎ জ্ঞান আছে, সেই জ্ঞানদ্বারাই বিচারপূর্বক কর্ম্ম করিতে করিতে তৃতীয় অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
আমাকে দ্বিতীয় অবস্থার এবং আপনাকে তৃতীয় অবস্থার লোক বলিলেন; আপনার ও আমার কার্য্যে প্রভেদ কি?
(চলবে…)
<<লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই ।। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা