: ভগবান ধর্ম্মরক্ষার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন, এই স্থানে “যুগ” শব্দের অর্থ কি?
:: কোন এক কার্য্যের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত যে সময় তাহারই নাম “একযুগ”। অতএব যুগে যুগে অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিতে; অথবা বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্দ্ধক্যে বুঝিতে হইবে। ইহার আরও এক অর্থ একই জীবের দুই তিন বারের জন্ম নিয়াও হইতে পারে। তুমি “যুগে যুগে” শব্দের অর্থ “সময়ে সময়ে” বলিয়া বুঝ, তাহা হইলেই তুমি সকলই বুঝিতে পারিবে।
: আপনার এই বিবিধ প্রকারের অর্থ আমি বুঝিলাম না। ভগবান ধর্ম্ম রক্ষার জন্য কালী, কৃষ্ণ ইত্যাদিরূপে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বরং বুঝিলাম। কিন্তু বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ় এবং বার্দ্ধক্য ইহার প্রত্যেক সময়ে একজনের একজীবনে ভগবান্ তিন চারি বার কি প্রকারে ভগবান্ অবতীর্ণ হন, বুঝিলাম না; এবং একই জীবের দুই তিন জন্ম নিয়াও কি প্রকারে একবার অবতীর্ণ হন, তাহাও বুঝিলাম না।
:: অবতারের অন্যতম উদ্দেশ্য অসুর নিপাত করা। তোমার হৃদয়ে জ্ঞানরূপ ভগবান্ যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া তোমার অধর্ম্মরূপ অসুরকে যুগে যুগে বিনষ্ট করেন; অতএব অধর্ম্মরূপ অসুর তোমার জ্ঞানের অবতরণে বিনষ্ট হইয়া যায়। এই প্রকারে একজনের জীবনে ভগবান পাঁচ সাত বারও অবতীর্ণ হইতে পারেন। যেমন এক ব্যক্তি মদ খাওয়া ও চুরি করা, এই দুইটি পাপকার্য্যে লিপ্ত আছে।
কতকদিন মদ খাওয়ার পর মদ খাওয়া যে মুহুর্তে তাহার পাপ বলিয়া বোধ হইল, সেই মুহর্তেই পরিত্যাগ করিল এবং চৌর্য্যবৃত্তিকেও যখন পাপ বলিয়া বোধ হইল, তখনই সে চৌর্য্যবৃত্তি পরিত্যাগ করিল। এই প্রকারে একজনের হৃদয়ে ভগবান্ বহুবার অবতীর্ণ হন। পক্ষান্তরে এক জীবের বহুবারের জন্ম নিয়াও ভগবান্ অবতীর্ণ হইতে পারেন।
: একবার যাহার হৃদয়ে ভগবান অবতীর্ণ হইলেন, সে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হইয়া যায় না কেন?
:: ভোগ ভিন্ন প্রারব্ধকর্ম্ম ক্ষয় পাপ্ত হয় না। বিশেষত: একবারেই জীবকে মুক্ত করিয়া দিলে ভগবানের সৃষ্টিকৌশলও থাকে না।
: ভগবান্ সর্ব্বব্যাপী; অতএব আমার হৃদয়ে তিনি সর্ব্বদাই আসেন, আবার “অবতীর্ণ হইলেন” ইহার অর্থ কি?
:: তুমি যখন তাঁহাকে তোমার হৃদয়ে দেখ এবং আছেন বলিয়া উপলদ্ধি কর, তখনই তিনি “অবতীর্ণ হইলেন” বলিয়া লোকে বলে।
: সাধক রাম প্রসাদ গাহিয়াছেন-
“মা আমার অন্তরে আছ
তোমায় বলে অন্তরে? শ্যামা!
তুমি পাষাণময়ী বিষম মায়া কত কাচ কাচাই কাচ।।
উপাসনাভেদে তুমি প্রধান মূর্ত্তি ধর পাঁচ,
যে জন পাঁচেরে এক করে ভাবে, তার হাতে মা কোথায় বাঁচ।।
বারে বারে যাতায়াত, পুত্রদারাসমন্বিত,
যে জন কাঞ্চনের মূল্য জানে, সে কি ভোলে পেয়ে কাচ।।
প্রসাদ বলে মম হৃদে অমল কমল ছাঁচ,
সেই ছাঁচে নির্ম্মিতা হয়ে, মনোময়ী হয়ে নাচ।।”
: প্রারব্ধ কর্ম্ম কাহাকে বলে?
:: শাস্ত্রকারেরা বাণের সহিত প্রারব্ধ কর্ম্মের তুলনা করিয়াছেন। বাণ যেমন ধনু হইতে ছাড়িয়া দিলে কর্ত্তার আর তাঁহার উপর কোন কর্ত্তৃত্ব থাকেনা, বাণ আপন গতিতে যেখানে ইচ্ছা যাইয়া পতিত হয়, জীবের প্রারদ্ধ কর্ম্ম ও তদ্রূপ।
: ইহাতেও বুঝিলাম না।
:: ছোটবেলা পড়িয়াছ-
“ললাটে লিখিতং যত্তু ষষ্ঠীজাগরবাসরে।
ন হরি: শঙ্করো ব্রহ্মা চান্যথা কর্ত্তুমর্হতি।।”
এই শ্লোকের অর্থ যদি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পার, তবেই “প্রারদ্ধ” উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবে। ‘ষষ্ঠী’ শব্দের অর্থ ছয়ের সমষ্টি। বিচ্ছিন্নভাবে নহে একীকৃত অবস্থায়। জাগরবাসরে- জাগ্রত অবস্থায়। অর্থাৎ পূর্ণ জ্ঞঅনের অবস্থায় (সৃষ্টির পূর্বের অবস্থায়)।
এখন এই শ্লোকের অর্থ হইল- সৃষ্টির পূর্বের অবস্থায় যখন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, পূর্ণজ্ঞানরূপে একমাত্র থাকিয়া “একোইহং বহু স্যাম” “আমি এক আছি বহু হইব” বলিয়া সঙ্কল্প করিয়া সৃষ্টি করিলেন, তখন যাহার ললাটে যাহা লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ যাহার সম্বন্ধে যে কর্ম্ম নির্দিষ্ট হইয়াছে, হরি, হর বা ব্রহ্মা সেই সঙ্কল্পের অধীন। এই সঙ্কল্পই- প্রারব্ধ। অতএব ভগবান একজনের জীবনে জ্ঞানস্বরূপে বহুবার অবতীর্ণ হইলেও, সেই সঙ্কল্পের অধীন থাকায় জীব মুক্ত হয় না। পক্ষান্তরে একবারেও মুক্ত হইতে পারে।
: মালসীগান, হরিসংকীর্ত্তন, জপ ও ধ্যানে আনন্দ পাই কেন?
:: তখন তোমার জিহ্বা কি উপস্থের কার্য্য কি চিন্তা থাকে না। অত:পর তিনি ইহাও বলিয়াছেন-
“যদি যোগী ত্রিকালজ্ঞ: সমুদ্রলঙ্ঘনে ক্ষম:।
তথাপি লৌকিকাচারাং মনসাপি ন লঙ্ঘয়েৎ।।”
ব্রহ্মচারীবাবা সমাজের প্রচলিত প্রথায় সম্পূর্ণ অনুমোদন করিতেন। তিনি বলিতেন- অধিকারিভেদে ক্ষেত্রব্রত হইতে অশ্বমেধ যজ্ঞ পর্য্যন্ত এবং সন্ধ্যা পূজা, ধ্যান, ধারণা প্রভৃতি, জীবের অবশ্য কর্ত্তব্য। তিনি নিজে কোন কোন ব্যক্তিকে মন্ত্র দিয়াছেন, কোন কোন ব্যক্তিকে ফুল দূর্ব্বাদ্বারা পূজা করাইয়াছেন। শিবপূজা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা ও হরিপূজা ইত্যাদি এবং পিতৃ-মাতৃ শ্রাদ্ধাদিকর্ম্মে তিনি সম্পূর্ণ অনুমোদন করিতেন; এবং বলিতেন ইহার প্রত্যেক কার্য্যেই বিশেষ উপকার আছে।
ব্রহ্মচারীবাবা প্রসঙ্গত এই তিনটি উপদেশও দিয়াছিলেন-
১. গরজ করিবে, আহম্মক হইবে না।
২. ক্রোধ করিবে, অন্ধ হইবে না।
৩. পাতা কাটিয়া বাত খাইবে, বাসন করিবে না। ইহা গৃহস্থের জন্য ব্যবস্থা নহে।
“গুরুবো বহব: সন্তি শিষ্যবিত্তাপহারকা:।
দুর্লভোহয়ং গুরুর্দ্দেবি শিষ্যসপ্তাপহারক:।।”
সাধারণ অর্থ: শিষ্যের অর্থ-নাশকারী গুরু বহু পাওয়া যায়; কিন্তু শিষ্যের ভবদু:খনাশক গুরু অতীব দুর্লভ।
এই অর্থ গ্রহণ করিলে এই শ্লোকস্থিত বহু গুরুদের প্রতি একটা ঘৃণার ভাবই আসে, ভক্তির ভাব আসে না। তাই ব্রহ্মচারীবাবা ইহার নিম্নলিখিত অর্থ আমাকে বলিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন “তত্ত্বনির্ণয় আমাদের প্রধান লক্ষ্য, তোদের ৬ষ্ঠী বা ৭মী বিভক্তি দ্বারা আমরা বাধ্য নহি। এই শ্লোকে ‘বিত্ত’ শব্দের অর্থ ‘চিত্ত বৃত্তি’। জীবের অন্ত:করণে যে সকল বৃত্তি থাকে তাহা বাহিরে সাকারিত হইলেই বিত্ত শব্দ বাচ্য হয়।
সুতরাং অন্তরে যাহা চিত্তবৃত্তি ছিল বাহিরে তাহাই জীবের বিত্ত হইল। এই অন্তরস্থ চিত্তবৃত্তি না থাকিলে বাহিরে জীবের কোন বিত্তই থাকিতে পারে না। এই চিত্তবৃত্তি না থাকিলে বাহিরে জীবের কোন বিত্তই থাকিতে পারে না। এই চিত্তবৃত্তি অনুকূল বা প্রতিকূল যে সকল বস্তু কি জীব দেখিতে পাওয়া যায় তাহারা প্রত্যেকেই জীবের গুরুরূপে কার্য করে; অর্থাৎ জীবকে ভোগ বা ত্যাগ করাইয়া মুক্তিপথে অগ্রসর করাইয়া দেয় এবং সন্তাপহারক গুরুর নিকট যাইবার উপযোগী করিয়া তোলে।
সন্তাপহারক গুরু, আমাতে যে তাপ নাই, তাপ যে একটা কাল্পনিক জিনিষ, তাপের যে প্রকৃতই অস্তিত্ব নাই, ইহা যে অবিদ্যাজনিত, রজ্জুতে সর্পভ্রমের মত ভ্রান্তিমাত্র এই জ্ঞানদান করিয়া সন্তাপহারক গুরু তাহা সূর্য্যোদয়ে অন্ধকার নাশের মত নাশ করিয়া ফেলেন। সেই দুর্লভ গুরু, লোকনাথের ন্যায় গুরু, প্রতি ঘরে ঘরে কেন প্রতি শতাব্দিতেও সর্ব্বদা ঘটেনা, কোটিতে গুটি পাওয়াও দুষ্কর।
তিনি আরও বলিতেন তোমার পিতা এবং পিতৃস্থানীয় পুরুষেরা এবং মাতা এবং মাতৃস্থানীয়া পিসীমাতা ও মাসীমাতা প্রভৃতি সকলেই তোমার গুরু এবং আমিও তোমার গুরু। মাতা সন্তানকে বলিতেছেন- “আরও একটু মিষ্টান্ন আহার কর” এই কার্যদ্বারা তিনি তোমাকে ভোগ করাইতেছেন। পিতা বলিতেন- “অধিক আহার করিও না। কারণ তাহা হইলে তোমার অসুখ হইবে।” ইহা দ্বারা তিনি ত্যাগের পথে নিতেছেন।
আর আমি তোমাকে বলিতেছি “যামিনি, তোমার ভোগও নাই ত্যাগও নাই, তুমি ভোগীও নও, ত্যাগীও নও। তুমি নির্বিকার নির্গুণ সেই পরম পুরাতন পুরুষ; তুমি সর্ব্বদাই আন্দময়, তোমাতে তাপের লেশমাত্রও নাই।” ধন্য তোমার পূর্বপুরুষের পুণ্যবল। একমাত্র তাঁহাদের পুণ্যের ফলেই আমি এই প্রকার গুরুর কৃপালাভ করিতে পারিয়াছি।
(চলবে)
<<লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার ।। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা